পিপলস ম্যাগাজিন ডেস্ক: সোশাল মিডিয়ায় একটি মিম ঘুরছে দু’দিন ধরে। একজন মাঝবয়সি পুরুষ রিডিং-এ বসে মনোযোগ সহকারে একটি মোটা বই পড়ছেন। বইটি হল, ‘মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়- জগদীপ ধনখড় পত্রাবলী’। বিখাত ব্যক্তিদের নিজেদের মধ্যে চালাচালি করা চিঠি নিয়ে বই প্রকাশের অজস্র উদাহরণ গোটা দুনিয়ায় ছড়িয়ে আছে। সেগুলোর বিক্রিও ভালো। পশ্চিমবঙ্গের মুখ্যমন্ত্রী ও রাজ্যপালের মধ্যে বিভিন্ন সময় তৈরি হওয়া বাগযুদ্ধ, এসএমএস, টুইট, পত্রযুদ্ধের সংগ্রহ আগামী দিনে বাণিজ্যসফল প্রকাশনার মর্যাদা পাবে কিনা, তা ভবিষ্যৎ বলবে। কিন্তু অতিমারি পরিস্থিতিতে এই লড়াই যে রাজ্যের মানুষের দেখভাল ও চিকিৎসার ক্ষেত্রে নেতিবাচক প্রভাব ফেলছে, তা সহজেই বলা যায়।
এ কথা শুরুতেই বলা দরকার যে বেশি রক্তপরীক্ষার ঝক্কি এড়িয়ে বেশি বেশি করে মানুষকে নিভৃতবাসে পাঠিয়ে পরিস্থিতি সামাল দেওয়ার যে কৌশল রাজ্য প্রশাসন নিয়েছিল, সেটা বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার নির্দেশ ও পরামর্শ মোতাবেক ছিল না। আইসিএমআর-এর গাইডলাইনের ফাঁক তাকে এই সুযোগ করে দিলেও, এই ধরনের অতিমারির ক্ষেত্রে পুরনো কাজের ধরনে সফল হওয়া কঠিন। কারণ এক্ষেত্রে নতুন ধরনের ভাইরাসের বৈশিষ্ট্যের সঙ্গে অঙ্গাঙ্গীভাবে জড়িয়ে রয়েছে আন্তর্জাতিক স্বাস্থ্য বাণিজ্যের বিষয় এবং দুই সাম্রাজ্যবাদী শক্তি চিন ও আমেরিকার ক্রমবর্ধ্বমান দ্বন্দ্ব। এক্ষেত্রে কেন্দ্রীয় আইনের মধ্যে দিয়ে গোটা দেশের ওপর সরাসরি নজর রেখেছে মার্কিন সাম্রাজ্যবাদ। প্রতিটি অসুস্থ মানুষের স্বাস্থ্য সংক্রান্ত যাবতীয় তথ্য তার চাই। সেই তথ্য দিয়েই আগামী দিনের বিশাল মাপের আন্তর্জতিক স্বাস্থ্য বাণিজ্যের জাল সাজানো হবে। অতিমারির ভাইরাস আগামী দিনের সেই স্বাস্থ্য বাণিজ্যের বাজার ও রণকৌশল তৈরি করার সুযোগ করে দিচ্ছে। মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় এই কাঠামোর মধ্যেই রাজ্য চালান। ফলে সেই বাস্তবতাকে এড়িয়ে বাজিমাত করা ছিল অসম্ভব। সেটাই হয়। শুধুমাত্র জটিল রোগীদের রক্তপরীক্ষা করার ফলে রাজ্যে কোভিড আক্রান্তের সংখ্যা কম দেখালেও মৃতের সংখ্যা কোভিডের গড় মৃত্যুহারের থেকে বেশি মাত্রায় বাড়তে থাকে। সেই তথ্য আসন্ন নির্বাচনগুলিতে তার বিরুদ্ধে যেতে পারে, এই আতঙ্কে মমতা চিকিৎসকদের নিয়ে যে কমিটি তৈরি করেন, তার অন্যতম প্রধান কাজ হয়ে দাঁড়ায় কো-মরবিড রোগীদের মৃত্যুতে কোভিডের ভূমিকাকে একেবারে গৌণ হিসেবে দেখানো। এই ধরনের মৃত্যুতে মৃত্যুর কারণ হিসেবে কোনটাকে প্রধান গুরুত্ব দেওয়া হবে, তা নিয়ে যদি চিকিৎসাশাস্ত্রে কোনো বিতর্কের সুযোগ থেকেও থাকে, তা গৌণ হয়ে প্রধান হয়ে দাঁড়ায় মৃতের সংখ্যা কমিয়ে দেখানো। সামান্য বস্তুবাদী চিন্তা আয়ত্ত করলেই রাজ্যের মুখ্যমন্ত্রী বুঝতে পারতেন, অতিমারির ক্ষেত্রে রাজ্যে কোভিড আক্রান্তের সংখ্যা বেশি হলে সেটা তার দায় হবে না। কিন্তু তাঁর জনপ্রিয়তাবাদী রাজনীতি এবং মাঝারি ও ছোটো ব্যবসায়ীদের ওপর অতিরিক্ত নির্ভরতা লকডাউন তোলার ব্যাপারে তার মধ্যে তাড়াহুড়ো তৈরি করে দিয়েছিল। যেটা কেন্দ্রের বিজেপি সরকারের দেশের মানুষের তথ্য বিক্রির ব্যবসা ও মার্কিন সাম্রাজ্যবাদের স্বার্থের বিরুদ্ধে যায়। ফলে স্বাভাবিক ভাবেই কেন্দ্রীয় দল পাঠিয়ে মমতাকে চেপে ধরে বিজেপি।
ঘটনা হল, কোভিড পরিস্থিতি ঘোরালো হওয়ার পর থেকেই মমতা তাঁর নিজস্ব জনপ্রিয়তাবাদী স্টাইলে পথে নেমে প্রশাসকের ভূমিকা পালন করতে শুরু করেন। অতিমারি পরিস্থিতিতে মুখ্যমন্ত্রীর ওই স্টাইল কার্যত সাফ করে দেয় বিরোধীদের। বাম-কংগ্রেসরা সরকারকে সহযোগিতার নীতি নিলেও রাজ্যে ক্ষমতা দখলের স্বপ্ন দেখা বিজেপির পক্ষে পরিস্থিতি জটিল হয়ে ওঠে। এই অবস্থায় বিজেপির হয়ে পথে নামেন রাজ্যপাল জগদীপ ধনখড়। বস্তুত, ভারতের দুর্বল যুক্তরাষ্ট্রীয় কাঠামোতে কেন্দ্রীয় সরকারগুলো বরাবরই বিরোধী দল শাসিত রাজ্য সরকারকে চাপে রাখার জন্য রাজ্যপাল পদটিকে ব্যবহার করেছে। এই পথ কংগ্রেসেরই দেখানো। কিন্তু পশ্চিমবঙ্গের বর্তমান রাজ্যপাল যা করছেন, তা অভূতপূর্ব। বলাই বাহুল্য, তার দিল্লির প্রভুদের তেমনই নির্দেশ রয়েছে।
রাজ্য বিজেপিকে অক্সিজেন দিতে তিনি ময়দানে নেমেছেন। পত্রযুদ্ধের মধ্যে দিয়ে অতিমারির পরিবেশে ঘৃণার রাজনীতি করে চলেছেন। তবলিগি জামাত নিয়ে সাম্প্রদায়িক মন্তব্য করেছেন। এটি তাদের দলীয় অবস্থান। করোনা পরিস্থিতির শুরু থেকেই কেন্দ্র নিজেদের ব্যর্থতা ঢাকতে মুসলিম সম্প্রদায়কে দায়ী করার চেষ্টা করেছে। রাজ্যপাল সেই পথ অনুসরণ করেছেন মাত্র। যা অত্যন্ত নিন্দনীয়। শুধু তাই নয়। কেন্দ্র নিজেদের ব্যর্থতা ঢাকতে প্রাথমিক ভাবে অবিজেপি শাসিত রাজ্যগুলিতে পরিদর্শক দল পাঠায়। গুজরাট বা উত্তর প্রদেশে দল না পাঠিয়ে পশ্চিমবঙ্গে দল পাঠানোতেই বোঝা যায়, মানুষের জীবন নয়, রাজনীতিই এখানে মুখ্য। দল রাজ্যে আসার মাত্র ১৫ মিনিট আগে খবর দেওয়ার মধ্যে দিয়েই বিজেপির ষড়যন্ত্রমূলক অভিষন্ধি প্রকাশিত।
অথচ রাজনীতির স্বর তুঙ্গে উঠলেও লকডাউনে দিনমজুরদের অসুবিধা নিয়ে কেন্দ্র-রাজ্য উভয়েই নীরব। ‘প্রচেষ্টা’র মতো অল্প কিছু অর্থ সাহায্যের প্রকল্প নিলেও এই ঘটনার রাজনৈতিক বিরোধিতা মুখ্যমন্ত্রীর মুখে শোনা যায়নি। অন্যদিকে রাজ্যের পরিযায়ী শ্রমিকদের ঘরে ফেরানো নিয়ে কোনো কথা রাজ্যপাল বলেননি।
রেশনের মাধ্যম জনগণের একটা বড়ো অংশকে বিনা পয়সায় খাদ্যশস্য দেওয়ার ঘোষণা রাজ্য সরকার করলেও, ভারতের সরকারি রাজনীতির ঐতিহ্য অনুযায়ী রেশন-দুর্নীতি এবারও বহাল। রেশন থেকে মানুষের চাল নিয়ে ত্রাণ হিসেবে জনগণকে দিয়ে নাম কেনার রাজনীতি করছেন স্থানীয় তৃণমূল নেতা-কর্মীরা। এ ব্যাপারে কোনো কথা বলেননি মুখ্যমন্ত্রী। আগেভাগে পরিস্থিতি সামলানোর উদ্যোগও নেনি। অন্যদিকে কেন্দ্রের প্রতিশ্রুতি মতো চাল একমাসেও রাজ্যে না এসে পৌঁছনো নিয়ে নীরব রাজ্যপাল।
অর্থাৎ স্পষ্টতই দেখা যাচ্ছে, দিনের পর দিন নিজের আচরণে রাজ্যবাসীর কাছে নিজেকে হাস্যাস্পদ করে ফেলা জগদীপ ধনখড় করোনাকে কাজে লাগিয়ে প্রভুদের কাছে ভাবমূর্তি ভালো করার খেলায় নেমেছেন। অন্যদিকে অতিমারি সামলানোর ক্ষেত্রেও ভোটের রাজনীতিকেই প্রধান গুরুত্ব দিয়েছেন রাজ্যের মুখ্যমন্ত্রী। সাহসিকতার সঙ্গে আপেক্ষিক ভাবে বস্তুবাদী অবস্থান নেওয়ার ক্ষেত্রে দুর্বলতা দেখিয়েছেন। সত্যি বলেত, তৃণমূল সরকারের কাজকর্মের বহু সমালোচনাই করা সম্ভব। কিন্তু অতিমারি পরিস্থিতিতে অসহায় মানুষের জীবনজীবিকাকে প্রধান গুরুত্ব না দিয়ে রাজ্যপাল ও বিজেপি যে চক্রান্তমূলক সাম্প্রদায়িক রাজনীতি করছেন, তা ঘৃণার অযোগ্য। জনবিরোধী একটি কাঠামোর মধ্যে থেকে জনপ্রিয়তাবাদী রাজনীতি করে এর বিরুদ্ধে এঁটে ওঠা কঠিন। মেহনতি মানুষের সংঘব্ধ রাজনীতিই এই সাম্প্রদায়িক রাজনীতিকে পরাস্ত করতে পারে।