প্রিয় রাহুল গান্ধীজি,
আশাকরি ভালো আছেন। আপনার পরিবারের সবাইও আশাকরি ভালোই আছেন। প্রথম সারির সংবাদপত্রে প্রকাশিত বর্তমান পরিস্থিতি নিয়ে আপনার বক্তব্যই আমাকে চিঠি লিখতে উৎসাহিত করলো। আপনি বলেছেন “ভারতের গরিবরা কবে জাগবেন? আপনারা খিদেয় মরছেন, ওরা আপনার ভাগের চাল থেকে সানিটাইজার তৈরি করে বড়লোকদের হাত সাফ করায় ব্যস্ত”। একজন প্রকৃত নেতার মতোই কথা বলেছেন আপনি। কিন্তু আপনার এই বক্তব্যের আরো একটু প্রাঞ্জল ব্যাখ্যার প্রয়োজন। গরিব মানুষের করণীয়টা ঠিক কি যদি একটু খুলে বলেন। আপনি একটি সর্বভারতীয় দলের অন্যতম নেতা, আপনি কি আপনার দলীয় কর্মীদের নির্দেশ দেবেন সরকার সকলের খিদে মেটাতে না পারলে খাদ্য নিগমের গুদামে যে কয়েকশ টন চাল মজুত আছে তা গরিব মানুষকে সংগঠিত করে লুট করে গরিব মানুষের মধ্যে বিলি বন্টন করার, যা এই মুহূর্তে প্রতিটা বাম দলের রাজনৈতিক এজেন্ডা হওয়া উচিত।
আচ্ছা আপনার কথা অনুযায়ী গরিবরা যদি বড়লোকদের বিরুদ্ধে জেগে ওঠে এবং নিজেদের হকের দাবি ছিনিয়ে নেবার জন্য সংগঠিত প্রতিরোধ গড়ে তোলে বাঁচার তাগিদে, তখন তো রাষ্ট্র তাদের উপর ঝাপিয়ে পড়বে তার সমস্ত শক্তি দিয়ে। তখন আপনার নির্দেশ কী হবে রাহুলজি- রাষ্ট্রের সশস্ত্র আক্রমণের বিরুদ্ধে সংগঠিত জনতার সশস্ত্র প্রতিরোধ গড়ে তোলা নাকি টাটা-বিড়লা সহ আপনাদের পারিবারিক গড-ফাদার গান্ধীজির কথামতো জনতাকে নিষ্ক্রিয় প্রতিরোধের কথা বলে শাসক শ্রেণির গুলির মুখে ছেড়ে দেওয়া?
গরিব মানুষেরা যাতে না জাগে তারজন্য চিরকাল শাসক শ্রেণি একদিকে যেমন ‘ভাগ কর, দমন ক’ নীতি নিয়েছে আর অন্যদিকে দমন মূলক আইন লাগু করেছে। যখন যেটা প্রয়োজন হয়েছে তারা সেটা নামিয়েছে। আর ’৪৭ পরবর্তী সময়ে সবথেকে বেশি আপনারাই ক্ষমতায় থেকেছেন এবং কখন কোন তাসটা খেলতে হবে, সেটা ঠিক করার ক্ষেত্রে আপনাদের মতো পারর্দিতা ভারতের অন্য কোনো শাসক দল অর্জন করতে পারেনি। যেমন আপনারা খুব সুন্দর পারদর্শিতার সাথে মিশা, টাডা, ইউএপিএ প্রভৃতি দমনমূলক আইন ক্ষমতায় থাকাকালীন লাগু করেছিলেন এবং বড়োলোকদের বিরুদ্ধে যারা গরিব মানুষদের সংগঠিত করতে চেয়েছে এই বড়োলোকি ব্যবস্থার বদলের লক্ষ্য নিয়ে তাদের কে ‘অভ্যন্তরীণ নিরাপত্তার ক্ষেত্রে সবচেয়ে বড় বিপদ’ বলে চিহ্নিত করেছেন এবং এই দমনমূলক আইনের বলে তাদেরকে জেলে পুরেছেন। গুম খুন, ভুয়া এনকাউন্টার এই সমস্তই আপনারা করেছেন বড়োলোকদের বিরুদ্ধে যারা গরিবদের ‘খেপিয়ে’ তুলেছে তাদেরকে বিশেষ করে নেতৃত্বকে। আজ যখন আপনি এই হিন্দু ব্রাহ্মণ্যবাদী ফ্যাসিস্ট শক্তির বিরুদ্ধে গরিব জনতাকে জাগতে বলছেন তখন কি একবার আপনাদের নিজেদের অতীতকে কাটাছেঁড়া করবেন না?
১৯৯১ সালে অর্থনৈতিক সংস্কারের নামে বহুজাতিক করপোরেশন এবং কোনো বাধা বিপত্তি ছাড়াই দেশে বীজ, প্রযুক্তি রফতানি করার জন্য সাম্রাজ্যবাদী শক্তির কাছে দেশের দরজা হাট করে দেওয়া হল ভারতের কৃষকদের বলি দিয়ে সাম্রাজ্যবাদকে আরো আরো ভালো করে সেবা করার স্বার্থে। যার পোশাকি নাম বিশ্বায়ন। শিক্ষা থেকে স্বাস্থ্য, দেশের খনিজ সম্পদ থেকে কৃষি সমস্ত কিছু উদারিকরণ, বেসরকারিকরণ, বিশ্বায়নের আওতাভুক্ত করা হয়েছিল নিশ্চয়ই গরিব মানুষদের কথা ভেবে নয়। তাই সাম্রাজ্যবাদী বিশ্বায়নের বিষময় প্রভাব পড়েছে দেশের বেশিরভাগ গরিব আম জনতার উপর, আর লাভবান হয়েছে দেশের ধনিক শ্রেণি। আর এই সবই হয়েছিল আপনারা ক্ষমতায় থাকাকালীন। আন্তর্জাতিক অর্থ ভান্ডারের নির্দেশেই সেদিন আপনার পরিবারের ঘনিষ্ঠ মনমোহন সিং-কে আপনাদের দলে নেওয়া হয়েছিল এবং মন্ত্রিসভায় অর্থমন্ত্রকের দায়িত্ব দেওয়া হয়েছিল। অন্যান্য ক্ষেত্রগুলোর মত স্বাস্থ্য ক্ষেত্রকেও বেসসরকারিকরণ করার ফল কি মারাত্মক হতে পারে করোনা তা চোখে আঙ্গুল দিয়ে দেখিয়ে দিচ্ছে। এই সব দেখে কি আপনার এবং আপনার দলের বোধোদয় হল রাহুলজি? আজকের দিনে বড়োলোকদের বিরুদ্ধে গরিব মানুষকে জাগতে বলার অর্থ বড়ো বড়ো জমির মালিক ও বিশ্বায়ন বিরোধী, যা অন্তর্বস্তুতে সাম্রাজ্যবাদ বিরোধী, আপসহীন ও শক্তিশালী আন্দোলন গড়ে তোলাকে মূল রাজনৈতিক কর্মসূচিকে এজেন্ডা হিসাবে সামনে নিয়ে আসা এবং এই এজেন্ডাকে সামনে রেখে যারা গরিবদের সংগঠিত করছে তাদের সাথে জোট গড়া। এই জোট পার্লামেন্টে আসন ভাগাভাগি ও ক্ষমতার স্বাদ গ্রহণের জোট নয়, প্রকৃত বিশ্বায়ন বিরোধী সাম্রাজ্যবাদ বিরোধী জোট। আর যদি আপনার এই বক্তব্য আগামীতে ভোটের বাক্স ভরার জন্য হয় তাহলে বলতেই হয় আপনি আপনার ঠাকুমার বাবা জওহরলাল নেহেরুর বোলচালকে খুব ভালো করেই রপ্ত করেছেন। কালোবাজারি রুখতে মিস্টার নেহেরু বলেছিলেন, সমস্ত কালবাজারিদের ল্যাম্পপোস্টে ঝোলাবেন। নেহেরু কতজন কালোবাজারিকে ল্যাম্পপোস্টে ঝুলিয়েছিলেন সেই সংখ্যা সরকারি পরিসংখ্যানে না থাকলেও তেলেঙ্গানার গ্রামগুলোর শহিদ বেদীতে স্বর্ণাক্ষরে সেই সব কমিউনিস্ট বিপ্লবীদের নাম লেখা আছে যাদেরকে মিস্টার নেহেরু ফাঁসিকাঠে ঝুলিয়েছিলেন।
রাহুলজি, করোনাকে কাজে লাগিয়ে পৃথিবীর বিভিন্ন দেশে শাসকরা ফ্যাসিবাদী কায়দায় তাদের ক্ষমতাকে আরো দৃঢ় করছে, ভারতেও তার ব্যতিক্রম হবে না। তার চিহ্নগুলো দেখাও যাচ্ছে। ইতিমধ্যেই ৬ জন গণআন্দোলনের কর্মী ও সাংবাদিককে ইউএপিএ আইনে জেলে পোড়া হয়েছে। এরই উদ্ধততর রূপ গরিব মানুষের পাতের ভাত দিয়ে বড়লোকদের জন্য হাত শুদ্ধি, মালিক শ্রেণির জন্য শ্রম আইনকে আমূল পাল্টে শ্রমিকদের ৮ঘন্টার জায়গায় ১২ঘন্টা কাজ বাধ্যতামূলক করা। আগামী দিনে আরো অনেকরকম ফ্যাসিস্ট আক্রমণ নামতে চলছে। ঠিক তেমনি এই প্রতিক্রিয়ার বিরুদ্ধে ন্যায় সঙ্গত কারণেই যে গরিব জনগণ বিদ্রোহ করবেই তা আর বলার অপেক্ষা রাখে না। ঠিক এইরকমই এক মুহূর্তে আপনার এই বক্তব্য যথেষ্ট আশাব্যঞ্জক। আশা রাখবো আপনার বোধোদয় হবে, জনগণের লড়াইয়ের কাঁধে ভর দিয়ে আবার মসনদে বসা ও গরিব মেহনতি জনতাকে স্বৈরতান্ত্রিক ফ্যাসিবাদী কায়দায় শোষণ করা- এই লক্ষ্য হবে না এবং গান্ধী-নেহেরু পরিবার চিয়াং কাইশেক নয়, বরং সান ইয়াত সেনের পদাঙ্ক অনুসরণ করে উজ্জ্বল ফ্যাসিবিরোধী ভূমিকা রাখবে। ভালো থাকবেন রাহুলজি।
অয়ন ব্যানার্জি