Home জনস্বাস্থ্য শরৎ থেকে মানিক, রোকেয়া থেকে হাসান আজিজুল – মড়ক ও মহামারি ছড়িয়ে আছে বাংলা সাহিত্যে

শরৎ থেকে মানিক, রোকেয়া থেকে হাসান আজিজুল – মড়ক ও মহামারি ছড়িয়ে আছে বাংলা সাহিত্যে

শরৎ থেকে মানিক, রোকেয়া থেকে হাসান আজিজুল – মড়ক ও মহামারি ছড়িয়ে আছে বাংলা  সাহিত্যে
1
মৌসুমী বিলকিস

লকডাউনে নানান সমস্যার মধ্যেও পৃথিবী জুড়ে অনেক মানুষ চোখ রাখছেন সাহিত্যের পাতায়। খুঁজে চলেছেন কোন গ্রন্থে আছে মড়ক, মহামারির হদিস। সেই সূত্রেই আলবেয়ার কাম্যুর ‘দ্য প্লেগ’ উপন্যাস বিক্রির রেকর্ড ছুঁয়েছে। এর সঙ্গে গাব্রিয়েল গার্সিয়া মার্কেজের ‘লাভ ইন দ্য টাইম অফ কলেরা’ উপন্যাসটিও ইতিমধ্যে অনেকের আলোচনাতেই এসেছে।  বিশ্ব সাহিত্যের আরও অনেক গ্রন্থের মূল বিষয় মহামারি, অতিমারি।

আরও পড়ুন: রুপোলি পর্দায় বন্দিজীবন কিংবা একা থাকার সিনেমা

বাংলা সাহিত্যে মহামারি কেন্দ্রীয় বিষয় হিসেবে আসেনি, অন্তত আমার  জানা নেই।

প্রসঙ্গত সন্দীপন চট্টোপাধ্যায়ের ‘কলেরার দিনগুলিতে প্রেম’-এর সঙ্গে আক্ষরিক অর্থে কলেরা-মহামারি বা মার্কেজের উপন্যাসটির কোন সম্পর্ক নেই। সন্দীপন  সে কথা গল্প শুরুর আগেই জানিয়েছেন। রইলো কিছু বাংলা সাহিত্যের হদিস যেখানে প্রসঙ্গক্রমে এসেছে মড়ক, মারির কথা। এ লেখায় কবিতাসহ বাদ পড়লো অনেক। খোঁজার ভার আগ্রহী পাঠকের।  

রবীন্দ্রনাথ দিয়ে শুরু করা যাক। ‘গোরা’ উপন্যাসে হরিমোহিনীর বয়ানে পাই, “কলেরা হইয়া চারি দিনের ব্যবধানে আমার ছেলে ও স্বামী মারা গেলেন।” ‘চতুরঙ্গ’ উপন্যাসে  প্লেগের চিকিৎসা করতে গিয়ে প্লেগে আক্রান্ত হয়ে মৃত্যু হয় জ্যাঠামশাইয়ের।

তাঁর ‘দুর্বুদ্ধি’ এবং ‘দিদি’ গল্পে এক বালিকা ও এক নারী কলেরায় মারা যায়, দুজনের নামই শশী। ‘মাল্যদান’ গল্পে কুড়ানিকে খোঁজার প্রসঙ্গে আছে, “সেবারে প্লেগ-দমনের বিভীষিকায় এত লোক এত দিকে পলায়ন করিতেছিল যে, সেই-সকল পলাতকদলের মধ্য হইতে একটি বিশেষ লোককে বাছিয়া লওয়া পুলিসের পক্ষে শক্ত হইল।” গল্পের নায়ক যতীন প্লেগ হাসপাতালের ডাক্তার।

 ‘ওলাওঠার বিস্তার’ নামে বিজ্ঞান প্রবন্ধ লিখলেও রবীন্দ্রনাথের গল্প-উপন্যাসের মূল বিষয় হিসেবে কলেরা, প্লেগ বা বসন্ত আসেনি। এই বিজ্ঞান প্রবন্ধে তিনি জানাচ্ছেন, “ভারতবর্ষ যে ওলাওঠা রোগের জন্মভূমি, এ সম্বন্ধে সন্দেহ অতি অল্পই আছে। ১৮১৭ খৃস্টাব্দে এই ভীষণ মড়ক বঙ্গদেশ হইতে দিগ্‌বিজয় করিতে বাহির হইয়া সিন্ধু, য়ুফ্রাটিস, নীল, দানিয়ুব, ভল্‌গা, অবশেষে আমেরিকার সেন্ট লরেন্স এবং মিসিসিপি নদী পার হইয়া দেশবিদেশে হাহাকার ধ্বনি উত্থিত করিয়াছিল।”

অবনীন্দ্রনাথ ঠাকুরও লিখেছেন, “শ্যামসুন্দর চলে গেল, রাধিকা গোঁসাই সমাজে কাজ নিলে, আর আসে না কেউ, দিনু তখন গানবাজনা করে, কলকাতায় প্লেগ, মহামারী, তার পরে এল স্বদেশী হুজুগ। ঠিক কিসে যে আমার বাজনাটা বন্ধ হল তা মনে পড়ছে না।“ (‘ঘরোয়া’) 

তাঁর মেয়ে প্লেগে মারা যান। ‘জোড়াসাঁকোর ধারে’-তে সেই সময়টা তিনি লিপিবদ্ধ করেছেন, “সেই সময়ে কলকাতায় লাগল প্লেগ। চারদিকে মহামারি চলছে, ঘরে ঘরে লোক মরে শেষ হয়ে যাচ্ছে। রবিকাকা এবং আমরা এবাড়ির সবাই মিলে চাঁদা তুলে প্লেগ হাসপাতাল খুলেছি, চুন বিলি করছি। রবিকাকা ও সিস্টার নিবেদিতা পাড়ায় পাড়ায় ইন্সপেক্‌শনে যেতেন। নার্স ডাক্তার সব রাখা হয়েছিল। সেই প্লেগ লাগল আমারও মনে। ছবি আঁকার দিকে না ঘেঁষে আরো গানবাজনায় মন দিলুম। চারদিকে প্লেগ আর আমি বসে বাজনা বাজাই। হবি তো হ,  সেই প্লেগ এসে ঢুকল আমারই ঘরে। আমার ছোট্ট মেয়েটাকে নিয়ে গেল। ফুলের মতন মেয়েটি ছিল, বড় আদরের। আমার মা বলতেন, ‘এই মেয়েটিই অবনের সবচেয়ে সুন্দর।’ ন-দশ বছরের মেয়েটি আমার টুক করে চলে গেল; বুকটা ভেঙে গেল। কিছুতে আর মন যায় না। এ বাড়ি ছেড়ে—চৌরঙ্গিতে একটা বাড়িতে আমরা পালিয়ে গেলুম।”  

সুকুমার রায়ও তাঁর ‘নানাগল্পে’-র ‘পেটুক’-এ লিখেছেন, “চারদিকে যে রকম প্লেগ আর ব্যারাম এই পাড়াসুদ্ধ ইঁদুর না মারলে আর রক্ষা নেই।”    

‘ঢাকায় ওলাউঠা’ শীর্ষক লেখায় দীনেশচন্দ্র সেন কলেরার মড়কে ভয়াবহ মনের অবস্থার কথা জানিয়েছেন, “একটা উৎকট দুঃস্বপ্নের মত দিনটা চলিয়া গেল। স্কুলে গেলাম, দেখিলাম সহপাঠীরা প্রায় সকলে পলাইয়া গিয়াছে, মাষ্টারবর্গও প্রায়ই অনুপস্থিত। রাস্তা দিয়া আসিতে পথে পথে কেবল ‘হরিবোল’, কান্নার রোল, অনাথ ছেলেমেয়েদের চিৎকার, দোকানপাঠ বন্ধ। ‘বলহরি’ মিষ্ট কথাটা বুকের মধ্যে বজ্র নিনাদের মত বাজিতে লাগিল।” (‘ঘরের কথা ও যুগসাহিত্য’)

প্লেগ, কলেরা বা বসন্ত রোগে মড়ক লাগার ফলে গড়ে উঠেছিল শীতলা-মনসাসহ নানান লৌকিক দেবীর থান ও তাঁদের কেন্দ্র করে কাব্য। মড়কে  মৃতদেহ সৎকারের জন্য পাওয়া যেত না কাউকে। কিন্তু সব সময় একদল মানুষ মানুষের পাশে এসে দাঁড়াতো, দেশসেবার অংশ হিসেবেই হোক বা মানবতার খাতিরে।  বিবেকানন্দ’র এক চিঠিতে দেখি, “বুদ্ধের পরে এই আবার প্রথম দেখা যাচ্ছে যে, ব্রাহ্মণ সন্তানেরা অন্ত্যজ বিসূচিকা-রোগীর শয্যাপার্শ্বে সেবায় নিরত। ভারতে বক্তৃতা ও অধ্যাপনায় বেশি কাজ হবে না। প্রয়োজন সক্রিয় ধর্মের। আর মুসলমানদের কথায় বলতে গেলে খোদার মর্জি হলে -আমি তাই দেখাতে বদ্ধ পরিকর।” (পত্রাবলী, ৩৫০, স্বামী বিবেকানন্দ রচনাবলী) কলেরা বা বিসূচিকা রোগীর সেবা ভারত সেবারই অঙ্গ হয়ে উঠছে।

মানুষের মধ্যে স্বাস্থ্য সচেতনতা তৈরি করাও ছিল বড়ো চ্যালেঞ্জ। জলবাহিত কলেরা আক্রান্ত গ্রামের মূল সমস্যা ছিল ব্যবহৃত জল। তখন যে পুকুরের জল খাওয়া হত সেই পুকুরেই চলতো স্নান, পোশাক কাচাও। তাই কলেরার মড়ক পরবর্তী গ্রামে গ্রামে ডাক্তার পাঠানোর সঙ্গে সঙ্গে টিউবওয়েল বসানোটাও সরকারি পরিকল্পনার মধ্যে আসে। স্থানীয় উদ্যোগে শুরু হয় নতুন কুয়ো খোঁড়া বা ব্লিচিং দিয়ে জল পরিশোধনের কাজও। সে প্রসঙ্গ এসেছে অনেক গল্প উপন্যাসে।  

এ প্রসঙ্গে সুকুমার রায়ের ‘অবাক জলপান’-এর দ্বিতীয় দৃশ্যের কথা স্মরণ করা যাক, “এই বোতলের মধ্যে দেখুন, ও বাড়ির পুকুরের জল; আমি এইমাত্র পরীক্ষা করে দেখলুম; ওর মধ্যে রোগের বীজ সব গিজ্‌‌গিজ্‌‌ করছে‒ প্লেগ, টাইফয়েড, ওলাউঠা, ঘেয়োজ্বর ‒ও জল খেয়েছেন কি মরেছেন! এই ছবি দেখুন‒ এইগুলো হচ্ছে কলেরার বীজ, এই ডিপথেরিয়া, এই নিউমোনিয়া, ম্যালেরিয়া ‒সব আছে।” 

যেমন শরৎচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়ের ‘পণ্ডিতমশাই’ উপন্যাসে  গ্রামের একমাত্র পুকুরে কলেরা রোগীর পোশাক ধোওয়া হতে থাকে পণ্ডিতমশাই বৃন্দাবনের চোখের সামনে। এই পুকুর সারা গ্রামের জলের চাহিদা যোগায়। ফলে সেই জল পান করে গ্রামে মড়ক লাগে। তিনি গ্রামে কলেরা দূর করতে বিশুদ্ধ পানীয় জলের ব্যবস্থা করছেন,  “সেদিন তারিণী মুখুয্যের দুর্ব্যবহারে ও ঘোষাল মহাশয়ের শাস্ত্রজ্ঞান ও অভিসম্পাতে অতিশয় পীড়িত হইয়া বৃন্দাবন গ্রামের মধ্যে একটা আধুনিক ধরনের লোহার নলের কূপ প্রস্তুত করাইবার সঙ্কল্প করে। যাহার জল কোন উপায়েই কেহ দূষিত করিতে পারিবে না এবং যৎসামান্য আয়াস স্বীকার করিয়া আহরণ করিয়া লইয়া গেলে সমস্ত গ্রামবাসীর অভাব মোচন করিয়া দুঃসময়ে বহু পরিমাণে মারীভয় নিবারণ করিতে সক্ষম হইবে..।” কিন্তু ঠিক তখনই ঘরে তাঁর মা কলেরায় আক্রান্ত হয়ে মৃত্যু বরণ করেন। নিজের সন্তানকেও কলেরায় হারান পণ্ডিতমশাই।

তারাশঙ্কর বন্দ্যোপাধ্যায়ের ‘ধাত্রীদেবতা’ উপন্যাসের নায়ক শিবনাথকেও কলেরা আক্রান্তের সেবা করতে গিয়ে নানান বিরুদ্ধতার শিকার হতে হয়েছে। বৃন্দাবনের  মতো একই দৃশ্য দেখতে হয়েছে তাকেও। ‘অস্পৃশ্য’দের সেবা করা নিয়েও হতে হয়েছে সামাজিক প্রতিরোধের শিকার। গ্রামের ব্রাম্ভণ্যতন্ত্র রেহাই দেয়নি ।     

বিভূতিভূষণ বন্দ্যোপাধ্যায়ের ‘পেয়ালা’ গল্পটি উত্তম পুরুষে লেখা। গল্পের কথক গ্রামে গ্রামে নলকূপ বসানোর সরকারি বরাত নেন। গল্পের প্রথমেই কথক কলেরার ভয়াবহ এক স্মৃতি স্মরণ করেন। কুলবেড়ের মেলা ফেরৎ কাকা গল্পের কথককে মেলা শেষ হওয়ার আগেই বাড়ি ফিরে আসার বিষয়ে বলছেন, “হঠাৎ কলেরা শুরু হয়ে গেল, ওই তো হ’ল মুস্কিল! সব পালাতে লাগল, বাওড়ের জলে রোজ পাঁচটাছ’টা মড়া ফেলছিল, পুলিস এসে বন্ধ ক’রে দিলে, খাবারের যত দোকান ছিল সব উঠিযে দিলে, কিছুতেই কিছু হয় না, ক্রমেই বেড়ে চলল। শেষে প্ৰাণ নিয়ে পালিয়ে এলাম।”

যদিও গল্পটা একটা পেয়ালার যার সঙ্গে জড়িয়ে অনেক মৃত্যু। তাঁর ‘হীরা মাণিক জ্বলে’ উপন্যাসেও জামাতুল্লার সমুদ্রের স্মৃতিতে জড়িয়ে থাকে কলেরায় আক্রান্ত হওয়ার ভয়াবহ দুঃসময়।

তারাশঙ্করের ‘আরোগ্য নিকেতন’ উপন্যাসে পাই ‘শিক্ষিত ছেলেরা’ বিশুদ্ধ পানীয়জলের ব্যবস্থা করে কলেরায় মৃত্যু আটকাতে চায়ছে। কুয়ো খুঁড়তে কোদাল ঘাড়ে নিয়েছে। তাদের নাম হয়েছে ‘কোদালি ব্রিগেড। সেবাব্রতের সঙ্গী তারা। কলেরার মড়ক থেকে গ্রাম বাঁচাতে তৎপর। লেখক জানাচ্ছেন, “শুকনো পুকুরের তলায় কুয়ো কেটে তার জল বের করলে। তাই তো! কথাটা তো কারুর মনে হয়নি! স্যানিটারি ইনস্পেক্টরেরা পুকুরে ব্লিচিং পাউডার গুলে দিয়ে জলকে শোধন করলে। অ্যান্টি-কলেরা ভ্যাকসিন ইনজেকশন দিলে। কলেরার টিকে!”    

তারাশঙ্করের অনেক গল্প-উপন্যাসেই পাওয়া যাচ্ছে মড়কের অনুষঙ্গ যা তাঁর মূল কাহিনিকে আক্রান্ত করছে।     

 ‘শ্রীকান্ত’ উপন্যাসের প্রথম ও দ্বিতীয় খণ্ডে একাধিক বার কলেরা প্রসঙ্গ এসেছে। শ্রীকান্ত ও ইন্দ্রনাথ কলেরায় মৃত এক শিশুর মৃতদেহ খুঁজে পায়। ওই করুণ দৃশ্য দেখে ইন্দ্রনাথের চোখ বেয়ে টপটপ জল ঝরে। ইন্দ্রর বয়ানে পাই, “আজকাল ভয়ানক কলেরা হচ্ছে কিনা! সবাই তো পোড়াতে পারে না…মুখে একটুখানি আগুন ছুঁইয়ে ফেলে দিয়ে যায়। শিয়াল-কুকুরে খায় আর পচে।”  

আর এক জায়গায় পাচ্ছি, “সকাল-বেলা শোনা গেল, এই ছোট-বড় বাঘিয়া ত বটেই, আরও পাঁচ-সাতখানি গ্রামের মধ্যে তখন বসন্ত মহামারীরূপে দেখা দিয়াছে। দেখা গিয়াছে যে, গ্রামের এই সকল দুঃসময়ের মধ্যেই সাধু-সন্ন্যাসীর সেবা বেশ সন্তোষজনক হয়। সুতরাং সাধুবাবা অবিচলিতচিত্তে তথায় অবস্থান করিবার সঙ্কল্প করিলেন।”

মড়কের জন্য ঔপনিবেশিক শোষণকেও এই উপন্যাসে দায়ী করা হচ্ছে, “ম্যালেরিয়া, কলেরা, হররকমের ব্যাধি-পীড়ায় লোক উজোড় হয়ে গেল, কিন্তু কাকিস্ত পরিবেদন। কৰ্ত্তারা। আছেন শুধু রেলগাড়ী চালিয়ে কোথায় কার ঘরে কি শস্য জন্মেছে শুষে চালান ক’রে নিয়ে যেতে। কি বলেন মশাই? ঠিক নয়?”

কোয়ারান্টিন শব্দটাও পাওয়া যাচ্ছে এই উপন্যাসে, “চারিদিক হইতে একটা অস্ফুট শব্দ কানে আসিতে লাগিল, কেরেন্টিন। খবর লইয়া জানিলাম, কথাটা quarantine, তখন প্লেগের ভয়ে বর্মা গভর্নমেন্ট  অত্যন্ত সাবধান। শহর হইতে আট-দশ মাইল দূরে একটা চড়ায় কাঁটাতারের বেড়া দিয়া খানিকটা স্থান ঘিরিয়া লইয়া অনেকগুলি কুঁড়েঘর তৈয়ারি করা হইয়াছে; ইহারই মধ্যে সমস্ত ডেকের যাত্রীদের নির্বিচারে নামাইয়া দেওয়া হয়। দশদিন বাস করার পর, তবে ইহারা শহরে প্রবেশ করিতে পায়।” 

শরৎচন্দ্রের ‘দেনাপাওনা’ উপন্যাসে  জীবানন্দের মতো পরাক্রান্ত এক ভূস্বামীও দীন গৃহহীন উমাচরণের কলেরায় মৃত স্ত্রীর কথা জেনে কাঁদছেন, “এই ফাল্গুনের শেষে বিসূচিকা রোগে তাহার স্ত্রী মরিয়াছে, উপযুক্ত দুই পুত্র একে একে চোখের উপর বিনা চিকিৎসায় প্রাণত্যাগ করিয়াছে, সে কোন উপায় করিতে পারে নাই; অবশেষে জীর্ণ ঘরখানি সে তাহার বিধবা ভ্রাতুষ্কন্যাকে দান করিয়া চিরদিনের মত গৃহত্যাগ করিয়া আসিয়াছে। এ জীবনে আর তাহার ফিরিবার আশা নাই, ইচ্ছা নাই; এই বলিয়া সে ছেলেমানুষের মত হাউহাউ করিয়া কাঁদিতে লাগিল। জীবানন্দের চোখ দিয়া টপটপ করিয়া জল পড়িতে লাগিল।”

শরৎচন্দ্রের ‘লালু’-র একটি গল্পে  কলেরার ভয়ে যখন সবাই গ্রাম ছেড়ে পালাচ্ছে গল্পের কথক এবং লালু গোপালখুড়োর মড়া পোড়ানো-দলের সঙ্গী। একটি গল্পের প্রথমেই পাই, “আমাদের শহরে তখন শীত পড়েছে, হঠাৎ কলেরা দেখা দিলে। তখনকার দিনে ওলাউঠার নামে মানুষে ভয়ে হতজ্ঞান হতো। কারও কলেরা হয়েছে শুনতে পেলে সে-পাড়ায় মানুষ থাকতো না। মারা গেলে দাহ করার লোক মেলা দুর্ঘট হতো। কিন্তু সে দুর্দিনেও আমাদের ওখানে একজন ছিলেন যাঁর কখনো আপত্তি ছিল না। গোপালখুড়ো তাঁর নাম, জীবনের ব্রত ছিল মড়া-পোড়ানো।” তারপর লালুর কীর্তি তো সবারই জানা।

অনুরূপ ঘটনা পাই বিভূতিভূষণেও। “সেবার শুয়োরমারি বস্তিতে ভয়ানক কলেরা আরম্ভ হইল, কাছারিতে বসিয়া খবর পাইলাম। শুয়োরমারি আমাদের এলাকার মধ্যে নয়, এখান থেকে আট-দশ ক্রোশ দূরে, কুশী ও কলবলিয়া নদীর ধারে। প্রতিদিন এত লোক মরিতে লাগিল যে, কুশী নদীর জলে সর্বদা মড়া ভাসিয়া যাইতেছে, দাহ করিবার ব্যবস্থা নাই।” ‘আরণ্যক’-এর পঞ্চম পরিচ্ছেদে কলেরার এই ভয়াবহ দৃশ্য।

মানিক বন্দ্যোপাধ্যায়ের গল্প উপন্যাসেও মহামারীর উল্লেখ পাওয়া যায়। ‘আরোগ্য’-তে ললনার মুখে শোনা যায়, “কলেরা বসন্ত লেগেছে খুব । রক্ষাকালীর পূজো হবে, চাঁদা চেয়ে নিল। রোগ ব্যারামের এমন ছড়াছড়ি বোধ হয় জগতে কোথাও নেই। এবার যেন কাটতেই চায় না অসুস্থ অবস্থাটা ।”

‘পুতুল নাচের ইতিকথা’-র নায়ক শশী নিজেই ডাক্তার। লেখক জানাচ্ছেন, “ভ্যাপসা গুমোট, শুষ্ক ডোবা-পুকুর-ভরা গ্রামের রুক্ষ মূর্তি আর কলেরা রোগীর কদর্য সান্নিধ্য, এই সমস্ত পীড়নের মধ্যে কুসুমের খাপছাড়া হাসিটুকু ভিন্ন মনে করিবার মতো আর কিছু শশী খুঁজিয়া পায় নাই ।”  

সৈয়দ মুজতবা আলী ‘পাদটীকা’ গল্পটি আরম্ভ করেছেন এভাবে, “গত শতকের শেষ আর এই শতকের গোড়ার দিকে আমাদের দেশের টোলগুলো মড়ক লেগে প্রায় সম্পূর্ণ উজাড় হয়ে যায়।”

নারায়ণ গঙ্গোপাধ্যায়ে গল্প ‘পুষ্করা’-তেও বাংলার মন্বন্তর পরবর্তী মড়ক থেকে উদ্ধার পাবার চিত্র। জগদীশ গুপ্তর ‘পয়োমুখম’ গল্পে ভূতনাথ নিজের স্ত্রীদের হত্যার পিছনে তার অর্থলিপ্সু কবিরাজ বাবার দুষ্কর্ম ধরে ফেলে শেষ পর্যন্ত। শেষতম বউ বেঁচে যায়। ভূতনাথ বলে, “এ বৌটার পরমায়ু আছে তাই কলেরায় মরল না, বাবা! পারেন তো নিজেই খেয়ে ফেলুন।” মানুষের এক অন্ধকার অধ্যায় বেরিয়ে পড়ে। কোভিড-১৯ মহামারি মানুষের তৈরি কিনা তা নিয়ে চাপান উতোর এখনও চলছে। শিব্রাম চক্রবর্তীর ‘দেবতার জন্ম’ গল্পের কথক যে-পাথরে হোঁচট খেতে খেতে বিরক্ত হয়ে উঠেছিল বসন্ত রোগ থেকে বাঁচতে সেই পাথরেই মাথা নোয়ায়। এই সময়ের সঙ্গেও বেশ মিল পাওয়া যায় না কি?

হাসান আজিজুল হকের ‘আগুনপাখি’ উপন্যাসে মেতর বউ-এর জবানীতে শোনা যায়, “এত রোগের নামও ত্যাকন জানত না লোকে। ডাক্তারবদ্যিও ছিল না তেমন। মরবার আগে মুখে যেদি ওষুধ পড়ত, তাই কত! পেরায় পিতি বছর কলেরা-বসন্তেই কত যি লোক মরত, তার সীমাসংখ্যা নাই।”

জহির রায়হানের  ‘হাজার বছর ধরে’ উপন্যাসে কলেরার মড়ক বর্ণিত হয় এভাবে, “অবশেষে আরো আট দশটি প্রাণ হরণ করে তবে গ্রাম থেকে বিদায় নিলেন ওলা বিবি।” ওলা, বসন্ত, যক্ষ্মা তিন বোন হিসেবে বর্ণিত হয় কাহিনিতে যারা একে অপরকে ছেড়ে থাকতে পারে না।  

‘সুলতানার স্বপ্ন’-তে বেগম রোকেয়া যে ইউটোপিয়ার দেশ নির্মাণ করেছেন তাতে আছে মহামারির আসল কারণ। উদ্ধার করা যাক সারার সঙ্গে গল্পের কথকের কথোপকথনের অংশ, “ভারতের প্লেগ সম্বন্ধেও অনেক কথা হইল, তিনি বলিলেন, ‘প্লেগ- ট্লেগ কিছুই নহে—কেবল দুর্ভিক্ষ প্রপীড়িত লোকেরা নানা রোগের আধার হইয়া পড়ে। একটু অনুধাবন করিলে স্পষ্ট প্রতীয়মান হয়, গ্রাম অপেক্ষা নগরে প্লেগ বেশি—নগরের ধনী অপেক্ষা নির্ধনের ঘরে প্লেগ বেশি হয় এবং প্লেগে দরিদ্র পুরুষ অপেক্ষা দরিদ্র রমণী অধিক মারা যায়। সুতরাং বেশ বুঝা যায়, প্লেগের মূল কোথায়—মূল কারণ দেশে অন্নাভাব। আমাদের এখানে প্লেগ বা ম্যালেরিয়া আসুক তো দেখি!”

 তাই তো, ধনধান্যপূর্ণা নারীস্থানে ম্যালেরিয়া কিংবা প্লেগের অত্যাচার হইবে কেন, প্লীহা-স্ফীত উদর ম্যালেরিয়াক্লিষ্ট বাঙ্গালায় দরিদ্রদিগের অবস্থা স্মরণ করিয়া আমি নীরবে দীর্ঘশ্বাস ত্যাগ করিলাম।”

ইতিমধ্যেই খবরে প্রকাশ করোনা-লকডাউনে কাজ ও খাদ্যাভাবে মানুষ কচুপাতা সেদ্ধ খেতে শুরু করেছেন। ‘খাবারের প্যাকেট দেখলে ছুটে আসছেন ভুখা লোকজন’, জানিয়েছেন বলিউড শাহেনশা।    

Share Now:

Comment(1)

LEAVE YOUR COMMENT

Your email address will not be published. Required fields are marked *