করোনা: ধনীদের কর ছাড়, গরিবের হাহাকার
Corona: Bail out for the rich and hunger for the poor নিবন্ধটি প্রকাশিত হয়েছিল এই পোর্টালে। বর্তমান নিবন্ধটি তার বাংলা অনুবাদ।
পিপল্স ম্যাগাজিন ডেস্ক: মুকেশ আম্বানির ক্ষতি দু’ লক্ষ ছাপ্পান্ন হাজার কোটি টাকা। দেশের সবচেয়ে বড়লোকটির এ হেন ক্ষতির কারণ কী? অবশ্যই করোনা; এবং তজ্জনিত দেশের শেয়ার বাজারের পতন। মিডিয়ায় আম্বানির এই ক্ষতির প্রচার শুনতে শুনতে আমরা ক্লান্ত। কিন্তু কোথাও তেমন শুনতে পাচ্ছি না সেই চল্লিশ কোটি গরিব নাগরিকের কথা, দেশজোড়া লকডাউনের জেরে যারা আরও গরিব হয়ে পড়বেন। তাঁরা দেশের অসংগঠিত ক্ষেত্রের শ্রমিক। তাঁরা দিন আনেন, দিন খান। কোটির ঘরে তাঁদের ওই সংখ্যাটার হিসেব কষেছে আন্তর্জাতিক শ্রম সংস্থা বা আইএলও। সুতরাং, মেইন স্ট্রিম মিডিয়া যে কথাটা আমাদের গেলাতে চাইছে, সেটা মিথ্যা। কোন কথাটা? ওই যে — করোনা নাকি গরিব-বড়োলোক চেনে না, করোনার সামনে সকলেই নাকি সমান অসহায়।
আরও পড়ুন: করোনাভাইরাসের সঙ্গে দুনিয়া জুড়ে ছড়াচ্ছে ফ্যাসিবাদের অতিমারি
আম্বানি দু’ লক্ষ ছাপান্ন হাজার কোটি টাকা খুইয়েছেন শেয়ার বাজারে। তার পরেও তাঁর ব্যক্তিগত সম্পত্তির পরিমাণ এক লক্ষ চুয়াত্তর হাজার কোটি টাকা। করোনা-আবহে শেয়ার বাজারের অনিশ্চয়তায় মোট চার লক্ষ কোটি টাকা ক্ষতির মুখে পড়েছেন ভারতের ধনীতম চোদ্দো জন কোটিপতি। তার পরেও যে পরিমাণ অর্থের তাঁরা মালিক, তা বেশির ভাগ ভারতীয় নাগরিকের কল্পনার বাইরে। লকডাউনের পর থেকে গত দু’ সপ্তাহ ধরে সেই নাগরিকেরা কিন্তু এক পয়সাও উপার্জন করার সুযোগ পাননি। প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদীও সেই নাগরিকদের কোনও সরকারি আর্থিক সাহায্য দেওয়ার প্রয়োজন বোধ করেননি। তিনি তো বলেই দিয়েছেন তিনি বিনিয়োগকারীদের সেবক। আর তাই, বছরে এক লক্ষ পঁয়তাল্লিশ হাজার কোটি টাকার কর ছাড় দিয়েছেন বৃহৎ কর্পোরেট সংস্থার মালিকদের। সরকারি তথ্য অনুয়ায়ী, ২০১৫-১৬ অর্থবর্ষে ভারতের ধনীরা সব মিলিয়ে এক লক্ষ কোটি টাকা ভর্তুকি পেয়েছেন। সেখানে, সরকারের আদায় করা মোট করের দুই-তৃতীয়াংশই কিন্তু দিয়েছিলেন গরিব মানুষেরা, পরোক্ষ কর প্রদানের মাধ্যমে।
তবে, এটা শুধু ভারতের ছবি নয়। দুনিয়া জুড়েই ব্যাপারটা এখন এ রকম। পুঁজিবাদী শাসনে, যখনই কোথাও কোনও সংকট ঘনায়, তখনই বড়লোকদের কর ছাড় দেওয়া হয়। আর, সেটা পোষানো হয় গরিবদের ওপর বাড়তি করের বোঝা চাপিয়ে। করোনা-প্রভাবে, অনলাইন বেচাকেনার সংস্থা অ্যামাজন-এর মালিক জেফ বেজোসের আর্থিক ক্ষতির পরিমাণ পাঁচশো কোটি মার্কিন ডলার। কিন্তু তার পরেও, ফোর্বস-এর তালিকা অনুযায়ী, গত মার্চ মাসের মাঝামাঝি পর্যন্ত জেফ বেজোসের মালিকানাধীন সম্পত্তির পরিমাণ এগারো হাজার তিনশো কোটি মার্কিন ডলার। একই ভাবে, বিল গেটসের ক্ষতির পরিমাণ দু’শো কোটি মার্কিন ডলার। তার পরেও, তাঁর সম্পত্তির পরিমাণ দশ হাজার পাঁচশো কোটি মার্কিন ডলার।
মার্কিন মুলুকে করোনা-হানার পর থেকে এখনও অবধি ত্রিশ লাখ মার্কিন অধিবাসী সেখানকার সরকারের কাছ বেকার ভাতার জন্য আবেদন করেছেন। কিন্তু প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্পের সহানুভূতি যে বৃহৎ মার্কিন কোম্পানিগুলোর দিকে, তাদের জন্য এক লক্ষ কোটি ডলার কর ছাড়ের অঙ্গীকার করেছেন তিনি। এ ছাড়াও, বড় বাণিজ্য সংস্থাগুলোর জন্য আরও পনেরো হাজার কোটি ডলার সাহায্যের প্রতিশ্রুতি দিয়েছেন ট্রাম্প। এত বড় ছাড়ের এই অর্থ কোত্থেকে আসবে? অবশ্যই আমেরিকার গরিব অধিবাসীদের ওপর কর চাপানোর মাধ্যমে। তথ্য হল, মার্কিন দেশের ধনীতম চারশো পরিবার সে দেশের গরিব ও মধ্যবিত্ত অধিবাসীদের চেয়ে কম পরিমাণ কর দিয়ে থাকেন। অর্থনীতিবিদ ইম্যানুয়েল সায়েজ ও গ্যাব্রিয়েল জ্যুকম্যান সম্প্রতি হিসেব কষে এটা দেখিয়েছেন।
লকডাউনের ফলে ব্যবসাবাণিজ্য বন্ধ থাকার ফলে অর্থনৈতিক বিপর্যয় দেখা দেবে। যার জের চলবে বহু দিন। ভারতে কোটি কোটি দিনমজুরের জীবন-জীবিকা ধ্বংসের মুখে পড়বে। একই দশা হবে পেনশন-নির্ভর বয়স্কদের; এমনকী, একটা বড় সংখ্যক মধ্যবিত্ত মানুষের। যাঁরা সরকারের বদান্যতার আশা করছেন এখনও, তাঁরা অবশ্যই হতাশ হবেন। প্রাপ্ত তথ্য-পরিসংখ্যানের ভিত্তিতে বলাই যায় যে ভারতে হোক বা বিদেশে, সর্বত্রই সরকার শুধু বৃহৎ কর্পোরেট সংস্থা ও অতি-ধনীদের সেবায় ব্যস্ত। শুনতে খারাপ লাগলেও, গরিব ও মধ্যবিত্তরা পুঁজিবাদী অর্থনীতির খাদ্য ছাড়া আর কিছু নন। তা হলে, উপায়? পুঁজিবাদের বদলে সমাজতান্ত্রিক অর্থনীতি যত দিন না চালু হচ্ছে, এ অবস্থা থেকে কোনও পরিত্রাণ নেই।