Home অর্থনীতি করোনাভাইরাস ও লকডাউন: স্বাস্থ্য, রাজনীতি ও অর্থনীতি

করোনাভাইরাস ও লকডাউন: স্বাস্থ্য, রাজনীতি ও অর্থনীতি

করোনাভাইরাস ও লকডাউন: স্বাস্থ্য, রাজনীতি ও অর্থনীতি
0

[বিপ্লবী ছাত্র ফ্রন্ট নামে একটি ছাত্র সংগঠনের করোনাভাইরাস ও লকডাউন নিয়ে তৈরি করা পুস্তিকার (করোনা ভাইরাস, লকডাউন ও কিছু কথা) সফট কপি আমাদের হাতে এসে পৌঁছেছে। মানুষকে সচেতন করার প্রশ্নে, লকডাউনের রাজনীতি ও অর্থনীতিকে বিশ্লেষণ করার প্রশ্নে এই পুস্তিকায় তাঁরা যে মতামত পেশ করেছেন, তার সঙ্গে আমরা মূলত একমত। করোনাভাইরাস-পরিস্থিতি নিয়ে আমাদের পাঠকদের নানা প্রশ্নের উত্তর একটি লেখার মাধ্যমে পৌঁছে দেওয়ার প্রয়োজনীয়তা আমরা অনুভব করছিলাম। এই পুস্তিকা আমাদের সেই সুযোগ করে দিল। পুস্তিকার শেষ অংশে বিপ্লবী ছাত্র ফ্রন্টের পক্ষ থেকে সাধারণ মানুষের উদ্দেশে নির্দিষ্ট রাজনৈতিক আহ্বান রাখা হয়েছিল। যা একান্তই স্বাভাবিক। কিন্তু একটি গণমাধ্যমের পক্ষে কোনো রাজনৈতিক সংগঠনের এই ধরনের কোনো আহ্বান প্রকাশ করা উচিত নয় মনে করে আমরা পুস্তিকার শেষতম অনুচ্ছেদটি বাদ দিয়েছি।]

মহামারির আকার নেওয়া করোনা ভাইরাসের আতঙ্কে ভুগছে গোটা বিশ্ব। মৃত্যুমিছিল রুখতে গোমূত্র পানের নিদান দেওয়া আমাদের ছাপ্পান্ন ইঞ্চির রাষ্ট্রনায়কও জনতা কার্ফুর অ্যাসিড-টেস্ট পার করা জনগণের ওপর জারি করেছেন আপাতত ২১ দিনের লকডাউন যা আরও বাড়বে কিনা তা পুরোপুরি অনিশ্চিত। একদিকে আমাদের দেশের রংবেরং-এর শাসকদলের নেতা ও কর্পোরেট মিডিয়া ‘করোনা নিয়ে অযথা আতংক ছড়াবেন না’-র ধুয়ো তুলে জনগনকে আতংকিত করে তুলছেন, অন্যদিকে জনগণের মধ্যে গণবৈজ্ঞানিক সচেতনতা গড়ে তোলার বিষয়ে এরা চরম উদাসীন। পরিস্থিতির সুযোগ নিয়ে নিজের নিজের রাজনৈতিক ফায়দা তুলতে ব্যস্ত সবাই। রোগ প্রতিরোধের নামে লকডাউন জারি করে একদিকে গরিব জনগণকে ধনে-প্রাণে মারার সুবন্দোবস্ত করা হচ্ছে, অন্যদিকে জনগণ নিত্য প্রয়োজনীয় কাজে রাস্তায় নামলে তাদের ওপর নেমে আসছে পুলিশি সন্ত্রাস। অবশ্য যে দেশের সরকার শিক্ষা এবং স্বাস্থ্য খাতের বরাদ্দ কমিয়ে বছর বছর সামরিক খাতে ব্যয় বাড়ায়,তাদের কাছে রোগের দাওয়াই হিসাবে লাঠি-গুলি বাদ দিয়ে আর কী আশা করা যেতে পারে?

তাই আজকের এই পরিস্থিতিকে বুঝতে গেলে একদিকে আমাদের যেমন করোনা সংক্রান্ত বৈজ্ঞানিক ব্যাখ্যাগুলিকে বুঝতে হবে, তেমনই বুঝতে হবে এর পিছনের সামাজিক-রাজনৈতিক-অর্থনৈতিক প্রেক্ষাপটকে। আসুন গণবৈজ্ঞানিক দৃষ্টিভঙ্গি থেকে আমরা করোনা এবং তার ফলে উদ্ভূত পরিস্থিতিকে একটু বুঝে নেওয়ার চেষ্টা করি-

করোনা ভাইরাস সম্পর্কে দু-চার কথা

গঠনগত ভাবে করোনা ভাইরাস একটা বিশাল আরএনএ (RNA) ভাইরাসের পরিবার। ‘করোনা’ শব্দটার আক্ষরিক অর্থ হলো মুকুট। ইলেকট্রন মাইক্রোস্কোপের তলায় এই পরিবারের ভাইরাসকে অনেকটা রাজার মাথার মুকুটের মতন দেখায়, সেই থেকে এই নামকরণ। অন্য সকল ভাইরাসের মতো এরাও জীবনধারণ ও বংশবৃদ্ধির জন্য কোনো না কোনো সজীব কোশের উপর নির্ভরশীল হয়ে থাকে। এই ভাইরাসের সবচেয়ে বাইরের অংশে থাকে গ্লাইকোপ্রোটিনের স্পাইক বা কাঁটা যেগুলোর সাহায্যে ভাইরাসটা জীবন্ত কোষে আটকে গিয়ে সংক্রামিত হয়। দ্বিতীয় উপাদানটা হলো রাইবোনিউক্লিক অ্যাসিড বা আরএনএ (RNA)। জীবন্ত কোশের ভিতরে প্রবেশ করে ভাইরাসটা  আরএনএ-র প্রতিলিপি তৈরি করে বংশ বিস্তার করে। আর তৃতীয় উপাদানটা হ’ল একটা লিপিড স্তর, এটা ভাইরাসের অন্যান্য অংশকে ধরে রাখে। করোনাভাইরাস-এর মারাত্মক প্রকোপ এবং এবং তাকে কী করে ঠেকিয়ে রাখা যায়, সেটা বুঝতে হলে এই তিনটে অংশের কথাই আমাদের মাথায় রাখতে হবে। যদিও করোনাভাইরাসের অনেক প্রজাতি আছে, তার মধ্যে মাত্র সাতটা প্রজাতি মানুষের দেহে রোগ সংক্রমণ করতে পারে। এদের মধ্যে চারটে সারা বছর ধরে অত্যন্ত সাধারণ হাঁচি-কাশি সর্দির উপসর্গ সৃষ্টি করে। এছাড়া মার্স কভ (MERS-CoV) – এটা একটা বিটা করোনাভাইরাস যা থেকে ২০১২ সালে মিডলইস্ট রেস্পিরেটারি সিন্ড্রোম বা মার্স (Middle East Respiratory Syndrome, or MERS) ছড়িয়েছিল। সার্স কভ (SARS-CoV)– এটা একটা বিটা করোনাভাইরাস যা অতি তীব্র শ্বাস রোগ  বা সার্স (severe acute respiratory syndrome, or SARS) ছড়িয়েছিল। প্রথম ২০০২ সালে চিন দেশে এই রোগ দেখা গিয়েছিল।  তৃতীয় আরেকটা টাইপ, সার্স কভ-২ (SARS-CoV-2) (severe acute respiratory syndrome coronavirus 2)-কেই নভেল করোনা ভাইরাস বলা হয়। নতুন আবিষ্কৃত এই নভেল করোনা ভাইরাসের সংস্পর্শে মানুষের দেহে যে ছোঁয়াচে রোগ সৃষ্টি হয়, সেই রোগের নাম কোভিড-১৯ (COVID-19) বা করোনা ভাইরাস ডিজিজ (coronavirus disease)। এই ভাইরাসকে নভেল বা নতুন বলা হচ্ছে কারণ এই সংক্রামক ভাইরাসটা এর আগে কখনো মানুষের মধ্যে ছড়ায়নি। ভাইরাসটার আরেক নাম ২০১৯-এনসিওভি (2019-NCOV)। মানুষ থেকে মানুষে এর সংক্রমণের হার প্রচণ্ড বেশি। সারা পৃথিবীর প্রায় ১৬৬টা দেশ এই ভাইরাস দ্বারা আক্রান্ত। ২০১৯-এর ডিসেম্বর মাসে চিনের ইউহান প্রদেশে সর্বপ্রথম এই রোগের প্রাদুর্ভাব হয়। ভাইরাস সংক্রমণ সব বয়েসের মানুষের মধ্যে হলেও যাদের রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা কম এবং যারা বয়স্ক, তাদের এই রোগে মারাত্মকভাবে আক্রান্ত হওয়ার সম্ভাবনা বেশি। এই ভাইরাস-কে একটা অপরিবর্তনশীল বস্তু বলে ভাবলে চলবে না। যেকোনো আর.এন.এ (RNA) ভাইরাসের মতো সার্স কভ-২-ও খুব সহজেই তার গঠন বদলাতে পারে। অর্থাৎ, ভাইরাস যখন বংশ বিস্তার করে তখন যেমন খুশি নিজেদের জিনের সজ্জা বদলে ফেলতে পারে। এই জিনের পরিবর্তিত সজ্জা নিয়েই ভাইরাস এক মানব দেহ থেকে অন্য মানব দেহে সংক্রামিত হয়। এখনও পর্যন্ত, করোনাভাইরাসের ক্ষেত্রেও প্রায় ৩০০বার মিউটেশান লক্ষ্য করা গেছে। কিন্তু এই মিউটেশানের প্রভাবে কোভিড-১৯ যুক্ত রোগীর উপসর্গে কী পরিবর্তন হচ্ছে তা এখনি বলা সম্ভব নয়। তাঁর জন্য প্রচুর নমুনা সংগ্রহ করে ভাইরাসের জিনোম সিকয়েন্সিং করে পরিবর্তন লক্ষ্য করতে হবে।এই রোগের প্রাথমিক লক্ষণগুলো সাধারণ সর্দি-কাশি, জ্বরের মতোই। যেমন-

  • জ্বর
  • শুকনো কাশি
  • হাত-পা-মাথায় ব্যথা
  • গলা ব্যথা

 কিছু মানুষের আবার কোনোরকম লক্ষণই দেখা যায় না। তবে এটা মনে রাখতে হবে যে এই করোনা ভাইরাসে আক্রান্তদের ৮০% কোনো রকম স্পেশাল চিকিৎসা ছাড়াই সেরে ওঠে। মূলত বাচ্চা এবং বয়স্ক মানুষদের এই ভাইরাসে আক্রান্ত হওয়ার সম্ভবনা বেশি, কারণ তাদের রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা অপেক্ষাকৃত কম হয়। একই কারণে ডায়াবেটিস, ব্লাড ক্যানসারে আক্রান্ত মানুষদেরও এই ভাইরাস দ্বারা সংক্রমিত হওয়ার সম্ভবনা বেশি। কোভিড -১৯এ আক্রান্তদের ৬ জনের মধ্যে ১ জন গুরুতর অসুস্থ হয়। কী এই গুরুতর অসুস্থতার লক্ষণ। দেখে নিন-

  • শ্বাসকষ্ট
  • পাঁচদিনের বেশি থাকা প্রবল কাশি
  • বুকে ব্যথা
  • কফের সাথে রক্ত

তাই প্রাথমিক ভাবে জ্বর বা সর্দি কাশি হলে চিকিৎসকের পরামর্শ নিন, বেশি করে জল খান, বিশ্রাম নিন। আতঙ্কিত হবেন না। তবে গুরুতর অসুস্থতার লক্ষণগুলি দেখা দিলে অবশ্যই কাছের চিকিৎসা কেন্দ্রে যান। এখনো পর্যন্ত গবেষণায় যা জানা গেছে, এই রোগের ভাইরাস বাতাসের মাধ্যমে ছড়ায় না। এই রোগ মূলত আক্রান্তদের থুতু-কফের মাধ্যমে ছড়ায়। আক্রান্ত মানুষ হাঁচলে বা কাশলে তার মুখ থেকে বেরোনো কফে মিশে থাকা ভাইরাস ছড়িয়ে পড়ে মোটামুটি ৩ ফুট দূরত্বের মধ্যে। সেই ব্যক্তির খুব কাছে থাকলে আপনার নিঃশ্বাসের সাথে ঢুকে পড়তে পারে করোনা ভাইরাস। তাই আক্রান্ত মানুষের থেকে ১ মিটার বা ৩ ফিট দূরত্ব বজায় রাখা দরকার। তাছাড়াও আক্রান্তদের হাঁচি-কাশির সময় বেরিয়ে আসা থুতু-কফ এর যেটুকু পোশাক, হাত বা সামনে থাকা কোনো জিনিসে লাগছে তার মাধ্যমেও এই রোগ ছড়িয়ে পড়তে পারে। সংক্রমিত ব্যক্তির সাথে খাবার, সিগারেট, পানীয় শেয়ার করলে লালার মাধ্যমে এই রোগ ছড়াতে পারে। বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা (WHO) জানাচ্ছে মলের মাধ্যমে এই রোগ ছড়ানোর সম্ভবনা অপেক্ষাকৃত কম। গবেষণায় দেখা গেছে আক্রান্তের মলে এই ভাইরাস উপস্থিত থাকতে পারে তবে বিশ্বব্যপী যে মহামারি দেখা গেছে তা মলের মাধ্যমে এই রোগ ছড়ায়নি। কোনো দেশে এই ভাইরাসটার সংক্রমণ ঘটার সময় প্রধানত চারটে পর্যায়ে ভাইরাসটা ছড়ায়।

পর্যায় ১. বিদেশ থেকে আগত রোগীর মাধ্যমে (Imported Cases) – যে সমস্ত দেশে আগেই সংক্রমণ ঘটেছে সেই অঞ্চল থেকে কেউ সংক্রমণের শিকার হয়ে নিজের দেশে ফিরলে, তাকে প্রথম পর্যায়ের সংক্রমণ বলা হয়।

পর্যায় ২. আঞ্চলিক সংক্রমণ (Local Transmission) –  বিদেশ থেকে আগত রোগীর সরাসরি সান্নিধ্যে এসে কেউ নিজে সংক্রামিত হলে তাকে দ্বিতীয় পর্যায়ের সংক্রমণ বলা হয়। এক্ষেত্রে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ ব্যাপার হলো, একজন আক্রান্ত ব্যক্তির থেকে অন্য সুস্থ মানুষের সংক্রমণের সম্ভাবনা যথাসম্ভব কমিয়ে আনা, যাতে সংক্রমণের শৃঙ্খলটাকে (transmission chain) কেটে দেওয়া যায়। ভারতে করোনা ভাইরাসের সংক্রমণ এখন এই পর্যায়ে আছে এবং সকলে সামাজিক দূরত্ব (social distance) বজায় রাখলে তবেই সংক্রমণ  এই পর্যায়ে রোখা যাবে।

পর্যায় ৩–  পারস্পরিক সম্প্রদায়ের মধ্যে সংক্রমণ (Community Transmission) – বিদেশ থেকে আগত রোগীর বা যে কোনো করোনা আক্রান্ত রোগীর সান্নিধ্যে না এসেও কেউ যখন সংক্রামিত হয় তখন তাকে তৃতীয় পর্যায়ের সংক্রমণ বলা হয়। এই পর্যায়ের সংক্রমণ অনেক দ্রুত, অনেক বড়ো এলাকা জুড়ে হয়।

পর্যায় ৪– মহামারি (Epidemic) –  এটা শেষ এবং সবথেকে খারাপ পর্যায় যখন সংক্রমণ অত্যন্ত দ্রুত মহামারির আকারে ছড়িয়ে পড়ে। এই পর্যায়ের সংক্রমণ একবার হয়ে গেলে কবে, কীভাবে আটকানো যাবে, তা বলা অসম্ভব।

এখন প্রশ্ন জাগতে পারে করোনা ভাইরাস-এর পরীক্ষা কীভাবে করা হয়? বস্তুত যে কোনো জায়গাতেই এই পরীক্ষার জন্য নমুনা সংগ্রহ করা সম্ভব। সাধারণতঃ রোগীর গলার ভিতরে একটি তুলোর ডেলা প্রবেশ করিয়ে, সেটার সাহায্যে লালা সংগ্রহ করে তা পরীক্ষাগারে পাঠানো হয়। এছাড়া র‍্যাপিড টেস্টে অ্যান্টিবডির উপস্থিতি লক্ষ্য করার জন্য রক্ত পরীক্ষাও করা যেতে পারে। তবে সম্ভবতঃ শুধুমাত্র চিনেই সেই পরীক্ষার ব্যবস্থা রয়েছে। নমুনা সংগ্রহের প্রক্রিয়াটা সহজ হলেও ল্যাবরেটারিতে তা পরীক্ষা করার পদ্ধতিটা বেশ জটিল। নমুনাটা দিয়ে রিভার্স ট্রান্সক্রিপ্টেজ পলিমারেজ রিঅ্যাকশান (Reverse Transcriptase Polymerase Chain Reaction) করা হয়। যেকোনো পলিমারেজ চেন রিঅ্যাকশান (PCR)  কোষের ডিএনএ-তে (DNA) ঘটে। কিন্তু, যেহেতু করোনা ভাইরাস একটা আরএনএ (RNA) ভাইরাস, তাই পরীক্ষাটার প্রথম ধাপে রোগীর দেহ থেকে প্রাপ্ত নমুনায় ভাইরাস থাকলে তার আরএনএ প্রথমে DNA-তে রূপান্তরিত হয়। তারপর PCR পদ্ধতিতে DNA-র অগুন্তিবার রেপ্লিকেশান ঘটে যে প্রতিলিপি তৈরি হয়, তা থেকে নমুনাতে ভাইরাসের উপস্থিতি সহজেই বোঝা যায়। সেক্ষেত্রে আক্রান্ত ব্যক্তিকে করোনা পজিটিভ বলা হয়। আর ভাইরাস না থাকলে কোন প্রতিলিপিই তৈরি হয় না। সেক্ষেত্রে আক্রান্ত ব্যক্তিকে করোনা নেগেটিভ বলা হয়। ২৪ ঘন্টা লাগে টেস্টের ফল আসতে। তবে প্রচুর নমুনা পরীক্ষার ক্ষেত্রে, সব ধাপগুলো একবারে করার সুযোগ না থাকায় অনেকসময় ৪৮-৭২ ঘণ্টাও লাগতে পারে।

করোনা বিষয়ক জনস্বাস্থ্যবিধি

  • কী ভাবে এই সংক্রমণের হাত থেকে বাঁচব?
  • নিয়মিত সাবান-জল দিয়ে হাত পরিষ্কার করুন। অ্যালকোহল বেসড হ্যান্ড স্যানিটাইজার দিয়ে হাত পরিষ্কার করতে পারলে ভালো। বাড়ির বাইরে থাকলে অবশ্যই অ্যালকোহল যুক্ত হ্যান্ড স্যানিটাইজার ব্যবহারের চেষ্টা করুন। অসুস্থ কারোর সংস্পর্শে এলে বা খেতে যাওয়ার আগে করুন। তবে মনে রাখবেন ময়লা হাতে কিন্তু স্যানিটাইজার কাজ করে না, সেক্ষেত্রে সাবান জল দিয়ে আগে হাত ধোন।
  • কোনো ব্যক্তির হাঁচি বা কাশি থাকলে তার থেকে ১ মিটার বা ৩ ফুট দূরত্ব বজায় রাখার চেষ্টা করুন। কারণটা আগেই বলেছি।
  • অনেকের অকারণে চোখে, নাকে, মুখে হাত দেওয়ার বাজে অভ্যাস থাকে। এগুলো একেবারেই করবেন না। ভাইরাস আপনার হাত থেকে নাক,মুখ কিংবা চোখ দিয়ে আপনার শরীরে সহজেই প্রবেশ করতে পারে। এটা শুধু করোনা না অন্যান্য অনেক রোগের ক্ষেত্রেই সত্যি। তাই এই অভ্যাস একেবারেই ছাড়ুন।
  • হাঁচি বা কাশির সময় কনুইয়ের উল্টো দিক দিয়ে মুখ ঢেকে হাঁচুন বা কাশুন। হাতের তালু দিয়ে মুখ ঢেকে নয়। কারণ প্রতিদিন কাজের সময় হাতের তালু বারবার ব্যবহার হয় আর তা থেকে সংক্রমণের সম্ভবনা থাকে। এছাড়া রুমালে মুখ ঢেকে হাঁচি বা কাশির পরে রুমাল পকেটে ভরে রাখুন, দিনের শেষে রুমাল কেছে ধুয়ে নিন। এই অভ্যাস তৈরি করতে পারলে সাধারণ সর্দি কাশির মতো ভাইরাস ঘটিত রোগ থেকেও মুক্তি পাবেন।
  • রাস্তাঘাটে বেরিয়ে প্রয়োজন ছাড়া যেখানে সেখানে হাত দেবেন না। সিঁড়ি দিয়ে ওঠানামার সময় রেলিং না ধরে ওঠারই চেষ্টা করুন।
  • যেহেতু এই আমরা বেশিরভাগই দিনের অনেকটা সময় আমাদের স্মার্ট ফোনে প্রয়োজনে-অপ্রয়োজনে আঙুল চালায়, তাই নিজের ফোনটিকে যতটা সম্ভব মুছে পরিষ্কার রাখুন।
  • ধূমপায়ীদের উদ্দেশ্যে বিশেষ সতর্কবার্তা – যেহেতু এই রোগ মুখের লালার মাধ্যমে ছড়ায় , তাই বন্ধুদের সাথে ভাগ করে বিড়ি-সিগারেটের কাউন্টার খাওয়া বন্ধ করুন।
  • সবচেয়ে বড়ো কথা অযথা আতঙ্কিত হবেন না। গুজবে কান দেবেন না। চিকিৎসক এবং স্বাস্থ্য কর্মীদের সাথে সহযোগিতা করুন। ওপরের লেখা পরামর্শগুলো মেনে চলুন।
  • শরীর খারাপ হলেই কি  করোনা ভাইরাসের-এর জন্য পরীক্ষা করা জরুরি ?    

আগেই বলা হয়েছে, কোভিড-১৯ রোগের উপসর্গ মূলতঃ জ্বর, শুকনো কাশি, ক্লান্তি। এছাড়া সর্দিকাশি, শ্বাসকষ্ট, গলাব্যথা, ডায়েরিয়া-ও হতে পারে। সাধারণ ফ্লু বা সর্দিজ্বরের সঙ্গে এর অনেক মিল পাওয়া যায়। তাই এই উপসর্গগুলো থাকলে ডাক্তারের কাছে গিয়ে নিশ্চিত হওয়া উচিৎ যে রোগীর করোনা ভাইরাসের পরীক্ষা  করা প্রয়োজন কিনা। তবে পরীক্ষাগারের সংখ্যা যেহেতু সীমিত, এইসকল উপসর্গযুক্ত যেকোনো রোগীর-ই অযথা পরীক্ষার সংখ্যা কমানো উচিৎ। আগে ডাক্তারের পরামর্শ নেওয়া উচিত। যদিও এই রোগের নির্দিষ্ট কোন চিকিৎসা নেই (এই প্রতিবেদনটা  লেখার দিন পর্যন্ত), তার মানে এই নয় যে পরীক্ষা করা অর্থহীন। পরীক্ষায় রোগ আছে  প্রমাণিত হ’লে রোগীকে আলাদা করে রাখা যায় যাতে তার থেকে ভাইরাস অন্য সুস্থ মানুষের দেহে সংক্রামিত না হয়। এছাড়াও পরীক্ষা হলে তবে কোন দেশে  কত আক্রান্তের সংখ্যা তার একটা পরিষ্কার চিত্র পাওয়া সম্ভব। আর তবেই ভাইরাসের প্রকৃতি ও ছড়িয়ে পড়ার গতি নির্ণয় করা যায়।

  • সার্স কভ-২  কোনো পৃষ্ঠতলে (surface) বা কোনো জিনিসের উপর কতক্ষণ বাঁচতে পারে?

কোভিড-১৯ (COVID-19) একটা সংক্রামক রোগ। এটি মানুষ থেকে মানুষে ড্রপলেট ট্রান্সমিশনের মাধ্যমে ছড়ায়। অর্থাৎ, কোনো আক্রান্ত ব্যক্তির হাঁচি বা কাশির সময় যে অতি সূক্ষ্ জলের ফোঁটা বা এরোসল তৈরি হয় তার মাধ্যমে ভাইরাসটি ছড়িয়ে পড়ে। সেইজন্য এই  নভেল করোনা ভাইরাস কোনো জিনিসের পৃষ্ঠতলে ঠিক কতক্ষণ বাঁচতে পারে সেইটা জানা অত্যন্ত প্রয়োজন। সাম্প্রতিক এক গবেষণায় ন্যাশনাল ইনস্টিটিউট অফ হেল্থ-এর একদল বিজ্ঞানীরা দেখিয়েছেন যে, এই ভাইরাসটা এরোসলে অর্থাৎ বাতাসে সূক্ষ্ম ড্রপলেট অবস্থায় প্রায় ৩ ঘন্টা পর্যন্ত বাঁচতে পারে। কার্ডবোর্ড-এর উপর ভাইরাসটা প্রায় ২৪ ঘন্টা এবং প্লাষ্টিক বা স্টেইনলেস স্টিল এর উপর প্রায় তিন দিন পর্যন্ত বেঁচে থাকতে সক্ষম ।

  • শিশুদেরও কি করোনা ভাইরাসে আক্রান্ত হবার সম্ভাবনা আছে?

শিশু তথা কিশোরদের কোভিড-১৯-এ আক্রান্ত হবার সম্ভাবনা তুলনামূলকভাবে কম। CDC (Center for Disease Control and Prevention), China থেকে প্রকাশিত তথ্য অনুসারে, করোনাভাইরাস আক্রান্তদের মধ্যে  ০-৯ বছরের শিশু এবং ১০-১৯  বছর বয়সিদের আক্রান্তের সংখ্যা  যথাক্রমে  ০.৯% এবং ১.২% মাত্র। আরেকটা সমীক্ষা অনুসারে, কোভিড-১৯ আক্রান্তদের মধ্যে ০-১৪ বছরের বাচ্চাদের সংখ্যা ০.৯% যেখানে বড়দের (১৫-৪৯বছর)  সংখ্যা ৫৭.৮%। কিন্তু কেবলমাত্র কোভিড-১৯ আক্রান্ত শিশুদের নিয়ে প্রকাশিত আরেকটি সাম্প্রতিক গবেষণাপত্রের ফলাফল অনুসারে আক্রান্ত শিশুদের মধ্যে ছোটো (<৫ বছর), বিশেষত নবজাতকদের মধ্যে শারীরিক অবস্থার সংকটজনক অবনতি হবার প্রবণতা কিছুটা বেশি ।  তাই শিশুদের ক্ষেত্রেও সমস্তরকম সতর্কতামূলক ব্যবস্থা নেওয়া একান্ত জরুরি।

  • কেন সাবান দিয়ে হাত ধোওয়া জরুরি?

আগেই বলা হয়েছে, করোনা ভাইরাসের গঠন লক্ষ্য করলে দেখা যায় যে প্রধানত তিনটে উপাদানে গঠিত এই  নভেল করোনাভাইরাস। সবচেয়ে বাইরের অংশে থাকে গ্লাইকোপ্রোটিনের কাঁটা যেগুলোর সাহায্যে ভাইরাসটা জীবন্ত কোষে আটকে গিয়ে সংক্রামিত হয়। দ্বিতীয় উপাদানটা হ’ল রাইবোনিউক্লিক অ্যাসিড বা আরএনএ (RNA)। যখন কোনও জীবন্ত কোষের ভিতরে  ভাইরাসটি ঢোকে, তখন সে বংশ বিস্তার করে আরএনএ-র প্রতিলিপি তৈরির মাধ্যম। আর তৃতীয় উপাদানটা হ’ল একটা লিপিড স্তর, এটা  ভাইরাসের অন্যান্য অংশ-কে ধরে রাখে। এই লিপিড স্তরটাকে  ভাঙ্গতে পারলে ভাইরাসটাকে মারা সম্ভব। সাবানের আনবিক গঠন দেখলে বোঝা যায় যে, এদের একটা মাথা এবং একটা লেজ আছে।সাধারণত মাথাটা হাইড্রোফিলিক (hydrophilic), অর্থাৎ মাথাটার জলের অণনুগুলোর প্রতি আকর্ষণ প্রবল। লেজটা আবার হাইড্রোফোবিক (hydrophobic), অর্থাৎ লেজটা জলকে একেবারেই পছন্দ করে না। এবার সাবান আর জল দিয়ে হাত ধুলে ভাইরাসের  লিপিড স্তরের প্রতি জলে গোলা সাবানের অনুর লেজের আকর্ষণ প্রবল হয়। অন্য দিকে  জলের অনু আবার সাবানের অনুর মাথাকে আকর্ষণ করে। এই টানাপড়েনের মধ্যে পড়ে ভাইরাসের লিপিড স্তরটা ভেঙে যায়, ফলে ভাইরাসটা  নিষ্ক্রিয় হয়ে মারা যায়।

  • কেন হ্যান্ড সানিটাইজারের থেকে সাবান বেশি কার্যকর?

স্যানিটাইজারের মূল উপাদান হল অ্যালকোহল। অ্যালকোহল-ও করোনভাইরাস-এর লিপিড স্তরটা ভেঙে ফেলতে সক্ষম। কিন্তু সাবানের মতো ভাইরাসের লিপিড স্তরের সঙ্গে অ্যালকোহলের দ্রুত বন্ধন গঠন হয় না, যার ফলে স্যানিটাইজার ব্যবহার করলে ভাইরাস নিষ্ক্রিয় হতে সময় লাগে।  তাই  হ্যান্ড স্যানিটাইজারের থেকে সাবান ভাইরাস নষ্ট করতে বেশি কার্যকর। সাবান ও জল  ব্যবহারের সুযোগ না থাকলে তখন হ্যান্ড স্যানিটাইজার বিকল্প হতে পারে।

  • আচ্ছা মাস্ক পরা কি তবে দরকার নেই?

না, একজন সুস্থ মানুষের মাস্ক পরার কোনো দরকার নেই। যদি আপনি করোনায় আক্রান্ত হন কিংবা একজন সংক্রমিত ব্যক্তির দেখাশোনা করেন তবেই একমাত্র মাস্ক পরুন। এছাড়া আপনার যদি সর্দি কাশি হচ্ছে সেক্ষেত্রে সতর্কতা মূলক ব্যবস্থা হিসাবে মাস্ক পরতে পারেন। WHO-এর ওয়েবসাইট জানাচ্ছে এর বাইরে মাস্ক ব্যবহারের অর্থ আপনি মাস্কটি নষ্ট করছেন, কারণ গোটা বিশ্ব জুড়েই মেডিক্যাল মাস্কের আকাল চলছে। আমাদের দেশেও সাধারণ মানুষের অসচেতনতার সুযোগ নিয়ে এক শ্রেণির ব্যবসাদার মাস্কের ব্যাপক কালোবাজারি করছে। তাই এই কালোবাজারি রুখে দিতে সচেতন ভাবে মাস্কের ব্যবহার করুন।

  • খবরের চ্যানেলে, পেপারে  ইনকিউবেশন পিরিয়ড, কোয়ারেন্টাইন–এইসব শব্দগুলো শুনছি।এগুলোর মানে কী?

রোগ সৃষ্টিকারী কোনো অনুজীব আমাদের দেহে প্রবেশ করার পর থেকে সেই রোগের লক্ষণগুলো(symptoms) আমাদের দেহে ফুটে উঠতে নির্দিষ্ট সময় লাগে, এই সময়টাকে বলা হয় ইনকিউবেশন পিরিয়ড। করোনা অর্থাৎ SARS COV-2  এর ক্ষেত্রে এই সময়টা ১৪ দিন বলে অনুমান করছেন বিজ্ঞানীরা। এর মানে দাঁড়ায় যে এই ১ থেকে ১৪ যে কোনো দিনের মধ্যে দেখা দিতে পারে কোভিড ১৯ এর লক্ষণ।

বিদেশ বা করোনা আক্রান্ত এলাকা থেকে কেউ যদি আমাদের দেশে প্রবেশ করেন তাহলে তার দেহে কভিড-১৯ রোগের কোনো লক্ষণ দেখা যায় কিনা তা দেখার জন্য ১৪ দিন ওই ব্যক্তিকে অন্য সুস্থ ব্যক্তিদের থেকে আলাদা রাখা হয়, এই প্রক্রিয়ার নাম কোয়ারেন্টাইন

অনেকের ক্ষেত্রে পরিস্থিতি অতটা গুরতর না হওয়ায় তাদের বাড়িতেই সকলের থেকে আলাদা থাকতে বলা হচ্ছে এবং ১৪দিন পর্যন্ত স্কুল, কলেজ, মন্দির, মসজিদ, চার্চ, স্টেশন, বিমানবন্দর, পার্ক-এর মতো পাবলিক প্লেস থেকে দূরে থাকতে বলা হচ্ছে। বাড়িতে আলাদা বাসনপত্র, আলাদা বাথরুম ব্যবহার করতে হবে। এই প্রক্রিয়ার নাম হোম কোয়ারেন্টাইন

ইতিমধ্যে ভাইরাসে আক্রান্ত হিসাবে চিহ্নিত ব্যক্তিকে সকলের থেকে আলাদা জায়গায় চিকিৎসাধীন রাখা কেবলে আইসোলেশন

 করোনা ভাইরাস ও বাজারচলতি কিছু মিথ

করোনা ভাইরাসকে নিয়ে তৈরি মিম, মেসেজ, পোস্টে ইতিমধ্যে ভর্তি ফেসবুকের দেওয়াল, হোয়াটসঅ্যাপের ইনবক্স। এগুলোর মধ্যে দিয়ে বাজারে ছড়াচ্ছে বেশ কিছু মিথ। না জেনে এগুলো বিশ্বাস করছেন সাথে সাথে শেয়ারও করছেন আপনিও। ‘হু’ এর ওয়েবসাইট অনুসারে দেখে নিন এগুলোর সত্যতা কতখানি।

  • করোনা ভাইরাস কি উষ্ণ ও আর্দ্র আবহাওয়া যুক্ত এলাকায় ছড়াতে পারে?

WHO এর মতামত অনুসারে, এখনো পর্যন্ত পাওয়া প্রমাণের ভিত্তিতে বলা যায় যে, করোনা ভাইরাস যেকোনো ধরনের আবহাওয়া যুক্ত অঞ্চলেই ছড়াতে পারে। তাই উষ্ণ আবহাওয়ার উপর অযথা ভরসা না করে আমাদের প্রত্যেকের যথাযথ সুরক্ষার ব্যবস্থা নেওয়া দরকার।

  • গরমজলে স্নান করলে কি করোনা ভাইরাস থেকে মুক্তি সম্ভব?

WHO এর মতামত অনুসারে, গরম জলে স্নান করে করোনা ভাইরাস প্রতিরোধ করা সম্ভব নয়। আমরা যে রকম উষ্ণতার জলেই স্নান করিনা কেন,আমাদের দেহের স্বাভাবিক উষ্ণতা সর্বদা ৩৬.৫ ডিগ্রি সেন্টিগ্রেড থেকে ৩৭ ডিগ্রি সেন্টিগ্রেড-এর কাছাকাছি থাকে। আবার, অতিরিক্ত গরম জলে স্নান করলে তা আমাদের শরীরের চামড়াকে পুড়িয়ে দিতে পারে, যা আরও সমস্যার সৃষ্টি করবে।

  • করোনা ভাইরাস কি মশার দ্বারা সংক্রামিত হতে পারে?

WHO এর মতামত অনুসারে, এখনও পর্যন্ত কোনো তথ্য বা প্রমাণ পাওয়া যায়নি, যাতে করোনা ভাইরাস মশার মাধ্যমে সংক্রামিত হতে পারে, তাই অযথা আতঙ্কিত হয়ে কোনো লাভ নেই।

  • আল্ট্রাভায়োলেট রশ্মি কি করোনা ভাইরাস প্রতিরোধে উপযোগী?

আল্ট্রাভায়োলেট ল্যাম্প, যা থেকে আল্ট্রাভায়োলেট রশ্মি পাওয়া যায়, সেগুলি কখনোই হাত বা শরীরের অন্য কোনো অংশকে জীবাণু মুক্ত করতে ব্যবহার করা উচিৎ নয়, কারণ এগুলি ত্বকের ভীষণভাবে ক্ষতি করতে পারে।

  • মাছ মাংস খেলে কি এই রোগে আক্রান্ত হব?

না। তবে মাছ মাংস ভালো করে রান্না করে খাওয়া বাঞ্ছনীয়। চিকেন, মটন কিংবা অন্যান্য যে কোনো মাংসই ভালো করে ধুয়ে রান্না করে খেতে হবে। প্রসঙ্গত বলে রাখা ভালো কাঁচা মাংস ধোওয়ার পর ভালো করে সাবান দিয়ে হাত ধোবেন।

  • কোভিড-১৯ প্রতিরোধে কোনো ভ্যাকসিন, ওষুধ বা টিকা আছে কি?

এখনও পর্যন্ত সেরকম কিছু আবিষ্কার হয়নি। তবে আমেরিকা, কিউবা প্রভৃতি দেশে এরকম ওষুধ তৈরির কথা শোনা যাচ্ছে। যদিও WHO এখনও কোনোরকম প্রতিষেধক আবিষ্কারের সংবাদে স্বীকৃতি দেয়নি।

  • অ্যান্টিবায়োটিক কোভিড-১৯ প্রতিরোধে কাজ করে?

না করে না। কোনো রকম ভাইরাস ঘটিত রোগে অ্যান্টিবায়োটিক কাজ করে না।

  • নিয়মিত মদ্যপান করলে কি এই ভাইরাস আক্রমণের সম্ভাবনা কম?

এই কথাটি একটা বড়ো গুজব। মদ্যপানের সাথে এই রোগের কোনো সম্পর্ক নেই। বরং অতিরিক্ত মদ খেলে আপনি অসুস্থ হয়ে পড়তে পারেন।

  •  গো মূত্র, গোবর ব্যবহারে লাভ পাওয়া যাবে?

আপনার ক্ষতির সম্ভবনা বাড়বে। দয়া করে কোনরকম ভ্রান্ত প্রচারে পা দেবেন না। পশুর মল মূত্র খেয়ে কোনোদিন রোগ সারে না, বরং রোগে ধরে। ইতিমধ্যে আমাদের রাজ্যে দুজন গোমূত্র খেয়ে হাসপাতালে ভর্তি হয়েছেন। তাই এসব থেকে সম্পূর্ণ ভাবে নিজেকে দূরে রাখুন।

  •  হোমিওপ্যাথি ওষুধ ব্যবহারে কি লাভ পাওয়া যাবে?

না যাবে না।

  • আমি করোনায় আক্রান্ত হলেই কি মারা যাবো?

না, এরকম ভাবার কোনো কারণ নেই। প্রতি ১০০ জন সংক্রমিত ব্যক্তির মধ্যে ২ জন মারা যাচ্ছেন । করোনায় মৃত্যুর হার এবোলা, এইডস, সা্র্স,মার্সের এর মতো রোগের তুলনায় অনেক কম। যদিও এই ভাইরাস সংক্রমণের হার অনেক বেশি। তাই বেশি সংখ্যক মানুষ আক্রান্ত হলে মৃতের সংখ্যাও বাড়তে থাকবে। তবে বাচ্চা,বয়স্ক কিংবা ডায়াবেটিস, ব্লাড ক্যান্সারের মতো রোগে আক্রান্তরা বাদে বেশির ভাগ মানুষ উপযুক্ত চিকিৎসা পেলে অবশ্যই এই রোগ কাটিয়ে উঠতে পারেন। তাই আতঙ্কিত হবেন না।

  • থার্মাল স্ক্যানার কি করোনা ভাইরাস যুক্ত মানুষদের চিহ্নিত করতে সক্ষম?

থার্মাল স্ক্যানার শুধুমাত্র অতিরিক্ত শারীরিক উষ্ণতাযুক্ত মানুষদের চিহ্নিত করতে সক্ষম। এই অতিরিক্ত উষ্ণতার কারণ করোনা ভাইরাস হতেও পারে আবার নাও হতে পারে।আবার করোনা ভাইরাস সংক্রমণের প্রাথমিক অবস্থায় দেহের উষ্ণতা অতিরিক্ত বৃদ্ধি পায় না, তাই সেক্ষেত্রে সেইসব মানুষদের চিহ্নিতকরণ থার্মাল স্ক্যানার-এর মাধ্যমে সম্ভব নয়।

  • সমস্ত শরীরে অ্যালকোহল বা ক্লোরিন লাগালে,তা কি সংক্রামিত করোনা ভাইরাসকে মেরে ফেলতে পারে?

যদি করোনা ভাইরাস শরীরের ভেতর প্রবেশ করে থাকে তবে শরীরের বাইরে অ্যালকোহল বা ক্লোরিন লাগিয়ে কোনো লাভ নেই। সেক্ষেত্রে সঠিক চিকিৎসা ব্যবস্থা গ্রহণ করা উচিৎ। উপরন্তু অতিরিক্ত অ্যালকোহল বা ক্লোরিন মুখ বা চোখের মিউকাস মেমব্রেনের ক্ষতি করতে পারে। তবে রোগ সংক্রমণের হাত থেকে বাঁচার জন্যে অ্যালকোহলযুক্ত স্যানিটাইজার দিয়ে হাত পরিষ্কার করা আবশ্যক।

  • নিউমোনিয়ার ভ্যাকসিন কি করোনা ভাইরাস প্রতিরোধে ব্যবহার করা যায়?

WHO এর মতামত অনুসারে,নিউমোনিয়ার ভ্যাকসিন করোনা ভাইরাস প্রতিরোধে সক্ষম নয়। এই ভাইরাসটি নতুন এবং এটির নিজস্ব ভ্যাকসিন প্রয়োজন, যা আবিষ্কারের জন্য গবেষণা চলছে।

  • রসুন খেয়ে কি করোনা ভাইরাস প্রতিরোধ করা সম্ভব?

রসুন একটি স্বাস্থ্যকর খাদ্য এবং এর বেশ কিছু জীবাণুনাশক গুণ আছে ঠিকই, কিন্তু WHO এর মতে, এমন কোনও প্রমাণ নেই যে রসুন খেয়ে করোনা ভাইরাস প্রতিরোধ করা সম্ভব হয়েছে। তাই অযথা গুজব ছড়িয়ে বিভ্রান্তি সৃষ্টিকরা ঠিক নয়।

করোনা নিয়ে দুই বিশ্বশক্তির চাপানউতোর এবং তার পশ্চাতে রাজনৈতিক-অর্থনৈতিক সমীকরণ

করোনার উপদ্রব আসার আগে চিন-আমেরিকার মধ্যে অব্যাহত ছিল বাণিজ্যিক যুদ্ধ। কে কাকে কত বেশি শুল্ক চাপিয়ে প্রতিপক্ষকে কুপোকাত করতে পারে, ট্রাম্প এবং চিনফিংয়ের মধ্যে সেই দৌড়ই এত দিন চলছিল। বাণিজ্যিক দিক থেকে দুই দেশের  ক্ষতি তো হচ্ছিলই, তার প্রভাব পড়ে দক্ষিণ-এশিয়ার দেশগুলির উপরে।

কিন্তু নোভেল করোনাভাইরাসের আমদানি হওয়ায় বিশ্বের প্রায় সব দেশের অর্থনীতি টলে গিয়েছে।উহান প্রদেশে প্রথম চিহ্নিত করা যায় করোনাভাইরাসকে। আক্রান্তের সংখ্যা বেড়ে প্রায় ৮০ হাজার। সেখানেই ৩ হাজার মানুষের মৃত্যু হয়েছে। এখন প্রশ্ন উঠছে, এই ভাইরাসের কীভাবে উৎপত্তি হল? প্রথমে মনে করা হয়েছিল, উহান প্রদেশের হুয়ানান সি-ফুড মার্কেট থেকে এই ভাইরাসের আমদানি। সামুদ্রিক প্রাণীর থেকে COVID-19 জীবাণু মেলে। উহানে এমন মারণ ভাইরাস কোথা থেকে এল সে সম্পর্কে নানা কথা ছড়িয়েছে বিশ্ব বাজারে। ইজরায়েলি মাইক্রোবায়োলজিস্টরা আগেই দাবি করেছিলেন সিঙ্গল-স্ট্র্যান্ডেড এই আরএনএ ভাইরাসকে তৈরি করা হয়েছে মারণাস্ত্র হিসেবেই। প্রাণঘাতী এই ভাইরাসের ছোবলে শত শত প্রাণনাশ করা সম্ভব। হুয়ানানের ঐ সি-ফুড মার্কেট থেকে মাত্র ৭ কিমি দূরে উহান ইনস্টিটিউট অব ভাইরোলজির বিএসএল-৪ ল্যাবোরটরিতে অতি গোপনে এই জৈব রাসায়নিক মারণাস্ত্র তৈরির কাজ চলছিল দীর্ঘ সময় ধরেই। হয় সেখান থেকেই ভাইরাস কোনওভাবে বাইরে চলে গেছে, অথবা ইচ্ছাকৃতভাবেই সংক্রমণ ছড়িয়ে দেওয়া হয়েছে। সম্প্রতি করোনাভাইরাসকে ‘জেনেটিক্যালি মডিফায়েড’  বলে উল্লেখ করেন মার্কিন অধ্যাপক ড. ফ্রান্সিস বয়েল। রাসায়নিক অস্ত্র নিরস্ত্রীকরণ সংগঠনেরও অন্যতম মাথা তিনি।  নোভেল করোনাভাইরাস যে নিছকই কোনও ভাইরাসের সংক্রমণ নয়, সে বিষয়ে আগেও মুখ খুলেছিলেন ডঃ ফ্রান্সিস। তাঁর দাবি ,উহানের এই বায়োসেফটি লেভেল ফোর ল্যাবরেটরিকে সুপার ল্যাবরেটরির তকমা দিয়েছিল বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা। বলা হয়েছিল, এই ল্যাবে ভাইরাস নিয়ে কাজ হলেও তা অনেক বেশি সুরক্ষিত ও নিরাপদ। ল্যাবোরেটরির জন্যই রয়েছে আলাদা উইং যার বাইরের পরিবেশের সঙ্গে কোনও যোগাযোগ নেই। ড. ফ্রান্সিস বলেন, সার্স ও ইবোলা প্রাণঘাতী হয়ে ওঠার পরে অভিযোগের আঙুল ওঠে এই গবেষণাগারের দিকেই। রোগ প্রতিরোধ নয়, বরং প্রাণঘাতী জৈব অস্ত্র বানাতেই মত্ত গবেষকরা। যারই পরিণতি হাজার হাজার মৃত্যু। নোভেল করোনাভাইরাসের জিনগত বদল ঘটানো হয়েছে এবং উহানের এই ল্যাবোরেটরি থেকেই ভাইরাস ছড়িয়েছে। এমনকি বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার অনেকেই এ ব্যাপারে জানতেন বলেও দাবি করেছিলেন তিনি। এরকম গুজবও ছড়ায় যে কানাডা থেকে এই ভাইরাস চুরি করে এনে গবেষণা করছিল চিন; সেই গবেষণা করতে গিয়ে লিকেজ ঘটে এই বিপত্তি।মার্কিন প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প তো আরেকধাপ এগিয়ে এই ভাইরাসকে ‘চাইনিজ ভাইরাস’ আখ্যা দিয়ে বলেন এই ভাইরাস জনিত যাবতীয় মহামারি ও আর্থিক বিপর্যয়ের দায় চিনকে নিতে হবে এবং এর জন্য চিনের উপর আর্থিক শুল্ক চাপানোর কথা ঘোষণা করেন তিনি।ট ্রাম্পের সুরে সুর মিলাতে শুরু করে ইউরোপ ও ভারতের শাসকশ্রেণি। যদিও জাপানের একটি সংবাদ মাধ্যম জানাচ্ছে, চিনে যে এই ভাইরাস তৈরি হয়েছে, এমন কোনও প্রমাণ মেলেনি। ৪টি মহাদেশের ১২টি দেশ থেকে ১০০-র বেশি জিনোম সংগ্রহ করা হয়। গবেষণায় দেখা গিয়েছে চিন করোনার উৎপত্তিস্থল নয়। চিনের এক গবেষণা দাবি করছে, মানুষ থেকে মানুষের সংক্রমণ ছড়ায় নভেম্বর থেকে। হুয়ানানে অনেক পরে এই ভাইরাসের আমদানি হয়। গ্লোবাল টাইমসের ১৩ মার্চের রিপোর্ট বলছে চিনা বিদেশমন্ত্রকের মুখপাত্র ঝাও লিজিয়ান বৃহস্পতিবার টুইটারে পোস্ট করে লেখেন, মার্কিন সেনাদের থেকেই করোনাভাইরাস ছড়িয়ে পড়েছিল উহানে। সেখান থেকে সংক্রমণ ছড়ায় চিনের মূল ভূখণ্ডে। ঝাওয়ের দাবি, গত বছর অক্টোবরে উহানে আয়োজিত সপ্তম মিলিটারি ওয়ার্ল্ড গেমে যোগ দিয়েছিলেন আমেরিকার অন্তত ৩০০ জন সেনা অ্যাথলেট। তখনই তাঁদের মধ্যে কয়েকজন ফ্লু-তে আক্রান্ত হন। পরে কয়েকজনের মৃত্যুও ঘটে। তখন বলা হয়েছিল নিছক জ্বর বা সংক্রামক ব্যধিতে আক্রান্ত হয়ে মৃত্যু হয়েছে সেনাদের। পরে জানা যায়, তাঁরা সকলেই করোনাভাইরাসে আক্রান্ত ছিলেন। চিনের দাবির পরেই হইচই শুরু হয়ে গিয়েছে বিশ্বে। মার্কিন সেন্টার ফর ডিজিজ কন্ট্রোল অ্যান্ড প্রিভেনশন (সিডিসি)-এর ডিরেক্টর রবার্ট রেডফিল্ড স্বীকার করেছেন মার্কিন সেনাদের রক্তে মারণ ভাইরাসের জীবাণু মিলেছিল এটা ঠিক, তবে তাঁদের থেকেই যে ভাইরাস উহানে ছড়িয়েছিল সেটা একেবারেই ঠিক নয়। চিনের দাবি পুরোপুরি অস্বীকার করেন তিনি। , ঝাও এর অভিযোগ আরও যে  করোনা ভাইরাস যে নিছক মারণ জীবাণু নয়, বরং জিনের গঠন বদলে তৈরি করা রাসায়নিক মারণাস্ত্র, এমন খবরও আমেরিকাই রটিয়েছে। জাপানের সংবাদ মাধ্যম আসাহি দাবি করে, মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রেই প্রথম করোনাভাইরাসের উৎপত্তি  হয়। ইনফ্লুয়েঞ্জা নিয়ন্ত্রণ করতে ব্যর্থ হয়েছে ট্রাম্প প্রশাসন। চিন এবং জাপানের দাবি নিয়ে মুখ না খুললেও, ইউএস সেন্টার্স ফর ডিজিজ কন্ট্রোল অ্যান্ড প্রিভেনশনের তরফে জানানো হয়, নিউ ইয়র্ক সিটি, লস অ্যাঞ্জেলস, সান ফ্রান্সিসকো, সিয়াটেলে ইনফ্লুয়েঞ্জা আক্রান্তদের  নোভেল করোনাভাইরাস পরীক্ষা করা হবে। এদিকে সিডিসি করোনাভাইরাসের তথ্যে সিলমোহর দেওয়ার পরেই চিনা বিদেশমন্ত্রকের মুখপাত্র ঝাও লিজিয়ান পত্রপাঠ সেই ভিডিও সমস্ত চিনা ওয়েবসাইটে আপলোড করে বলেন, “নাক ঘুরিয়ে হলেও আমেরিকা মানতে বাধ্য হচ্ছে যে তাদের সেনাদের থেকেই ভাইরাস ছড়িয়েছে। সাহস থাকলে গোটা বিশ্বের সামনে জোর দিয়ে এটা স্বীকার করা উচিত।”পাশাপাশি ট্রাম্পের করোনা ভাইরাসকে ‘চাইনিস ভাইরাস’ বলে করা মন্তব্যকে  ‘বর্ণবিদ্বেষী’ বলে মন্তব্য করেন চিনা চিকিৎসক ইউজিন জিউ।তাকে সমর্থন জানান আমেরিকান অর্থনীতিবিদ ডেভিড রথসচাইল্ড ও অভিনেত্রী মিয়া ফ্যারো। পাশাপাশি চিনা সোশ্যাল মিডিয়া উইবোতেও নিন্দার ঝড় বয়ে যায়।পাশাপাশি এই ভাইরাসের মার্কিনি যোগের বিষয়ে চাঞ্চল্যকর দাবি সামনে আসে যখন গত ১০ মার্চ  খোদ হোয়াইট হাউসের ওয়েবসাইটেই একটি মাস পিটিশন জমা পড়ে যাতে গত বছর অগস্ট মাসে আমেরিকান সামরিক বিভাগের সবথেকে বড় জীবাণু্বিষয়ক গবেষনাগার ফোর্ট ডেট্রিক ল্যাবের রহস্যজনক ভাবে বন্ধ হয়ে যাওয়ার ব্যাপারে জানতে চাওয়া হয়।ওই পিটিশনে বেশকিছু ঘটনার কালপঞ্জি উল্লেখ করে দাবি করা হয় ওই ল্যাবের বন্ধ হয়ে যাওয়ার খবর যে যে মিডিয়াতে প্রকাশিত হয়েছিল,রহস্যজনক ভাবে পিটিশনটি লঞ্চ করার পর খবরগুলি উধাও হয়ে গেছে। এই পিটিশনটি টুইট করে ঝাও লিজিয়ান দাবি করেন ভাইরাস আমেরিকার ল্যাবের থেকে হাওয়াইয়ের সামরিক কর্তাদের ই-সিগারেট মারফত উহানে এসছে। প্রসঙ্গত আমেরিকার সি.আই.এ-র ডেপুটি ডিরেক্টরও উহানের মিলিটারি গেমসে এসে নিউমোনিয়ায় আক্রান্ত হয়েছিলেন। এমনকি কানাডা ও ফ্রান্সের গবেষকদের যে যৌথ গবেষণাপত্র থেকে উদ্ধৃত করে বিজ্ঞানী বয়েল এই ভাইরাস কে জেনেটিক্যালি ইঞ্জিনিয়ারড বলেছিলেন, সেখানেও এই ভাইরাস বিষয়ে সেরকম কিছু বলা নেই। যেটা বলা রয়েছে তা হল এই ভাইরাসের স্পাইকে কিছু বিশেষ কার্যকরিতা রয়েছে যা প্রাকৃতিক বা কৃত্রিম যে কোনো উপায়েই আসতে পারে। উপরন্তু ভূ-রাজনৈতিক বিশেষজ্ঞদের মতে ষাটের দশকে পরমাণু গবেষণায় প্রবেশ করার পর থেকে জৈব মারণাস্ত্র গবেষনায় চিন বরাদ্দ কমিয়েছে। ফেডারেশন অফ আমেরিকান সায়েন্টিস্ট-এর মতে, এই ভাইরাস কোনো গবেষণাগার নয় বরং বাদুড়ের কোনো বন্য প্রজাতি থেকে প্যাঙ্গলিন মারফৎ মানবদেহে এসছে। যদিও জিনোম বিশ্লেষণ করে বাহক হিসেবে প্যাঙ্গলিনের কোনো প্রমাণ মেলেনি। সামগ্রিক চিত্র বিশ্লেষণ করে এটুকুই বলা যায় ক্রমেই এই করোনাকে ঘিরে মার্কিনি প্রচারের মিথ্যাচার নগ্ন হয়ে যাচ্ছে।

করোনাভাইরাসের কারণে বিশ্বে অর্থনৈতিক সংকট প্রবল হতে পারে। করোনাভাইরাসের সংক্রমণে অর্থনীতির ক্ষতির হিসাব-নিকাশ শুরু করেছে বিশ্বের বিভিন্ন গবেষণা প্রতিষ্ঠান। জাতিসংঘ, বিশ্বব্যাংক সাময়িক তথ্য-উপাত্তের ভিত্তিতে আশঙ্কার কথাও জানাচ্ছে। ইতোমধ্যে জাতিসংঘের UNCTAD এবং এশিয়ান ডেভেলপমেন্ট ব্যাংক (এডিবি) করোনাভাইরাসের প্রভাব সম্পর্কিত পৃথক দুটি প্রতিবেদন প্রকাশ করেছে। ওই দুটি প্রতিবেদনের মূল কথা হলো- মানুষের জন্য মারণঘাতী এই ব্যাধি অর্থনীতিকে বিপর্যস্ত করবে। তবে অর্থনীতির ক্ষতির পরিমাণ নির্ভর করবে সংক্রমণের তীব্রতার ওপর। এই ভাইরাস চূড়ান্তভাবে আঘাত করলে বিশ্বের অর্থনীতিতে উৎপাদন কমবে ৩৪ হাজার ৬৯৭ কোটি ডলার।এ ছাড়া চিনের মাত্র ২ শতাংশ রফতানি কমলে উন্নত ও উন্নয়নশীল সব দেশের এক হাজার ৫৬০ কোটি ডলার পর্যন্ত ক্ষতির মধ্যে পড়তে হবে। অর্থনৈতিকভাবে শীর্ষ ক্ষতিগ্রস্তদের তালিকায় ভারতের নামও রয়েছে। কাঁচামাল আমদানির অভাবে কমে যাবে শিল্পোৎপাদন। এর ফলে মোট দেশজ উৎপাদন (জিডিপি) প্রবৃদ্ধি হ্রাস পাবে। করোনাভাইরাস সংক্রমণের ধরনের ওপর অর্থনীতির ক্ষতির আনুমানিক ধারণা দিয়েছে এডিবি। করোনাভাইরাস আক্রমণ আর না হলে বৈশ্বিক জিডিপি কমবে .০৮৯ শতাংশ বা সাত হাজার ৬৬৯ কোটি ডলারের। মধ্যম পর্যায়ের আক্রমণ হলে জিডিপি কমবে ১৫ হাজার ৫৯৫ কোটি ডলার। আর তীব্র আকার ধারণ করলে ৩৪ হাজার ৬৯৭ কোটি ডলারের জিডিপি হারাবে বিশ্ব। এ ক্ষেত্রে জিডিপি কমবে .৪০৪ শতাংশ হারে। শুধু চিনের অভ্যন্তরীণ ক্ষতির কারণে বৈশ্বিক পর্যটন শিল্পে ধস নামবে। পর্যটনে সবচেয়ে ক্ষতির মুখে পড়বে পালাউ, মালদ্বীপ ও কম্বোডিয়া। আর বিশ্বের বিভিন্ন দেশের সরকার যদি সুরক্ষামূলক ব্যবস্থা না নেয়, তবে প্রায় আড়াই কোটি মানুষ তাঁদের চাকরি হারাবেন। আন্তর্জাতিক শ্রম সংস্থা (আইএলও) এ শঙ্কার কথা জানিয়েছে। তবে আইএলও বলেছে, ২০০৮ সালে বৈশ্বিক মন্দার সময় যেভাবে বিশ্বব্যাপী সমন্বিত উদ্যোগ নেওয়া হয়েছিল, তেমনটা করা হলে সম্ভাব্য বেকারত্বের হার অনেক কম হতে পারে।সংস্থাটি বৈশ্বিক এ দুর্দশা থেকে রক্ষায় জরুরি, বৃহৎ ও সমন্বিত উদ্যোগের তাগিদ দিয়েছে। এর পাশাপাশি আর্থিক প্রণোদনা এবং আয় ও চাকরির ক্ষেত্রে সহযোগিতা দেওয়ার কথাও বলেছে। এসব উদ্যোগের মধ্যে আছে সামাজিক সুরক্ষা, স্বল্পমেয়াদি কাজের পরিধির প্রসার, ছোট ও মাঝারি আকারের শিল্পের শুল্ক হ্রাস।করোনা মহামারির প্রভাব খুব স্বল্পমাত্রায় হলে চাকরি হারাবেন অন্তত ৮০ লাখ মানুষ। আর এর প্রভাব খুব বেশি মাত্রায় হলে বেকার হয়ে পড়া মানুষের সংখ্যা দাঁড়াবে ২ কোটি ৪৭ লাখ। ২০০৮-০৯ সালে বৈশ্বিক আর্থিক সংকটের সময় চাকরি হারিয়েছিলেন ২ কোটি ২০ লাখ মানুষ। আইএলওর মহাপরিচালক গাই রাইডার বলেন, ‘এটা শুধু বৈশ্বিক স্বাস্থ্য সংকট না, এটা বৈশ্বিক শ্রমবাজার এবং অর্থনীতির সংকট। মানুষের ওপর এর ভয়ানক প্রভাব আছে। ২০০৮ সালে সারা বিশ্ব সংকট থেকে উত্তরণে সমন্বিতভাবে লড়াই করেছিল। এর ফলে ভয়াবহ পরিস্থিতি সামাল দেওয়া গিয়েছিল। বর্তমান পরিস্থিতি থেকে উত্তরণে এখনো তেমন নেতৃত্ব দরকার।’

একদিকে করোনাজনিত মহামারির দরুণ অব্যাহত মৃত্যুমিছিল অপরদিকে তীব্র আর্থিক সংকটের মধ্যেও বিশ্বপুঁজির  অন্তহীন মুনাফালালসার কমতি নেই। ১৬ মার্চ, ২০২০-র খবর হচ্ছে ন্যাশনাল ইন্সটিটিউটস অব হেলথ-এর তরফে করোনাভাইরাসের প্রথম ভ্যাক্সিন সফলভাবে প্রয়োগ করা হয়েছে। এর নাম দেওয়া হয়েছে mRNA-1273।একটি খবরের শিরোনাম হচ্ছে – Trump reportedly offered $1 B to poach coronavirus vax for US use only। জার্মান ফার্মাসিউটিক্যাল কোম্পানি CureVac জানুয়ারি মাস থেকে ভ্যাক্সিন তৈরির চেষ্টা করে যাচ্ছিল। এই CureVac-এর ভ্যাক্সিন কেনার জন্য ট্রাম্পের এই প্রলোভন দেখানো।আমেরিকায় বিতর্ক শুরু হয়েছে – জনসাধারণের ট্যাক্সের টাকায় যে রিসার্চ হয় সে রিসার্চের ফল কেন বাণিজ্যিকভাবে বিপুল মুনাফার জন্য কর্পোরেটদের হাতে তুলে দেওয়া হবে?রয়টার্স-এর খবর (১৫ মার্চ, ২০২০) অনুযায়ী – Germany tries to halt U.S. interest in firm working on coronavirus vaccine। সে খবরেই বলা হয়েছে যে CureVac-এর প্রধান লগ্নীকারী Horst Seehofer জানাচ্ছেন যে তিনি ভ্যাক্সিন বিক্রি করবেন না এবং এই ভ্যাক্সিনের লক্ষ্য হবে “help people not just regionally but in solidarity across the world”। আমেরিকার আরেকজন প্রেসিডেন্ট পদপ্রার্থী বার্নি স্যান্ডার্স বলেছেন তিনি নির্বাচিত হলে এই ভাক্সিনকে সম্পূর্ণত বিনামূল্যে মানুষের কাছে পৌঁছে দেবেন। ২০ ফেব্রুয়ারি, ২০২০-তে ৪৬ জন ডেমোক্র্যাটের স্বাক্ষর সম্বলিত একটি চিঠি ট্রাম্পকে দেওয়া হয়েছে। তাতে বলা হয়েছে – We write to ask you to ensure that any vaccine or treatment developed with U.S. taxpayer dollars be accessible, available, and affordable. That goal cannot be met if pharmaceutical corporations are given authority to set prices and determine distribution, putting profit-making interests ahead of public health priorities. Americans deserve to know that they will benefit from the fruits of their public investments.মানুষের বাঁচার জিয়ন কাঠিও কর্পোরেট পুঁজির আবর্তে পড়ে গেছে। প্রসঙ্গত উল্লেখযোগ্য, বর্তমান অর্থনীতির এই ধ্বসের মাঝেও আমেরিকান বহুজাতিক ফার্মা কোম্পানি ইলি লিলি-র শেয়ার লাভের মুখ দেখেছে কারণ এরা সর্বসাধারণ্যে বিবৃতি দিয়েছে যে  তারা করোনাভাইরাসের নতুন চিকিৎসা নিয়ে আসছে।

করোনা: অথ ভারত কথা

গত ডিসেম্বরে চিনের উহান প্রদেশে এই রোগ ছড়ানোর পর সরকারের হাতে যথেষ্ট সময় ছিল যাতে করে প্রত্যেক আর্ন্তজাতিক বিমানবন্দরে উপযুক্ত কোয়ারেন্টাইন পরিকাঠামো গ্রহণ করে এই রোগকে এদেশে ছড়িয়ে পড়া থেকে আটকান যেত। কিন্তু সরকারের উদাসীনতা এবং অসচেতনতা কীভাবে আমদের দেশকে করোনা বিপর্যয়ের দিকে ঠেলে দিল এবার আমরা তা দেখব-

এবিষয়ে কোনো সন্দেহ নেই যে দেশের এলিট এবং মধ্যবিত্তরাই বিদেশ থেকে করোনাভাইরাস নিয়ে আসছেন। দেশের প্রথম ঘটনাটার কথাই মনে করুন। কেরলের যে ব্যক্তির দেহে প্রথম এই ভাইরাসের অস্তিত্ব ধরা পড়ে, তিনি চিনের উহান প্রদেশ থেকে দেশে ফেরেন। যেখান থেকে কোভিড-১৯-এর জন্ম। তারপর বলিউডের গায়িকা কনিকা কাপুর। তিনি ইউকে থেকে দেশে ফেরেন, লখনউ বিমানবন্দরের পরীক্ষা এড়িয়ে একের পর এক অনুষ্ঠান ও পার্টি করেন। সেখানে রাজনৈতিক নেতা থেকে সমাজের গণ্যমান্য ব্যক্তিরা উপস্থিত ছিলেন।উত্তর প্রদেশ পুলিশ কনিকার বিরুদ্ধে এফআইআর করলেও, যে সব রাজনৈতিক নেতারা ‘সামাজিক দূরত্ব’ রক্ষার দায়িত্ব না মেনে সেইসব অনুষ্ঠানে হাজির হয়েছিলেন, তারা দিব্যি আছেন। ভারতের এলিটরা কিন্তু এর পরেও পার্টি বন্ধ করেননি, বিদেশ থেকে করোনা নিয়ে আসাও থামাননি। যে সব মন্ত্রীসান্ত্রীরা কনিকা কাপুরের অনুষ্ঠানে গিয়েছিলেন, তারা পরে নিজেদের গৃহবন্দি করেছেন। তাদের মধ্যে দুজন- রাজস্থানের প্রাক্তন মুখ্যমন্ত্রী বসুন্ধরা রাজে এবং তার ছেলে দুষ্যন্ত সিং(তিনি আবার প্রেসিডেন্ট কোভিন্দের সঙ্গে দেখা করেন, সংসদেও যান)-এর করোনা পরীক্ষা হয় এবং একদিনের মধ্যে নেতিবাচক রিপোর্ট আসে। সাধারণ মানুষকে অবশ্য করোনা পরীক্ষা করতে অনেক যোগ্যতার প্রমাণ দিতে হচ্ছে, রিপোর্ট আসতে ৫-৭ দিন সময়ও লাগছে। ভারতের এলিটরা শুধু য়ে করোনাভাইরাস বিদেশ থেকে নিয়ে আসছেন, তাই নয়, তারা তা গরিব ও শ্রমজীবী মানুষের মধ্যে ছড়িয়েও দিচ্ছেন। ভারতে সবচেয়ে বেশি করোনা আক্রান্তের সংখ্যা মহারাষ্ট্রে। অথচ সেখানে প্রথম কোনো শ্রমজীবীর করোনা আক্রান্ত হওয়ার ঘটনা ঘটেছে সে রাজ্যে করোনার হানা শুরু হওয়ার বেশ কিছুদিন পরে। এক গৃহ পরিচারিকা। তার নিয়োগকর্তা সম্প্রতি আমেরিকা থেকে করোনা নিয়ে ফিরেছিলেন। কলকাতায় এক ব্যবসায়ীপুত্র ইংল্যান্ড থেকে করোনা নিয়ে ফিরে তিনদিন শহরে দিব্যি ঘুরে বেড়ান। পরে দেখা যায় তার সঙ্গে তার বাবা-মা এবং গৃহ পরিচারিকাও করোনা-আক্রান্ত। ভারত সরকারও এব্যাপারে পিছিয়ে নেই। করোনা মহামারির ছড়িয়ে পড়ার দুমাস পরেও মোদি্ সরকার মার্কিন প্রেসিডেন্ট ট্রাম্পের ভারত সফর বাতিল করেনি। ট্রাম্প ভারতের তিনটি শহরে ঘুরেছেন। তার একটি অনুষ্ঠানে ১ লক্ষেরও বেশি লোক ছিল। সেখানে গরিবদের বস্তি যাতে ট্রাম্প দেখতে না পান, তার জন্য গুজরাত সরকার একটি পাঁচিলও বানায়। শাসকশ্রেণির এই ট্রাম্প-বন্দনার আড়ালে চাপা পড়ে গিয়েছে দিল্লিতে একতরফা সংখ্যালঘু নিধনের খবর।

শুধু তাই নয় করোনার মোকাবিলায় এদেশের স্বাস্থ্যমন্ত্রক কিংবা কেন্দ্রে ক্ষমতাসীন বিজেপি ঘনিষ্ঠ নেতা-মন্ত্রীরা প্রথম থেকেই সচেতনভাবে নানা অপবিজ্ঞান গুজব আকারে ছড়িয়েছেন। এমনকি কেরালায় যখন পরপর তিনজনের এই রোগ ধরা পরল তখন কেন্দ্রীয় সরকারের আয়ুষ মন্ত্রকের তরফ থেকে করোনার হাত থেকে বাঁচতে হরিতকি কিংবা হোমিওপ্যাথি ঔষধ আর্সেনিকাম অ্যালবাম-৩০ খাওয়ার কথা বলা হয়েছে আর তার সাথে সাথে ইউনানি চিকিৎসার উপর ভরসা রাখার কথা বলা হয়েছে। অন্যদিকে হিন্দু মহাসভার সভাপতি চক্রপাণি মহারাজ গো-মূত্র ও গোবর সেবনের নিদান দিয়ে দেশের বড় বড় শহরে গো-মূত্র পার্টির আয়োজন করেছেন। করোনা তাড়াতে যজ্ঞ,হরিনামের আয়োজন করা হয়েছে বিভিন্ন জায়গায়। এমনকি করোনা তাড়াতে কখনও মাছ-মাংস-ডিমের মত উচ্চ-প্রোটিনসমৃদ্ধ খাবারের পরিবর্তে নিরামিষ ভোজনের পরামর্শ দিয়েছেন আবার কখনও বা নামযজ্ঞের নিদান দিয়েছেন। কর্পোরেট পোষিত মিডিয়া এবং আইটি সেলকে ব্যাবহার করে জনগণের মধ্যে একদিকে যেমন করোনা নিয়ে ‘আতঙ্ক ছড়াবেন না’ বলে গণ-হিস্টিরিয়া তৈরি করা হচ্ছে,অন্যদিকে হোয়াটসঅ্যাপ ইউনিভার্সিটিকে ব্যবহার করে জনমানসে অপবিজ্ঞানের প্রসার ঘটান হচ্ছে। এমনকি এই লকডাউনের ট্রেলার হিসাবে চলা ১৪ ঘন্টার জনতা-কার্ফুর সপক্ষেও এই হোয়াটসঅ্যাপ ইউনিভার্সিটি যুক্তি সাজিয়েছিল যে এতে নাকি ভাইরাসের সংক্রমণ হাত থেকে রেহাই পাওয়া যাবে এমনকি সারাদিনের হোম-কোয়ারেন্টাইনের শেষে প্রধানমন্ত্রীর কাঁসর-ঘন্টা বাজানোর নিদানের পক্ষেও এদের যুক্তি ছিল যে এর ফলে উদ্ভুত সুপারসনিক শব্দ নাকি এই ভাইরাস নির্মূলীকরণে সক্ষম হবে।যাইহোক একদিকে উচ্চশিক্ষায় মৌলিক বিজ্ঞান গবেষণা খাতে ক্রমাগত ব্যয় সংকোচ,অন্যদিকে অপবিজ্ঞান-চর্চা খাতে বাজেট বৃদ্ধি করা এদেশের ব্রাম্মণ্যবাদী হিন্দু ফ্যাসিবাদী সরকার বিজ্ঞানচর্চার অপমৃত্যু ঘটাচ্ছে। এটা কোনও নতুন ঘটনা নয়,আচার্য প্রফুল্লচন্দ্র রায় তাঁর ‘দি হিস্ট্রি অফ হিন্দু কেমিস্ট্রি’ বইতে দেখিয়েছেন কিভাবে এই ব্রাহ্মণ্যবাদ জাতি-বর্ণ ব্যাবস্থার মধ্যে দিয়ে এক বিশাল সংখ্যক মানুষকে জ্ঞানচর্চা থেকে বঞ্চিত করে ‘তত্বের সাথে কর্মের’ যোগকে বিচ্ছিন্ন করেছে,পাশাপাশি শংকরাচার্য্যের অদ্বৈতবাদী মায়াবাদী দর্শনের(‘ব্রত্ম সত্য জগৎ মিথ্যা’) প্রচার বস্তুজগৎ সম্পর্কে জনগণের অনুসন্ধিৎসাকে নিরুৎসাহিত করেছে এবং কণাদের অণুর সম্পর্কে প্রাথমিক ধারণাকে নস্যাৎ করেছে। মনু শল্যচিকিৎসাকে নিষিদ্ধ করার মধ্যে দিয়ে চরক-সুশ্রুতের আমলে চিকিৎসাবিজ্ঞানের যে বিকাশ ঘটছিল তাকে রুদ্ধ করেছে। বৈদিক যুগে তো তারা অনার্যদের কৃষি-প্রযুক্তির বিকাশ হিসেবে যে নদীবাঁধগুলি ছিল সেগুলিকে ধবংস করেছে। এভাবেই ব্রাম্মণ্যবাদীরা প্রাচীনকাল থেকেই আমাদের দেশের বিজ্ঞানের বিকাশের পথে অন্তরায় হয়ে কাজ করেছে।আর আজও মনুর সুযোগ্য উত্তরাধিকারীরা করোনা সংক্রমণ ঠেকানোর অজুহাতে কুসংস্কার,অন্ধবিশ্বাস ও অপবিজ্ঞান সংক্রমণের সুযোগ হাতছাড়া করছেন না।

এতক্ষণ তো দেখা গেল এদেশের শাসকশ্রেণির উদাসীনতা ও অসচেতনতা কিভাবে এদেশে করোনা-বিপদ ডেকে এনেছে , এবার আমরা আসব আসন্ন করোনা বিপদ ও তার মোকাবিলায় এদেশের স্বাস্থ্যব্যবস্থার প্রস্তুতি প্রসঙ্গে। আলোচনার সুবিধার্থে এই অংশটিকে আমরা দু-ভাগে ভাগ করব।

 প্রথমে আমরা দেখব এদেশের শাসকশ্রেণির স্বাস্থ্যনীতি জনমুখী না জনবিরোধী, জনগণ না কর্পোরেট কার স্বার্থবাহী? একটা দেশের স্বাস্থ্যের হাল হকিকত বোঝা যায় সে দেশের শিশুদের স্বাস্থ্যের অবস্থার বিচারে। যদি আমাদের দেশের শিশু স্বাস্থ্যের অবস্থার দিকে তাকাই তাহলে দেখা যাবে এক বেদনাদায়ক চিত্র। পাঁচ বছরের নীচে সবচেয়ে বেশি শিশু মারা যায় ভারতে। নবজাতক মৃত্যুর হারেও সারা বিশ্বে শীর্ষস্থান দখল করেছে ভারত। শুধু তাই নয়, পাঁচ থেকে চোদ্দ বছর বয়সের মধ্যে শিশুমৃত্যুর সংখ্যাও ভারতে সবচেয়ে বেশি। মূলত অপুষ্টির কারণেই এদেশে মারা যায় অবোধ শিশুরা। সম্প্রতি এক রিপোর্টে এসব বেদনাদায়ক তথ্য জানিয়েছে ইউনিসেফ। ইউনিসেফ রিপোর্টে জানানো হয়েছে, ২০১৮সালে ভারতে পাঁচ বছরের কমবয়সি ৮লক্ষ ৮২হাজার শিশুর মৃত্যু হয়েছে, বিশ্বের দেশগুলির তালিকায় ভারত শীর্ষে।জানানো হয়েছে, ভারতে মৃত এই শিশুদের ৬৯শতাংশের মৃত্যুর কারণই হলো অপুষ্টি। ইউনিসেফ জানিয়েছে, ২০১৮সালে ভারতে ৫লক্ষ ৪৯হাজার নবজাতক শিশু মারা গিয়েছিল। এব্যাপারেও বিশ্বের দেশগুলির মধ্যে ভারত শীর্ষস্থানে রয়েছে।ভারতে পাঁচ বছর হওয়ার আগেই যে শিশুরা মারা গিয়েছিল, তাদের ৬২শতাংশেরই মৃত্যু হয়েছে নবজাতক অবস্থায়। একইসঙ্গে রিপোর্ট জানিয়েছে, পাঁচ থেকে চোদ্দ বছর বয়সের মধ্যে শিশুমৃত্যুর সংখ্যাও ভারতে সর্বোচ্চ। ২০১৮সালে পাঁচ থেকে চোদ্দ বছর বয়সি মোট ১লক্ষ ৪৩হাজার শিশু মারা গিয়েছে ভারতে।ভারত সরকারের স্বাস্থ্য ও পরিবার কল্যাণ মন্ত্রকের প্রকাশিত ‘সুসংহত জাতীয় পুষ্টি সমীক্ষা, ২০১৬-১৭’ জানিয়েছিল, ৬ থেকে ২৩মাস বয়সি ভারতীয় শিশুদের মাত্র ৬.৪শতাংশ ন্যূনতম পর্যাপ্ত খাদ্য পায়! বাকিরা প্রয়োজনীয় খাবারটুকুও পায় না!ওয়েল্ট হাঙ্গার হিলফে এবং কনসার্ন ওয়ার্ল্ডওয়াইড নামে দু’টি সংস্থার ২০১৯সালের যৌথ রিপোর্টে জানানো হয়েছে, ক্ষুধা সূচক অনুযায়ী বিশ্বের ১১৯টি দেশের মধ্যে ভারতের স্থান হয়েছে ১০২! অথচ ২০১৪ সালে এই তালিকায় ভারত ছিল ৫৫ নম্বরে। ২০১৭ সালে ৪৫ ধাপ নিচে নেমে ভারতের স্থান হয় ১০০। এবার ২০১৯ সালে আরও ২ ধাপ নিচে নেমেছে ভারত। ইউনিসেফের সর্বশেষ রিপোর্টে আরও জানানো হয়েছে, ২০১০থেকে ২০১৮সালের মধ্যে ২২শতাংশ ভারতীয় শিশুই স্বাভাবিকের চেয়ে কম ওজন নিয়ে জন্মগ্রহণ করেছিল! জন্মের পরে মাতৃদুগ্ধ পান করার সুযোগ পেয়েছিল মাত্র ৪১শতাংশ ভারতীয় শিশু! দু’বছরের কমবয়সি শিশুদের মধ্যে ৫৫শতাংশের খাবার হিসাবে একদিনও বিন্দুমাত্র সবজি বা ফল জোটেনি! বিস্তারিত হিসাব পেশ করে ইউনিসেফ আরও জানিয়েছে, চার বছরের কমবয়সি ভারতীয় শিশুদের মধ্যে ৩৮শতাংশই বয়সের তুলনায় কম উচ্চতার (স্টান্টিং) সমস্যায় ভুগছে। দেখা গিয়েছে, ভারতের জনসমষ্টির গরিবতম ২০শতাংশের মধ্যে স্টান্টিং শিশুদের অনুপাত ৫১শতাংশ। প্রতিবেদন জানিয়েছে, পাঁচ থেকে উনিশ বছর বয়সি ভারতীয় সন্তানদের মধ্যে ২৭শতাংশ হয় রোগা, নতুবা খুব রোগা। আবার ৭শতাংশ ভুগছে বেশি ওজনের সমস্যায়। ইউনিসেফ রিপোর্টের তাৎপর্যপূর্ণ তথ্য, ভারতীয় মহিলাদের ২৪শতাংশই কম ওজনের, ৫১শতাংশ আবার রক্তাল্পতায় ভোগেন! স্বাস্থ্যমন্ত্রকের তত্ত্বাবধানে গত ১৯ জুন এক রিপোর্ট প্রকাশিত হয়৷ তাতে বর্তমান চিকিৎসা ব্যবস্থার যে চিত্র ফুটে উঠেছে তা খুবই উদ্বেগজনক৷ রিপোর্টে দেখা যাচ্ছে ১৩০ কোটি ভারতবাসীর জন্য রয়েছেন ১০ লক্ষ অ্যালোপাথি চিকিৎসক৷ অর্থাৎ, ১১, ০৮২ জন প্রতি একজন অ্যলোপ্যাথি চিকিৎসক৷ তুলনামূলকভাবে কম উন্নত রাজ্যগুলির অবস্থা আরও ভয়ানক৷ যেমন বিহারে ২৮,৩৯১ জনের জন্য বরাদ্দ মাত্র একজন অ্যালোপ্যাথি চিকিৎসক৷ দাঁতের চিকিৎসার ক্ষেত্রে অবস্থা আরও ভয়াবহ৷ ২০০৩ সালে সরকারি দন্তচিকিৎসক ছিলেন ৫০,০০০ জন৷ ২০১৭–তে বেড়ে হয়েছে ২.৫ লক্ষ৷ কিন্তু চিকিৎসক ও রোগীর অনুপাত তুলনামূলকভাবে খারাপ হয়েছে৷ বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা  ‘হু’ (ডব্লিউএইচও)–এর মানদণ্ড অনুযায়ী ৭,৫০০ জনের জন্য একজন দন্তচিকিৎসক থাকার কথা, বর্তমান ভারতে এই সংখ্যাটা ১,৭৬,০০৪ জনের জন্য একজন৷ ছত্তিশগড়, ঝাড়খণ্ডের মতো রাজ্যের অবস্থা আরও খারাপ৷ ছত্তিশগড়ে ২৫ লক্ষ রোগীপিছু একজন দন্তচিকিৎসক৷ ঝাড়খণ্ডে ১০ লক্ষ রোগীর জন্য একজন দন্তচিকিৎসক৷ উত্তরপ্রদেশে সংখ্যাটি হবে প্রায় ১১ লক্ষ ৷ কেবলমাত্র চিকিৎসকের ঘাটতি নয়, সরকারি হাসপাতালগুলির অবস্থাও তথৈবচ৷ দেশে ২৩ হাজার হাসপাতাল রয়েছে৷ তাতে রয়েছে মাত্র সাত লক্ষ বেড ৷ WHO-র নির্দেশিকা অনুযায়ী যেখানে প্রতি ১০০০০ জনসংখ্যা পিছু হাসপাতাল বেড থাকা উচিত ১০ টি করে সেখানে আমাদের দেশে আছে মাত্র ০.৯টি যার মধ্যে ০.৫টি সরকারি এবং ০.৪টি বেসরকারি। সরকারি হাসপাতালে ১,৮৪৪ জন রোগীর জন্য বরাদ্দ একটি বেড, তার মধ্যে গ্রামাঞ্চলে ২০,০০০ হাসপাতালে বেডের সংখ্যা তিন লক্ষ৷ রোগীর বিচারে এই সংখ্যাটা এতই কম যে এক, একটি বেডে চার–পাঁচজন রোগী রেখে চিকিৎসা করতে হয়৷ বেডে যাদের জায়গা হয় না তাদের মেঝেতে রাখতে হয়৷ সরকারি হাসপাতালে চিত্রটা এরকম কেন ? স্বাস্থ্য পরিষেবার বেহাল অবস্থার অন্যতম কারণ, বরাদ্দের অভাব৷ দেশের মোট জাতীয় উৎপাদনের (জিডিপি) ১.০২ শতাংশ খরচ হয় স্বাস্থ্য খাতে৷ পরিসংখ্যান বলছে, ২০১৭–তে স্বাস্থ্যখাতে মোট যা খরচ হয়েছে তার ৬৭.৭৮ শতাংশ রোগীকে নিজের পকেট থেকে দিতে হয়েছে৷ চিকিৎসার ক্ষেত্রে মাথাপিছু বরাদ্দ ১,১১২ টাকা, অথচ এককালীন হাসপাতালে ভর্তির গড় খরচ ২৬,৪৫৫ টাকা৷ তাহলে গরিব মানুষ কোথায় যাবে? এ বছর স্বাস্থ্যখাতে বরাদ্দ হয়েছে ৬৯ হাজার কোটি টাকা। এই মুহূর্তে দেশের স্বাস্থ্য-খরচের সিংহভাগই খরচ হয় ব্যক্তিগত পকেট থেকে। একটি সূত্রের মতে বছরে দেশের মোট স্বাস্থ্য খরচ ৫,২৮,৪৮৪ কোটি। সেখানে সরকারি খরচ মাত্র ৬৯০০০ কোটি। স্বাস্থ্যখাতে মোট ৬৯০০০ কোটির মধ্যে ৬৪০০ কোটি খরচ হবে আয়ুষ্মান ভারত প্রকল্পের জন্য।টায়ার টু, টায়ার থ্রি শহরের কুড়ি হাজার হাসপাতাল আয়ুস্মান ভারত প্রকল্পের আওতায় আসবে। অথচ, পরিসংখ্যান অনুযায়ী দেশের ৭০ শতাংশ মানুষ গ্রামে থাকেন। আর এই ৭০ শতাংশ মানুষের চিকিৎসার জন্য ২৮ শতাংশ ডাক্তার কাজ করেন। তাহলে এই প্রকল্পে দেশের বৃহত্তর জনগণ কতখানি লাভবান হবেন? প্রাথমিক চিকিৎসার উন্নতিই যে কোনও দেশের স্বাস্থ্যোন্নতির মূল কথা এটাতেও বোধহয় নতুন করে কিছু বলার নেই। ভারতে প্রতি বছর প্রায় ৩৯ হাজার কোটি টাকার চিকিৎসা সংক্রান্ত যন্ত্রপাতির ব্যবসা হয়। যার ৮০-৯০ শতাংশই আসে বাইরে থেকে।আরও একটা তথ্য দিয়ে রাখা যাক। এ বছরের প্রতিরক্ষা ক্ষেত্রে বাজেট ৩.৩৭ লক্ষ কোটি – স্বাস্থ্য খরচের পাঁচগুণ!

এবার আমার আসব করোনা বিপর্যয় মোকাবিলায় সরকারের প্রস্তুতি কেমন সে প্রসঙ্গে। করোনা মোকাবিলায় এদেশের সরকারের প্রস্তুতি দেখলে মূর্চ্ছা যাওয়ার মতন অবস্থা হবে। প্রতি ৮৬০০০ নাগরিক পিছু ১টা করে আইসোলেশন বেড,প্রতি ৩৬০০০ নাগরিক পিছু ১টা করে কোয়ারেন্টাইন বেড। ১৩২ কোটির দেশের জন্য মাত্র ১.৫লক্ষ করোনা টেস্টিং কিট এবং ৫২টি টেস্ট সেন্টার। WHO থেকে ডিসেম্বর মাসেই করোনার ভয়াবহতা সম্পর্কে প্রাথমিক তথ্য দেওয়া হয় এবং জানুয়ারি মাসে আসে প্রথম সতর্কবার্তা। তখন থেকেই আমাদের প্রস্তুতি নেওয়া উচিত ছিল কিন্তু বাস্তবে তা হয়নি। যদি তখন থেকেই পার্সোনাল প্রটেকটিভ ইক্যুইপমেন্ট যেমন মাস্ক, হাত ধোয়ার সাবান, স্যানিটাইজার, কভার অল স্যুট যথেষ্ট পরিমাণে মজুত করা হতো ও সরকার একটা সঠিক বণ্টন ব্যবস্থা লাগু করতো তাহলে সংকট দেখা যেতো না। বাস্তবে যেটা হলো, চাহিদা বেড়ে যাওয়া মাত্র ৫ টাকা দামের মাস্ক বাজারে ২৫ টাকা দরে, ২০০ মিলি স্যানিটাইজার ২০০ টাকা দরে বিক্রি হতে লাগলো। এমনকি রফতানি পর্যন্ত বন্ধ করা হয়নি। একথা সবার জানা যে রাজনৈতিক নেতৃত্বের ভাষণ নয়, করোনা প্রতিরোধে নির্ণায়ক ভূমিকা পালন করেন চিকিৎসক, স্বাস্থ্য ও সাফাই কর্মীরা। তাই তাঁদের নিরাপত্তার জন্য প্রয়োজন বিশেষ ধরনের পোশাক (কভার অল স্যুট)। আজ একথা সংবাদ মাধ্যমের কল্যাণে সবাই জেনে গেছে, যে কেন্দ্রীয় বস্ত্র মন্ত্রক একমাস ধরে বসে থেকেছে কিন্তু পোশাক তৈরির ব্যাপারে যথেষ্ট উদ্যোগ নেয়নি। এই সীমাহীন অপদার্থতার দায় কে নেবে? এমনকি যেখানে চিন,দক্ষিন কোরিয়া,শ্রীলঙ্কা সহ ইউরোপের প্রায় সব দেশ যেখানে এই টেস্ট ফ্রি করে দিয়েছে কিংবা বাংলাদেশ,পাকিস্তানে ৩০০-৫০০টাকায় এই টেস্ট করানো যাচ্ছে সেখানে আমাদের দেশে এই টেস্টের খরচা প্রায়  ৪৫০০টাকা। যদিও সরকারি হাসপাতালে এই টেস্ট ফ্রিতে করানো যাবে কিন্তু সেখানেও রয়েছে টেস্টিং সংক্রান্ত সরকারি নির্দেশিকা যাতে পরিস্কারভাবে বলা হয়েছে যে কেবলমাত্র বিদেশ থেকে যারা ফিরে এসছেন তাঁরা এবং তাঁদের সংস্পর্শে থাকা লোকজনই কেবল সরকারি টেস্টের সুযোগ পাবে। এখন এই রোগ যদি গোষ্ঠী সংক্রমণের চেহারা নেয় তবে এই রোগে আক্রান্ত হবেন দেশের হাজার হাজার সাধারণ খেটে খাওয়া মানুষ,যাদের এই করোনাজনিত শ্বাসকষ্ট দেখা গেলেও যেহেতু এদের কোনও বিদেশভ্রমণের রেকর্ড কিংবা সদ্য দেশে ফেরা কোনও প্রবাসী ভারতীয়র সংস্পর্শে থাকার সুযোগ কোনোটাই নেই ,সেহেতু এরা করোনা টেস্ট সংক্রান্ত সরকারি বিধির আওতায় পড়বেন না অর্থাৎ এদের গ্যাটের কড়ি খসিয়ে বেসরকারি ক্লিনিক থেকে ৪৫০০টাকা গচ্চা দিয়ে এই টেস্ট করাতে হবে অথবা দিনের পর দিন সরকারি হাসপাতালে ‘অজানা জ্বরে’ চিকিৎসাধীন থাকতে হবে। এরকমই ঘটেছে ছত্তীসগঢ়ের একটি সরকারি হাসপাতালে ভর্তি থাকা কিছু রুগীর ক্ষেত্রে।অজানা জ্বর ও শ্বাসকষ্টে আক্রান্ত হয়ে হাসপাতালে ভর্তি হওয়ার পর এদের নমুনা রায়পুর এইমসে পাঠান হয়েছিল। কিন্তু যেহেতু এরা সরকারি বিধি অনুযায়ী করোনা টেস্টের আওতায় পড়ছেন না,তাই এদের নমুনা সেখানে পরীক্ষা করা হয়নি। আমাদের মত দেশে যেখানে ধনী-গরিব বৈষম্য তীব্র সেখানে ধনী বা উচ্চ-মধ্যবিত্তরাই যে কেবল বিদেশগমনের সুযোগ পায় তা বলাই বাহুল্য। তাঁরা ও তাঁদের আত্মীয়স্বজনদের (পড়ুন সামান্য সংখ্যক উচ্চবিত্ত) জন্য দেশের হাজার-হাজার জনগনের করের টাকায় ফ্রিতে টেস্টের ব্যবস্থা হবে আর এই উচ্চবিত্তদের দ্বারা বাহিত হয়ে আসা এই রোগ গোষ্ঠী সংক্রমণের চেহারা নিলে দেশের লক্ষ-লক্ষ শ্রমজীবী মানুষকে ছুটতে হবে প্রাইভেট ক্লিনিকে।এই তেলা মাথায় তেল দেওয়াই হল আমাদের দেশের সরকারের শ্রেণি দৃষ্টিভঙ্গি। এখানেই শেষ নয়,টেস্টিং কিটের অপ্রতুলতার কারণে চিকিৎসা বিষয়ক গবেষণা সংস্থা আইসিএমআরের(ICMR) তরফ থেকে দেশি-বিদেশি মিলিয়ে মোট ১৬টি সংস্থাকে এই কিট সরবরাহের বরাত দেওয়া হয়েছে। এদের মধ্যে প্রথমেই আসবে পুনের মাইল্যাব,গুজরাতের কোসেরা ডায়াগনস্টিক এবং জার্মানির অল্টনা ডায়াগনস্টিকের কথা-এদেরকে সমস্ত সরকারি ও বেসরকারি পরীক্ষাকেন্দ্রে টেস্টকিট সরবরাহের বরাত দেওয়া হয়েছে। এছাড়াও ১২টি বিদেশি কোম্পানীকে র‍্যাপিড অ্যান্টিবডি টেস্ট কিটের বরাত দেওয়া হয়েছে যার মধ্যে ৭টি চিন,২টি আমেরিকার এবং বাকিগুলি সিঙ্গাপুর ও পোল্যান্ডের। সি-গ্রিন ও এসডি বায়োসেন্সরের মত দক্ষিণ কোরীয় কোম্পানিকে RT-PCR Based  টেস্টকিট তৈরির বরাত দেওয়া হয়েছে। এছাড়াও এই টেস্টের জন্য যে প্রোব-প্রাইমার-ডাই লাগবে তা সমস্ত সরকারি ও বেসরকারি ল্যাবে সরবরাহের বরাত দেওয়া হয়েছে আমেরিকান কোম্পানি বায়োমেডনোমিক্স এবং সিটিকে বায়োটেককে। এছাড়াও স্পেন সহ বহু ইউরোপীয় দেশে যেখানে সমস্ত বেসরকারি হাসপাতালকে জাতীয়করণ করে করোনা চিকিৎসায় কাজে লাগান হচ্ছে সেখানে ভারতে দেখা যাচ্ছে এর উল্টো চিত্র-রিলায়েন্সের মত কোম্পানিগুলি ঢাকঢোল পিটিয়ে মুম্বইতে বানাচ্ছে করোনা চিকিৎসায় বিশেষ হাসপাতাল। অর্থাৎ করোনা বিষয়ে যে সামগ্রিক চিত্র পাওয়া গেল তাতে এটা পরিস্কার যে সত্যিই যদি এই রোগ আমাদের দেশে মহামারির আকার নেয় তবে তার সামনে ‘ঢাল-তরোয়াল বিহীন’ নিধিরাম সর্দারের মত এদেশের শাসকশ্রেণিও দিশেহারা হয়ে পড়বে এবং যাবতীয় দায় ঝেড়ে ফেলে জনগণকে বলবে ‘চাচা আপন প্রাণ বাঁচা’।আর বাস্তবিকই করোনা মহামারির আকার নেওয়ার অনেক আগেই এদেশের নেতা-মন্ত্রীরা সব দায় ঝেড়ে ফেলে জনগণকে নিজের সুরক্ষার ব্যবস্থা নিজেকেই করার জন্য লকডাউন হয়ে যেতে বলছে এবং দেশের অসহায় জনতাকে ঠেলে দিচ্ছে কর্পোরেট হাঙরদের মুনাফালোভী করালগ্রাসে।

লকডাউন এবং তার নেপথ্যের কাহিনি

দুর্ভাগ্যজনক হলেও সত্য আমাদের দেশে কিছু মানুষের করোনায় আক্রান্ত হয়ে মৃত্যু হয়েছে। আক্রান্ত বেশ কিছুজন এখনও হাসপাতালে ভর্তি। যদিও যে দেশে ডেঙ্গুকে অস্বীকার করে ‘অজানা জ্বরে মৃত্যু’ হিসেবে আকছারই দেখান হয়,সেই দেশে সাধারণ রোগে মৃত্যুকেও করোনা হিসেবে দেখানো হবে কিনা তার কোনও গ্যারান্টি নেই। পাশাপাশি ঘটনা এটাই যে আমাদের দেশে যক্ষ্মা,ম্যালেরিয়া,ডেঙ্গু,পেটখারাপ এবং অপুষ্টিজনিত কারণে চিকিৎসার অভাবে প্রতিদিন হাজার হাজার লোক মারা যায়। ঋণের দায়ে আত্মহত্যা করে হাজার হাজার কৃষক।সেই দেশে করোনা ঠেকাতে লকডাউনের দাওয়াই দিয়ে একদিকে প্রশাসনিক অতিসক্রিয়তা অপরদিকে লকডাউনের নাম করে রাস্তায় নিরীহ নাগরিকের উপর পুলিশি তাণ্ডব(যা ইতিমধ্যেই একজনের প্রাণ কেড়ে নিয়েছে)এইসমস্ত ঘটনা আমাদের মনে প্রশ্ন জাগায় যে সরকার আদৌ করোনা প্রতিরোধে আন্তরিক নাকি এর পেছনে আছে তার অন্য কোনও দূরভিসন্ধি! আসলে করোনা প্রকোপ আসার আগে থেকেই ভারতের অর্থনীতি একেবারে মুখ থুবড়ে পরার অবস্থায় ছিল। তাই চিরকাল জনমোহিনী মুখোশের আড়ালে একের পর এক জনবিরোধী সিদ্ধান্ত নিয়ে চলা এদেশের শাসকশ্রেণি কি সমস্ত অর্থনৈতিক বিপর্যয়কে করোনার ঘাড়ে চাপিয়ে,লকডাউনকে অজুহাত করে অর্থনৈতিক জরুরি অবস্থা জারির দিকে এগিয়ে যাচ্ছে?

এই প্রশ্নের উত্তর পেতে গেলে করোনার পিছনে অর্থনৈতিক চিত্রটাকে একটু দেখে নিতে হবেঃ-

মোদি-সরকার ভারতবাসীকে প্রতিশ্রুতি দিয়েছিল ক্ষমতায় এলে ‘আচ্ছে দিন’ উপহার দেবেন। বাস্তবত তিনি ক্ষমতায় বসার পর থেকে ঘৃণা,আতংক আর হিংসা ছাড়া দেশবাসীকে কিছুই উপহার দিতে পারেননি। তার সরকার সবচেয়ে মোক্ষম আঘাতটা দিয়েছিল ২০১৬-এর ৮ নভেম্বর দেশের প্রায় ৮৬ শতাংশ প্রচলিত মুদ্রা বাতিল করে, বিমুদ্রাকরণের মাধ্যমে। অউটলুক পত্রিকার একটি রিপোর্ট জানাচ্ছেঃ The cost of printing currency notes escalated to Rs 7,965 crore in 2016-17, the year when the government had banned the high-value 500 and 1,000 rupee bills, the government informed Parliament Tuesday.  [অউটলুক, নভেম্বর ২৫, ২০১৯]এরপর মোদি সরকারের জিএসটি তথা ‘এক জাতি এক কর’-এর নীতি আর্থিক সংকটকে আরও ত্বরান্বিত করল। ফলস্বরূপ ভারতীয় অর্থনীতিতে গত ৪৫বছরের মধ্যে সর্বোচ্চ বেকারত্বের অভিশাপ নেমে এসেছে। বর্তমানে তা আরও বাড়ছে। এন এস এস ও -এর দেওয়া এই তথ্যকে সরকার প্রথমে চেপে গেলেও পরে তা স্বীকার করতে বাধ্য হয়েছে। শুধু গত তিন বছরে ৯০ লক্ষ মানুষ কাজ হারিয়েছেন। একদিকে কেন্দ্রীয় ব্যাঙ্কের অভূতপূর্ব সুদের হার হ্রাসের ধাক্কায় প্রবীণ নাগরিক-সহ স্থির সুদের আয়ের উপর নির্ভরশীল অধিকাংশ ভারতবাসীর দিন সংকুলান যেখানে ক্রমশ যথেষ্ট কঠিনতর হচ্ছে, অন্যদিকে বাজারে সুদের হার যথেষ্ট হ্রাস পাওয়া সত্বেও বিনিয়োগ ও উৎপাদন বাড়ছে না। সম্প্রতি এন এস এস ও রিপোর্ট আরেকটি চাঞ্চল্যকর তথ্য ফাঁস করেছে। তারা জানিয়েছে ২০১৭ সালের জুলাই থেকে ২০১৮ সালের জুন মাসের মধ্যে গ্রামাঞ্চলের মানুষের পণ্য কেনার ক্ষমতা কমেছে ৮.৮ শতাংশ। ১৯৭২ সালের পর গ্রামীন মানুষের ক্রয় ক্ষমতার এই অবনমন এই প্রথমবার ঘটলো। গ্রাম-শহর মিলিয়ে এই ক্রয় ক্ষমতার হ্রাস ঘটেছে ১৩ শতাংশ। টমাস পিকেটি এবং তার সহযোগীদের তৈরি বিশ্ববৈষম্যের তথ্যাভান্ডারের (ওয়ার্ল্ড ইন ইকুইলিটি ডেটাবেস) পরিসংখ্যান অনুযায়ী ২০১৭ সালে ৯ শতাংশ ধনীর হাতে ছিল দেশের সম্পদের মোট ৫৮ শতাংশ, ২০১৮ সালে তা বেড়ে দাঁড়িয়েছে ৭৩ শতাংশে। অর্থাৎ দেশের ৯১ শতাংশ মানুষের আয় ক্রম হ্রাসমান। ক্রেডিট সুইস রিপোর্ট অনুযায়ী বিগত ৮০ বছরের মধ্যে সবচেয়ে বেশি আয়ের বৈষম্য সৃষ্টি হয়েছে প্রথমবারের মোদি সরকারের জমানায়। গ্লোবাল ওয়ার্ল্ড হেলথ রিপোর্ট অনুযায়ী ধনী-দরিদ্র বৈষম্যে ভারতের স্থান এখন বিশ্বে দ্বিতীয়। দেশের ৬০ শতাংশ মানুষের হাতে আছে মাত্র মোট সম্পদের ৪.৮ শতাংশ।৭ লক্ষের উপর কলকারখানা নতুন করে বন্ধ হয়েছে স্রেফ বিগত ৫ বছরে। ১৯৮০-৮১ তে ১০০ একক মূল্য উৎপাদনে শ্রমিকের মজুরির ভাগ ছিল ২৮.৫ শতাংশ। ২০১২-১৩ তা নেমে দাঁড়ায় ১১ শতাংশে। পরবর্তীকালে তা কমে ৯ শতাংশে এসে ঠেকেছে।(সূত্রঃ আই এল ও, এশিয়া প্যাসিফিক ওয়ার্কিং পেপার সিরিজ) অর্থাৎ শ্রমের দ্বারা উৎপাদিত মূল্যের ৯০ শতাংশ পুঁজিপতি শ্রেণী একাই আত্মসাৎ করে। এদিকে ফিনান্স বিল ২০১৭ এর মধ্যে দিয়ে ভারতের ইতিহাসে এই প্রথম রাজনৈতিক দলের বিদেশ থেকে পাওয়া অর্থের কোনো হিসেব নেওয়া হবে না এই আইন পাশ করিয়ে বিদেশ থেকে অর্থ আমদানি এবং দূর্নীতিকে পুরোপুরি আইনসিদ্ধ এবং বৈধ করা হলো।সমগ্র বিশ্বের মধ্যে সবচেয়ে বেশি অপুষ্টিতে ভোগেন এদেশের নাগরিকরা। ১৫ থেকে ৪৯ বছর বয়সের অর্ধেকের বেশী নারীই এদেশে অপুষ্টিতে ভোগেন। ৫ বছরের কম শিশুদের মৃত্যুর সংখ্যাও সারা পৃথিবীর মধ্যে এদেশেই সব চেয়ে বেশি।GII(global innovation index)-এর রিপোর্ট অনুযায়ী বিশ্ব ক্ষুধাসূচকে আমরা ১১৯টি দেশের মধ্যে ১০৩নম্বরে। দৈনিক শিশুমৃত্যুর হার ৩০০০।এগুলি নিছক মৃত্যু নয় বরং বলা ভালো কাঠামোগত হিংসার (স্ট্রাকচারালা ভায়োলেন্স) ফলশ্রুতি।খিদের এতোই দাপট যে পেটে খিদে নিয়ে প্রতিদিন রাতে ঘুমোতে যান এদেশের ২০ কোটি মানুষ। কাঠামোগত সন্ত্রাসের আরেকটা উদাহরণ হলো কৃষকের আত্মহত্যা। খোদ কেন্দ্রীয় স্বরাষ্ট্র মন্ত্রকের পরিসংখ্যান বলছে, ২০১৬ সালে সারা দেশে মোট ১১,৩৭৯টি কৃষক আত্মহত্যার ঘটনা ঘটেছে। অর্থাৎ ওই বছর প্রতি মাসে গড়ে ৯৪৮ কৃষক আত্মঘাতী হয়েছেন। আর দৈনিক সংখ্যাটা দাঁড়ায় ৩১। ১৯৯৫ সাল থেকে ২০১৬ সাল পর্যন্ত দেশে মোট ৩,৩৩,৪০৭ জন কৃষক আত্মহত্যার তথ্য NCRB-র কাছে নথিভুক্ত হয়েছে। জীবনধারণের স্বাস্থ্য সংক্রান্ত তথ্য বলছে  ২২৪ টি দেশের মধ্যে ভারতের অবস্থান ১৬৪ নম্বরে। আঞ্চলিকভাবে পাকিস্তান ছাড়া আর সব দেশের নীচে। ‌২০১৬ তে যক্ষারোগে, multi drug resistance এ বিশ্বে প্রথম। পাঁচ বছরের নিচে ডায়রিয়ায় শিশুমৃত্যুর হারে নাইজেরিয়ার সাথে আমরা যুগ্মভাবে প্রথম।  GHI (global hunger index) – ১১৯ দেশের মধ্যে আমরা  ১০৩ এ।  ২০১৭ তে অপুষ্টিতে আমরা শীর্ষে। পরিবেশ দূষণে আমরা  সারা বিশ্বের জঘন্যতম ১৫টি দূষিত শহরের মধ্যে ১৪টিই আমার দেশের।  ২০১৮ য় কুড়ি লক্ষ অকাল মৃত্যুর কারণ ছিল দূষিত পরিবেশ।  EPI (environmental performance index) – ১১১৮০ টি দেশের মধ্যে আমাদের স্থান ১৭৭ এ! জলের পরিস্থিতি – ১৯৫০ এ মাথা পিছু জলের পরিমাণ  ৫০০০ কিউবিক মিটার থেকে বর্তমানে  ১১৪০ কিউবিক মিটার (১০০০কিউবিক মিটার সর্বনিম্ন সীমা!) । করোনা মোকাবিলার অন্যতম রাস্তা সাবান জলে হাত ধোওয়া, কিন্তু দেখা যাচ্ছে আমাদের দেশে হাত ধোওয়ার জন্য পরিষ্কার জল পাওয়াও একজন নিম্নবিত্ত মানুষের পক্ষে কতখানি কঠিন।পানীয় জলের জন্য গ্রামের মানুষ মাইলের পর মাইল হেঁটে যাচ্ছে- এ দৃশ্য তো এই দেশে খুবই সাধারণ।  HCI (wor human capital index) – শিক্ষাগত অবস্থার এই মানদন্ডে ১৫৮টি দেশের মধ্যে আমরা  ১১৫ নম্বরে। ২০১৭তে আমরা এক ঝটকায় ১২ ধাপ নীচে নেমে এসেছি , এমনকি নেপাল, শ্রীলঙ্কার থেকেও নীচে। I  CT development index (IT) -১৭৬ দেশের মধ্যে ১৩৪ নম্বরে ! অথচ টি টি এন / পি আর-এর রিপোর্ট জানাচ্ছে ৩ বছরে মোদির শুধু বিমান খরচই ২৫৫ কোটি রুপি। একদশকে দলিত নির্যাতন বেড়েছে ৬৬ শতাংশ, এমনটাই বলছে ন্যাশনাল ক্রাইম রেকর্ড ব্যুরো। ২০০৭ থেকে ২০১৭ পর্যন্ত রিপোর্ট বলছে,প্রতি ১৫ মিনিটে অপরাধের শিকার হন দলিতরা। শুধু তাই নয়, প্রতিদিন ধর্ষিত হন ৬ দলিত মহিলা। এক দশকে দলিত নির্যাতন বেড়েছে ৬৬ শতাংশ। লোকসভায় বিজেপির সাংসদ তরুন বিজয় জানাচ্ছেন মোদিজীর ‘স্বচ্ছ ভারতে’ প্রতি বছর মাথায় করে মলমূত্র পরিস্কার করতে গিয়ে এই কাজের সাথে যুক্ত ২২৩২৭ জন মানুষের মৃত্যু হয়। অথচ, যখন কংগ্রেস নেতৃত্বাধীন ইউ এ পি এ সরকার যেখানে ২০১৩-১৪ সালে ৫৫ কোটি টাকা মাথায় করে মলবহনকারীদের পুনর্বাসনের জন্য বরাদ্দ করেছিল মোদি সরকার তার জমানায় মাথায় করে মল বহনকারীদের পুর্নবাসনে এক পয়সাও খরচ করেনি। তবু আমরা বলতে পারি, নরেন্দ্র মোদি-অমিত শাহ যুগলবন্দি মিথ্যা বচন কদাপি বলেন না। শুধু তারা যা বলেন তার অর্থের মধ্যে কিছু ফ্যালাসি থেকে যায়, যা আমাদের মতো মধ্যমেধার মানুষজন হয়ত বুঝে উঠতে পারি না। এই যেমন তিনি ২০১৪ সালে ক্ষমতায় বসার আগে বলেছিলেন ‘আচ্ছেদিন’ আনবেন। ২০১৯ এর লোকসভা ভোটের আগে বললেন ‘ম্যায় হু চৌকিদার’। ‘আচ্ছেদিনের’ গল্প কেন ‘চৌকিদারের’ গল্পে বদলে যাচ্ছে এই বলে আমরা হই হই করে উঠলাম। কিন্তু হায়! আমরা তো তাঁকে বুঝতে সম্পূর্ণ ব্যর্থ হয়েছিলাম। তিনি বিগত ৫ বছর ধরে প্রতিশ্রুতি মতন ‘আচ্ছেদিন’ এনেছেন। তবে সেটা আম জনতার জন্য ‘আচ্ছেদিন’ নয়, কর্পোরেট পুঁজির জন্য ‘আচ্ছেদিন’। তিনি জনতার প্রতি নয় কর্পোরেট পুঁজির প্রতিই দায়বদ্ধ, আর দায়বদ্ধ সংঘ পরিবারের কাছে। কারণ, তাদের কল্যানেই তিনি প্রধানমন্ত্রীর পদে আজ সমাসীন। কিভাবে কর্পোরেট পুঁজির কাছে তিনি প্রতিশ্রুতি রক্ষা করেছেন? ধনী-দরিদ্র বৈষম্যের চিত্র দিয়েই তা পরিস্কার যা আমরা উপরে দেখিয়েছি। ধন বৈষম্যে ভারতের স্থান রাশিয়ার পরেই, বিশ্বে দ্বিতীয়। এটা গ্লোবাল ওয়েলথ রিপোর্টের তথ্য। একবার ভাবুন তো ধনী ব্যক্তিদের জন্য কতখানি ‘আচ্ছেদিন’ এনে দিয়েছেন মোদি-শাহ যুগলবন্দি! এরপর যখন প্রথম ৫ বছর অতিক্রমের দোরগোড়ায়, তখন মোদি স্বাভাবিকভাবেই নিজেকে ‘চৌকিদার’ দাবি করলেন। এর মানে যদি আমরা করি যে মোদি ‘দেশ রক্ষক’ হিসাবে ‘চৌকিদার’ দাবি করছেন তাহলে তা হবে মুর্খের স্বর্গে বাস করা। যদি আমরা আবেগতাড়িত হয়ে বলতে শুরু করি যে ‘মোদির আমলেই সবচেয়ে বেশি সম্পদ বাইরে পাচার হয়েছে’; যদি আমরা দাবী করি যে ‘মোদির আমলে সমস্ত দূর্নীতিকে বৈধ করে দেওয়া হয়েছে’ বা ‘মোদির আমলে দেশের যাবতীয় সম্পদ কর্পোরেটদের পায়ের তলায় সঁপে দেয়া হয়েছে’; অথবা মোদির আমলে ব্যংক লুটেরারার প্রকাশ্যে ব্যাংক লুট করে অন্য দেশে ভেগে গেছে; তবে তা দিয়ে চৌকিদারত্বের দাবীকে খন্ডন করা যাবে না। কারণ, মোদি তো কর্পোরেট পুঁজির সম্পদ রক্ষার ‘চৌকিদার’! সেই অর্থে মোদি নিজেকে ঠিকই দাবী করে থাকেন। কিন্তু সমস্যা হচ্ছে এতো কিছু চেষ্টার পরও, মোদি সরকার দেশের অর্থনীতির সংকট থেকে দেশকে উদ্ধার করতে পারছেন না। শুধুমাত্র জনগণ নয় শাসকশ্রেণীর তথাকথিত উন্নয়নের মানদন্ডগুলোও অর্থাৎ এক কথায় বাজার অর্থনীতির মানদন্ডগুলোও বড্ড বেয়ারা তথ্য দিচ্ছে যে। তারা জানাচ্ছে সামনে বিরাট আর্থিক সংকট দেশকে গ্রাস করতে চলেছে। কর্পোরেট কর কমানোর মধ্যে দিয়ে জনগণের উপর করের বোঝা বাড়িয়ে; জনগণকে কর্মক্ষেত্র থেকে ছাঁটাই করে; খুচরো ব্যবসায়ীদের ব্যবসাকে লাটে তুলে দিয়ে; জনগনের মজুরি সহ অন্যান্য যাবতীয় অধিকারগুলো খর্ব করে; উন্নয়নের নামে তাদের জীবন-জীবিকা থেকে উচ্ছেদ করেও শিল্পকে চাঙ্গা করা যাচ্ছে না। চিত্রটা কি রকম একটু দেখা যাক। গত ১৮ নভেম্বর ২০১৯ এর আনন্দবাজারের সম্পাদকীয় বলছেঃ “টাকার দামের পতন অব্যহত, ইহা সমস্যার একটি প্রকাশমাত্র। কেন টাকার দাম পড়িতেছে, সেই কারণ সন্ধান করিলে একটি স্পষ্ট উত্তর মিলিবে-ভারতীয় অর্থব্যবস্থার উপর বিশ্বমঞ্চে ভরসা কমিতেছে। সাম্প্রতিক অতীতে ভারতীয় রিজার্ভ ব্যংকও বিপুল পরিমাণ ডলার ঘরে তুলিয়াছে, অর্থাৎ টাকার ভবিষ্যতের উপর  দেশের কেন্দ্রীয় ব্যংকেরও বিশেষ আস্থা নাই। আস্থা হারাইবার কারণ প্রকট – অর্থ্যব্যবস্থার সর্বাঙ্গে গতিভঙ্গের ঘুণ ধরিয়াছে। শিল্পক্ষেত্রে উৎপাদনের সূচক নিম্নমুখী, বিদ্যুতের চাহিদা নাই। অক্টোবর মাসে পাইকারি মূল্যসূচকের নিরিখে মূল্যবৃদ্ধির হার কার্যত শূণ্যে ঠেকিয়াছে। শিল্পক্ষেত্রে গতিভঙ্গের সকল লক্ষন স্পষ্ট। অন্যদিকে খুচরা পণ্যের মূল্য সূচকের নিরিখে মূল্যবৃদ্ধির হার গত ষোলো মাসে সর্বোচ্চ, রিজার্ভ ব্যংকের সহনসীমার ঊর্দ্ধে। আপাত জটিল ধাঁধা – যেখানে পাইকারি বাজারে মূল্যবৃদ্ধির হার ৪০ মাসের তলানিতে, সেখানে খুচরা পণ্যে এমন মূল্যবৃদ্ধি হইতেছে কিভাবে? উত্তর আছে হিসাবের পদ্ধতিতে। পাইকারি মূল্যসূচকে খাদ্যপণ্যের গুরুত্ব ১৫ শতাংশ, খুচরা মূল্যসূচকে সেই গুরুত্ব ৪৫ শতাংশের বেশী। শুধুমাত্র খাদ্যপণ্যের শুধুমাত্র খাদ্যপণ্যের পাইকারি মূল্যসূচকের মূল্যবৃদ্ধির হার সেপ্টেম্বরে ছিল ৫.০৮ শতাংশ, অক্টোবরে তাহা বাড়িয়া হইয়াছে ৭.৬৫ শতাংশ। অর্থাৎ শিল্পক্ষেত্র ধুঁকিতেছে, কিন্তু বাজারে খাদ্যমূল্য অগ্নিমূল্য। সাধারণ মানুষ দুই অস্ত্রেই ঘায়েল হইতেছেন। তাহার উপর টাকার দামের নিম্নগতি অব্যহত থাকিলে পেট্রোপণ্য সহ আরও অনেক কিছুরই দাম বাড়িবে, তাহার আঁচ আসিয়ে লাগিবে সাধারণ মানুষের গায়ে। নরেন্দ্র মোদি ভারতের অর্থ ব্যবস্থাকে যে চক্রব্যুহের মধ্যে আনিয়া ফেলিয়াছেন তাহা হইতে বাহির হইবার পথ তাহারা জানেন বলিয়া বিশ্বাস হয় না”।(আ ব পঃ ১৮ নভেম্বর ২০১৯)। এদিকে সরকারের অন্দরে কাঁপুনি ধরিয়ে ‌মুডিস ইনভেস্টর সার্ভিস সম্প্রতি একটি রিপোর্ট প্রকাশ করেছে। তাতে তাঁরা জানিয়েছে, ভারতীয় অর্থনীতিতে মন্দা আরো দীর্ঘস্থায়ী হবে। তারা আরো জানিয়েছে চলতি অর্থবর্ষে অর্থাৎ ২০১৯–২০ সালে ভারতের জিডিপ হার কমে ৫.‌৬ শতাংশে নামবে যেখানে শুরুতে ভাবা হয়েছিল ভারতে জিডিপি হার ২০১৯–২০২০ সালে ৫.‌৮ শতাংশ হবে। শিল্পসংস্থাগুলিতে ছাঁটাই ক্রমশ বাড়ছে। ২০১৪ সালে কলকারখানা, যন্ত্রপাতি ইত্যাদিতে বিনিয়োগের অংক ছিল জিডিপির ৩৪.৩ শতাংশ; ২০১৭ সালে তা কমে দাড়িয়েছে ৩০.৭ শতাংশে। ইউ এ পি এ আমলে এই অনুপাত ছিল গড়ে ৩৯ শতাংশ, মোদির জমানায় তা কমে হয়েছে গড়ে ৩১.৮ শতাংশ। এটা দেখাচ্ছে বৈদেশিক বানিজ্যে আমাদের দ্রুত অধঃগতির দিকটাকে। ২০১৪ সালে ভারতের রপ্তানি বানিজ্য গড়ে ১৩/১৪ শতাংশ হারে বৃদ্ধি পেয়েছিল মোদি-১ জমানায় তা কমে দাড়িয়েছিল ১.৬ শতাংশে। এর ফলে বিদেশি মূল্যের ঘাটতি বেড়েছে ২.৯ শতাংশ । তাই ডলারের দাম ক্রমবর্দ্ধমান। এদিকে বিগত ৩০ বছরের হিসাবে যা হয়নি তাই করতে চলেছে রিজার্ভ ব্যাংক সংবাদমাধ্যম সূত্রে খবর, চলতি বছরে এখনও পর্যন্ত ১‌.‌১৫ বিলিয়ন ডলারের সোনা বিক্রি করে ফেলেছে রিজার্ভ ব্যাঙ্ক। শিল্পে লগ্নি তলানিতে। এর সঙ্গে গাড়িনির্মাতা, যন্ত্রাংশ সংস্থা, ডিলারও অসংগঠিত ক্ষেত্র, সর্বত্র কর্মী ছাঁটাই হচ্ছে দ্রুতগতিতে। শুধু গাড়ি শিল্পে গত কয়েক মাসের মধ্যেই কাজ হারিয়েছেন ৩.৫ লক্ষের বেশি মানুষ। তাদের মধ্যে ২.৫লক্ষ ডিলারকর্মী। যন্ত্রাংশ শিল্পে ১লক্ষ। গাড়িসংস্থাগুলিতে অন্তত ১৫হাজার। গত ত্রৈমাসিকে বৃহত্তম গাড়িনির্মাতা মারুতি সুজুকিতে বিক্রি কমেছে প্রায় ২০শতাংশ। বিপুল কমেছে নিট মুনাফা। অন্যান্য গাড়িসংস্থাগুলির অবস্থাও তখৈবচ। অবিলম্বে চাহিদার উন্নতি না হলে আগামিদিনে ১০ লক্ষ কর্মী কাজ হারাতে পারেন। ফলে এই মুহূর্তে গাড়ি সংস্থাগুলি গাড়ি শিল্পকে বাঁচাতে বিপুল ত্রাণসাহায্যের দাবি করেছে কেন্দ্রীয় সরকারের কাছে। ভারতের জিডিপিতে মোটরগাড়ি শিল্পের অবদান হল ৭ শতাংশ এবং এই ক্ষেত্র প্রত্যক্ষ এবং অপ্রত্যক্ষ ভাবে প্রায় ৩ কোটি ৭০ লক্ষ শ্রমিক নিয়োগ করে থাকে। মোটর গাড়ি, শীততাপ নিয়ন্ত্রক যন্ত্র এবং ঠাণ্ডা মেশিন অথবা টিভি ও ওয়াশি্ং মেশিনের মত ব্যয়বহুল ভোগ্যপণ্যের বিক্রি যথেষ্ট কমার পাশাপাশি বিস্কুটের প্যাকেটের বিক্রিও কমে গেছে। পার্লে এবং ব্রিটানিয়া কোম্পানিও শ্রমিক ছাঁটাই করছে। সম্প্রতি আজকাল পত্রিকার একটি প্রতিবেদন জানাচ্ছেঃ “২০২০ অর্থবর্ষে জিডিপি বৃদ্ধির পূর্বাভাস আগের থেকে আরও কমার ইঙ্গিত দিয়েছে স্টেট ব্যাঙ্ক অফ ইন্ডিয়া। ব্যাঙ্কের রিপোর্টে বলা হয়েছে, ২০২০ অর্থবর্ষে জিডিপি বৃদ্ধির হার কমে দাঁড়াবে মাত্র ৫%। অথচ আগে এসবিআই জানিয়েছিল, বৃদ্ধির হার হবে ৬.১%। এমনকী চলতি অর্থবর্ষের দ্বিতীয় ত্রৈমাসিকে বৃদ্ধির হার ৪.২%–‌এ নামতে পারে বলেও আশঙ্কা। এ বিষয়ে আগেই সতর্কবার্তা দিয়েছে এশিয়ান ডেভেলপমেন্ট ব্যাঙ্ক, বিশ্ব ব্যাঙ্ক, ওইসিডি, রিজার্ভ ব্যাঙ্ক ও আইএমএফ। এসবিআই জানিয়েছে, অর্থনীতির বৃদ্ধির হার কমার কারণ একাধিক। গাড়ি বিক্রি কমছে। কমছে বিমানযাত্রীর সংখ্যা। বিমান সংস্থাগুলির ব্যবসা বাড়ছে না। শিল্পের কোর সেক্টরে উৎপাদন বাড়ছে না। নির্মাণ ও পরিকাঠামো ক্ষেত্রে বিনিয়োগ কমছে। এর সঙ্গে পাল্লা দিয়ে শিল্পোৎপাদনের সূচক সেপ্টেম্বরে নেমে এসেছে ৪.৩% হারে, যা খুবই উদ্বেগজনক। শিল্পে মন্দার পাশাপাশি নন ব্যাঙ্কিং আর্থিক প্রতিষ্ঠান, সরকারি ও বেসরকারি ব্যাঙ্কগুলি ঋণদান কমিয়েছে আশঙ্কাজনকভাবে। এর সঙ্গে যুক্ত হচ্ছে কৃষি সঙ্কট। এসব কিছু মিলিয়েই রাশ টানছে অর্থনীতির অগ্রগতিতে, এমনই উল্লেখ করা হয়েছে এসবিআই রিপোর্টে। রিপোর্টে বলা হয়েছে, ২০১৯ অর্থবর্ষের প্রথম ত্রৈমাসিকে যে ৩৩টি গুরুত্বপূর্ণ সূচকের বৃদ্ধির হার ছিল ৬৫%, চলতি অর্থবর্ষের দ্বিতীয় ত্রৈমাসিকে সেগুলির বৃদ্ধি নেমে এসেছে ২৮%–‌এ। এর ওপর এ বছর অতিরিক্ত বর্ষার কারণে মধ্যপ্রদেশ, মহারাষ্ট্র, গুজরাট, কর্ণাটক ও পাঞ্জাবের মতো কৃষিপ্রধান রাজ্যগুলিতে খরিফ শস্যের ফলনে ব্যাপক ক্ষতির আশঙ্কা দেখা দিয়েছে। মধ্যপ্রেদেশে ৪০ থেকে ৫০% সয়াবিন চাষ, ৩০ থেকে ৪০% বাদাম চাষ, গুজরাটে ৩০% তুলো চাষ ক্ষতির মুখে। এর প্রভাব পড়বে কৃষির বৃদ্ধিতেও। বেহাল দশা ঋণ বাজারেরও। আর্থিক পরিষেবা সংস্থা ক্রেডিট সুইজ জানিয়েছে, জুলাই থেেক সেপ্টেম্বের মধ্যে ভারতে ঋণদানের হার নেমে এসেছিল মাত্র ৬%–‌এ, যা নোটবন্দির সময়ের সমান। এর কারণ নন ব্যাঙ্কিং আর্থিক প্রতিষ্ঠানের তহবিলে ঋণ দেওয়ার মতো পুঁজি নেই। রাষ্ট্রায়ত্ত ব্যাঙ্কও ঝুঁকি নিয়ে ঋণ দিতে সাহস করছে না। সরকার বিপুল পরিমাণ পুঁজি জোগানো সত্ত্বেও চলতি অর্থবর্ষের প্রথম ত্রৈমাসিকে ব্যাঙ্ক ঋণের পরিমাণ কমেছে ৩%। এমনকি বেসরকারি ব্যাঙ্কের ঋণ গত এক বছরে ২২% থেকে ১৪%–‌এ নেমে এসেছে। মিউচুয়াল ফান্ড থেকেও  পুঁজি জোগান কমেছে ৩০%। আইএলঅ্যান্ডএফএস–এর বিপুল অনিয়মের খবর সামনে আসার পর অন্য নন ব্যাঙ্কিং আর্থিক সংস্থাগুলিকে কেউই পুঁজি জোগাতে রাজি নয়। সমস্যা মেটাতে বাজার থেকে ঋণ করার চেষ্টাও সফল হচ্ছে না। আবার ধার করার খরচও বেড়েছে বিপুল হারে। ফলে চরম সঙ্কটে ঋণের বাজারও”। ১৯৪৭ সাল থেকে আজ অবধি সবচেয়ে অর্থনৈতিক সংকটের মধ্যে দিয়ে চলছে ভারত এ কথা স্বীকার করে নিয়েছে বিজেপি নেতা সুব্রাহ্মণ্যম স্বামীও। চরম সংকটে ইস্পাত, টায়ার, যন্ত্রাংশ, রং-সহ আরও বেশ কিছু শিল্প।এই সংস্থাগুলিতেও কাজ হারানোর চরম সংকট তৈরি হয়েছে।সমস্যায় ভোগ্যপণ্য শিল্পও। ফলে সরকারের কাছে ত্রাণের দাবি উঠেছে দেশের বিভিন্ন শিল্পসংস্থা থেকে। অর্থাৎ একদিকে শিল্পের বেহাল দশা। অন্যদিকে দেশের ব্যাপক জনগণও সংকটে জর্জ্জরিত। তাঁরা প্রতিদিন কর্মচ্যুত হচ্ছেন, বে-রোজগার হচ্ছেন, তাঁদের ব্যয় করার ক্ষমতা কমছে; অন্যদিকে নিত্য প্রয়োজনীয় জিনিষপত্রের দাম ক্রমবর্দ্ধমান। এটা আজ এমনকি অনেক বুর্জোয়া অর্থনীতিবিদও মনে করছে যে জনগনের আর্থিক দুর্দশা, তাদের ক্রয় ক্ষমতা কমে যাওয়ার কারনে, দেশের অভ্যন্তরীন বাজারের ব্যপক সংকোচনই দেশের আর্থিক সংকটের প্রধান কারণ। এ অবস্থায় সামনে আছে দুটো পথ। একটা পথ হচ্ছে – জনগণের হাতে কাজ দাও। জনগণের ক্রয় ক্ষমতা বাড়াতে যাবতীয় ব্যবস্থা গ্রহন করো। মূল্যবৃদ্ধি কমাতে তৎপর হও। অন্য পথটি হচ্ছে জনগণের উপর আরও শোষনের বোঝা বাড়িয়ে; আরো মুনাফা করে এবং জনগণের উপর করের বোঝা বাড়িয়ে কর্পোরেট পুঁজিকে আরো কর ছাড় দিয়ে; সংকটের হাত থেকে আপাত ত্রাণ নেওয়ার চেষ্টা। যা দেশকে অনিবার্যভাবে ফ্যাসিবাদের দিকে নিয়ে যেতে বাধ্য। একদিকে জনগণের কর্মসংস্থান বাড়লে, তাদের আয় বাড়লে একদিকে যেমন বাজারের অগ্রগতি হবে, শিল্পে গতি আসবে; তেমনই জনগণের দরকষাকষির জায়গায়টাও বাড়বে (ব্যপক বেকারির সময় যেটা কমে যায়) অন্যদিকে যদি জনগণের দরকাষাকষির জায়গাটা ভেঙ্গে দিয়ে তাঁকে আরও সস্তা শ্রমিকে পরিণত করে আরো অতিমুনাফা করার মধ্যে দিয়ে শিল্প কিছুদিন আরো শ্বাস ফেলতে পারে কিন্তু তা সাময়িক। কিন্তু এদেশের মুনাফা লোভী, জনবিরোধী লুম্পেন কর্পোরেট পুঁজির একটা বড় অংশের এই পথ রক্ষার দ্বিতীয় পথই বেশি পছন্দ, তাই তাদের পছন্দ মোদি-অমিত শাহ জুটি।  তাই দ্বিতীয়বার ক্ষমতায় বসেই তাই মোদি তড়িঘড়ি কিছু বিল পাশ করিয়েছে তার মধ্যে অন্যতম হলো মিনিমাম ওয়েজেস বিল। যার মধ্যে দিয়ে তারা শ্রমিককে প্রায় ক্রীতদাসের স্তরে নামাতে চাইছে। অন্যদিকে এন আর সি চালু করে কোটি কোটি জনগণকে তারা ডি-ভোটার তথা অ-নাগরিক বানিয়ে, তাদের ডিটেনশান ক্যাম্পে রেখে, যাবতীয় নাগরিক অধিকার কেড়ে নিয়ে, আরেক ধরনের ক্রীতদাস বানাতে চাইছে। তারই সাথে সাথে ইউ এ পি এ আইন সংশোধন,আর টি আই বিল,নতুন সেজ আইন,অরণ্য আইন,খনি আইনের মত একের পর এক আইনকে তড়িঘড়ি পাশ করিয়ে দেশের জল-জঙ্গল-জমিন ও শ্রমসম্পদের কর্পোরেট লুন্ঠনের পরিপূর্ণ বন্দোবস্ত কায়েম করেছে। এরই ধারাবাহিকতায় দেখতে হবে আজকের এই লকডাউনকে।

তাহলে এটা পরিস্কার হল যে মোদির জমানায় একদিকে শ্রমিকদের বেতন কমানো, অন্যদিকে কর্পোরেট সংস্থাগুলিকে বিপুল ছাড় দেওয়ার ফলে দেশের অর্থনীতি মুখ থুবড়ে পড়েছে। গত ৪৫ বছরে বেকারত্বের হার সর্বোচ্চ। তার ওপরে লক ডাউনের প্রভাবে দেশের অর্থনীতি ধ্বংসের মুখে এসে দাঁড়াবে বলেই মনে করছেন বিশেষজ্ঞরা। সবচেয়ে বেশি ক্ষতিগ্রস্ত হবেন অসংগঠিত ক্ষেত্রের শ্রমিকরা। দেশের প্রায় ৯৩ শতাংশ শ্রমিক অসংগঠিত ক্ষেত্রে কাজ করেন। ন্যাশনাল রেস্টুরেন্ট এসোশিয়েশনের মতে দেশে রেস্টুরেন্টগুলিতে কমপক্ষে ৭৩ লক্ষ মানুষ কাজ করেন। এর মধ্যে অন্তত ১৫ লক্ষ মানুষ কাজ হারাবেন। দেশের দোকান কর্মচারীদের সংখ্যা প্রায় চার কোটি ষাট লক্ষ। রিটেলার্স এসোসিয়েশন অফ ইন্ডিয়ার মতে এর মধ্যে কাজ চলে যাবে প্রায় এক কোটি ১০ লক্ষ মানুষের। ২০১৭ সালে নির্মাণ শিল্পে কাজ করতেন পাঁচ কোটির বেশি মানুষ। বর্তমান আর্থিক সঙ্কটের ফলে এদের প্রায় ২০ শতাংশ ইতিমধ্যেই কাজ হারিয়েছেন। করোনা লক ডাউনের ফলে আরও প্রায় ৩৫ শতাংশ মানুষ কাজ হারবেন বলে নির্মাণ সংস্থাগুলির আশংকা।অ্যাপ- ভিত্তিক পরিবহণের  (ওলা, উবর প্রভৃতি) সঙ্গে যুক্ত প্রায় ৫০ লক্ষ মানুষ। লক ডাউন শুরু হবার আগেই এক্ষেত্রে চাহিদা কমে গেছিল প্রায় ৪০ শতাংশ। স্বাভাবিক ভাবেই এক্ষেত্রেও ব্যাপক কর্ম সংকোচনের আশংকা করছেন সংশ্লিষ্ট মহল। গাড়ি শিল্পে সঙ্কটের কারণে আগে থেকেই কর্মী ছাঁটাই চলছিল। ২০১৯-এ গাড়ি ও তার যন্ত্র নির্মাণ  শিল্পের সঙ্গে যুক্ত প্রায় ২৩ লক্ষ মানুষ কাজ হারিয়েছিলেন। করোনা আতংক শুরু হবার পর গাড়ির শোরুমগুলিতে খদ্দেরের সংখ্যা প্রায় ৭০ শতাংশ কমে গেছে বলে জানিয়েছে ফেডারেশন অফ অটোমোবাইল ডিলার্স এসোসিয়েশন। আর লক ডাউন শুরু হবার পরপরই এই সুযোগে উৎপাদন বন্ধ করে দিয়েছে ফোর্ড, হিরো এবং ফিয়াট সংস্থা। কৃষির পরে সব চেয়ে বেশি কর্ম সংস্থান হয়  দেশের বস্ত্র শিল্পে।পোশাক শিল্পের শ্রমিকদের প্রায় ৬৫ শতাংশই মহিলা। করোনা এবং লক ডাউনের ফলে এই শিল্পও এখন বন্ধ হবার মুখে। কিন্তু ভারত এর মত দেশে যেখানে প্রায় ৭০% মানুষ দারিদ্র্যসীমার নীচে বাস করে সেখানে হোম কোয়ারেন্টাইন করতে গেলে সরকারকে কিছু বিষয় মাথায় রাখা উচিত। পেটের টানই একমাত্র কারণ যার জন্য এরকম পরিস্থিতিতেও খেটে খাওয়া মানুষ বাইরে বেরোতে বাধ্য হবে। তাই এই পরিস্থিতিতে সেসব মানুষকে যাতে বাড়ি থেকে বেরোতে না হয় সে ব্যবস্থা করার দায়িত্ব সম্পূর্ণভাবে সরকারকেই নিতে হবে। এই ব্যবস্থা না করা হলে সবথেকে বেশি ক্ষতিগ্রস্থ হবে দিন আনা দিন খাওয়া মানুষগুলো। বিশেষজ্ঞদের মতে সরকার যদি অবিলম্বে বেকার ও কর্মচ্যুতদের জন্য ভাতা দেওয়া শুরু না করে এবং বিশেষত ক্ষুদ্র ও মাঝারি শিল্পগুলিকে বাঁচানোর জন্য প্যাকেজ ঘোষণা না করে তবে ভারত যদি করোনার প্রকোপ থেকে বেঁচেও যায় তার পর দেখা দেবে অনাহারজনিত মহামারি। এরকমই দেখা গেছিল ১৯১৮ সালের স্প্যানিশ ফ্লু- এর সময়তেও ,শুধু অনাহারেই বহু মানুষ মারা গেছিলো পঞ্জাব ও পার্শ্বস্থ রাজ্যগুলোতে । কারণ ব্রিটিশরা সমস্ত খাদ্যশস্য চালান করে দেয় ও খাদ্যসংকট দেখা দেয়। এখন এই একই কাজ করছে মজুতদাররা। দ্রব্যমূল্য বৃদ্ধি পাচ্ছে অস্বাভাবিক হারে।

এই লকডাউন গায়ে লাগবে না ব্যবসায়ীদের। কারণ তাদের রিটার্ন জমা দেওয়া ও ঋণ পাওয়ার সুবিধার কথা এরমধ্যেই জানিয়ে দিয়েছিলেন অর্থমন্ত্রী নির্মলা সীতারামন।গায়ে লাগবে না সরকারি চাকুরিজীবীদের। গায়ে লাগবে না, সেইসব আইটি বা আইটি নির্ভর পরিষেবা দেওয়ার সংস্থার কর্মীদের, যাদের ঘরে বসে কাজ করলেও চলে। গায়ে লাগবে তাদেরই, যাদের ওপর সব বোঝা চাপিয়ে নিশ্চিন্তে থাকা যায়। শ্রমজীবী। অথচ তাদের নামও মুখে আনলেন না প্রধানমন্ত্রী ও অর্থমন্ত্রী। নরেন্দ্র মোদির লকডাউনের ঘোষণায় স্বাস্থ্য পরিষেবার(করোনা চিকিৎসা)উন্নতিতে ১৫ হাজার কোটি টাকা বরাদ্দ করার ঘোষণা রয়েছে। কিন্তু এই সময়কালে যেসব শ্রমজীবীরা দৈনিক মজুরিতে কাজ করেন, তাদের কী হবে, তা নিয়ে কোনো ঘোষণা নেই। যেসব নিম্ন মধ্যবিত্ত ও মধ্যবিত্তরা ছোটো বেসরকারি সংস্থায় কাজ করেন, যে সব ছোটো দোকানদার নামমাত্র সঞ্চয় করেন, তারা কীভাবে নিত্য প্রয়োজনীয় দ্রব্য মজুত করবেন, সে সম্পর্কে কোনো বক্তব্য নেই। অথচ ইউনিসেফের হিসেব অনুযায়ী আমাদের দেশে ২০১৮ সালে ৯ লক্ষ শিশু অপুষ্টিতে মারা গেছে।বাজেটে স্বাস্থ্যক্ষেত্রে নামমাত্র বরাদ্দ, ১০০০০ জনসংখ্যায় ০.৯ টি হাসপাতাল বেডের দেশে করোনা সামাল দেওয়া অসম্ভব বুঝেই শ্রমজীবীদের নতুন করে বলি করল বড়লোকদের রাষ্ট্র। রাজ্যের মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় দারিদ্র্যসীমার নীচের মানুষের জন্য মাসিক ৫ লক্ষ চাল-গম বিনা পয়সায় দেওয়ার ব্যবস্থা করেছেন। অসংগঠিত ক্ষেত্রের শ্রমিকদের জন্য মাসিক ১০০০টাকা ভাতার ঘোষণাও করেছেন। কিন্তু ওই টাকায় যে সংসার চলে না, তা বোঝার জন্য অঙ্ক জানার দরকার পড়ে না।

করোনা কর: লকডাউনের সময় শ্রমজীবীদের ভাতা দেওয়ার উপায়

সরকারের নেতা, মন্ত্রী, অফিসারদের অজুহাত হল এত মানুষকে আর্থিক সাহায্য দেবার জন্য প্রচুর অর্থের প্রয়োজন এবং এত অর্থ সরকারের হাতে নেই। সরকারের চিরকেলে পদ্ধতিই হল বাজার থেকে বা বহুজাতিক ব্যাংক (বিশ্বব্যাংক, এডিবি প্রভৃতি) থেকে ঋণ নিয়ে অর্থের সমস্যা মেটানো। এর ফলে বিপুল পরিমাণে সুদ এবং অন্যান্য শর্ত সরকারের কাঁধে চাপে যা পরে জনগণের ওপর কর চাপিয়ে তোলা হয়। বিশেষজ্ঞদের মতে চড়া সুদে এবং জন বিরোধী শর্তে ঋণ না নিয়ে সরকারের উচিত দেশীয় কর্পোরেট ও বহুজাতিকদের ওপর ‘করোনা কর’ চাপিয়ে অর্থ সংগ্রহ করা । কিন্তু বড়লোকদের ওপর কর বসানোর নীতি নিয়ে তো মোদি সরকার চলছে না। অন্য কোনও সংসদীয় দলও বড়োলোকদের ওপর কর বসানোর দাবি করছে না। আমরা দেখাব কিভাবে কর্পোরেট সংস্থা এবং দেশের উচ্চ বেতনভুক কর্মচারীদের ওপর কর চাপিয়ে সরকার অনায়াসেই ছয় মাসের জন্য গরিব মানুষদের অন্ন-বস্ত্রের ব্যবস্থা করে তাঁদের আইসোলেশনে রাখা সম্ভব। সরকারি পরিসংখ্যান অনুযায়ী দেশে শ্রমিক- কর্মচারির সংখ্যা এখন প্রায় ৪০ কোটি। যদিও এদের সকলেই দিন মজুর শ্রেণিভুক্ত নন, অনেকেরই মাস মাইনে আছে। তবু যেহেতু এই ৪০ কোটি শ্রমিকের প্রায় ৯৩ শতাংশই অসংগঠিত ক্ষেত্রে কাজ করেন এবং এদের অধিকাংশই এক দিন কাজে না গেলে সেই দিনের বেতন পান না, অনেকেই দিন মজুর তাই আমরা ধরে নিচ্ছি যে আইসোলেশনে থাকা এই ৪০ কোটি মানুষকেই আর্থিক সাহায্য বা ভাতা দিতে হবে। প্রত্যেককে মাসে ১০,০০০ টাকা করে ভাতা দিলে প্রতি মাসে চার লক্ষ কোটি টাকার প্রয়োজন পড়বে। যদি ছয় মাসের জন্য এই ভাতা চালু রাখতে হয় তবে ২৪ লক্ষ কোটি টাকা প্রয়োজন হবে। প্রকৃতপক্ষে কিন্তু এর চেয়ে অনেক কম অর্থ প্রয়োজন হবে। যাদের মাস মাইনে রয়েছে বা যারা সবেতন ছুটি পাচ্ছেন, তাঁদের ভাতা দিতে হবে না। যাদের পে-কাট হয়েছে কিন্তু কিছু বেতন পাচ্ছেন, তাদের ভাতার পরিমাণ স্বাভাবিকভাবেই কম হবে। আর করোনাকে ছয় মাসের আগেই নিয়ন্ত্রণ করা সম্ভব হলে ছয় মাস ধরে ভাতা দেবার প্রয়োজন হবে না। তবু আমরা ধরে নিচ্ছি ২৪ লক্ষ কোটি টাকাই প্রয়োজন হবে।কোথা থেকে এত টাকা আসবে? দেশের মাত্র ১৫ টি বড় কোম্পানির ২০১৯ সালের নিট মুনাফার হিসেব নিয়েছি আমরা। এই মুনাফার পরিমাণ হল ৪ লক্ষ ৭৫ হাজার কোটি টাকা। প্রথম ৫০০ টি কোম্পানির নিট মুনাফা ১০০ লক্ষ কোটি টাকারও বেশি (সূত্রঃ ইটি ৫০০, ২০১৯ র‍্যাঙ্কিং)। মনে রাখতে হবে যে এই মুনাফা হল কোম্পানিগুলির অন্যান্য সমস্ত খরচ এবং কর দেবার পরে নিট মুনাফা। সরকার যদি এই মুনাফার ওপর ২৫ শতাংশ কর বসায়, তাহলেই প্রয়োজনীয় ২৪ লক্ষ কোটি টাকা উঠে আসবে। আর এই টাকা থেকে গরিব মানুষকে ভাতা দিলে তাদের আর ক্ষুধার জ্বালায় লক ডাউন ভেঙ্গে রোজগারের আশায় পথে নামতে হবে না। আইসোলেশন সফল হবে। ফলে করোনা সংক্রমণ ছড়াবে না।অনেকেই বলতে পারেন যে কোম্পানির মুনাফার ওপর এভাবে কর বসানো ন্যায় সংগত হবে না। আমাদের প্রশ্ন, সরকার যদি গরিব মানুষের রুটি রুজি বন্ধ করে তাদের ঘরে বসিয়ে দিতে পারে, তবে এই সংকটের সময়ে ধনী কোম্পানিগুলির ওপর কর বসাতে পারবে না কেন? তাছাড়া শ্রমিকদের শ্রমের ফলেই তো কোম্পানিগুলি মুনাফা করে। রিলায়েন্স ইন্ডাস্ট্রিজ গত বছর নিট মুনাফা করেছিল ৩৯,৫৮৮ কোটি টাকা। আইটিসি-র সংস্থাগুলি এ বছর প্রথম কোয়ার্টারেই মুনাফা করেছে ১২,০০০ কোটি টাকার বেশি। উইপ্রো’র মুনাফা ছিল ৯০০৩ কোটি। এশিয়ান পেইন্টসের ১৯,৬০৯ কোটি। হিন্দুস্তান ইউনিলিভারের ৩৯,৮৬০ কোটি। ইনফোসিসের ১৫,৪০৪ কোটি। অভাবনীয় এই দুর্যোগের সময় বিশাল মুনাফা করা এই কোম্পানিগুলির ওপর করা বসানো অন্যায় হবে কেন?করোনা মোকাবিলার জন্য কর বসিয়ে অর্থ সংগ্রহের আরও উৎস রয়েছে। আমাদের দেশে রয়েছেন বিভিন্ন উচ্চ বেতনভুক অফিসাররা যাঁদের ওপর করোনা-কর বসানো যেতেই পারে। ২০১৯ সালে টেক মহিন্দ্রর সিইও জিপি গুড়ানির বাৎসরিক বেতন ছিল ১৫০.৭ কোটি টাকা। হিরো মোটোকর্প-এর সিইও পবন মুঞ্জাল বেতন হিসাবে নিয়েছিলেন ৬০ কোটি টাকা। ইনফোসিস-এর বিশাল সিক্কা বেতন পেয়েছেন ৪৫ কোটি টাকা। টাটা গ্রুপের নটরাজন চন্দ্রশেখরণ পেয়েছিলেন ২৬ কোটি টাকা। ভারতে প্রায় ৯৭,০০০ উচ্চ বেতনভুক অফিসার রয়েছেন, ২০১৭-১৮ সালে যাঁদের বাৎসরিক আয় ছিল এক কোটি টাকা বা তার বেশি। (সুত্রঃ রিপোর্ট, সেন্ট্রাল বোর্ড অফ ডাইরেক্ট ট্যাক্সেস ২০১৯)। এই স্তরের অফিসারদের ওপরেও ২৫ শতাংশ হারে করোনা-কর বসানোই যায়। দেশের সিনেমা তারকারা বিশাল অর্থ রোজগার করেন। ২০১৮ সালে সালমান খানের আয় ছিল ২৫৩ কোটি টাকা। অক্ষয় কুমার আয় করেছিলেন ১৮৫ কোটি, আমির খান ৯৮ কোটি, অমিতাভ বচ্চন ৯৭ কোটি, শাহরুখ খান ৫৬ কোটি, রজনিকান্ত ৫০ কোটি। ক্রিকেটার বিরাট কোহলি আয় করেছিলেন ২২৮ কোটি টাকা, ধোনি ১০১ কোটি, শচিন তেন্ডুলকর ৮০ কোটি। (সুত্রঃ বিজনেস ইনসাইডার) এদের থেকেও কর নেওয়া যেতে পারে। দেশের ৪৭৫ জন সাংসদ কোটিপতি। বিজেপির ৩০৩ সাংসদের মধ্যে ২৬৫ জনই কোটিপতি। কংগ্রেসের ৫১ জনের মধ্যে ৪৩ জন কোটিপতি। পশ্চিমবঙ্গ থেকে নির্বাচিত ৪২ জন সাংসদের মধ্যে ৩১ জন কোটিপতি।  ‘গরিব দরদি’ এই সব রাজনীতিকরাই বা করোনা মোকাবিলার জন্য কর দেবেন না কেন? এই ভাবে সমস্ত উৎস থেকে করোনা-কর ওঠালে যে অর্থ সংগ্রহ করা যাবে, তা দিয়ে অনায়াসেই দেশের হাসপাতালগুলির পরিকাঠামো উন্নত করে আরও ভাল ভাবে করোনার চিকিৎসা করা সম্ভব হবে। আইসোলেশনে থাকা গরিব মানুষদের মুখেও ভাত তুলে দেওয়া যাবে। উপরের আলোচনা থেকে দেখা যাচ্ছে যে ধনীদের ওপর কর বসিয়ে ভারত সরকার অনায়াসে আরও ভাল ভাবে করোনা পরিস্থিতির মোকাবিলা করতে পারে। আইসোলেশনে থাকা অবস্থায় দিন মজুরদের আর্থিক সাহায্য দিতে পারে। কিন্তু তা না করে সরকার করোনা-আইসোলেশনের নামে গরিব মানুষের রুটি-রুজি বন্ধ করে তাঁদের অনাহারে রাখতে চাইছে। গরিব মানুষকে ভাতা না দিলে দেশে অনাহারে মৃত্যু বাড়বে। লক ডাউন বা আইসোলেশনও সম্ভব হবে না।

করোনা মোকাবিলা ও জনগণের ভূমিকা

এখনও পর্যন্ত আলোচনায় এটা পরিস্কার যে করোনা হল এই পুঁজিবাদী দুনিয়া দ্বারা সৃষ্ট বিপর্যয়।একথা শুধু আমরাই বলছিনা,একথা বলছেন বিশিষ্ট সমাজবিজ্ঞানী নাওমি ক্লেইন। তিনি গোটা ব্যাপারটাকে ‘ডিজাস্টার ক্যাপিটালিজম’ বা ‘দুর্যোগ পুঁজিবাদ’ আখ্যা দিয়ে দেখিয়েছেন কিভাবে এই মুনাফালোভী নিও-লিবারাল বাজার ব্যাবস্থা এভাবে বিপর্যয় সৃষ্টির মধ্যে দিয়ে কৃত্রিম সংকট তৈরি করে পণ্যের মূল্য বাড়িয়ে মুনাফা আরও বাড়িয়ে নেয়। একদিকে সাম্রাজ্যবাদী দেশগুলির অভ্যন্তরীণ দ্বন্দ্ব যখন তীব্র থেকে তীব্রতর হচ্ছে,অন্যদিকে তখন গোটা ইউরোপ,লাতিন আমেরিকা সহ ভারত জুড়ে বিক্ষুব্ধ শ্রমজীবী জনতা দখল নিয়েছে রাজপথের । সেইসময় বিশ্বপুঁজিবাদ বিরোধী আন্দোলনের ঝটিকাকেন্দ্রগুলিতে করোনা আতঙ্ক যেভাবে জনগণের সংগ্রামী ঐক্যে ফাটল ধরানোর চেষ্টা করছে তাতে এই করোনার পিছনে সাম্রাজ্যবাদের অনেক সুগভীর চক্রান্ত খুঁজে পাওয়া যাচ্ছে।

এখন পুঁজিবাদ সৃষ্ট এই বিপর্যয় মোকাবিলায় মানবজাতির সামনে দুটো রাস্তা খোলা-প্রথম পথটা হল জনগণের উপর আমলাতান্ত্রিক ফরমান জারি করে জনজীবনকে স্তব্ধ করে দিয়ে রাষ্ট্র হিসাবে নাগরিক পরিষেবায় নিজের যাবতীয় দায়কে ঝেড়ে ফেলা ও জনগণের ভবিষ্যৎকে কর্পোরেটের মুনাফার হাতে ছেড়ে দেওয়া আর দ্বিতীয় পথটি হল ব্যাপক জনগণকে সামিল করে গণ লাইনের নীতি দৃঢ়ভাবে আঁকড়ে ধরে গণচেতনার বিকাশ ঘটিয়ে এই মহামারিকে প্রতিরোধ করার। প্রথম রাস্তায় হাঁটতে গিয়ে ইতিমধ্যেই আমেরিকা,ইউরোপ কিংবা এদের বিশ্বস্ত মিত্র ভারতের সরকার করোনা মোকাবিলায় হাবুডুবু খাচ্ছে ।অন্যদিকে দ্বিতীয় রাস্তায় হেঁটে ইতিমধ্যেই চিন,কিউবা,ভিয়েতনাম নিজেদের দেশে যে শুধু করোনাকে রুখে দিয়েছে তাই নয়,পাশাপাশি করোনা মোকাবিলায় বিশ্বের বাকি দেশগুলির দিকেও সাহায্যের হাত বাড়িয়ে দিয়েছে। এটা সম্ভব হওয়ার পিছনে রয়েছে দুটো কারণঃ প্রথমত একসময় সমাজতান্ত্রিক হওয়ার দরুণ দেশগুলিতে শিক্ষা,স্বাস্থ্যের মত মৌলিক পরিকাঠামো যথেষ্ট পরিকল্পিত এবং দ্বিতীয়ত একটা সমাজতান্ত্রিক বিপ্লব পার করে আসার দরুণ এখানকার জনগণের চেতনার মানও যথেষ্ট এগিয়ে। প্রথম পথের ব্যর্থতা আরও বোঝা যায় যখন ইতালিতে তোমাদের ‘মুনাফার থেকেও আমাদের জীবন অনেক দামি’ এই দাবিতে শ্রমিকরা ধর্মঘট ডাকে।

 আমাদের দেশের অবস্থা বিচার করলে মুলতঃ তিনটে জিনিস বেড়িয়ে আসছে-

  • প্রথমতঃ ভারতের অর্থনীতির এমনিই যা বেহাল দশা চলছিল তাতে ভারতের শাসকশ্রেণিকে হয়ত অর্থনৈতিক জরুরি অবস্থা ঘোষণা করতেই হত। সেক্ষেত্রে করোনাকে উপলক্ষ করে লকডাউনের নামে জনজীবনে রাষ্ট্রীয় নিয়ন্ত্রণ সংক্রান্ত অতিসক্রিয়তা কিন্তু সেই অশুভ ইঙ্গিতই বহন করছে।
  • দ্বিতীয়তঃ রাষ্ট্র এই আসন্ন করোনা বিপদের সামনে ল্যাজ গুটিয়ে যেভাবে নিজের সমস্ত দায়ভার জনগণের ঘাড়ে চাপিয়ে দিয়েছে তাতে মনে হয়  রাষ্ট্র তার জনকল্যাণকামী চেহারার কফিনের শেষ পেরেকটা এভাবেই পুঁতছে।
  • তৃতীয়তঃ এই  অর্থনৈতিক বিপর্যয় এক শ্রেণির কালোবাজারি,মজুতদার এবং কর্পোরেট স্বাস্থ্য ব্যাবসায়ীদের সামনে এক বিপুল মুনাফার দরজা খুলে দিচ্ছে।

আসলে সমস্যা অনেক গভীরে আছে।  ভারতবর্ষের কাঠামোটাই এভাবে গঠিত হয়েছে। ১১৭৬ বঙ্গাব্দে বা ১৭৭০ সালে  ছিয়াত্তরের মন্বন্তরের প্রেক্ষাপট দেখা যাক। পলাসির যুদ্ধে জয়ের পরেও এই ভৌগোলিক অঞ্চলের সংগ্রামী শ্রমজীবী মানুষদের ভয়ে ব্রিটিশদের সাহস ছিল না গোটা বঙ্গবিহারে লুঠ করতে ঝাপিয়ে পড়ার। তারপরেও তারা  কিভাবে বাঙলাকে কেন্দ্র করে গোটা ভারতে দখল জমাতে পারলো? তারা এই ভারতেরই তৎকালীন মধ্যশ্রেণি এবং জমিদারদের  কাজে লাগালো। জমিদারদের কাছ থেকে রাজস্ব আদায়ের নামে তারা কিছু ক্ষমতা তাদের হাতে দিল। ‘তালুকদার’, ‘গাঁতিদার’ প্রভৃতি উচ্চস্বত্তভোগী তৈরি করলো তারা যারা অত্যাচার করে খাজনা আদায়ের মতলব আঁটবে আর লুঠ করবে। ‘নাজিম’ নামে খাজনা লুঠের দস্যু তৈরি করলো। এর আগে ব্যাক্তি মাফিক খাজনা আদায় হতো না এবং ফসল ইত্যাদি হতো খাজনা। ব্রিটিশরা প্রথম ব্যাক্তি ধরে খাজনা আদায় আর ফসলের পরিবর্তে মুদ্রা দিয়ে খাজনার প্রচলন করে। তারা গ্রামের চাষিদের বাধ্য করে তাদের মজুদ খাদ্য পর্যন্ত বিক্রি করে দিতে। এবং ১৭৬৯ সালে তারা সকল খাদ্য মজুত রাখে এবং ১৭৭০ সালে চড়া দামে ছাড়ে। তারপর নেমে আসে ভয়ঙ্কর দুর্ভিক্ষ।  বঙ্গবিহারের আনুমানিক এক-তৃতীয়াংশ জনসংখ্যা কমে যায় এই দুর্ভিক্ষের পরে। তার পরেও নির্লজ্জ ওয়ারেন হেস্টিংস জানায়, “তাতেও আমাদের খাজনা আদায় কম হয়নি।” বাংলা বিহারের দরিদ্র কৃষকের রক্ত সেদিন শুধু বিদেশিরা নয় সাথে ছিল দেশীয় জমিদার এবং এই মধ্যশ্রেণি যারা ব্রিটিশদের আসার আগে রাজপ্রাসাদে রাজাদের ভোগবিলাসের জিনিস পাঠাতো, তারাই ব্রিটিশরা আসার পরে তাদের সঙ্গী হয়ে দেশের সম্পত্তি লুঠে এবং দেশের গরিব মানুষ নিধনে  ব্রিটিশদের প্রিয় সঙ্গী ছিল।তারাই এখন আমাদের দেশের বৃহৎ পুঁজিপতি। আজও বিদেশী লুঠেরা পুঁজিপতিদের স্বার্থই তাদের স্বার্থ। এবং তাদের সম্মিলিত স্বার্থ দেশভাগ থেকে আজ NRC, ধর্মযুদ্ধ থেকে ভারত-পাক যুদ্ধ। এই জমিদারশ্রেণি যারা দেশের মাত্র ৪.২% তাদের হাতে এখনও দেশের ৩২% কৃষি জমি।  এখনও  প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদী শেষ বাজেটে এদের কয়েক লক্ষ কোটি টাকা ভর্তুকি দিয়েছে অথচ কোরোনা থামাতে দেওয়া টাকার থেকে বল্লভভাই প্যাটেলের মূর্তি গড়তে বেশি টাকা লেগেছে। এমনকি বিজেপির শেষ লোকসভা ভোটে প্রচারও তার থেকে বেশি টাকায় হয়েছে। আর কেনই বা হবে না? টাটা নিজে ৭৫% ফান্ড দিয়েছে বিজেপির তহবিলের তাদের ক্ষমতায় আনার জন্য। এদের পূর্বসূরি জামশেদজি টাটা দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সময় “ভারত মাতা” – র বুক চিড়ে দেশের প্রাকৃতিক সম্পদ বের করে এনেছে ব্রিটিশদের যুদ্ধের সময় অস্ত্র তৈরির জন্য। আয়রনি দেখুন- গান্ধী যিনি যেকোন আপসহীন লড়াইয়ের বিরোধী ছিলেন এবং আবেদন-নিবেদনের নীতিতে বিশ্বাসী ছিলেন তার শেষ জীবনে আশ্রয় ছিল বিড়লা হাউস অথচ তাকে হত্যা করার পরে RSS নিষিদ্ধ হলে সেই নিষিদ্ধতা তুলে নেওয়ার জন্য আর এক হিন্দুত্ববাদী জওহরলাল নেহেরুর কাছে মিডিয়েট করেন এই জে.ডি. বিড়লাই। এইসবের মধ্যে আর যারা আজও আমাদের দেশের মানুষের শত্রুর ভূমিকা নিচ্ছে তারা হল কিছু সাম্রাজ্যবাদের উচ্ছিষ্টভোগী বুদ্ধিজীবী যারা হয় NRC সমর্থন করছে অথবা সমর্থন না করলেও মানুষকেই বলছে ভিড় থেকে সরে যেতে ক্ষমতাকে বলছে না NRC তুলে নিতে, তারা আজও লক ডাউন সমর্থন করছে অথচ শ্রমজীবী মানুষের রোজগার-খাবার এবং  তাদের উপর পুলিসী বর্বরতা নিয়ে চুপ করে আছে। এর কারণ কি? মেকলে যখন ভারতে শিক্ষাব্যবস্থা প্রচলন করেছিলেন তখন তাদের উদ্দেশ্যই ছিল এমন এক শিক্ষিত মধ্যবিত্ত তৈরি করা যারা ব্রিটিশরা ভারতের মঙ্গলের জন্য ভারতে এসেছে এটা বিশ্বাস করবে এবং প্রচার করবে। ফলও তারা পায়। ব্রিটিশরা মেহনতি মানুষদের উপর নিষ্ঠুর লুঠ চালানোর পর তারা যখন একে একে সন্ন্যাসী বিদ্রোহ, গাড়ো বিদ্রোহ থেকে পরবর্তীতে তেভাগা, তেলেঙ্গানা, নকশালবাড়ির আন্দোলন চালিয়ে যায় প্রতিবার এরা তথাকথিত অহিংসতা আর সনাতনপ্রেমের উন্মত্ততা আঁকড়ে শ্রমজীবী মানুষকে দোষারোপ করেছে। এই আন্দোলনের বিরোধিতা করেছে। অহিংসতার নমুনা হল লেখার শুরুতে ভারতে আত্মহত্যা করা মানুষের পরিসংখ্যান। অহিংসতা মানে হল শ্রমজীবীর উপর হিংসা কিন্তু ক্ষমতার উপর অহিংসা এবং গোলাপ ফুল।

তথ্যসূত্র

১। পিপলস ম্যাগাজিন

২। পিপলস মিডিয়া

৩। পিপলস ডেইলী চায়না

৪। গ্রাউন্ডজিরো

৫। দ্য ওয়্যার

৬। দ্য উইক

৭। ডক্টরস ডায়ালগ

৮। বিজ্ঞ্যান ডট কম

৯। আরুষ

১০। বিজনেস স্ট্যান্ডার্ড

১১। Towards a New Dawn

RSF এর পক্ষ থেকে এই প্রবন্ধটি যৌথভাবে লিখেছেন –

নির্বাণ, সৌম্যদীপ, জুলেখা, অঙ্কন, অভিনব এবং ইন্দ্র

Share Now:

LEAVE YOUR COMMENT

Your email address will not be published. Required fields are marked *