গণতন্ত্রকে ধ্বংস করতে করোনাকে কাজে লাগাতে পারে কর্তৃত্ববাদী শাসকরা, সতর্কতা জরুরি
পিপলস ম্যাগাজিন ডেস্ক: আমেরিকার যুদ্ধবাজ শাসকরা বহুদিন ধরেই চাইছেন মেক্সিকো সীমান্তে নিয়ন্ত্রণ বাড়াতে। করোনা ভাইরাস তাদের সেই সুযোগ করে দিয়েছে। তারা বারবার বলছেন, সীমান্ত আকেই নাকি ঠেকা যাবে করোনা অতিমারিকে। অন্যদিকে ইজরায়েল ও সিঙ্গাপুরের শাসকরা করো না ঠেকাতে জনগণের মোবাইল ফোনে আড়ি পাতছেন.
সর্বদা জনগণকে নিয়ন্ত্রণে আগ্রহী ইরানের শাসকরা এই সুযোগে গোটা দেশে সেনাবাহিনী নামিয়ে প্রতিটি অলিগলি ফাঁকা করে দিচ্ছেন। অন্যদিকে অভিবাসী বিরোধী আন্দোলন করে উঠে আসে এক দক্ষিণপন্থী রাজনৈতিক নেতা বলে চলেছেন, অভিবাসীদের সঙ্গে করোনা ভাইরাসের ছড়িয়ে যাওয়ার নাকি ‘স্পষ্ট সম্পর্ক’ রয়েছে।
আধুনিক যুগ্রে সবচেয়ে বিধ্বংসী অতিমারিকে নিয়ন্ত্রণ করতে জুনিয়া জুড়ে জনস্বাস্থ্য আধিকারিক, চিকিৎসক ও স্থানীয় রাজনৈতিক নেতা উদয়াস্ত পরিশ্রম করছেন।
কিন্তু কর্তত্ববাদী জাতীয় নেতারা এই সুযোগে এমন কিছু পদক্ষেপ করছেন, যা তারা বহুদিন ধরে চেয়েও করে উঠতে পারছিলেন না। আর সেটা করতে গিয়ে মানুষের প্রাণকেও তারা গুরুত্ব দিচ্ছেন না।
করোনা ভাইরাস গোটা দুনিয়ার স্বাস্থ্য ব্যবস্থাকে সমস্যায় ফেলে দিয়েছে, অর্থনীতিও গভীর সংকটে। ধস নেমেছে শেয়ার বাজারে, শ্রমিকরা দলে দলে কর্মহীন হচ্ছেন। কিন্তু বিশেষজ্ঞরা বলছেন, এ সবের পাশাপাশি এই অতিমারি রাজনীতির চেহারাও পালটে দিতে পারে। বিভিন্ন দেশে এই সুযোগ কাজে লাগিয়ে কর্তৃত্ববাদী শাসকরা গণতন্ত্রের কণ্ঠরোধ করে নিজেদের ক্ষমতা আরও বাড়িয়ে নিতে পারে।
সম্প্রতি রাষ্ট্রপুঞ্জের একদল বিশেষজ্ঞ এ বিষয়ে একটি সতর্কবার্তাও জারি করেছেন। তাঁরা বলেছেন, “আমরা মানছি, বর্তমান পরিস্থিতিতে জরুরি অবস্থার মতো ক্ষমতা প্রয়োগ আন্তর্জাতিক আইনসম্মত, পাশাপাশি আমরা এটাও বলতে চাই, তা যেন যথাযথ, যতটুকু দরকার ততটুকুই এবং কারও প্রতি বৈষম্যমূলক না হয়”। “কোভিড-১৯ ছড়িয়ে পড়ার ফলে যে জরুরি অবস্থা বহু দেশে জারি করতে হয়েছে, তা যেন কোনো রাজনৈতিক গোষ্ঠী, সংখ্যালঘু ও ব্যক্তির বিরুদ্ধে কাজে লাগানো না হয়”, বলছেন রাষ্ট্রপুঞ্জের মানবাধিকার ও গণতান্ত্রিক স্বাধীনতা বিষয় এই বিশেষজ্ঞ দল। “স্বাস্থ্যরক্ষার আবরণ দিয়ে একে যেন অন্য কোনো কাজে ব্যবহার না করা হয়, মানবাধিকার কর্মীদের কণ্ঠরোধও যেন না করা হয়”, বলা হয়েছে ওই বিবৃতিতে।
ইতিমধ্যেই দেখা যআচ্ছে সরকারগুলি এই অতিমারিকে নিজেদের কাজে লাগাচ্ছে। ইরাক, আলজিরিয়া, লেবাননে দীর্ঘদিন ধরে আন্দোলন চলছিল, সেগুলি শাসকদের সমস্যাতেও ফেলেছিল, এই সুযোগে সেগুলিকে বন্ধ করা হয়েছে।
তুরস্কের রক্ষণশীল ইসলামপন্থী শাসকরা করোনা না ছড়াতে দেওয়ার জন্য বার, নাইট ক্লাব, গ্রন্থাগার বন্ধ করে দিয়েছে অথচ শপিং মল, দোকান, রেস্তোরাঁগুলি খুলে রেখেছে।
ভারতে দেশজোড়া লকডাউন চালু হওয়ার পরের দিনই শাহিনবাগের ধরনামঞ্চ বুলডোজার দিয়ে ভেঙে দেওয়া হয়েছে। জামিয়া মিলিয়ার দেওয়ালের গ্রাফিত্তি সম্পূর্ণ অপ্রয়োজনীয় ভাবে মুছে দেওয়া হয়েছে। সব মিলিয়ে গত ডিসেম্বর থেকে চলতে থারা এনআরসি-সিএএ বিরোধী আন্দোলনকে স্তব্ধ করার জন্য করোনা-পরিস্থিতিকে মোদি সরকার কাজে লাগাচ্ছে।
ইজরায়েলের বেঞ্জামিন নেতানিয়াহু এবং রোমানিয়ার দক্ষিণপন্থী লুদোভিক অরব্যানের মতো যেসব শাসক দেশে বেশ সমস্যার মধ্যে ছিলেন, সাময়িক ভাবে তারা তার থেকে মুক্ত হয়ে গেছেন।
রোমানিয়ার এক সাংসদ বলেছেন, “ এ যেন এমন একটা নির্বাচন, যাতে বিরোধীরা প্রচারই করার সুযোগ পায়নি। শাসকরা এমনি এমনি জিতে গেছে”।
নেতানিয়াহুর বিরুদ্ধে চলা দুর্নীতি মামলায় তাঁর সম্প্রতি আদালতে যাওয়ার কথা ছিল। কিন্তু বহু মানুষের জড়ো ঙওয়া আটকাতে মামলাগুলি দুমাস পিছিয়ে দেওয়া হয়েছে।
নেতানিয়াহুর বিরোধীদের নতুন সরকার গড়ার সুযোগ দেওয়া হলেও এই সুযোগে নেতানিয়াহু সারাক্ষণ টিভি, সংবাদপত্র জুড়ে থাকছেন। প্যালেস্থাইনের সংগ্রামীদের চিহ্নিত করার জন্য তৈরি প্রযুক্তিকে কাজে লাগানো হচ্ছে করোনা আক্রান্ত রোগীদের মোবাইল ফোন ট্যাপ করতে। তারা কাদের সঙ্গে কথা বলছেন, সেটা নাকি করোনা প্রতিরোধে খুব জরুরি তথ্য।
সংবাদমাধ্যমের স্বাধীনতায় হস্তক্ষেপ করছে বেশ কিছু দেশ। সরকারি তথ্যের সত্যতা নিয়ে কেউ প্রশ্ন করলে, তাদের ভুয়ো সংবাদ পরিবেশনকারী বলে দাগিয়ে দেওয়া হচ্ছে। সম্প্রতি এই কারণে গার্ডিয়ানের কায়রো সংবাদদাতাকে সাংবাদিকতা করার অধিকার কেড়ে নেওয়া হয়েছে।
জর্ডনের সম্রাট সম্প্রতি সবকটি ছাপা সংবাদপত্র বন্ধ করে দিয়েছেন। শহরে ঢোকার সবকটি জায়গায় সেনা মোতায়েন করা হয়েছে।
করোনাভাইরাস প্রতিরোধের কারণ দেখিয়ে বেশ কিছু দেশে জেলবন্দিদের সঙ্গে পরিবারের দেখা করা বন্ধ করে দেওয়া হয়েছে।
এই প্রসঙ্গে বলা যেতে পারে, কর্তৃত্ববাদী শাসকদের দেশগুলি বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই দেশে করোনা আক্রান্তের সংখ্যা কমিয়ে দেখালেও দু-একটি ক্ষেত্রে করোনা প্রতিরোধে ভালো ভূমিকা রেখেছে। যেমন সিঙ্গাপুর ও মরক্কো। বিশেষত মরক্কোর মতো গরিব দেশে এই সমস্যা সামলানো বেশ কঠিন ছিল। বিশেষত ফ্রান্স ও স্পেনের মতো দুটি করোনা-বিধ্বস্ত দেশের সঙ্গে তাদের অত্যন্ত ঘনিষ্ঠ সম্পর্ক। কিন্তু রাজতন্ত্রের প্রতি জনগণের আনুগত্যকে কাজে লাগিয়ে সেদেশে করোনাকে বাগে আনতে অনেকটাই সফল হয়েছেন, সেখানকার একনায়করা।
এটা ঠিক যে গণতন্ত্র না থাকায় সদিচ্ছা থাকলে একনায়করা অনেকসময় জনগণের স্বার্থে কার্যকর ভূমিকা দৃঢ় ভাবে নিতে পারে। কিন্তু বেশিরভাগ ক্ষেত্রএই উলটোটা হয়। আমেরিকার কথাই ধরা যাক, করোনা পরিস্থিতিকে কাজে লাগিয়ে ট্রাম্প হোয়াইট হাউজে নিজের বন্ধুদের একের পর এক নিয়োগ করছেন, যাদের অভিজ্ঞতা ও প্রশাসক হিসেবে দক্ষতা বলার মতো নয়। এসবই ক্ষমতা কেন্দ্রীভূত করার লক্ষণ। করোনার জন্য মার্কিনদের ইউরোপ ভ্রমণ বন্ধ রাখলেও ট্রাম্প ইউকে-র ক্ষেত্রে ছাড় দিয়েছিলেন বন্ধু বরিস জনসনের স্বার্থে।
১৯৩৩ সালে হিটলার জার্মানিতে রাইখস্ট্যাগের মতো ঘটনা ঘটিয়েছিলেন এবং স্থায়ী ভাবে ক্ষমতা দখলের পথে গেছিলেন। করোনাকে কাজে লাগিয়ে এ যুগ্রে একনায়করাও সেরকম করবেন না, এমন কথা বলা যায় না।
যেমন ধরা যাক ফিলিপিনস। সেখানকার দক্ষিণপন্থী শাসক রদ্রিগো দুয়ের্তে ‘দুর্যোগপূর্ণ’ পরিস্থিতির নাম করে ছ মাসের জন্য নাগরিকদের স্বাধীন ভাবে চলাফেরা এবং জড়ো হওয়ার অধিকার কেড়ে নিয়েছেন। পৃথিবীর আর কোনো দেশে জনজীবনকে এতদিনের জন্য ব্যহত করার সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়নি।
রাজনৈতিক বিশেষজ্ঞদের মতে, সংকটে যেমন জনগণ এক হয়ে আন্দোলনের পথে হাঁটেন, একনায়করাও তেমনই সংকটকে কাজে লাগিয়ে তাঁদের লুকনো ইচ্ছাগুলো পূর্ণ করতে চায়।
সব মিলিয়ে বর্তমান পরিস্থিতি ফ্যাসিবাদের পথ আরও সুগম করে দিতে পারে। গণতান্ত্রিক ও জনদরদি শক্তিগুলির করোনা প্রচারে ভেসে না গিয়ে এ দিকটিতে সতর্ক নজর রাখা প্রয়োজন।