ভারতের বড়োলোকরা গরিবদের মধ্যে করোনা ছড়াচ্ছেন কিন্তু এক পয়সাও খরচ করছেন না
‘থালি, তালি আর ঘন্টি’ দিয়ে ভারতের প্রধানমন্ত্রী জনসেবকদের কৃতজ্ঞতা জানানোর আহ্বান জানানোর পর ভারতের উচ্চ মধ্যবিত্ত শ্রেণির সে কি উল্লাস! যাদের ছাড়া আজকাল কোনো কিছুই সম্পূর্ণ হয় না, সেইসব সেলিব্রিটিরাও প্রধানমন্ত্রীর এই আহ্বানকে সাধুবাদ জানালেন। কমল হাসান, সোনু নিগম, রজনীকান্ত- বাদ যাননি কেউই। পরে টিকটক ভিডিও পোস্ট করে সেইসব উচ্চ মধ্যবিত্তরা দেখালেন, তারা তাদের আকাশছোঁয়া বহুতলের ছাদ বা ব্যলকনি থেকে কতটা মন দিয়ে শাঁখ, থালা, ঘণ্টা ইত্যাদি বাজিয়েছেন। এমনকি বাজিও ফাটিয়েছেন।
আরও পড়ুন: করোনা লক ডাউন: অভূতপুর্ব কর্মহীনতার মুখোমুখি ভারত
সাধারণ মানুষ অবশ্য ওইসব এলিটিজমকে পাত্তা দেননি। অসচেতনতার চূড়ান্ত নজির দেখিয়ে তারা প্রধানমন্ত্রীর আহ্বানে সাড়া দিয়েছেন।দল বেঁধে কাঁসর ঘণ্টা, বাসন, খোল করতাল নিয়ে রাস্তায় বেরিয়ে করোনা উৎসব পালন করেছেন।
বিদেশ থেকে আসা উপহার
তাদের এই অসচেতনতা এবং উদাসীনতা চমকপ্রদ কিছু নয়। কারণ দেশের এলিট এবং মধ্যবিত্তরাই বিদেশ থেকে করোনাভাইরাস নিয়ে আসছেন। দেশের প্রথম ঘটনাটার কথাই মনে করুন। কেরলের যে ব্যক্তির দেহে প্রথম এই ভাইরাসের অস্তিত্ব ধরা পড়ে, তিনি চিনের উহান প্রদেশ থেকে দেশে ফেরেন। যেখান থেকে কোভিড-১৯-এর জন্ম। তারপর বলিউডের গায়িকা কনিকা কাপুর। তিনি ইউকে থেকে দেশে ফেরেন, লখনউ বিমানবন্দরের পরীক্ষা এড়িয়ে একের পর এক অনুষ্ঠান ও পার্টি করেন। সেখানে রাজনৈতিক নেতা থেকে সমাজের গণ্যমান্য ব্যক্তিরা উপস্থিত ছিলেন।
উত্তর প্রদেশ পুলিশ কনিকার বিরুদ্ধে এফআইআর করলেও, যে সব রাজনৈতিক নেতারা ‘সামাজিক দূরত্ব’ রক্ষার দায়িত্ব না মেনে সেইসব অনুষ্ঠানে হাজির হয়েছিলেন, তারা দিব্যি আছেন।
ভারত সরকারের কথাই ধরা যাক। করোনা মহামারির ছড়িয়ে পড়ার দুমাস পরেও মোদি্ সরকার মার্কিন প্রেসিডেন্ট ট্রাম্পের ভারত সফর বাতিল করেনি। ট্রাম্প ভারতের তিনটি শহরে ঘুরেছেন। তার একটি অনুষ্ঠানে ১ লক্ষেরও বেশি লোক ছিল। সেখানে গরিবদের বস্তি যাতে ট্রাম্প দেখতে না পান, তার জন্য গুজরাত সরকার একটি পাঁচিলও বানায়।
ভারতের এলিটরা পার্টি বন্ধ করেননি, বিদেশ থেকে করোনা নিয়ে আসাও থামাননি। যে সব মন্ত্রীসান্ত্রীরা কনিকা কাপুরের অনুষ্ঠানে গিয়েছিলেন, তারা পরে নিজেদের গৃহবন্দি করেছেন। তাদের মধ্যে দুজন- রাজস্থানের প্রাক্তন মুখ্যমন্ত্রী বসুন্ধরা রাজে এবং তার ছেলে দুষ্যন্ত সিং(তিনি আবার প্রেসিডেন্ট কোভিন্দের সঙ্গে দেখা করেন, সংসদেও যান)-এর করোনা পরীক্ষা হয় এবং একদিনের মধ্যে নেতিবাচক রিপোর্ট আসে। সাধারণ মানুষকে অবশ্য করোনা পরীক্ষা করতে অনেক যোগ্যতার প্রমাণ দিতে হচ্ছে, রিপোর্ট আসতে ৫-৭ দিন সময়ও লাগছে।
গরিবদের সঙ্গে ভাগ-বাটোয়ারা
ভারতের এলিটরা শুধু য়ে করোনাভাইরাস বিদেশ থেকে নিয়ে আসছেন, তাই নয়, তারা তা গরিব ও শ্রমজীবী মানুষের মধ্যে ছড়িয়েও দিচ্ছেন। ভারতে সবচেয়ে বেশি করোনা আক্রান্তের সংখ্যা মহারাষ্ট্রে। অথচ সেখানে প্রথম কোনো শ্রমজীবীর করোনা আক্রান্ত হওয়ার ঘটনা ঘটেছে গত বৃহস্পতিবার। এক গৃহ পরিচারিকা। তার নিয়োগকর্তা সম্প্রতি আমেরিকা থেকে করোনা নিয়ে ফিরেছিলেন।
কলকাতায় এক ব্যবসায়ীপুত্র ইংল্যান্ড থেকে করোনা নিয়ে ফিরে তিনদিন শহরে দিব্যি ঘুরে বেড়ান। পরে দেখা যায় তার সঙ্গে তার বাবা-মা এবং গৃহ পরিচারিকাও করোনা-আক্রান্ত।
এখন পয়সার ব্যাগ কেউ বের করেননি
চিনের বিলিওনেয়ার জ্যাক মা লক্ষ লক্ষ মুখোশ ও টেস্টিং কিট আফ্রিকা ও এশিয়ার বিভিন্ন দেশে পাঠাচ্ছেন। বিল গেটস ১০০ মিলিয়ন ডলার সাহায্য করেছেন ফেব্রুয়ারিতেই। পপস্টার রিহানা ৫ মিলিয়ন ডলার দেবেন বলেছেন। আরও অনেকেই বহু সাহায্যের কথা ঘোষণা করেছেন। কিন্তু রা কাড়ছেন না কোনো ভারতীয় ধনী। তারা ব্যালকনিতে উঠে হাততালি আর প্রধানমন্ত্রী মোদিকে কৃতজ্ঞতা জানিয়েই সন্তুষ্ট।
প্রবল জাতীয়তাবাদী অক্ষয় কুমার বা অনুপম খের, বামেদের প্রিয় অনুরাগ কাশ্যপ বা স্বরা ভাস্কর অথবা সবার স্টার অমিতাভ বচ্চন- কাউকেই এখনও কোনো ঘোষণা করতে দেখা য়ায়নি। আমাবানি বা আদানির মতো বিলিওনেয়াররাও এসব নিয়ে এখন মাথা ঘামাচ্ছেন না। মাহিন্দ্রা গোষ্ঠীর প্রধান আনন্দ মাহিন্দ্রা শুধু মুখ খুলেছেন। তিনি নিজের বসার আবছরের বেতন দান করেছেন, মাহিন্দ্রা রিসর্টগুলিকে কেয়ার সেন্টার হিসেবে কাজে লাগাতে দিয়েছেন এবং ভেন্টিলেটর বানানোর সিদ্ধান্ত নিয়েছেন।
বোঝাই য়াচ্ছে, ভারতের ওপর তলার লোকজন সমাজবিজ্ঞানের নিয়ম মেনেই নিজেদের সঙ্গে শ্রমজীবীদেরও ডোবানোর পণ করে বসে আছেন।
দ্য প্রিন্ট ডট ইনে প্রকাশিত জ্যোতি যাদবের নিবন্ধের পরিমার্জিত অনুবাদ