Home জনস্বাস্থ্য শ্রমজীবীদের সুরক্ষা না দিয়ে লকডাউনের পথে হাঁটলে করোনার পর আসবে অনাহারজনিত মহামারি

শ্রমজীবীদের সুরক্ষা না দিয়ে লকডাউনের পথে হাঁটলে করোনার পর আসবে অনাহারজনিত মহামারি

শ্রমজীবীদের সুরক্ষা না দিয়ে লকডাউনের পথে হাঁটলে করোনার পর আসবে অনাহারজনিত মহামারি
0
জুলেখা পারভিন

‘জনতা কার্ফু ‘ শব্দ টা নিয়ে গত দুদিন ধরে অনেক আলোচনা মতামত শুনছি। করোনা মোকাবিলায় প্রধানমন্ত্রী র এই ঘোষণা অনেকেরই মনে ধরেছে। যুক্তি দেওয়া হচ্ছে যে করোনা ভাইরাস যেহেতু ১২ ঘণ্টার বেশি বাঁচে না তাই ১৪ ঘণ্টার কার্ফু জারি করে সংক্রমণ রোধ করা সম্ভব। কিন্তু বিভিন্ন গবেষণাতে দেখা গেছে যে covid -19 স্টেনলেস স্টিলের ওপর ৭২ ঘণ্টা (WHO), কার্ডবোর্ড এর উপর প্রায় ২৪ ঘণ্টা পর্যন্ত বেঁচে থাকতে পারে। যদি তর্কের খাতিরে ধরে নেওয়া হই যে কার্ফু জারির জন্য বহিঃস্থ  সংক্রমণ রোধ করা সম্ভব কিন্তু যারা এরমধ্যেই সংক্রমিত অথচ এখনো কোনো লক্ষণ প্রকাশ পায়নি সেরকম মানুষের সংখ্যা নেহাত কম বলে মনে করা বোকামি হবে(যারা রাস্তাঘাটে কোনোভাবে আক্রান্ত দের সংস্পর্শে এসেছে)। এই পরিস্থিতিতে শুধুমাত্র ১৪ ঘণ্টার কারফিউতে কি এই রোগ শৃঙ্খল ভেঙে দেওয়া সম্ভব? ১৪ ঘণ্টা পেরিয়ে গেলেই  তারা বাইরে বেরোবে আর অন্যদেরও নিজের অজান্তেই সংক্রমিত করবে। তাই যদি কেউ ভেবে বসেন যে ১৪ ঘণ্টা র কারফিউতে গেলেই সব পরিস্থিতি স্বাভাবিক হয়ে যাবে তা বিশাল ভুল হবে। এইরকম একটি অবৈজ্ঞানিক ধারণা অনেক জায়গায় ছড়িয়ে দেওয়া হচ্ছে। 

আরও পড়ুন: প্রধানমন্ত্রীর ‘জনতা কারফিউ’-এর নিদান শ্রমজীবী বিরোধী: জনস্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞ ডাঃ আনোয়ার হোসেন

 একথা সত্যি যে  এরকম ভয়ঙ্কর পরিস্থিতিকে নিয়ন্ত্রণ করার একমাত্র উপায় হচ্ছে হোম কোয়ারেন্টাইন , সোজাসুজি বলতে গেলে আমাদের দেশকে পুরোপুরি লক ডাউন করতে হবে। কিন্তু ভারত এর মত দেশে যেখানে প্রাই ৭০% মানুষ দারিদ্র্যসীমার নীচে বাস করে সেখানে হোম কোয়ারেন্টাইন করতে গেলে সরকারকে কিছু বিষয় মাথায় রাখা উচিত। পেটের টানই একমাত্র কারণ যার জন্য এরকম পরিস্থিতিতেও খেটে খাওয়া মানুষ বাইরে বেরোতে বাধ্য হবে।তাই এই পরিস্থিতিতে সেসব মানুষকে যাতে বাড়ি থেকে বেরোতে না হয় সে ব্যবস্থা করার দায়িত্ব সম্পূর্ণভাবে সরকারকেই নিতে হবে। এই ব্যবস্থা না করা হলে সবথেকে বেশি ক্ষতিগ্রস্থ হবে দিন আনা দিন খাওয়া মানুষগুলো। যদি করোনার প্রকোপ থেকে বেঁচেও যায় তার পর দেখা দেবে অনাহারজনিত মহামারি। এরকমই দেখা গেছিল ১৯১৮ সালের স্প্যানিশ ফ্লু- এর সময়তেও ,শুধু অনাহারেই বহু মানুষ মারা গেছিলো পঞ্জাব ও পার্শ্বস্থ রাজ্যগুলোতে । কারণ ব্রিটিশরা সমস্ত খাদ্যশস্য চালান করে দেয় ও খাদ্যসংকট দেখা দেয়। এখন এই একই কাজ করছে মজুতদাররা। দ্রব্যমূল্য বৃদ্ধি পাচ্ছে অস্বাভাবিক হারে। ইতিমধ্যে এই সংকটের সময় অতি প্রয়োজনীয় অ্যালকোহলযুক্ত স্যানিটাইজার এবং মাস্কের ক্ষেত্রে এ ছবি দেখা গেছে।

এই সুযোগে একবার দেখে নেওয়া যাক আমাদের দেশ কোভিড-১৯ এর মতো সংক্রামক রোগের মোকাবিলায় কতখানি প্রস্তুত –

১৭ মার্চ, ২০২০ তারিখে কেন্দ্রীয় স্বাস্থ্য মন্ত্রক থেকে পাওয়া তথ্য অনুসারে ভারতে প্রতি ৮৪ হাজার মানুষের জন্য একটি আইসোলেশন বেড, প্রতি ৩৬ হাজার মানুষের জন্য একটি কোয়ারেন্টাইন বেড বর্তমান। চিকিৎসকের সংখ্যাও তথৈবচ, প্রতি ১১,৬০০ জন ভারতীয়ের জন্য একজন চিকিৎসক।  এতো গেল সংক্রামক রোগের কথা। এমনি সাধারণ অবস্থাতেও প্রতি ১৮২৬ জন ভারতীয়ের জন্য একটি হাসপাতাল বেড আছে। ( দি ইন্ডিয়ান এক্সপ্রেস, ২২ মার্চ, ২০২০) এই ছবিটা থেকে স্পষ্ট যে  করোনা ব্যাপক জনতার মধ্যে সংক্রমিত হলে তা মোকাবিলা করা আমাদের দেশের স্বাস্থ্য ব্যবস্থার পক্ষে কঠিন। রাতারাতি কিছু পরিবর্তন হবে না যদিও তবু  এই মুহূর্তে সরকারের উচিত-

১. প্রত্যেক পরিবারের জন্য  বিনামূল্যে খাদ্যশস্য এবং সংক্রমণের হাত থেকে বাঁচতে প্রয়োজনীয় অ্যালকোহলযুক্ত স্যানিটাইজার এবং মাস্কের ব্যবস্হা করা।

২. সমস্ত রকম কালোবাজারি ও  মজুতদারির বিরুদ্ধে কঠিন পদক্ষেপ নেওয়া।

৩.শ্রমিকদের সবেতন ছুটির ব্যবস্থা করা।

৪. আইটি সেক্টরের কর্মীদের জন্য ‘Work From Home ‘ – এর ব্যবস্থা করার জন্য বেসরকারি সংস্থাগুলোকে নির্দেশ দেওয়া উচিত। যদি কোনো সংস্থার পরিকাঠামো না থেকে সেক্ষেত্রে কর্মীদের সবেতন ছুটি দিতে হবে।

৫.  বেশির ভাগ সরকারি হসপিটালে কোভিড ১৯ এর চিকিৎসার পরিকাঠামো গড়ে তোলা। আগাম সতর্কতা হিসাবে গ্রামে চিকিৎসার মূল স্তম্ভ স্বাস্থ্যকেন্দ্রগুলোকেও প্রস্তুত করা।

৬. বেশিরভাগ চিকিৎসকই জানাচ্ছেন ভারতবর্ষের জনসংখ্যার নিরিখে এই মুহূর্তে হাতে থাকা করোনা টেস্ট কিটের সংখ্যা নিতান্তই কম। তাই অবিলম্বে পর্যাপ্ত পরিমাণে কিটের ব্যবস্থা করা অত্যন্ত জরুরি।

৭. যে সব ডাক্তারবাবু এবং স্বাস্থ্যকর্মীরা নিজেদের জীবনের ঝুঁকি নিয়ে আক্রান্তদের চিকিৎসা করছেন তাঁদের সুরক্ষায় আজ ঢিলেঢালা। কারণ মাস্ক, সংক্রমণ প্রতিরোধী পোশাক অপ্রতুল। ঘণ্টা কাঁসর বাজিয়ে কিংবা হাততালি দিয়ে এঁদের অভিবাদন জানানোর বদলে তাঁদের সুরক্ষার ব্যবস্থা করা বেশি দরকার। তাই চিকিৎসক এবং স্বাস্থ্যকর্মীদের জন্য পর্যাপ্ত সংখ্যক মাস্ক , স্যানিটাইজার- এর ব্যবস্থা করতে হবে কেন্দ্রীয় সরকারকে।

 এসব পদক্ষেপগুলো না নিয়ে শুধু ‘জনতার কারফিউ’ ঘোষণা করার মধ্য দিয়ে প্রধানমন্ত্রীর জনগণের প্রতি তীব্র অবজ্ঞা ফুটে ওঠে। যদিও এদের কাছ থেকে এর বেশি কীই বা আশা করা যায়। আজই ওনার দলের পশ্চিমবঙ্গের বিখ্যাত নেতা ঘোষণা করেছেন ‘ শনির দশা ‘-র কারণে করোনা ভাইরাস দেখা দিয়েছে। করোনা ভাইরাসের ভারতে সংক্রমণ শুরুর প্রাথমিক স্তরে কোনো ব্যবস্থা নেওয়ার বদলে যেভাবে এরাই করোনা আটকাতে গোমূত্রের গুণ গেয়েছেন তারই ফল আজকের এই বেহাল দশা। এর দায় কী প্রধানমন্ত্রী এড়িয়ে যেতে পারেন?

কিন্তু এই সংকটের সময়ে এই প্রশ্নগুলি তুললেই সুশীল সমাজের একাংশ এবং প্রধানমন্ত্রীর ‘ভক্ত’- দের থেকে ধেয়ে আসছে  সব কিছু নিয়ে রাজনীতি করার অভিযোগ। তাদের উদ্দেশ্যে আমার একটাই প্রশ্ন –

আয়করের ওপর ৪% হারে শিক্ষা ও স্বাস্থ্য সেস দেওয়া দেশের জনগণের পক্ষ থেকে এই সংকটের সময়ে সরকারের কাছে এই দাবি গুলি তোলা অন্যায়? পুনশ্চ: এই লেখা যারা পড়ছেন তাদের অনেকের বাড়িতেই পরিচারক – পরিচারিকা রয়েছেন, যদি ওপরের দাবিগুলোর সাথে আপনি সহমত হন তাহলে অবশ্যই পরিচারক – পরিচারিকাদের এই সময় সবেতন ছুটি দিন। রাষ্ট্রে্র কাছ থেকে ওদের কী কী প্রাপ্য সে বিষয়ে সচেতন করুন।আর যাদের পক্ষে নানা কারণে ছুটি দেওয়া সম্ভব নয়, তাঁরা ওদের কাজে সাহায্য করুন এবং যাতে আপনার বাড়িতে থাকার সময়টুকু অন্তত ওরা করোনা সংক্রান্ত স্বাস্থ্যবিধি মেনে চলতে পারেন, তার ব্যবস্থা করুন।

Share Now:

LEAVE YOUR COMMENT

Your email address will not be published. Required fields are marked *