গত ১১-১২ জানুয়ারি হায়দরাবাদে অনুষ্ঠিত বিপ্লবী লেখক সংঘ (ভিরাসম)-এর ২৭তম সম্মেলনে কেরলের কবি কে কে দাসের বক্তব্য (ইংরাজি)
প্রিয় সাথিরা,
সম্মেলনে অংশগ্রহণকারী সকল অতিথি ও সংগঠনকে লাল সেলাম। বিপ্লবী লেখক সংঘের পঞ্চাশ বর্ষ পূর্তির এই সম্মেলনে উপস্থিত থাকতে পেরে আমি অত্যন্ত খুশি। আমায় আমন্ত্রণ জানানো এবং এখানে উপস্থিত থাকার সুযোগ দেওয়ার জন্য উদ্যোক্তাদের ধন্যবাদ জানাচ্ছি।সৃজনশীল সাহিত্যের বিকাশে বিপ্লবী লেখক সংঘের কঠিন পরিশ্রম ও দৃঢ়চেতা সংগ্রামের দীর্ঘ ইতিহাস রয়েছে।
আমি আপনাদের জানাতে চাই, ৫৩ বছর আগে আমি একটি কবিতা লিখেছিলাম। যার নাম ছিল ‘মালানদিনতে মাত্তোলি’(পার্বত্যভূমিতে অনুরণন)। আমি যে অঞ্চলে থাকি, সেখানে ওই কবিতাটির অর্ধশতবর্ষ উদ্যাপিত হয়েছে। দ্য অক্সফোর্ড ইউনিভার্সিটি প্রেস আমার কবিতা ‘কালো নাচ’ প্রকাশ করেছিল, সেই কবিতাটি এমজি বিশ্ববিদ্যালয় তাদের মালয়ালাম সাহিত্যের এম এ স্তরের পাঠক্রমে স্থান দিয়েছে। পেঙ্গুইন বুকস প্রকাশিত গ্রন্থে কবিতাটি আছে। ভারতীয় গণতন্ত্রের শত্রু হিন্দু ফ্যাসিবাদকে ধ্বংস করাই সমকালীন ভারতে সবচেয়ে জরুরি। অবশ্যই এটি নয়া গণতান্ত্রিক বিপ্লবের কর্তব্য। প্রতিক্রিয়াশীল শক্তির সঙ্গে মতাদর্শগত সংগ্রাম চালানোর পাশাপাশি শ্রেণি সংগ্রাম ও বর্ণবাদী আধিপত্যর বিরুদ্ধে লড়াইয়ের মানসিকতাসম্পন্ন জনগণের সাহিত্য সৃষ্টি করার কাজে নেতৃত্ব দেবেন বিপ্লবী লেখকরাই।
সাহিত্য ও জনগণ পরস্পরের সঙ্গে যুক্ত। ‘জনগণের থেকে জনগণের কাছে’ নীতিটি লেখকদের মাথায় রাখতে হবে। সমাজ শুধুমাত্র জনগণের সমাহার নয়।এর মধ্যে রয়েছে উৎপাদনের পদ্ধতি, উৎপাদন সম্পর্ক এবং উৎপাদিকা শক্তি। ভাষা, আচরণ, শরীরি ভাষা এবং কথা বলার দক্ষতা এগুলির ওপর ভিত্তি করেই তৈরি হয়েছে। সংক্ষেপে বলতে গেলে এটাই সংস্কৃতির সামগ্রিকতা।জনগণের মধ্যে থেকে, জনগণের জন্য এবং জনগণের দ্বারাই তা তৈরি হয়।
ভারতীয় সমাজের উৎপাদন সম্পর্কের বুনিয়াদ হল বর্ণবাদী ব্যবস্থা। উৎপাদিকা শক্তিও জাতি ও অর্ধজাতিতে বিভক্ত। এর ফলেই দলিতদের ওপর শোষণ এবং সামাজিক, অর্থনৈতিক, রাজনৈতিক নিপীড়ন চলছে।এই বর্ণবাদী ব্যবস্থা একটি অমানবিক ব্যবস্থা, যা জনগণের মুক্তি ও সাম্যের অধিকারকে নাকচ করে দেয়। তাই আমাদের প্রধান কাজ বর্ণবাদী আধিপত্যকে নির্মূল করা।উচ্চ বর্ণ, উচ্চ শ্রেণির শাসকদের অর্থনৈতিক ক্ষমতার ওপরেও আমাদের আঘাত হানতে হবে। বর্ণবাদী আধিপত্য ও অর্থনৈতিক শোষণ থেকে জনগণকে মুক্ত করার এটিই একমাত্র উপায়। জনগণের হাতে জমি- এই মহান আহ্বানের মধ্য দিয়ে কৃষি বিপ্লব করেই সামন্ততন্ত্রকে সমূলে বিনাশ করা সম্ভব। এটা কোনো নতুন কথা না হলেও, অনুশীলনের ক্ষেত্রে আমরা ব্যাপক জনগণকে আমাদের কর্মসূচিতে যুক্ত করতে পারিনি। রাজনীতি ও সাহিত্যের ক্ষেত্রে এটি প্রাসঙ্গিক বিষয়।
নয়া গণতান্ত্রিক সংস্কৃতির বুনিয়াদি মূল্যবোধ এবং সামাজিক, অর্থনৈতিক ও রাজনৈতিক মুক্তি ও সাম্যের ভিত্তিতে জমাজকে পুনর্গঠিত করতে হবে। ধর্ম-বর্ণ নির্বিশেষে সকল অংশের মেহনতি মানুষকে ঐক্যবদ্ধ করে বর্ণবাদী ব্যবস্থার বিনাশ ও শ্রেণি সংগ্রামের পথে এগিয়ে নিয়ে যেতে হবে। ভারতের সর্বহারা যদি জাতপাতের জোয়াল থেকে মুক্ত না হয় তাহলে আমরা জাতীয় মুক্তি সংগ্রামের শত্রুদের ধ্বংস করতে পারব না। ভারতীয় বিপ্লব এই মুহূর্তে বিশ্ব বিপ্লবের প্রথম সোপান। ভারত যেহেতু সাম্রাজ্যবাদী শক্তিগুলির নয়া উপনিবেশ, তাই তারা নিশ্চিত ভাবেই ভারতীয় বিপ্লবের বিরোধিতা করবে। অতএব ফ্যাসিবাদ এবং কর্পোরেট পুঁজিবাদী শক্তির বিরুদ্ধে আমাদের রণনৈতিক শক্তিকে ক্ষুরধার করতে হবে।
বর্ণ ব্যবস্থার স্তরীভূত ক্ষমতা বিন্যাস নিজেই একটি ফ্যাসিবাদী ব্যবস্থা। এতে সাংস্কৃতিক আধিপত্যের মধ্য দিয়ে সম্পত্তির অধিকার এবং রাজনৈতিক ক্ষমতা উদ্ভূত হয়। জনগণের সাম্য ও স্বাধীনতাকে নাকচ করার জন্য ধর্মীয় দর্শনের অত্যাচারের অস্ত্র হিসেবে কাজ করে।হিন্দু ফ্যাসিবাদ শুধুমাত্র একটি ধর্মের প্রশ্ন নয়। এটি ধর্ম, কর্পোরেট লগ্নি পুঁজি ও সাম্রাজ্যবাদের সমন্বয়।
তাই ফ্যাসিবাদকে উচ্ছেদ করে জনগণ ও দেশকে স্বাধীন করার কর্মসূচি নয়া গণতান্ত্রিক বিপ্লবের মধ্যে দিয়ে সম্পূর্ণ করতে হবে। সর্বহারা ও শ্রমিক শ্রেণির সকল অংশের নেতৃত্বেই তা করতে হবে। ভারতের সংবিধান, ফ্যাসিবাদী রাষ্ট্রের পথে কোনো চিনের প্রাচীর নয়। ২০১৯-এর নাগরিকত্ব আইনের বিরুদ্ধে সংগ্রাম জনগণ ও রাজনৈতিক দলগুলির কাছে একটি শিক্ষা।
দলিত কবিতা ও জাতীয় মুক্তি
দলিত কবিতা ও ভারতের জাতীয় মুক্তি নিয়ে কয়েকটি মতাদর্শগত প্রশ্ন আমি তুলতে চাই। দলিতদের মুক্তির জন্য রাজনৈতিক সংগ্রাম, সাংস্কৃতিক সংগ্রামের মতাদর্শগত বিকাশ এবং সাহিত্যিক সৃজনশীলতার বাস্তব প্রয়োগের মধ্য দিয়ে দলিত কবিতা জন্ম নিয়েছে।
এটি নয়া গণতান্ত্রিক বিপ্লবের জাতীয় মুক্তির পর্যায়। ভারতের নয়া গণতান্ত্রিক বিপ্লব শ্রেণি যুদ্ধের পাশাপাশি বর্ণবাদী ব্যবস্থা নির্মূল করার কর্মসূচিও চালাবে অর্থাত বর্ণ ব্যবস্থা নিকেশকারী শ্রেণিযুদ্ধ। দলিতদের মুক্তি ছাড়া জাতীয় মুক্তি সম্ভব নয়, জাতীয় মুক্তি ছাড়া দলিতদের মুক্তি সম্ভব নয়। দলিত সাহিত্য জাতীয় মুক্তি সংগ্রামের একটি শক্তিশালী অস্ত্র এবং তার মধ্যে দিয়েই এর জন্ম। এটি বর্ণবাদী ব্যবস্থা ও অর্থনৈতিক ক্ষমতাকে নিকেষ করার দলিত মুক্তি কর্মসূচির সঙ্গে যুক্ত, অর্থাত উৎপাদন সম্পর্কের বর্ণবাদী আধিপত্য এবং সাম্যের মানবিকতাকে বাতিল করার সংস্কৃতিকে নির্মূল করাই এই কর্মসূচির লক্ষ্য।
দলিত কবিতা কী?
দলিত কবিতা হল এমন কবিতা যাতে দেশের গণ চরিত্রের সামাজিক, অর্থনৈতিক ও ঐতিহাসিক বাস্তবতা প্রতিফলিত হয়। যে কোনো ব্যক্তি, যার গণতান্ত্রিক মনন এবং কবিতা লেখার উপযোগী নান্দনিক দক্ষতা আছে, তিনিই দলিত কবিতা রচনা করতে পারেন। অতএব সেই ব্যক্তি যেই হন না কেন, তিনি নিপীড়িত বর্ণ থেকেই আসুন বা উচ্চবর্ণ থেকে, তাঁকে তাঁর পদবী দিয়ে চিহ্নিত করা উচিত নয়। এই ধরনের বিভাজন কখনওই বিপ্লবের জন্য প্রয়োজনীয় গণতান্ত্রিক ঐক্যের কাজে লাগবে না।