সৌম্য মণ্ডল
কাশ্মীরি পন্ডিতদের অভিবাসনের ইস্যু ৯০-এর দশক থেকে উগ্র (অথবা নরম) হিন্দু জাতীয়তাবাদীদের অন্যতম প্রচারের ইস্যু হয়ে এসেছে। দক্ষিণপন্থীদের সমস্ত যুক্তি যখন অকেজো হয়ে যায়, তখন কাশ্মীরিদের আন্দোলনের বিরুদ্ধে অথবা ইসলামোফোবিয়া প্রচারের স্বার্থে টেনে আনা হয় কাশ্মীরি পন্ডিতদের ইস্যু। ১৯ জানুয়ারি শাহিনবাগে NRC-CAA বিরোধী অবস্থানে এসে চার জন কাশ্মীরি পন্ডিত প্লাকার্ড হাতে নিয়ে বিক্ষোভ দেখাতে থাকেন। যদিও CAA বা NRC র সাথে কাশ্মীরি পন্ডিতদের কাশ্মীরে ফেরার কোনো সম্পর্ক নেই। দেখা গেল শাহিনবাগের আন্দোলনকারীরাও তাদের মঞ্চে কাশ্মীরি পন্ডিতদের উপর নির্যাতনের বিরুদ্ধে প্রতিবাদ সভা করে ফেললেন। হিন্দু বিরোধী তকমা পাওয়ার ভয়ে মূলধারার বুদ্ধিজীবীদের এই সাহস নেই যে কেন আর কী পরিস্থিতিতে পন্ডিতদের উদ্বাস্তু হতে হলো তা নিয়ে বস্তনিষ্ট আলোচনায় যাওয়ার। বর্তমান প্রবন্ধটির লেখার জন্য নির্ভর করেছি মান্যগণ্য কাশ্মীরি পন্ডিত বুদ্ধিজীবীদের বিভিন্ন লেখা এবং বিভিন্ন সংবাদ সংস্থার প্রকাশিত সাধারণ কাশ্মীরি পন্ডিতদের মতামতের উপর।এ ছাড়া ঐতিহাসিক রামচন্দ্র গুহ প্রমুখের লেখা বিশেষত ঐতিহাসিক সিদ্ধার্থ গুহ রায়ের কাশ্মীর নিয়ে অনবদ্য বাংলা বইটি থেকে বিশেষ সাহায্য নেওয়া হয়েছে।
২০১৩ সালে ৩১ আগস্টের ইকনমিক এন্ড পলিটিক্যাল উইকলি পত্রিকায় লেখিকা সাদাফ মুন্সি লিখেছেন “নিঃসন্দেহে কাশ্মীরি পন্ডিতদের দেশান্তরে যাওয়া কাশ্মীরে হিন্দু-মুসলমান সাম্প্রদায়িক সস্প্রীতির সংস্কৃতির এবং কাশ্মীরিত্বের অত্যন্ত শক্তিশালী চেতনার উপর সবচেয়ে বড় আঘাত… দুই সম্প্রদায়ের মানুষের মধ্যে ইতিমধ্যে যথেষ্ট পরিমাণ সন্দেহ এবং অবিশ্বাস জন্মেছে যা ১৯৯০-এর আগে সম্প্রীতির সমাজে ছিলোনা”। আমরা অতি সংক্ষেপে বোঝার চেষ্টা করবো ১৯৯০ এর আগের কাশ্মীরে হিন্দু-মুসলমান সম্পর্ক কেমন ছিলো আর ১৯৯০ সালে কী ঘটলো এবং কেন ঘটলো। বর্তমান সমস্যাই বা কোথায় দাড়িয়ে আছে।
১৮৪৬ সালে প্রথম ইঙ্গ-শিখ যুদ্ধে শিখরা পরাজিত হলে ইংরেজরা ক্ষতিপূরণ বাবদ দেড় কোটি টাকা দাবি করে। তখন এই দাবি মেটাতে শিখরা জম্মুর ডোগরা রাজা গুলাব সিংকে কাশ্মীর বিক্রি করে দিতে বাধ্য হন। ডোগরা রাজপুতেরা জম্মুতে বসে কাশ্মীর শাসন করতেন বলে জম্মু-কাশ্মীর রাজ্যের উদ্ভব হয়। কাশ্মীরিদের কাছে মূঘল,শিখদের মত ডোগরা রাজারাও ছিলেন বিদেশি। প্রসঙ্গত উল্লেখযোগ্য কাশ্মীরের নতুন মালিক গুলাব সিং শিখদের হারাতে ইংরেজদের সাহায্য করেছিলেন। ডোগরা রাজারা ১৯৪৭ সালে তাদের শেষদিন পর্যন্ত নির্লজ্জ চাটুকারিতার বিনিময়ে ব্রিটিশ সরকারের স্নেহ পেয়ে এসেছেন।
১৯৪৭ সালে জম্বু-কাশ্মীরের জনসংখ্যার ৭৭% ছিলেন মুসলমান। আর কাশ্মীর উপত্যকার ৯৩% ছিলেন মুসলমান ধর্মাবলম্বী মানুষ। ডোগরা রাজাদের শাসনে প্রশাসন এবং আমলাতন্ত্র একচেটিয়া ডোগরা রাজপুতদের দখলে ছিলো। কাশ্মীরি পন্ডিতদের কেউ কেউ ছিলেন অনুপস্থিত জমির মালিক অথবা ক্ষুদ্র কৃষি জমির মালিক। কাশ্মীরি পন্ডিতরা সাধারণত উচ্চ শিক্ষিত হতেন এবং ভালো চাকরিতে নিযুক্ত হতেন কিন্তু রাজ্যের আমলাতন্ত্রে পন্ডিতদের কোনো স্থান দেওয়া হত না। রাজ্য শাসনের ক্ষেত্রে কাশ্মীরিদের অংশিদার করার দাবিতে তারা প্রায়ই সরব হতেন। মুসলমান প্রজাদের অবস্থা ছিলো সব চেয়ে শোচনীয়। ১৯২০ দশকে জিএন কাউল নামে এক কাশ্মীরি পন্ডিতের রচনা থেকে জানা যায় অন্তত ৯০% মুসলমান প্রজার বাড়ি হিন্দু মহাজনদের কাছে বন্ধকি পড়েছিলো। আরেক কাশ্মীরি পন্ডিত প্রেমনাথ বাজাজের বর্ণনা থেকে পাওয়া যায় ডোকরা শাসনে ছিন্ন বস্ত্রে নগ্ন পায়ে ঋণের বোঝায় জর্জরিত চাষি, ভুমিদাস মুসলমানের ছবি।
কাশ্মীরিরা যে ইসলাম গ্রহণ করেছিলেন সেই ধর্মীয় আদর্শ প্রচার করেছিলো সিলসিলা-ই-ঋষিয়ান নামে একটি স্থানীয় সুফি গোষ্ঠী যার আদিপুরুষ ছিলেন শেখ নূরউদ্দিন (১৩৭৯-১৪৪২)। কাশ্মীরি উপত্যকায় শেখ নূরউদ্দিনের অনুগামী সুফি সাধকরা হিন্দু মুসলমান সকলের কাছে শ্রদ্ধেয় এবং ঋষি নামে পরিচিত। ভক্তি আন্দোলনের ধারার এই সুফি সাধকরা সহনশীলতা,মানবতার আদর্শ প্রচার করে। নুর উদ্দিনের ইসলামে হিন্দু শৈব বা বৌদ্ধদের প্রভাব লক্ষ করা যায়। যদিও গত শতাব্দীর শেষের দিকে জামাত-ই-ইসলামি এবং আরো কিছু ইসলামি সংগঠন কাশ্মীরে ইসলামকে শুদ্ধ করতে প্রয়াসি হয়।
১৯৩১ সাল থেকে কাশ্মীরের রাজনীতিতে ব্যাপক প্রভাব বিস্তার করেন সেকুলারিজম ও আধুনিক গণতান্ত্রিক ভাবধারায় উদ্বুদ্ধ তরুণ নেতা শেখ আবদুল্লাহ। আবদুল্লাহ ছিলেন আলিগড় বিশ্ববিদ্যালয়ের রয়াসন বিভাগের স্নাতকোত্তরের ছাত্র, তিনি কাশ্মীরে একটি স্কুলে বিজ্ঞান শিক্ষক হিসেবে যোগ দেন। তিনি ছিলেন আরেক কাশ্মীরি পন্ডিত জহরলাল নেহেরুর ঘনিষ্ঠ বন্ধু। ঐতিহাসিক সিদ্ধার্থ গুহ রায় ১৯৩১ সালের উত্তাল জাতীয়তাবাদী সংগ্রাম সম্বন্ধে লিখেছেন “কাশ্মীরিদের জাতীয়তাবাদী সংগ্রামের মধ্যে নতুন মাত্রা যুক্ত হল তখনই যখন কাশ্মীরি কৃষকেরা জায়গীরদার ও মহাজনের বিরুদ্ধে প্রতিরোধ সংগ্রাম গড়ে তুললেন।আন্দোলনকারীদের আক্রমণের মূল লক্ষ্য কিন্তু সাধারণ ভাবে হিন্দুরা ছিলেন না। আক্রমণের লক্ষ্য ছিল পুলিশ এবং জায়গিরদার ও মহাজনের দল। এই জায়গিরদার ও মহাজনেরা প্রায় সকলেই ছিলেন হিন্দু।”
১৯৩২ সালের অক্টোবরে প্রতিষ্ঠিত মুসলিম কনফারেন্সের প্রথম সভাপতি নির্বাচিত হন শেখ আবদুল্লাহ। প্রথম সভাপতির ভাষণেই তিনি স্পষ্ট করে দেন যে কাশ্মীরের সংগ্রাম কখনোই সাম্প্রদায়িক আন্দোলন নয়, মুসলিম হিন্দু শিখ সব ধর্মীয় সম্প্রদায়ের মানুষের আশাআকাঙ্খা চরিতার্থ করাই আন্দোলনের উদ্দেশ্য। কিছুদিনের মধ্যেই মুসলিম কনফারেন্সে শেখ আবদুল্লাহর সেকুলার রাজনীতি ও ইউসুফ সাহের ধর্মীয় রাজনীতির মধ্যে মতাদর্শগত সংগ্রাম তীব্র হয়। ইউসুফ মুসলিম কনফারেন্স ত্যাগ করে আজাদ মুসলিম কনফারেন্স নামে একটি পৃথক সংগঠন গড়ে তোলেন এবং শেখ আবদুল্লাহর নেতৃত্বে মুসলিম কনফারেন্স তার নাম বদলে ন্যাশেনাল কনফারেন্স করে নেয়। প্রেমনাথ বাজাজ সহ বহু হিন্দু ওই সংগঠনের যোগ দেন। ১৯৪০ নাগাদ সংগঠনের নেতৃত্বে হিন্দু ও শিখ সম্প্রদায়ের নেতারা ভালো রকম ছিলেন। ন্যাশেনাল কনফারেন্সের ১৯৪৪ সালের “নয়া কাশ্মীর” নামে একটি ইস্তেহার প্রকাশিত হয় যেখানে জমিদারি ব্যবস্থার উচ্ছেদ, নারী-পুরুষের সমানাধিকার, ট্রেড ইউনিয়ন অধিকার ইত্যাদি সম্পন্ন এর সমতাবাদী কাশ্মীরি সংবিধানের ঘোষণা করা হয়। এই ইস্তেহার মুসলিম লিগ, কংগ্রেস বা হিন্দু-মুসলমান কোনো সাম্প্রদায়িকদেরই পছন্দ হয়নি। যদিও কাশ্মীরি জনগণ এই ‘নয়া-কাশ্মীর’ ইস্তেহারের আদর্শ বুকে করে লড়াই করেছিলেন দীর্ঘদিন।
১৯৪৬ সালে যখন স্পষ্ট হয়ে যায় যে রাজার রক্ষাকর্তা ব্রিটিশ আর ভারতে থাকবে না, তখন ন্যাশনাল কনফারেন্সের নেতৃত্বে রাজতন্ত্র বিরোধী কাশ্মীর ছাড়ো আন্দোলনে উত্তাল হয় জম্মু কাশ্মীর। আন্দোলনের প্রতিক্রিয়ায় রাজা শেখ আবদুল্লাহকে গ্রেফতার করেন। এই আন্দোলনে নেহেরু বন্ধু সেজে পেছন থেকে ছুড়ি মেরেছিলেন, অন্য দিকে জিন্না এই আন্দোলনকে গুন্ডামি বলে নিন্দা করেন। কংগ্রেস, মুসলিম লিগ বা অন্য হিন্দু মুসলিম সাম্প্রদায়িকরা দেশীয় রাজন্যবর্গের শাসনকে সমর্থন করতেন। কারণ জিন্না বা নেহেরু উভয়ই জনগণের উপর ভিত্তি করে নয়, রাজা জমিদারদের উপর ভিত্তি করে আগামীতে দেশ শাসন করতে চেয়েছিলেন। নিজেরাও ছিলেন অভিজাত শ্রেণির সন্তান।
১৯৪৬ সালে ক্যাবিনেট মিশনের প্রস্তাব অনুযায়ী ভারতে যে অন্তবর্তীকালিন সরকার ও কনস্টিটুয়েন্ট অ্যাসেম্বলি গঠিত হয়েছিল, মহারাজা হরি সিং তাতে যোগ দেননি। জিন্না রাজা হরি সিং-এর এই যোগ না দেওয়াকে তার সার্বভৌম অধিকার বলে সমর্থন করেছিলেন। রাজা হরি সিং-এর কাছে তিনটি বিকল্প ছিলো যথা ভারতে বা পাকিস্তান কোনো একটি দেশে যোগ দেওয়া বা স্বাধীন থাকা। হরি সিং স্বাধীন থাকতে চেয়েছিলেন। মৌলবাদী সংগঠন ‘জম্মু কাশ্মীর রাজ্য হিন্দুসভা’ রাজার অবস্থনকে সমর্থন করে ঘোষণা করেন কাশ্মীরের কখনোই ‘ধর্ম নিরপেক্ষ’ ভারতে যোগ দেওয়া উচিৎ নয়। ইউসুফের সাম্প্রদায়িক মুসলিম কনফারেন্সেও রাজার স্বাধীন থাকার সিদ্ধান্তকে সমর্থন করেন।
১৯৪৭ সালের সেপ্টেম্বর মাসে উত্তর কাশ্মীরের পুঞ্চ অঞ্চলের কৃষক অভ্যুত্থান সংগঠিত আকার ধারণ করে, রাজার বিরুদ্ধে এই বিদ্রোহে ‘আজাদ হিন্দ ফৌজের’ কিছু সৈনিকও যোগ দেন। আর তার সাথে পাল্লা দিয়ে বাড়ে রাজা হরি সিং-এর অত্যাচার। এর আগে বার বার কাশ্মীরে হিন্দু মৌলবাদীদের সাথে জিন্না রাজা হরি সিং-কে চোখ বন্ধ করে সমর্থন করে এলেও পুঞ্চের এই বিদ্রোহের সময় পাকিস্তান তার নীতি বদল করে। ১৯৪৭ সালের ২৪ অক্টোবর পাকিস্তানের উত্তর পশ্চিম সীমান্তের এক বিরাট সংখ্যক “জঙ্গি উপজাতি” কাশ্মীর আক্রমণ করে। আর এই হামলাকারিদের সাহায্যের হাত বাড়িয়ে দেয় পুঞ্চের জনতা। পাকিস্তানও অঘোষিত ভাবে সেনা বাহিনী পাঠিয়ে দেয় হামলাকারী ও বিদ্রোহীদের সাথে। রাজা বিপাকে পড়েন, শেখ আবদুল্লাহকে মুক্তি দেন। আবদুল্লাহর উপস্থিতিতে ২৬ অক্টোবর জম্মু কাশ্মীর ও ভারত সরকারে মধ্যে Instrument of Accession চুক্তি সাক্ষরিত হয়। এই চুক্তির মুল কথা হল এই যে প্রতিরক্ষা পররাষ্ট্র যোগাযোগ এই তিনটে ক্ষেত্রে জম্মু কাশ্মীর সরকার ভারতের কর্তৃত্ব মেনে নেবে। কিন্তু এই চুক্তি চূড়ান্ত হবে কাশ্মীরে গণভোটের পর। সেই দিনই কাশ্মীরে ভারতীয় সেনা পৌঁছলে সাহায্যের জন্য এগিয়ে আসে শেখ আবদুল্লার ন্যাশনাল কনফারেন্স-এর স্বেচ্ছাসেবকরা। ১৯৪৭ সালের ২ নভেম্বর নেহেরু তার বেতার ভাষণে কাশ্মীরের ভারতভুক্তির বিষয়টি কাশ্মীরের মানুষের গণভোটের মাধ্যমে নির্ধারিত হবে বলে ঘোষণা করেন। ১৯৪৮ সালের ১ জানুয়ারি নেহেরু রাষ্ট্রসংঘের নিরাপত্তা পরিষদে কাশ্মীরে গণভোটের প্রসঙ্গটি উত্থাপন করেন। নেহেরুর গণভোট সংক্রান্ত প্রতিশ্রুতির ভিত্তিতে ৬ জানুয়ারি নিরাপত্তা পরিষদে সিদ্ধান্ত নেওয়া হয় যে গণভোটের মাধ্যমের কাশ্মীরের ভবিষ্যৎ নির্ধারিত হবে, ১৯৪৮ সালের ২১ এপ্রিল রাষ্ট্রসংঘ কাশ্মীরে গণভোট সংক্রান্ত একটি প্রস্তাব গ্রহণ করে তাতে ভারত এবং পাকিস্তান উভয়ই গণভোটের মাধ্যমে কাশ্মীরের ভবিষ্যৎ নির্ধারনের বিষয়টি মেনে নিয়েছে বলে সন্তোষ প্রকাশ করা হয়। ১৯৪৮ থেকে ১৯৫৭ পর্যন্ত রাষ্ট্রসংঘ কাশ্মীরের গণভোট নিয়ে অন্তত ৮ টি প্রস্তাব নিয়েছে। এমনকি ১৯৪৮ সালের ১১ ডিসেম্বর গণভোট সংক্রান্ত রূপরেখা তৈরি হওয়ার পর ১৯৪৯ সালের ১ জানুয়ারি ভারত পাকিস্তান যুদ্ধ বিরতি ঘোষণা করে। যদিও সেই গণভোট আজও করা হয়ে ওঠেনি। শেষ পর্যন্ত ১৯৬৪ সালে রাষ্ট্রসংঘে ভারতীয় প্রতিনিধি ঘোষণাই করে দিলেন যে কোন অবস্থাতেই তার সরকার গণভোট করাতে রাজি নয়।
১৯৪৯ সালের অক্টোবর মাসে ভারতের আইনসভা ভারতীয় সংবিধানের ৩০৬-এ ধারা যুক্ত করে জম্মু কাশ্মীরের অভ্যন্তরীণ স্বায়ত্তশাসন মেনে নেয়, একই সাথে বলা হয় যে যতদিন না পর্যন্ত গণভোটের মাধ্যমে জম্মু কাশ্মীরের মানুষ তাদের ভবিষ্যৎ নির্ধারণ করেন ততদিন পর্যন্ত বিষয়টি Interim System হিসেবে থাকবে। পরবর্তী কালে ভারতের নবগঠিত সংবিধানে এই ৩০৬এ ধারাটি নতুনভাবে ৩৭০ ধারা হিসেবে যুক্ত হয়। কিন্তু এই ৩৭০ ধারায় গণভোটের বিষয়টিকে হাপিস করে দেওয়া হয়, ধীরে ধীরে ৩৭০ ধারাটিকে সংশোধনের মাধ্যমে প্রায় বিলুপ্তির পথে নিয়ে যায় কংগ্রেস সরকার। অবশেষ ২০১৯ সালে বিজেপি সরকার ধারাটাই বিলোপ করে দিলো সম্পূর্ণ ভাবে। ৩৭০ ধারার খসড়া দেখার পর শেখ আবদুল্লা অসম্ভব ক্ষুব্ধ হয়েছিলেন, কারণ এ ছিল কাশ্মীরিদের সাথে স্পষ্ট বিশ্বাসঘাতকতা। এই সময় থেকে আবার শেখ আবদুল্লা কাশ্মীরের গণভোট ও কাশ্মীরের স্বাধীনতার কথা তুলতে থাকেন এবং ব্যাপক জনসমর্থন পেতে থাকেন। ১৯৫৩ সালে ভারত সরকার রাজা হরি সিং-এর পুত্র কাশ্মীরের সদর-ই-রিয়াসত করণ সিং-কে দিয়ে কাশ্মীরের জননেতা শেখ আবদুল্লাকে গ্রেফতার করান। শেখ আবদুল্লার মুক্তির দাবিতে বিক্ষোভে ফেটে পড়ে কাশ্মীর, নির্মম অত্যাচারে এই আন্দোলন দমন করা হয়। পুলিশের গুলিতে অন্তত ৬০ জন কাশ্মীরি প্রাণ হারান। ১৯৫৩ সাল থেকে ১৯৬৮ সালের বেশিরভাগ সময়টাতেই শেখ আবদুল্লা জেলে কাটান। শেখ আব্দুল্লার সাথে তার সহকর্মী মির্জা আফজল বেগও জেলে ছিলেন। রাষ্ট্রসংঘের মানবধিকার সনদকে বুড়ো আঙ্গুল দেখিয়ে এই দুজনকে বিনা বিচারে আটক করে রাখা হয়, কোনো অপরাধেই এদের দোষী সাব্যস্ত করা হয়নি।
কাশ্মীরের স্বাধীনতাপন্থীরা ‘গণ ভোট’ ফ্রন্ট নামে একটি মঞ্চ গড়ে তোলেন। এই গণ ভোট ফ্রন্টের অন্যতম নেতা ছিলেন কাশ্মীরের ভগৎ সিং বলে পরিচিত বামপন্থী নেতা মুকবুল বাট। পরবর্তী কালে তিনি জম্মু কাশ্মীর ন্যাশানাল লিবারেশন ফ্রন্ট নামে সংগঠন তৈরি করে শোষণহীন ঐক্যবদ্ধ কাশ্মীর গড়ার জন্য সশস্ত্র সংগ্রাম গড়ে তোলেন। মুকবুল ভাট বা তার দল সীমান্তের দু’পারেই সক্রিয় ছিলো। পাক সেনার হাতে তার দলের বহু কর্মী নিহত হন। অবশেষে পাক সেনার সহযোগিতায় ভারতীয় সেনা মুকবুলকে গ্রেফতার করে এবং বিচারে মুকবুলের ফাঁসি হয়।
গণভোট ফ্রন্ট ছিলো উপত্যকায় কংগ্রেসের প্রধান প্রতিপক্ষ। শেখ আবদুল্লাহ ঘোষণা করেন গণ ভোট ফ্রন্ট ১৯৭১ সালে লোকসভা নির্বাচনে অংশগ্রহণ করবেন। নির্বাচনী প্রচার জোরদার করার উদ্দেশ্যে ৮ জানুয়ারি আবদুল্লাহ দিল্লি থেকে বিমানে কাশ্মীরের উদ্দেশে রওনা দিলে বিমানে বোমাতঙ্ক রটিয়ে বিমান বাতিল করা হয়। পরের দিন শেখ আবদুল্লাহ এবং আফজল বেগের জম্মু কাশ্মীরে প্রবেশের উপর নিষেধাজ্ঞা জারি করা হয়। তারপর আইন পাস করিয়ে গণভোট ফ্রন্টের নির্বাচনে অংশগ্রহণের অধিকার কেড়ে নেওয়া হয়। সম্প্রতি সন্ত্রাসী হামলার আতঙ্ক ছড়িয়ে অমরনাথ তীর্থ যাত্রা বাতিল করে হিন্দুতীর্থ যাত্রীদের বোকা বানিয়ে কাশ্মীর থেকে বের করে দিয়ে ৩৭০ ধারা বিলোপের সাথে কোনো মিল পাচ্ছেন কি? ১৯৭১ সালের লোকসভা বা ১৯৭২ সালের কাশ্মীরের বিধানসভা কোনো ভোটেই গণভোট ফ্রন্টকে অংশগ্রহণ করতে দেওয়া হয়নি।
যদিও বিরোধী দল ছাড়া গণতন্ত্র হবে কী ভাবে? কংগ্রেসের পূর্ণ সহযোগিতায় জনভিত্তিহীন জামাত-ই-ইসলামিকে ৫ টি আসনে জিতিয়ে দেওয়া হয় ওই নির্বাচনে। ব্যাপক কারচুপিতে জেতা কংগ্রেসের মূখ্যমন্ত্রী মীর কাসিম তার আত্মজীবনীতে সে কথা স্বীকার করেন। কংগ্রেস চেয়েছিলো স্বাধীনতাকামী ধর্মনিরপেক্ষ শক্তির জায়গায় ইসলামিক শক্তি প্রতিপক্ষ হিসেবে উঠে আসুক। এতে স্বাধীনতা সংগ্রামে হিন্দু মুসলমান কাশ্মীরি ঐক্যে যেমন ফাটল ধরবে, তেমন দুনিয়াকে দেখানো যাবে জাতীয় স্বাধীনতা সংগ্রাম নয়- কংগ্রস সরকার যা দমন করছে তা হল ইসলামিল মৌলবাদ। ৮০-র দশকে পাঞ্জাব কাশ্মীর সহ ভারতের বিভিন্ন প্রান্তে স্বাধীনতার দাবি শক্তিশালী হয়। ১৯৮৩ সালের নির্বাচনী প্রচারে ইন্দিরা গান্ধী নেতৃত্বাধীন কংগ্রেস সরাসরি মুসলমান ও শিখদের বিচ্ছিন্নতাবাদ থেকে দেশের অখণ্ডতা রক্ষার দায় হিন্দুদের কাঁধে তুলে নেওয়ার আবেদন করে পরিস্থিতির সাম্প্রদায়িকীকরণ করেন। ১৯৮৩ সালের নির্বাচনে সাম্প্রদায়িক মেরুকরণ স্পষ্ট হয়ে উঠেছিলো। ইতিমধ্যে শেখ আবদুল্লাহ হার মেনে নিয়ে কেন্দ্রীয় সরকারের সাথে আপস করে ‘ভারতীয় রাজনীতির মূল ধারায়’ ফিরে আসেন। তার পুত্র ফারুক আবদুল্লাহ কাশ্মীরের মুখ্যমন্ত্রী হন। কিন্তু তিনি ১৯৮৩ সালের ৩১ মে বেজওয়াড়াতে বিরোধীদের কনক্লেভে যোগ দেওয়ায় ইন্দিরা গান্ধী ক্ষিপ্ত হন এবং ১৩ জন বিধায়ক ভাঙিয়ে ফারুকের সরকার ফেলে দেওয়ার চেষ্টা করেন। কিন্তু সেই সময় রাজ্যপাল ছিলেন কাশ্মীরি পন্ডিত বি কে নেহেরু, তিনি ফারুকের সরকারকে তৎক্ষনাৎ ফেলে দিতে রাজি হলেন না। তখন বি কে নেহেরুকে সরিয়ে রাজ্যপাল হিসেবে পাঠানো হয় জগমোহন মালব্যকে। এই জগমোহন ছিলেন প্রাক্তন আমলা এবং ইন্দিরা পুত্র সঞ্জয় গান্ধীর কোলের লোক শুধু নয়, একই সাথে বিজেপি নেতা। দিল্লিতে মুসলমান বস্তিগুলোকে বুলডোজার দিয়ে নির্মম ভাবে ধংস করার ক্ষেত্রে তার ছিলো প্রধান ভূমিকা। তার গুণমুগ্ধ হয়ে ইন্দিরা তাকে কাশ্মীরের রাজ্যপাল হিসেবে বেছে নিয়ছিলেন। কাশ্মীর সরকার ব্যাপক ভাবে হিন্দু এবং মুসলমান মৌলবাদী শক্তিদের মদত দিতে থাকে। অন্যদিকে পাকিস্তানও চেয়েছিলো স্বাধীনতাপন্থী ধর্ম নিরপেক্ষদের প্রভাব কমে গিয়ে পাকিস্তানপন্থী ইসলামিক সংগঠনগুলোর প্রভাব বাড়ুক।
১৯৮৬ সালের অনন্তনাগ জেলায় হিন্দু ধর্মাবলম্বী মানুষ ও তাদের ধর্মীয় স্থানগুলোর উপর আক্রমণ হয়, যা এতদিন ধরে লালিত উপত্যকার ধর্মনিরপেক্ষ ভাবমূর্তির উপর কালিমা লিপ্ত করে। এই সাম্প্রদায়িক দাঙ্গার প্রেক্ষিতে মানবাধিকার কর্মীদের একটি দল কাশ্মীর যায়। এই দলের অনুসন্ধান জানায়, এই দাঙ্গা কোনো ভাবেই স্বতঃস্ফূর্ত ছিলো না। এটা করা হয়েছিলো গুজব রটিয়ে পরিকল্পনামাফিক। এই দলের কথা মানুষ মন দিয়ে শোনে এবং হিন্দু মন্দির গড়ে দিতে সম্মত হয়। লুক ভবানী এলাকায় একদিনে ১০ হাজার টাকা সংগৃহীত হয়। যদিও এই দলের মতে, এই দাঙ্গার পিছনে জামাত-ই-ইসলামি নয় কংগ্রেসের হাত ছিলো।
সরকার বিরোধী আন্দোলনে সব ধর্মের মানুষ নামলেও জগমোহন নিয়ন্ত্রিত প্রশাসন বেছে বেছে মুসলমানদের উপর বেশি অত্যাচার করে মুসলমান সত্তা জাগিয়ে তোলার জন্য। যে পদ্ধতি আমরা বর্তমানে উত্তর প্রদেশের যোগী সরকারকে নিতে দেখছি। এছাড়াও জগমোহন তার শাসনের কিছু সময়ের মধ্যে সরকারি পদগুলিতে মুসলমানদের নিয়োগ ৫০% কমিয়ে দিয়ে, মুসলিম সংখ্যাগুরু এলাকায় হিন্দু পরবের দিন মাংস বিক্রি নিষিদ্ধ ও ব্যাপক উন্নয়ন কর্মসূচির মধ্যে দিয়ে জগমোহন কাশ্মীরের ধর্মনিরপেক্ষ জাতীয়তাবাদকে ধ্বংস করতে চেয়েছিলেন।
এর পর ১৯৮৭ সালে ফারুক আবদুল্লাহ নিজের পিঠ বাঁচাতে কংগ্রেসের সাথে আবার জোট গঠন করে নির্বাচনে অবতীর্ণ হয়। এবার কং- ন্যাশনাল কনফারেন্স জোটকে হারাতে মুসলিম ইউনাইটেড ফ্রন্টের ছাতার তলায় ইসলামিক সংগঠনগুলোর সাথে গণতন্ত্র প্রিয় মানুষেরাও ঐক্যবদ্ধ হন। ব্যাপক রিগিং এবং কারচুপির মধ্যে দিয়ে ওই নির্বাচনে কং-কনফারেন্স জোট সরকারের তরফে ফারুক আবদুল্লাহ মুখ্যমন্ত্রী হন।
১৯৮৭ সালে কাশ্মীরের জেলে বসে ৫ জন যুবক মুকবুল ভাটের তৈরি সংগঠনটি পুনরুজ্জীবিত করার করেন। ধর্ম নিরপেক্ষ জম্মু কাশ্মীর লিবারেশন ফ্রন্টের ডাকে কাশ্মীরি যুবকেরা সশস্ত্র সংগ্রামে ঝাপিয়ে পড়ে। উপত্যকা আবার উত্তাল হয়। লিবারেশন ফ্রন্ট ১৯৮৯ সালে ১৫ সেপ্টেম্বর টিকা লাল টাপলু নামে এক বিজেপি নেতা, ৪ নভেম্বর নীলকান্ত গঞ্জু নামে এক প্রাক্তন বিচারপতিকে হত্যা করে, যিনি মুকবুল ভাটের মৃত্যুদন্ডের আদেশ দিয়েছিলেন। লিবারেশন ফ্রন্টের তরফে জানানো হয় এই হত্যাগুলো রাজনৈতিক হত্যা, এর সাথে ধর্মের কোনো সম্পর্ক নেই। সরকার পক্ষ এবং লিবারেশন ফ্রন্টের মধ্যে ব্যাপক খুনোখুনি হয়। সরকার পক্ষ যেমন লিবারেশন ফ্রন্টের সদস্য সমর্থকদের হত্যা করেছে তেমনি লিবারেশন ফ্রন্টও হিন্দু মুসলিম নির্বিশেষে সরকারপন্থীদের হত্যা করে। যদিও সরকার বা হিন্দুত্ববাদীদের তরফে গোটা ঘটনায় ধর্মীয় রং লাগাবার জন্যে শুধু মাত্র হিন্দুদের মৃত্যুর সংখ্যাটাই প্রচার করা হয়।
ব্যাপক রাষ্ট্রীয় দমন পীড়নের সময় কোথাও কোথাও মসজিদ থেকে হিন্দু বিরোধী ভাষণ দেওয়া হয়। পন্ডিতদের নামে হুমকি দিয়ে বেনামি পোস্টার পড়তে থাকে। কোথাও কোথাও ‘কাশ্মীরের স্বাধীনতা চাই, পন্ডিত পুরুষদের ছাড়া কিন্তু পন্ডিত নারীদের নিয়ে’ এরকম স্লোগানও উঠেছিলো। যদিও গবেষকদের মতে হিন্দু বিরোধী স্লোগান কোথাও কোথাও উঠলেও তা বিচ্ছিন্ন। গোটা কাশ্মীরের আন্দোলনে এই ধরনের মনোভাব ছিল না।
বিজেপি ও বাম সমর্থিত ভিপি সিং সরকার জগমোহনকে আবার রাজ্যপাল করে পাঠায় কাশ্মীরি আন্দোলন দমন করতে ১৯৯০ সালে। জগমোহন এতই কুখ্যাত ছিলেন কাশ্মীরের মানুষের কাছে যে প্রতিবাদে ভারতপন্থী ফারুক আবদুল্লাহ পদত্যাগ করেন।প্রশাসনের পুরো কর্তৃত্ব চলে যায় রাজ্যপালের হাতে। দ্বিতীয়বার জানুয়ারি মাসে ক্ষমতা হাতে পেয়েই গভর্নর জগমোহন ঘোষণা করেন যে জঙ্গিদের সন্ত্রাসী কার্যকলাপের প্রেক্ষিতে সরকারের পক্ষে হিন্দু পন্ডিতদের নিরাপত্তা দেওয়া সম্ভব নয়। কিছুদিন পর ফেব্রুয়ারি মাসের শেষের দিকে কয়েকজন কাশ্মীরি পন্ডিত নেতাকে ডেকে বলেন কাশ্মীর উপত্যকায় সন্ত্রাসীদের দমন করতে ভারতীয় সেনা বড়োসড়ো সামরিক অভিযান করবে। পন্ডিতরা যেন কিছু দিনের জন্য কাশ্মীর উপত্যকা ছেড়ে চলে যায়। এমনকি উপত্যকা ত্যাগের বিনিময়ে জমি নগদ টাকা সহ বিভিন্ন সুযোগ দেওয়ার কথা ঘোষণা করা হয়। হিংসা,সাম্প্রদায়িক প্রচার এবং গুজবে এমনিতে সংখ্যালঘু হিন্দু সমাজ আতঙ্কিত ছিলেন। এর পর খোদ রাজ্যপাল এবং প্রশাসন যখন নিরাপত্তার দায়িত্ব নিতে অস্বীকার করে এবং এলাকা ছেড়ে চলে যেতে বলে তখন আর কি উপায় থাকতে পারে? কাশ্মীরে স্বাধীনতাপন্থীদের হাতে অনেক মুসলমানের প্রাণ গেছে কখনো মুসলমান নেতাদের ডেকে কাশ্মীর ছেড়ে যেতে বলা হয়েছে কি?
রাতারাতি জম্মুতে ত্রাণ শিবির খুলে ফেলা হয়। কাশ্মীর উপত্যকার এক ট্যাক্সি চালক রাজিন্দর সিং ১৯৯০ সালের মার্চ মাসে মানবধিকার সংগঠন পিইউসিএল-কে জানায় ১৯৮৪ সালের শিখ বিরোধী দাঙ্গার সময় বা অন্য কোনো দাঙ্গার সময় আগে ভাগে এরকম ত্রাণ শিবির খোলা হয়নি।
কে এল কাউল এবং এম কে তেং-এর দাবি অনুযায়ী ২ লক্ষ ৬০ হাজারের উপর পন্ডিত কাশ্মীর থেকে প্রাণ বাঁচাতে পালিয়েছিলেন। ১৯৯৪ সালে জানুয়ারি মাসে Sunday সাময়িকীর দেওয়া তথ্য অনুযায়ী এই সংখ্যাটা ৩ লক্ষ ৫০ হাজার। যদিও ১৯৮৯ সালে কাশ্মীরি পন্ডিতদের জনসংখ্যা ছিলো ১লক্ষ ৪০ হাজারের কাছাকাছি। হিন্দুত্ববাদীরা বা সংবাদ মাধ্যম অহেতুক মিথ্যা বলার বাতিক জনিত কারণে দেশান্তরি পন্ডিতদের সংখ্যাটা বাড়িয়ে বলে। কিন্ত দেশান্তরি পন্ডিতদের আসল সংখ্যাটাতো কম নয়! এখন কাশ্মীরে মাত্র ৩ থেকে ৪ হাজার পন্ডিত ২৯২টা অঞ্চলে ছড়িয়ে ছিটিয়ে মুসলমানদের সাথেই বাস করেন।
Sunday পত্রিকার মত অনুযায়ী ৫০টি হিন্দু মন্দির ধ্বংস করা হয়েছিলো। বিজেপি নেতা আদবানির দাবি অনুযায়ী ৪০ টি হিন্দু মন্দির ধ্বংস করা হয়েছিলো। আর এস এস এর ইস্তেহারে বলা হয়েছিলো জঙ্গিরা ৩৬ টি হিন্দু মন্দির ধ্বংস করে। India Today র সাংবাদিকরা ২৩ টি ‘ধ্বংসপ্রাপ্ত’ মন্দিরের তালিকা নিয়ে ১৯৯৩ সালে ফেব্রুয়ারিতে কাশ্মীর ভ্রমণ করেন। এই সাংবাদিকদের মতে ২৩ টি মন্দিরের মধ্যে ২১টি ছিলো পুরোপুরি অক্ষত। মন্দিরের পুজারিরা পর্যন্ত সাংবাদিকদের বলেছিলেন তাদের উপর বা ধর্মস্থানের উপর কোনো আক্রমণ হয়নি। মন্দিরের ছবি সহ রিপোর্টটি ২৮ ফেব্রুয়ারি India Today র সংখ্যায় ছাপা হয়।
ঐতিহাসিক রামচন্দ্র গুহর মতে ১৯৯০-এর দশকে শাসক শ্রেণি যে সাম্প্রদায়িক পরিবেশ তৈরি করেছিলো তার ফলে এবং লিবারেশন ফ্রন্টের সংগঠন ধাক্কা খাওয়ার সুযোগে লিবারেশন ফ্রন্টের প্রতিদ্বন্দ্বী হিসেবে হিজবুল মুজাহিদিন উঠে আসে, যা নতুন স্লোগান নিয়ে আসে “না গেরিলা যুদ্ধ, না জাতীয় মুক্তি সংগ্রাম, আল জিহাদ! আল জিহাদ!”। কাশ্মীরের জাতীয় স্বাধীনতা সংগ্রামকে ইসলামের সংগ্রামে পরিণত করতে চায় এমন সংগঠনের প্রভাব বাড়াতে চেয়েছিলো ভারত-পাক দুই পক্ষই। তারা অনেকটা সফলও বটে। প্রতিরোধী সংগঠন ইসলামিক বা পাকিস্তানপন্থী যাই হোক না কেন কাশ্মীরি জনতার আকাঙ্ক্ষা আত্মমর্যাদা, আজাদি।
আন্তর্জাতিক সংবাদ সংস্থা আল জাজিরার ২০১১ সালের একটি প্রতিবেদনে এখনো কাশ্মীর উপত্যকায় রয়ে গেছেন এরকম একজন পন্ডিত সঞ্জয় টিকুর বয়ান উল্লেখ করা হয়েছে। তিনি ১৯৯০ সালে ঠিক কী ঘটেছিলো তা স্মৃতি থেকে বর্ণনা করেন। তিনি জানান যে শ্রীনগরে তার বাড়ির বাইরে উর্দুতে লেখা একটি পোস্টার পরে। তিনি সেটি পড়তে না পেরে দাদুকে ডাকেন। দাদু সেই পোস্টারের অনুবাদ করে বলেন তাতে যা লেখা ছিলো তার মর্মার্থ হলো তাদের পরিবারকে কাশ্মীর ছেড়ে চলে না গেলে মেরে ফেলার হুমকি।এই খবর সংবাদ পত্রে প্রকাশিত হওয়ার পর এলাকার মুসলমান প্রতিবেশীরা তাদের বাড়িতে ভিড় করে জমা হন, ক্ষমা চান এবং কাশ্মীর না ছাড়ার জন্য আবেদন জানান। সঞ্জয় টিকলুর পরিবার কাশ্মীর ছাড়েনি।
ভিডিওর অংশতে সঞ্জয় টিকলু জানিয়েছেন গণভোটে যদি ভারত আর পাকিস্তান দুটো বিকল্প থাকে তবে তিনি ভারতের পক্ষে ভোট দেবেন। কিন্তু স্বাধীন কাশ্মীর যদি কোনো বিকল্প হয়, সংখ্যাগরিষ্ঠ মানুষ যদি স্বাধীন কাশ্মীর চায় এবং স্বাধীন কাশ্মীরে যদি তার সামাজিক রাজনৈতিক স্বাধীনতা রক্ষিত হয় তবে তিনি স্বাধীন কাশ্মীরের পক্ষে। কারণ তার আত্মপরিচিতি রাজস্থান বা জম্মু নয় কাশ্মীরের সাথে জড়িত।
প্রখ্যাত তথ্যচিত্র নির্মাতা সঞ্জয় কাক নিজে একজন কাশ্মীরি পন্ডিত। ২০০৭ সালে তিনি তার অনবদ্য তথ্য চিত্র “জসন ই আজাদি” প্রকাশ করেন যা কাশ্মীরের আজাদির লড়াইয়ের প্রতি তার সহানুভূতির প্রমাণ। তার মতে হিন্দু হোক বা মুসলমান স্বাধীনতা সমস্ত কাশ্মীরির আকাঙ্খা।
কাশ্মীরি পন্ডিতদের ঘরে ফেরানো হিন্দুত্ববাদীদের একটি অন্যতম ইস্যু। কাশ্মীরি পন্ডিতদেরও তাদের ঘরে ফেরাবার দাবিতে মাঝে মাঝে প্রতিবাদ বিক্ষোভ দেখা যায়। জম্বু কাশ্মীর লিবারেশন ফ্রন্টের নেতারা বিশেষত ইয়াসিন মালিক ১৯৮৯ সাল থেকেই পন্ডিতদের আশ্বস্ত করে আসছেন এবং ঘরে ফেরার আবেদন জানিয়ে আসছেন। একই বার্তা বার বার দিয়েছেন বর্ষীয়ান হুরিয়ত কনফারেন্সে নেতা গিলানি। হিজবুল কামান্ডার বুরহান ওয়ানি কাশ্মীরি পন্ডিতদের নিজের দেশে ফিরতে আবেদন জানিয়েছিলেন, শুধু তাই নয় ভারত সরকারকে কাশ্মীরি পন্ডিতদের ফিরিয়ে আনতে পরিবহণের সমস্ত ব্যবস্থা করার দাবি জানিয়েছিলেন তার ভিডিও বার্তায়। বুরহান ওয়ানির মৃত্যুর পরে হিজবুলের নতুন কমান্ডার আবার কাশ্মীরি পন্ডিতদের ঘরে ফেরার ডাক দেন এবং তাদের নিরাপত্তার আশ্বাস দেন। তিনি পন্ডিতদের উদ্দেশ্য করে বলেন, যারা কাশ্মীরে বাস করছে এরকম পন্ডিতদের দেখুন তারা ভালো আছে।
কিন্তু তাহলে রহস্য হলো কাশ্মীরি পন্ডিতরা ঘরে ফিরতে পারছেন না কেন? কে বাধা দিচ্ছে? ২০১৯ সালের নভেম্বর মাসে ভারতের কনসাল জেনারেল সন্দীপ চক্রবর্তী নিউইয়র্কে একটি সভায় কাশ্মীরি পন্ডিতদের ঘরে ফেরা প্রসঙ্গে ইজরায়েলি সেটলমেন্টকে আদর্শ হিসেবে হাজির করে বলেন, যদি ইজরায়েলিরা পারে তবে আমরাও পারবো। ইঙ্গিত স্পষ্ট। সহজ ভাবে সম্প্রীতির পরিবেশে ঘরে ফেরা নয়, কৃত্রিম সমস্যা তৈরি করে সামরিক ট্রাকে চাপিয়ে পন্ডিতদের ঘরে ফেরানোর লক্ষ্য ভারতের শাসক শ্রেণির(যদি আদৌ ঘরে ফেরানোটা উদ্দেশ্য হয়)। আর কাশ্মীরি পন্ডিতরা সত্যি যদি স্বাভাবিক ভাবে ঘরে ফেরে তবে রাজনীতির কারবারিদের ব্যবসা মার যাবে। কনসাল জেনারেল তার বক্তব্যে কাশ্মীরি পন্ডিতদের দিল্লি বা জম্মুতে এখনো রিফিউজি ক্যাম্প বা ফুটপাথে বসবাসের কথা উল্লেখ করেছেন। এই কাশ্মীরি পন্ডিতদের রিফিউজি ক্যাম্প বা ফুটপাথ বাসের কথা হিন্দুত্ববাদীদের মুখে প্রায়ই শোনা যায়। কিন্তু সত্যি কি কাশ্মীরি পন্ডিতরা ১৯৯০ সাল থেকে আজ পর্যন্ত ৩০ বছর ধরে রিফিউজি ক্যাম্পে বা ফুটপাথে আছেন? এখনো যদি থাকেন তবে সেই ব্যর্থতার দায় ভার কি বিজেপি সরকারের উপরেও বর্তায় না?
সাংবাদিক সিভম ভিজ তার প্রতিবেদনে দেখিয়েছেন, জম্মু হোক বা দিল্লি আদৌ কোথাও কোনো পন্ডিত রিফিউজি ক্যাম্পে নেই, কেউ ফুটপাথেও থাকেনা। প্রত্যেকে কংগ্রেস আমলেই ঠিকঠাক বাড়ি বা টাউনশিপে স্থানান্তরিত হয়ে গেছেন। উদাহরণ হিসেবে ‘জগতি টাউনশিপের’ ছবি দিয়েছেন যা বিজেপি এবং মিডিয়া পন্ডিতদের দুর্দশা বর্ণনা করতে রিফিউজি ক্যাম্প নামে চালিয়েছেন। সিভম ভিজের মতে কাশ্মীরি পন্ডিতদের বাস্তবিকই আর উপত্যকায় ফেরা সম্ভব নয় কারণ কাশ্মীরি পন্ডিতরা উচ্চশিক্ষিত হওয়ায় তারা দেশে বিদেশে বিভিন্ন ক্ষেত্রে সুপ্রতিষ্ঠিত। তিনি প্রশ্ন তুলেছেন কাশ্মীরি পন্ডিতদের সন্তানরা কি মুম্বাইয়ের কর্পোরেট হাউসের চাকরি ছেড়ে পুরনো শহর শ্রীনগরে গিয়ে থাকতে চায়? তিনি উদাহরণ দিয়ে দেখিয়েছেন পুরনো প্রজন্মের কাশ্মীরি পন্ডিতরা উপত্যকায় ফিরতে চায় না কারণ তাদের বন্ধুরা বেশির ভাগই জম্মুতে থাকেন। শ্রীনগরে গেলে নিজেকে বহিরাগত বলে মনে হয় কারণ এখন প্রায় সবাই সেখানে অপরিচিত। আর নতুন প্রজন্ম পুরনো শহর শ্রীনগরে ফিরতে চায়না, ঐ শহরের ঘর বাড়ি, শৌচাগার, গলি সবই পুরনো ধরনের।
২০১৭ সালে জানুয়ারি মাসে কাশ্মীরে পিডিপি-বিজেপি সরকার ঢাক ঢোল পিটিয়ে উপত্যকায় পন্ডিত উদ্বাস্তদের টাউনশিপ বানাবার জন্য ১০০ একর জমি চিহ্নিত করার কথা ঘোষণা করেছিলো। স্বাধীনতাপন্থী সংগঠনগুলো কাশ্মীরি সমাজ থেকে পন্ডিতদের বিচ্ছিন্ন করে, এরকম প্রকল্পের বিরোধিতা করে। যদিও ঐ বছর ২৩ নভেম্বর জম্মুর অ্যাকটিভিস্ট রোহিত চৌধুরীর করা আরটিআই মারফত জানা গেছে, সকারের তরফে আদৌ এরকম কোনো পরিকল্পনা হয়নি।
ব্রিটিশ আমল থেকেই ধর্মের নামে বিভাজন শাসক শ্রেণির পুরনো হাতিয়ার। মিথ্যা প্রচার, অতিরঞ্জন উগ্রহিন্দুত্ববাদের ভিত্তি। ভারতে এই উগ্র জাতীয়তাবাদ প্রকাশ্যে ঘোষণা করে সরাসরি সংখ্যালঘুদের ক্ষতি করেছে। আর হিন্দুদের ক্ষতি করেছে বোকা বানিয়ে। যার অন্যতম উদাহরণ কাশ্মীরি পন্ডিতরা।