মালবিকা মিত্র
পঞ্চায়েত নির্বাচনের ঢাকে পড়লো কাঠি। প্রাক নির্বাচনী ও নির্বাচনোত্তর আইন শৃঙ্খলা বিঘ্নিত হবে। সেই অনিবার্য সম্ভাবনায় মুক্ত অবাধ নির্বাচনের স্বার্থে কয়েকশ’ কোম্পানি কেন্দ্রীয় বাহিনীর দাবি অনিবার্য ভাবে ধ্বনিত হবে। হওয়াই স্বাভাবিক, সরকারি কর্মচারীরা প্রাণের ঝুঁকি নিয়ে প্রহসনের নির্বাচন করতে যাবেন কেন? নিরপেক্ষ রাজ্য সরকারি কর্মচারীরা পক্ষপাতদুষ্ট রাজ্য সরকারি পুলিশের হাতে নিরাপত্তাহীনতায় ভুগতে থাকে। এতো আশঙ্কা, নিরাপত্তার অভাব নিয়ে ভোট করতে যাওয়া যায় না। একজন অবসরপ্রাপ্ত সরকারি কর্মচারী হিসেবে আমি সোচ্চার কন্ঠে কেন্দ্রীয় বাহিনী দাবি করছি।
সমস্যা দেখা দিচ্ছে অন্যত্র। কেবল নির্বাচনের সময়ে কেন? সারা বচ্ছর মানুষের জীবন নিরাপত্তা কি উপেক্ষা আর অবজ্ঞার বিষয়? তাহলে কেন সারা বছরই শান্তি শৃঙ্খলা নিরাপত্তার দায়িত্ব কেন্দ্রীয় বাহিনীর হাতে থাকবে না? সেটাই দেশ ও দশের পক্ষে মঙ্গলজনক। আমার দাবি, সারা বছর রাজ্যে কেন্দ্রীয় বাহিনীর উপস্থিতি চাই।
আর তাছাড়া রাজ্য সরকারের প্রয়োজন কোথায়? দুর্নীতি, স্বজন পোষণ, অর্থ নয়ছয়, এক কথায় অনিয়ম। সেই অনিয়মের নিরপেক্ষ তদন্তের জন্য সিবিআই, এনআইএ, ইডি। এতো হ্যাপার দরকার হয় না, যদি কেন্দ্রীয় প্রশাসন নিযুক্ত থাকে। কোনো রাজ্য প্রশাসন নয়, সব আইএএস, আইপিএস, আইআরএস। একদম পারফেক্ট ডবল ইঞ্জিন। টু ইন ওয়ান। নেশন, চলেগি নেহি, দৌড়েগি। রাজ্যই তো দেশকে এগুতে দেয়না, বিপরীত মুখে টানতে থাকে। একজন রাজ্যপাল থাকবে, দিল্লির সাথে থাকবে হটলাইন যোগাযোগ। থাকবে আইএএস সচিবালয়। নো মুখ্যমন্ত্রী, নো মন্ত্রিসভা।
অন্ততঃ এখন এখনই একটা কাজ করা সম্ভব: রাজ্য সরকারের কর্মচারী নয়, পুরো কেন্দ্রীয় বাহিনী আর কেন্দ্রীয় সরকারি কর্মচারীদের দিয়েই এই ভোটটা হয়ে যাক। ব্যাপারটা দারুণ জমবে। একটাই সমস্যা দেখা দেবে। সারপ্লাস।
তার মানে এই যুক্তরাষ্ট্রের কাঠামোটা আগে উচ্ছেদ করা প্রয়োজন। এই কাঠামোই তো হাবিজাবি শেখায়। নানা ভাষা, নানা মত, নানা পরিধান, যত্তোসব বাখোয়াজি। আঞ্চলিক ভাষা, সংস্কৃতি, জাতিসত্তার স্বাতন্ত্র্য রক্ষা। কেএফসি ডমিনো’স সারা দেশে চলছে না? বাংলায় ধনতেরাস, হোলি, দিওয়ালি, হনুমান জয়ন্তী, রামনবমী, রঙ্গোলি, সঙ্গীত, মেহেন্দি চলছে না? আদানি ফরচুন ব্র্যান্ডের ধোকলা বানাবে, সমস্যা কি? আর বাংলা ভাষা তো ইফ, বাট, হোয়াট, সো, সরি, প্লিজ, কিঁউ কি, আরে ইয়ার, জলদি বাঁতাও, উঠা লে, বিন্দাস, ঝাক্কাস কে আপনা বনা লিয়া। সুতরাং নো পরিসানি।
আমি খুব খুশি। এক দেশ, এক ধর্ম, এক আইন, এক প্রশাসন, এক ভাষা, এক খাদ্যাভ্যাস। দারুণ ব্যাপার। আমি ডবল ইঞ্জিনের পূর্ণাঙ্গ একটা ছবি কল্পনায় দেখতে পাচ্ছি। টু ইন ওয়ান ! ভাবুন, নতুন সংসদ ভবনের দ্বারোদ্ঘাটন, ২৮ মে ! মনে হবে রাম মন্দিরের দ্বারোদ্ঘাটন। সংসদ, রাম মন্দির, আদালত, সব একাকার। তিলক, হরে কৃষ্ণ, হরি বোল, দুর্গা দুর্গা, বিপদভঞ্জন মধুসূদন রক্ষা করো …. ছিঃ, কেমন ন্যাকা ন্যাকা। মাথায় ফেট্টি কপালে সিঁদুর জয় শ্রীরাম, কি দারুণ।
জুতোর একটাই পেরেক পায়ে বিঁধছে। শুনেছি গো রক্ষার মতো মীন রক্ষা সমিতি হয়েছে, বিষ্ণুর মৎস্য অবতার। গুজরাট রাজস্থান এমপি ইউপির ভেজ শুদ্ধাচারী হিন্দুরা নাকি ননভেজদের হিন্দু মনেই করে না। সেই বৈদিক যুগেই কয়েক শ’ বছর পরে পরেই আর্যদের ঢেউ প্রবেশ করেছে। দ্বিতীয় ঢেউয়ের ধাক্কায় প্রথম ঢেউ ছড়িয়ে পড়ে অভ্যন্তরে। অভ্যন্তরে অনার্য ভাষা রীতিনীতির সংস্পর্শে আসে। অর্থাৎ দ্বিতীয় দফার আর্যদের চোখে প্রথম দফার আর্যরা অশুদ্ধ। আরও ঢেউ আসতে থাকে, একই নিয়মে প্রথম দ্বিতীয় তৃতীয়রা অশুদ্ধ অসুর হিসেবে চিহ্নিত হয়ে যায়। সুদূর নিম্ন গাঙ্গেয় সমভূমির আমরা আগে থেকেই অশুদ্ধ অসুর। তাহলে কি হইবো কাকা?
আবার কি হলো? টু ইন ওয়ান জুতোর একটা সমস্যা না হয় বুঝলাম। ডাঁটা চিবোলে পাতের পাশে ছিঁবড়ে একটু নাহয় জমবে। অব তো হাসো ইয়ার। কি হলো? কোই দুসরা তকলিফ?
উত্তর-পূর্ব ভারত, কাশ্মীর সর্বত্রই তো কেন্দ্রীয় বাহিনীর তত্ত্বাবধানে রয়েছে। তারপরও তো আগুন জ্বলছে। ইরম শর্মিলা চানুর ঐতিহাসিক অনশন তো কেন্দ্রীয় বাহিনী ও তার বিশেষ ক্ষমতা আফস্পার বিরুদ্ধে। কেন্দ্রীয় বাহিনীর হাতেই তো মনোরমা ধর্ষণ ও খুন, হাজার হাজার মায়ের প্রতিবাদ। মধ্য ভারতের ছবিটাও আশা ব্যঞ্জক নয়। বস্তার, বয়লাডিলা, মধ্য ভারতের সমগ্র আদিবাসী জনজাতির পাহাড় জল-জঙ্গল-রক্ষার লড়াই নিজেদের জীবন দিয়ে কেন্দ্রীয় বাহিনীকে চিনেছে। প্রতিদিনই মেয়েরা বাহিনীর হাতে ধর্ষিতা হয়। সুধা ভরদ্বাজ, গৌতম নওয়ালখা, অরুন্ধতী রায়, ভারভারা রাও, হিমাংশু কুমারের লেখায় বাহিনীর কুৎসিত রূপ ফুটে উঠেছে। আর সোনি সোরির ওপর পীড়নের কাহিনি তো সর্বজনশ্রুত। পশ্চিমবঙ্গের শীতলকুচি, সেখানেও তো কেন্দ্রীয় বাহিনীর হাতেই চার গ্রামবাসীর মৃত্যু। তাহলে? কী যে করি ভেবে নাহি পাইরে।
কনফিউশন কিছুতেই যাচ্ছে না কাকা। এই যে লিখেছে : “দেশের সীমান্ত রক্ষা করাই সশস্ত্র বাহিনীর কাছ থেকে প্রত্যাশিত …. শাসক শ্রেণি ক্রমশ বেশি বেশি করে সশস্ত্র বাহিনী ও আধা সেনা বাহিনীর ওপর নির্ভর করে …… জনগণকে দমনের হাতিয়ার হিসেবে ব্যবহৃত হয় …… মৌলিক অধিকারের প্রয়োগ কার্যতঃ বন্ধ হয়ে যায়। মাসের পর মাস, বছরের পর বছর কেন্দ্রীয় বিধিনিষেধ জারি রেখে গোটা এলাকায় মানুষের স্বাধীনতাকে অস্বীকার করা হয়।”
দেখুন, আরও লিখেছে : “বিচার বিভাগ প্রশাসনের প্রভাব ও নিয়ন্ত্রণের অধীন !! ….. রাজ্যগুলির জন্য ওপর থেকে নিযুক্ত কোনও রাজ্যপাল থাকবে না। প্রশাসনিক কৃত্যগুলি সংশ্লিষ্ট রাজ্যগুলির প্রত্যক্ষ নিয়ন্ত্রণে থাকবে” ….. তার মানে আইএএস আইপিএস না, বিসিএস ……
থামো দেখি। হঠাৎ করে মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের ভাষণ, কর্মসূচি পড়তে শুরু করলে কেনো? না কাকা না, এসব তো লিখেছে সিপিএমের কর্মসূচির পুস্তিকায়। কি সাংঘাতিক !! তাহলে কেন্দ্রীয় বাহিনীর কি হবে?
ঠিক আছে। ওসব কথা এরাজ্যের জন্য নয়। বলতে হবে কেরালায় এবং অন্যান্য বিজেপি-বিরোধীদের দ্বারা শাসিত রাজ্যে। যারা সিপিএমকে হারিয়ে ক্ষমতায় এসেছে, তাদের ক্ষেত্রে যুক্তরাষ্ট্রীয় কাঠামো রক্ষার নীতিগত অবস্থান বজায় রাখা চলে না। তাই শুধু নিরাপদে ভোটের দাবি তুললেই চলবে না, কেন্দ্রীয় বাহিনীর কথাও বলতে হবে।