দুর্বল হতে থাকা সরকারি পরিষেবার চোরাবালিতে ডুবছেন স্বার্থমগ্ন সরকারি কর্মচারীরা
মালবিকা মিত্র
১৯৯৭ সালের কথা বলছি। মুক্তদ্বার উদারীকরণ চালু হলেও তখনও সর্বগ্রাসী হয়নি। আমি পুরুলিয়া জেলা স্কুলে শিক্ষকতা করি। সরকারি বিদ্যালয়ের শিক্ষক শিক্ষিকারা আবার নিজেদের ‘গ্রুপ এ’ অফিসার বলতে বেশি তৃপ্তি বোধ করে। তা হলো কি, আমার মা CVA মানে ceribro vascular accident-এ আক্রান্ত হয়ে চন্দননগরের সরকারি হাসপাতালে ভর্তি হলেন। ডাঃ স্বর্ণকারের তত্ত্বাবধানে ভর্তি হলেন। ডাক্তারবাবু বললেন, যেখানেই যাবেন এই চিকিৎসাই হবে। ডেক্সট্রোস, এন এস, রিঙ্গার্স সল্যুশন, ম্যানিটল, ক্যাথিটার ও তার সেফগার্ড হিসেবে অ্যান্টিবায়োটিক, কাইমোরাল ফোর্ট, ল্যাসিক্স, অ্যাসপিরিন, মোটামুটি এগুলো মনে আছে এখনও। প্রশ্ন করলাম বেটার ট্রিটমেন্ট পাবার কোনো সাজেশন? বললেন, জাঁকজমক চাকচিক্যের ঠিকানা বলতে পারি, যেখানেই যান চিকিৎসা এটাই, যেটা চলছে। মা ২৬ দিন হাসপাতালে থেকে জীবন ফিরে পেয়ে বাড়ি ফিরলেন।
আমি পুরুলিয়া ফিরে গিয়ে শুনলাম, মায়ের চিকিৎসা বাবদ আমি নাকি সর্বোচ্চ ৪০০ (চারশো) টাকা ও ২৬দিন দুবেলা অর্থাৎ ৫২ টি আয়া খরচ পাবো। এই ছিল মেডিকেল রিইমবার্সমেন্ট। আমি হিসেব মতোই পেয়েছিলাম। এক্ষেত্রে বলে রাখি, গ্রুপ এ থেকে গ্রুপ ডি সবার এই একই বরাদ্দ ছিল। হাজার হাজার টাকার ওষুধ কিনে দিয়েছি, একথা সত্যি। আবার মেট্রন কেতকী দত্ত কখনো কখনো বলেছেন নতুন স্টক এসেছে, দুদিন কিনতে হবে না। বরাদ্দ নিশ্চিত ভাবে সামান্য। কিন্তু সবার সমান।
প্রসঙ্গত বলে রাখি, বিকাশ ভবনে আমার বদলির জন্য রিমাইন্ডার দিতে গিয়ে, কৌতূহল বশতঃ জানতে চাইলাম, যদি চন্দননগর মহকুমা হাসপাতালে আমার মায়ের যথাযথ চিকিৎসার ব্যবস্থা না থাকতো তাহলে? জানলাম তখন আরও বড়ো সরকারি হাসপাতালে রেফার করা হতো। যদি দেখা যায় ওই রোগের চিকিৎসা এ রাজ্যের কোনো সরকারি হাসপাতালে হয় না। তখন বেসরকারি হাসপাতালে, ভিন রাজ্যের হাসপাতালে হবে সরকারি খরচে। আমার বেশ ভালো লাগলো। সরকারি হাসপাতালে কর্মচারী ডাক্তার আসছেন বদলি হয়ে, ডিএম-এসডিও-টিও-কর্মচারী আসছেন বদলি হয়ে। তারাও নিশ্চিন্ত সন্তানের স্কুল কলেজে ভর্তি নিয়ে। তাদের ভর্তি হবেই।
এই নিরাপদ নিশ্চিন্ত জীবনের ছেদ ঘটলো বছর পাঁচ দশের মধ্যে। বুদ্ধবাবুর শাসনে নতুন পে কমিশনে সরকারি কর্মচারীদের শরীরের শ্রেণিভেদ ঘটলো। গ্রুপ ডির মাথা আর গ্রুপ এ অফিসারের মাথা এক নয়, স্বীকৃতি দেওয়া হলো। অতএব দুজনের মাথা ব্যথার চিকিৎসার প্যাকেজ আলাদা। কিন্তু সরকারি হাসপাতালে তো দ্বিধারার চিকিৎসা পরিসেবা প্রদান সম্ভব নয়। অতএব বেসরকারি স্বাস্থ্য ব্যবস্থার দ্বারস্থ। ১৯৯০-এর উদারীকরণ অর্থনীতির সুবাদে অনেক বেসরকারি কর্পোরেট হাসপাতাল গজিয়ে উঠেছিল। কিন্তু তাদের পরিসেবা মূল্য সাধারণের নাগালের বাইরে। ফলে তাদের ব্যবসা জমছিলো না। সরকারি কর্মচারীদের নতুন হেল্থ স্কিমে সরকারি অর্থ কর্পোরেট হাসপাতালের ঘরে তুলে দেবার ব্যবস্থা করা হলো। মনে রাখবেন ‘টিম বুদ্ধ’ ছিল কর্পোরেট পুঁজির সেবায় নিয়োজিত। মনে আছে সেই উক্তি, ‘রতন টাটার কেশাগ্র স্পর্শ করতে দেবো না’।
আরও পড়ুন: মহার্ঘভাতা অধিকার : কিন্তু….
শুধু টিম বুদ্ধকে দুষলে ভুল হবে।
(১) একদিকে সরকারি হাসপাতালে রক্তসঞ্চালন-বরাদ্দ কমানো হতে লাগলো সুকৌশলে। ফলে সরকারি হাসপাতালের ওপর থেকে সাধারণ আস্থা কমতে লাগলো।
(২) বেসরকারি হোটেল কাম হাসপাতালের চোখ ধাঁধানো গ্ল্যামার মানুষকে স্বপ্নে বিভোর করলো। ফলে তার কাছে সরকারি স্বাস্থ্য ব্যবস্থা, চিকিৎসা উন্নত করার দাবি এলো না। বরং আত্মার আরাম আমরি, অ্যাপোলো, আর এন টেগোর, হাতের মুঠোয় পড়ে পাওয়া চোদ্দো আনা।
(৩) যে বেসরকারিকরণ সহজে করা সম্ভব ছিল না, বামপন্থী সরকার কতো সহজে স্বেচ্ছায় সেই জনগণকে তেতো গেলাতে সক্ষম হলো। ব্রেখটের নাটক মনে পড়ছে। স্বৈরাচারী শাসক বেড়ালকে জোর করে লঙ্কা বাটা খাওয়াতে গিয়ে নিজেই বেড়ালের কামড়ে আঁচড়ে রক্তাক্ত হয়। সংশোধনবাদী লঙ্কা বাটা লাগায় বেড়ালের মলদ্বারে। প্রবল জ্বলুনিতে বেড়াল মুখ ঘুরিয়ে পেছন চাটতে থাকে, যাতে সব লঙ্কাটুকু পরিষ্কার করা যায়। এই হলো স্বেচ্ছায় লঙ্কা বাটা খাওয়ানো।
(৪) একথা সত্যি যে এর পরেও সমস্ত মানুষকে রাতারাতি কর্পোরেটমুখী করা সম্ভব হতো না। নাগালের মধ্যেই, হাফ গেরস্ত একগুচ্ছ নার্সিং হোম গজিয়ে উঠেছিল। এরা যেন বাচ্চা শুয়োর। মুষিকের বড়ো, আবার গজ অপেক্ষা ছোটো, মুষিক বৃদ্ধি গজক্ষয়। শূয়োরের বাচ্চা। এগুলো নিচের তলার কাছে সহজে গ্রহণযোগ্য হলো, আবার মধ্যবর্গের কাছেও গ্রহণযোগ্য। কর্পোরেটে উল্লম্ফনের পূর্বে এই মধ্যবর্তী স্তরটি বিশেষ তাৎপর্যপূর্ণ। লক্ষণীয়, সরকারি হেল্থ স্কিমে কর্পোরেট হাসপাতাল ছাড়াও বেশ কিছু হাফ গেরস্ত হাসপাতালের নাম রয়েছে। সরকারি উচ্চ বর্গের অফিসারের স্বাস্থ্য ও সরকারি পিয়নের স্বাস্থ্য তো সমান গুরুত্বপূর্ণ নয়।
তাহলে বিষয়টি দাঁড়ালো, সরকারি হাসপাতাল আছে, কিন্তু এই সব সরকারি হাসপাতালে কোনও সরকারি কর্মচারী যায়না। এমনকি ওই হাসপাতালের কর্মীরাও নয়। সরকারি বিদ্যালয় আছে, কিন্তু এই সব সরকারি বিদ্যালয়ে কোনও সরকারি অফিসার কর্মচারী যায়না। এমনকি ওই বিদ্যালয়ের শিক্ষক শিক্ষাকর্মীর সন্তানও নয়। সরকারি হাসপাতাল বিদ্যালয়ে কর্মচারী অফিসারের বেতন হয়, ইনক্রিমেন্ট হয়, সেই উপার্জন বাজারে ফিরে আসে না। ক্ষমতাবান কর্পোরেট ঝুলিতে জমা হয়। বেসরকারিকরণের সরকারি নীতির অংশীদার হই আমি। কর্পোরেট থাবায় স্বাস্থ্য শিক্ষা মহার্ঘ হয়। আমি মহার্ঘ ভাতার জন্য লড়াই করি। একবার অনুভব করিনা, যেটার ওপর আমি দাঁড়িয়ে আছি সেটাই অপসৃয়মান। আর স্বাস্থ্যসাথী কার্ডের সুবাদে এখন দরিদ্রতম ব্যক্তিও আমরি রুবি পৌঁছে যাচ্ছে। এবার তাহলে সরকারি হাসপাতালের সুবিশাল ক্যাম্পাস বছর দশ পরে আগাছায় ভরবে। বন্ধ কারখানার মতো করুণ দশা। অতঃপর রিয়াল এস্টেট ভবিতব্য।
ডানলপ কারখানা বন্ধ হবার বহু আগেই ডিউটি সিডিউল কমছে, পাঁচদিনের সপ্তাহ, চারদিনের সপ্তাহ যখন রোগের ইঙ্গিত দিচ্ছিল, কেউ সচেতন হয়নি। এখন সরকারি হাসপাতাল, বিদ্যালয় যেমন। সবাই অবসর এনজয় করেছে। তারপর একদিন নেমে এলো স্থায়ী অবসরের কাল। মাথায় বজ্রাঘাত। কখনো ভেবে দেখেছেন, বিরাট ক্যাম্পাস জুড়ে বিল্ডিং, স্কুল হাসপাতাল উভয়ের। কেউই যদি না যায় সেগুলো হবে abundant ক্যাম্পাস। তারপর একদিন সেগুলো জলের দরে হাত বদল হবে। সরকার নিজে দায় ঝেড়ে ফেলতে ব্যস্ত, আর জনতা ততোধিক ব্যস্ত হয়ে দৌড়াচ্ছে বেসরকারি হাসপাতালে স্কুলে। একে মনসা, তায় ধুনোর গন্ধ।
বলতে দ্বিধা নেই, আমার এলাকায় (ওয়ার্ডে) বাম আমলের প্রথম ১৫ বছরে জিএসএফপি স্কুল জন্ম নিলো যত্রতত্র। অপরিকল্পিত ভাবে। বলতে পারেন, শিক্ষক নিয়োগের জন্য বিদ্যালয় প্রতিষ্ঠা। ছিল মাত্র একটি, হলো মোট ছয়টি। বাম সরকারের মেয়াদেই চারটি স্কুলের গঙ্গা প্রাপ্তি ঘটলো। অথচ এলাকায় বেসরকারি বিদ্যালয়ে ছাত্রের স্থান সংকুলান হয় না। খুব দায়িত্ব নিয়ে বলছি, যে দুটি জিএসএফপি স্কুল চালু আছে, সেগুলোর শিক্ষক শিক্ষিকাদের নিরলস অধ্যবসায় ও পরিশ্রমের ফলে বেসরকারি স্কুল থেকে ছাত্র সরকারি স্কুলে পড়তে আসছে। এই দুই স্কুল আমার শৈশবকাল থেকে পরম্পরা বজায় রাখতে পেরেছে। ‘পরের ছেলে পরমানন্দ, যত গোল্লায় যায় ততই আনন্দ’ পরিচিত এই ছকের বাইরে পরম যত্নে, পিতৃ মাতৃসুলভ স্নেহের বন্ধনে আগলে রাখেন। অভাবের সংসারে মা যেমন ‘চাল বাড়ন্ত’ বলে সন্তানকে উপোসী রাখেন না। খুদকুড়ো, বুনো শাক, মেটে আলু যাহোক কিছু সন্তানের মুখে তুলে দেন। জানেন, কল্যাণী গান্ধি হার্ট হাসপাতালে বাইপাস সার্জারি বন্ধ হতে বসেছিল। কারণ সার্জারির সাতজনের টিমের একজন অবসর নিয়েছেন। তাই বলে তো সার্জারি বন্ধ করা যায় না। কার্ডিও থোরাসিক সার্জনরা ঠিক করলেন বুদ্ধিমান ও একনিষ্ঠ একজন গ্রুপ ডি কর্মীকে বেছে নেওয়া হলো। ওটির কাজে যেটি তুলনামূলকভাবে সহজ সরল যান্ত্রিক পুনরাবৃত্তির কাজ, সেই কাজ শিখিয়ে বুঝিয়ে নেওয়া হলো। দিব্যি সফল ভাবে চললো ওপেন হার্ট সার্জারি। কোনও কোনও বিদ্যালয়ে তো দেখেছি, নিউট্রিশন শিক্ষক রসায়ন শিক্ষকের অভাব, স্ট্যাটের শিক্ষক ম্যাথের অভাব পূরণ করছেন। তবে সেটা হাতে গোনা। বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই বলেন, ৩০ শতাংশ ডিএ বাকি, অতএব নর্মাল ক্লাস চলবে ৩০ শতাংশ কম। কারো যুক্তি, তিন শতাংশ ডিএ, অতএব তিন শতাংশ ক্লাশ।
অনেকে বলেন, আগে সরকারি স্কুলের গুণগত মান ভালো ছিল। সরকারি হাসপাতালের গুণগত মান উন্নত ছিল। কথাটা আমি একদমই বিশ্বাস করি না। চন্দননগর হাসপাতালে আমি তিনবার ভর্তি ছিলাম। একবার আমার ওয়ার্ডে ভর্তি অধ্যাপক অমিয় সাহা, তিনি চন্দননগরের পার্টি নেতাও বটে। ভর্তি ছিলেন জেলা কোঅর্ডিনেশন কমিটির সম্পাদক রঞ্জিত ঘোষ। জগদ্দল থেকে সাপের কামড়ের রুগী এসেছে ভোর বেলায়। সকাল ৯ টা অবধি তাকে এভিএস দেওয়া হয়নি, কারণ স্টক নেই। রুগী ক্রমশ খারাপ অবস্থায়। সুপার যখন ওয়ার্ডে রাউন্ড দিতে এলেন আমরা বাধা দিলাম। এভিএস-এর ব্যবস্থা আগে করতে হবে। এলাকাবাসী হসপিটাল মনিটর নির্মল সেনগুপ্ত এসে হাজির। তিনি বললেন, ধরুন হাসপাতাল সুপার, এসডিও, ডিএম, এসপি-কে যদি সাপে কামড়ায় তাহলেও কি বলা হবে স্টক নেই। সেই দিন জানলাম একটা এমারজেন্সি স্টক রাখা হয়। রোগী এভিএস পেয়ে সুস্থ হয়ে বাড়ি গেলো।
আমি দুবার স্কুল অফ ট্রপিক্যাল মেডিসিনের সাধারণ ওয়ার্ডে ভর্তি ছিলাম। আমার ওয়ার্ডে ভর্তি ছিলেন স্বাস্থ্যমন্ত্রী ননী ভট্টাচার্য, কলকাতা জেলা পার্টির নেতা রঘুনাথ কুশারী। এর ফলে সরকারি স্কুল হাসপাতালে মনিটরিং ছিল। সিস্টেম নিজে চলে না। সহিসের মনিটরিং প্রয়োজন। এই দায়িত্ব পালন না করে আমরা ঠাঁটবাঁট চাকচিক্যের প্রেমে মজে দায় এড়ালাম। বরং সরকারি সাহায্য প্রাপ্ত শিক্ষক কর্মচারীরা দাবি করলাম সকলের জন্য হেল্থ স্কিম চাই। কোন হেল্থ স্কিম? ২০০৯ সালে আমার গল ব্লাডার স্টোন অপারেশন হলো বেলুড়ে। ল্যাপরোস্কোপি সার্জারি চন্দননগর হাসপাতালে ছিল না। খরচ করলাম ৫২০০ টাকা। প্রি অপ ১ দিন, পোস্ট অপ ২ দিন। মোট ৩ দিন। বলে রাখি, আমি সরকারি হেল্থ স্কিম অন্যায় বোধ করে আজও গ্রহণ করিনি। ২০১০ সালে আমার সহকর্মী ওই একই সার্জারি করলেন আর এন টেগোরে হেল্থ স্কিমে। খরচ ২৮০০০ টাকা। আরও উল্লেখযোগ্য, দুপুরে ৩টায় অপারেশন, আর রোগী ভর্তি হলেন ওইদিন দুপুর ১২ টায়। রাজকোষ থেকে জলজ্যান্ত ২৩০০০ টাকা নিঃসরণ কর্পোরেটের ঘরে। কিন্তু কর্পোরেট আতিথেয়তায় কি পরম তৃপ্তি লাভ!
আমার কার্ডিয়াক বাইপাস সার্জারি করলেন ডাঃ ইউ এন সরকার, পিজি র থোরাসিক সার্জন। খরচ হয়েছিল সাকুল্যে ৫৮ হাজার টাকা। হেল্থ স্কিমে আর এন টেগোরে ডাঃ ইউ এন সরকারই করলেন ডিএম অফিসের এক অফিসারকে, খরচ ৩লাখ ৫০ হাজার টাকা। এখানেই হেল্থ স্কিমের নিহিত রহস্য। বেশিদিন আগের কথা নয়, অক্টোবর ২০২২ হবে। আমার পাড়ার এক কট্টর সিপিএম কর্মীর শাশুড়ি মা অসুস্থ হয়ে চুঁচুড়া সদর হাসপাতালে আইসিইউতে ভর্তি। সে আমাকে ডেকে জানালো, প্রথম দিন ঘন ঘন রুগীর প্যারামিটারগুলি চেক আপ ও সারাক্ষণ মনিটরিং, পেশেন্ট পার্টিকে জানানো, এককথায় কর্পোরেট হাসপাতালের সার্ভিস, অসাধারণ। আট দিনের মাথায় সুস্থ হয়ে বাড়ি ফিরেছে। অসাধারণ পরিষেবা। আসলে চুঁচুড়ার কিছু মানুষ এমডিসিসি গঠন করে হাসপাতালের ওপর চুঁচুড়ার সিটিজেনদের মনিটরিং চালায়। একটা পলিসি বা অধিকার নিজে নিজে কখনো কার্যকর হয়না। ওপর থেকে হাতুড়ি তলা থেকে নেহাই, আর সর্বোপরি সাঁড়াশি দিয়ে চেপে ধরে রাখা, তবেই তো কাঙ্ক্ষিত আকৃতি দেওয়া সম্ভব। সাঁড়াশি সম সামাজিক মনিটরিং না থাকলে শুধু হাসপাতাল সরকার কোনো সুফল দেবে না। আমরা এই দায়িত্ব পালন না করে কর্পোরেটকে নাগালে পেতে ছুটলাম।
মনিটরিং না থাকলে কোনো কর্পোরেট হাসপাতালেও সুবিচার পাবেন না। একজন নিম্নবিত্ত বুকে ব্যথা নিয়ে আর এন টেগোরে ভর্তি হলো। পরদিন ডাক্তার জানালেন করোনারি আর্টারি ব্লক, দুটি স্টেন্ট বসাতে হবে। আড়াই লাখ টাকার প্যাকেজ। পেশেন্ট পার্টিকে বলা হলো এমারজেন্সি ভর্তি হয়েছে। তাই স্বাস্থ্যসাথী কার্ড গ্রহণ যোগ্য নয়। এদিক ওদিক আলোচনা করে পেশেন্ট পার্টি জানালো, পেশেন্ট ডিসচার্জ করুন, একদিনের বিল জমা নিন। তারপর ওই পেশেন্টকে রিঅ্যাডমিশন করা হলো। অথরিটি ভর্তি নিতে, স্বাস্থ্যসাথী কার্ড অ্যাকটিভেট করতে বাধ্য হলো। এই মনিটরিং প্রয়োজন। কেন হবেনা, তাহলে কী ভাবে হবে, নিজের অধিকার বুঝে নিতে হবে।
আসলে আমি সহজেই যুক্তিপূর্ণ ভাবেই বলতে পারি জাতীয় স্বাস্থ্য নীতির ত্রুটি, বৈষম্যমূলক সরকারি সিস্টেম, একটা গিভেন সিস্টেমের মধ্যে অবস্থান করে তার সীমার মধ্যেই দাবি দাওয়া নির্ধারণ করতে হয়, এই সব যুক্তি সত্য। কিন্তু হাতের বেড়ি পায়ের শিকলকে অলঙ্কার জ্ঞান করে আহ্লাদে আটখানা না হয়ে শিকলের ঝনঝনানি শোনাতে বাধা কোথায়? সিস্টেমের দোহাই দিয়ে সিস্টেমের সর ননীটুকু চেটে পুটে নেবো, আর সিস্টেমকে গাল দিয়ে দায় পারবো এটাই সুবিধাবাদ। সিস্টেমকে নিরন্তর প্রশ্নের মুখে দাঁড় করাতে হয়। খাঁচার পাখি খিদে তেষ্টা পেলে চেঁচামেচি করে ঠিকই, কিন্তু সর্বক্ষণ ঠোঁট দিয়ে খাঁচার কাঠিগুলি ঠোকরায়। ভালবেসে নয়, সিস্টেমের প্রতিবাদে। মুক্তির আকাঙ্ক্ষায়।
ঊনিশ শতকের প্রথমার্ধে এ দেশের সাবেক শিক্ষা প্রতিষ্ঠানগুলোর গঙ্গা প্রাপ্তি ঘটলো মেকলে নীতির মাধ্যমে। সমস্ত পুরাতন দেশীয় শিক্ষা প্রতিষ্ঠান লাটে উঠলো। প্রাচ্যবিদ হোরেস হেম্যান উইলসন খুব মর্মাহত হয়ে দেশে ফিরে গেলেন। কেশবচন্দ্র সেনের পিতা রামকমল সেনকে চিঠিতে লিখেছিলেন, I think it’s very much your own fault. You submitted too quietly. At least there should have two forces, physical and moral. You employed neither. আজ সিস্টেমের দোষ দিচ্ছি। আমরা সরকারি বিদ্যালয়, সরকারি হাসপাতালকে রক্ষা করার কোনো চেষ্টাই করলাম না।
আমাদের সরকারি অফিসার কর্মচারীদের সুবিধাবাদ কেমন সেই গল্পটা শুনুন। একজন দিদিমনি মানে গ্রুপ এ অফিসার অবসর নিলেন। এলাহি আয়োজন। খাসির মাংস, চিংড়ি, ইলিশ ইত্যাদি। শিক্ষক শিক্ষাকর্মী মিলে ৪৮ জনের আয়োজন। সমস্যা হলো গ্রুপ ডি র তিনজন এসেছেন সপরিবারে। ফলে আটজন বেশি। দু একজন শিক্ষক বললেন, ‘মাত্র তো আটজন। কেউ মাছ কেউ মাংস, যাচাই পরিবেশন না করে একটু ভাগ করে নিলেই তো হয়ে যায় সবার’। কিন্তু অধিকাংশ বললেন, ‘এটা করলে দিদিকে অপমান করা হয়। দিদি একটা রাজকীয় আয়োজন করেছেন সহকর্মীদের জন্য। তিনি দুঃখ পাবেন। কেন ওরা অবিবেচকের মতো পরিবার নিয়ে আসবে’। কুযুক্তির তরিকাটা ভাবুন। বিস্তর গালি গালাজ খেয়েছিলেন ওই দু একজন শিক্ষক। তাতে কি, সমস্যার সুষ্ঠু সমাধান তারাই দিয়েছিলেন। গিভেন সিচুয়েশনে মানিয়ে নেওয়া, একটু ত্যাগ করে ম্যানেজ করে নেওয়া একটা জীবন শৈলী। আবার সিস্টেমকে প্রশ্ন করেও যেতে হবে।
সিস্টেম বদলানো, অধিকার বুঝে নেওয়া, আবার সিস্টেমের সাথে সাময়িক মানিয়ে নেওয়া, সে বড়ো কঠিন কাজ, অনেক শতাব্দীর মনীষার কাজ। তার চাইতে বরং শর্টকাট রাস্তা বেশি স্বস্তিদায়ক। সিস্টেমকে আস্বাদ করবো, আবার বৈষম্য মূলক সিস্টেমকে দোষারোপ করবো। অতএব নিজের কবর খোঁড়া যাক, খুঁড়েই তো চলেছি।