আজকের ভারতবর্ষের আর্থিক, সামাজিক, রাজনৈতিক ও সাংস্কৃতিক চালচিত্রে ফ্যাসিবাদ বিষয়ক আলোচনা এক গুরুত্বপূর্ণ প্রতর্কে পরিণত হয়েছে। এখন প্রশ্ন উঠতেই পারে বিংশ শতকের শুরু থেকে দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের শেষ পর্যন্ত এক ঐতিহাসিক পর্ব শেষ করে নিঃশেষিত হয়ে যাওয়া ফ্যাসিবাদকে নিয়ে ‘ পৃথিবীর বৃহত্তম গণতন্ত্র ‘ রূপে বিজ্ঞাপিত ভারতে ফ্যাসিবাদকে নিয়ে চর্চা করার কারণ কী! এই প্রশ্নের সহজ উত্তর হল বর্তমান সময়ে আমাদের রাষ্ট্র পরিচালনায়,রাষ্ট্র নীতিতে, সংবিধান মেনে তৈরি হওয়া বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানের কর্মকাণ্ডে এমন কিছু চরিত্র লক্ষ্মণ প্রকাশ পাচ্ছে যার সঙ্গে ইউরোপে ত্রিশ-চল্লিশের দশকে গণতন্ত্রকে ব্যবহার করে যে ফ্যাসিবাদ মাথাচাড়া দিয়েছিল তার যথেষ্ট সাদৃশ্য আছে। এমনকি ১৯৫০ সালের ২৬ জানুয়ারি সংবিধানের শপথ নিয়ে যে বহুত্ববাদী ভারতবর্ষ যাত্রা শুরু করেছিল, তাকেও বদলে ফেলার এক সুনির্দিষ্ট নকশা আজ বিদ্যমান। অন্যদিকে যে ইউরোপে ফ্যাসিবাদের জন্ম,সেখানেও আজকের ফলিত রাজনীতিতে ফ্যাসিবাদের প্রভাব বর্ধমান। এই পরিস্থিতিতে ভারতে ফ্যাসিবাদের উদ্ভব, লক্ষ্মণ ও চরিত্র বিচারের চর্চা বাড়ছে। বর্তমান নিবন্ধটি সেই চলমান চর্চার অংশ হিসাবে রচিত।
(২)
ফ্যাসিবাদকে সংজ্ঞায়িত করতে কমিউনিস্ট আন্তর্জাতিকের কার্যকরী সমিতির ত্রয়োদশ প্লেনাম অধিবেশনে অত্যন্ত সঠিকভাবেই বলা হয়েছিল যে ক্ষমতায় আসীন ফ্যাসিবাদ হল লগ্নিপুঁজির তরফে সবচেয়ে প্রতিক্রিয়াশীল, সবচেয়ে সংকীর্ণ জাতীয়তাবাদী এবং সবচেয়ে সাম্রাজ্যবাদী অংশের সন্ত্রাসবাদী একনায়কত্ব। জর্জ ড্রিমিটভকে অনুসরণ করে আমরা বলতে পারি ফ্যাসিবাদ হল শ্রমজীবী জনতার উপর পুঁজির হিংস্রতম আক্রমণ, ফ্যাসিবাদ নিরঙ্কুশ সঙ্কীর্ণ জাতীয়তাবাদ আর পররাজ্য হরণের যুদ্ধ, ফ্যাসিবাদ জঘন্যতম প্রতিক্রিয়া ও প্রতিবিপ্লব, ফ্যাসিবাদ হল শ্রমিকশ্রেণি ও প্রত্যেকটি মেহনতকারী মানুষের ক্রূরতম শত্রু। দেশের ঐতিহাসিক, সামাজিক ও অর্থনৈতিক অবস্থা, তার জাতীয় বৈশিষ্ট্য ও আন্তর্জাতিক অবস্থান অনুসারে বিভিন্ন দেশে ফ্যাসিবাদের বিকাশ ও ফ্যাসিস্ট একনায়কত্বও বিভিন্ন রূপ গ্রহণ করে। ফ্যাসিবাদের মধ্যে যে একনায়কত্বের ধারণা থাকে তার অন্যতম উপাদান হল সন্ত্রাস। নিছক সংসদীয় পদ্ধতির বিনাশ ফ্যাসিবাদের শর্ত নয় কারণ আমরা দেখেছি বেনিটো মুসোলিনি প্রথম কয়েকবছর ক্ষমতায় থাকার সময় ইতালির সংবিধানের একটা লাইন সংশোধন না করেও সেখানে ফ্যাসিবাদের চালনা করতে সমর্থ হয়েছিলেন। বুর্জোয়া গণতন্ত্রের সঙ্গে ফ্যাসিবাদের সম্পর্ক সেই অর্থে বৈরিতামূলক নয় কারণ পুঁজিবাদের বিশেষ সংকটের সময় বুর্জোয়া শাসনকে রক্ষা করতে ফ্যাসিবাদের উদ্ভব হয়। অবশ্য ফ্যাসিবাদের ক্ষমতায় আরোহণ একটি বুর্জোয়া গভর্নমেন্টের পরিবর্তে আর একটা বুর্জোয়া গভর্নমেন্টের স্থান অধিকারের মত সাধারণ ঘটনা নয়। এ হল বুর্জোয়া শ্রেণির আপন শ্রেণি আধিপত্য বজায় রাখার এক ধরনের রাষ্ট্ররূপ, বুর্জোয়া গণতন্ত্রের বদলে আর এক ধরনের রাষ্ট্ররূপ, প্রকাশ্য সন্ত্রাসবাদী একনায়কত্ব স্থাপন।
(৩)
ফ্যাসিবাদ নামক মতাদর্শটির রাজনৈতিক, সামাজিক ও অর্থনৈতিক বৈশিষ্ট্যগুলি চেনা ও তারপর তাদের আন্তঃসম্পর্কগুলি পরীক্ষা করাও জরুরি। বিশিষ্ট অর্থনীতিবিদ ও লেখক অমিত ভাদুড়ি তাঁর “In the middle of the end game” ( দি টেলিগ্রাফ, ২ নভেম্বর, ২০২০)-এ লিখেছেন সম্ভবত ফ্যাসিবাদের সবথেকে সাধারণ রাজনৈতিক প্রকাশ, দেশরক্ষার নামে ‘জাতির শত্রু’দের বিরুদ্ধে সামরিক শক্তি জাহির করার মাধ্যমে পেশীশক্তি সম্পন্ন জাতীয়তাবাদ প্রদর্শন। শত্রু বাইরের হতে পারে বা ভিতরের। ‘ আমাদের ‘ জাতীয়তাবাদের ক্ষতিসাধন করার লক্ষ্যে বাইরের ও ভিতরের শত্রুরা একযোগে ষড়যন্ত্র করছে এটা দেখাবার সবচেয়ে ভালে পন্থা হল একই সাথে দুটি পাখি মারা—অভ্যন্তরীণ দমননীতিকে ন্যায়সঙ্গত প্রতিভাত করার পাশাপাশি বহিঃশত্রুর বিরুদ্ধে জঙ্গিবাদকে ন্যায়সঙ্গত করে তোলা। ‘ আমাদের ‘ জাতীয়তাবাদের বহিঃস্থ ও অভ্যন্তরীণ শত্রুর বিরুদ্ধে দেশপ্রেমিকের কর্তব্য বোঝানোর জন্য, জাতীয় সুরক্ষার নামে যুদ্ধকালীন জরুরি অবস্থার কৃত্রিম বাতাবরণ তৈরি করে, রাজনৈতিক শক্তি হিসাবে জাতিরাষ্ট্রের জাতীয়তাবাদকে সমগ্র রাজনীতির মূল ভাষ্যে পরিণত করা ফ্যাসিবাদের মার্কামারা সামাজিক বৈশিষ্ট্য এবং ফ্যাসিবাদী প্রবণতাগুলি সর্বাধিক দ্রুত বিস্তার লাভ করে, যদি শত্রুকে ধর্মীয় সংখ্যালঘু বা জাতিসত্তা গোষ্ঠী, ভিন্ন ঐতিহ্যবাহী শরণার্থী ইত্যাদি হিসাবে চিহ্নিত করা যায়। আধুনিক প্রযুক্তির সঙ্গে, বিশেষত সামরিক ও প্রচারের ক্ষেত্রে, আধুনিকতা-বিরোধী জাত,লিঙ্গ,ধর্ম এবং বর্ণ প্রথার ঐতিহ্যের সহাবস্থান ফ্যাসিবাদী চিন্তাধারার অভ্রান্ত বৈশিষ্ট্য। গরিবদের জন্য সহানুভূতি সূচক অবিরাম বক্তৃতা, কিছু লোক দেখানো প্রকল্প অন্যদিকে বড়ো বড়ো ব্যবসায়িক প্রতিষ্ঠানগুলিকে প্রাকৃতিক সম্পদ সহ আকর্ষণীয় সব কনট্রাক্ট পাইয়ে দিয়ে আরও বড়ো করার জন্য সকল রকম সুযোগ সুবিধা প্রদান। মুক্ত বাণিজ্যের সঙ্গে দুর্বল সরকার কল্পনা মাত্র। ফ্যাসিবাদ যে কৃষি, শিল্প অথবা পরিষেবায় ক্ষুদ্র ব্যবসার সঙ্গে খাপ খাওয়াতে পারে না, এই বাস্তবতা গোপন করে।
(৪)
ভারত রাষ্ট্রের আজকের ফ্যাসিবাদী প্রবণতার স্বরূপ উপলব্ধি করতে হলে অবশ্যই আমাদের বিগত সময়ের দিকে চোখ ফেরাতে হবে। যে কোনো তৃতীয় বিশ্বের দেশের মত ভারতেও কোন বুর্জোয়া বিপ্লব সম্পন্ন হয়নি, যেমন ভাবে উন্নত পশ্চিমি দেশগুলিতে হয়েছিল। ‘ পৃথিবীর বৃহত্তম গণতন্ত্র ‘ বলে ভারতকে যতই বিজ্ঞাপিত করা হোক না কেন,শুরুর দিন থেকে ভারতে সংখ্যাগরিষ্ট রাজনৈতিক লাইনের অনুশীলন হয়নি, যা হয়েছে তা হল সাম্প্রদায়িক লাইন। ১৯৪৫ সালে অল ইন্ডিয়া সিডিউলড কাস্ট ফেডারেশনের সভায় ডঃ বি.আর.আম্বেদকর খুব পরিষ্কার ভাষায় বলেছিলেন যে ভারতীয় গণতন্ত্র এক স্থায়ী সাম্প্রদায়িক সংখ্যাগরিষ্ঠতা দ্বারা চালিত। এই সংখ্যাগরিষ্ঠতা ছিল তার ভাষায়,”born,not made”। এই সাম্প্রদায়িক সংখ্যাগরিষ্ঠতা বলতে আম্বেদকর বুঝিয়েছিলেন, এই গণতান্ত্রিক ব্যবস্থা ব্রাহ্মণ্যবাদী উচ্চবর্ণের সেবা করে। তাই এই তথাকথিত ভারতীয় গণতন্ত্র সামন্ততান্ত্রিক উৎপাদন সম্পর্ক দ্বারা চালিত হয় ( এককথায় বর্ণবাদ), অন্যদিকে পশ্চিমের পরিণত গণতান্ত্রিক দেশগুলিতে দেখা যায় উৎপাদনের পুঁজিবাদী সম্পর্ক।
ভারত রাষ্ট্রের জন্মের সময় থেকেই তার রাজনৈতিক ইতিহাসে আমরা কিছু কিছু ফ্যাসিস্ট প্রবণতা দেখতে পাই। স্বাধীনতার মুহূর্তে দেখি তেলেঙ্গনায় সামরিক শক্তি প্রয়োগ করে সেখানকার কৃষক বিদ্রোহকে নৃশংসভাবে দমন করা। দুই হাজার গ্রামের হাজার হাজার কৃষক সেদিন রাষ্ট্রীয় সন্ত্রাসের শিকার হয়েছিলেন। ১৯৫৫ সালে নাগালিমের নেতৃত্বে গড়ে ওঠা নাগাদের আত্মনিয়ন্ত্রণের অধিকারের আন্দোলনকে দমন করতে ভারত রাষ্ট্র সেখানকার জনগনের বিরুদ্ধে যুদ্ধ ঘোষণা করে। ১৯৬০ এর দশকে মিজোরামে আকাশপথে বোমা নিক্ষেপের ঘটনা বহু আলোচিত। নকশালবাড়ির আন্দোলন যা ভারতের আধা-সামন্ততান্ত্রিক, আধা-ঔপনিবেশিক কাঠামোকে ভাঙতে চেয়েছিল তাকে নৃশংসভাবে দমন করা হয়( অপারেশন স্টিপলচেজ)। ভারতীয় সংবিধানের মধ্যেই কি ধরণের ফ্যাসিবাদী প্রবণতা লুকিয়ে আছে তা ভালো করে বোঝা যায় জরুরি অবস্থার সময়। অল্প সময়ের জন্য হলেও ফ্যাসিবাদী প্রবণতাগুলো কিভাবে মতপ্রকাশের স্বাধীনতা, আন্দোলন করার অধিকারকে গুঁড়িয়ে দিয়ে এক স্বৈরতান্ত্রিক ব্যবস্থা গড়ে তুলতে পারে, তার আদর্শ উদাহরণ হল ইন্দিরা গান্ধির জরুরি অবস্থাকালীন শাসন। একই সঙ্গে এটাও উল্লেখ করা দরকার যে সংবিধান চালু হওয়ার সময় থেকেই সিডিশন ল,আর্মড ফোর্সেস স্পেশাল পাওয়ার অ্যাক্টের মত শ্বাসরোধকারী আইনগুলো সংবিধানে ছিল যা ফ্যাসিবাদী কায়দায় যে কোন বিরোধিতাকে দমন করতে পারে।
(৫)
ভারতে ফ্যাসিবাদী লক্ষ্মণ প্রধান হয়ে ওঠার ঘটনাক্রম শুরু হয় নব্বই এর দশকের প্রথমদিকে যখন ‘ উদারীকরণ – বেসরকারিকরণ-ভুবনায়নের ‘ নামে নয়া উদারবাদের আগ্রাসন শুরু হয়। ঋণের ফাঁদে পড়ে ( ব্যালেন্স অব পেমেন্ট সংকট) তখন আন্তর্জাতিক অর্থ লগ্নি সংস্থাগুলির নীল নকশা মেনে ভারত তার সংস্কার কার্যক্রম শুরু করে। এই নয়া উদারবাদ ভারতীয় জনগণের জন্য ভয়ংকর বিপর্যয় ডেকে আনে। এই প্রেক্ষাপটে ফ্যাসিবাদের জমি প্রস্তুত করা হতে থাকে। একটু নজর করলে দেখা যায় ১৯৯০ সালে লালকৃষ্ণ আদবানির রথযাত্রা, ১৯৯২ সালে বাবরি মসজিদ ধ্বংসের আবহাওয়ায় গোটা দেশে আগ্রাসী ব্রাহ্মণ্যবাদী মতাদর্শে হিন্দুত্বকে এক জাতীয় পরিচিতি হিসাবে নির্মাণ করার কাজ শুরু হয়। এই হিন্দুত্বের রাজনৈতিক প্রতিনিধি ভারতীয় জনতা পার্টির লোকসভায় দুটো আসন থেকে ১২০ টি আসনে পরিণত হওয়ার সাফল্যের রসায়ন এই ব্রাহ্মণ্যবাদী রাজনীতির কৌশলী প্রয়োগ। যদিও একথা অনস্বীকার্যযে এই ব্রাহ্মণ্যবাদী হিন্দুত্বের ভাবনার বীজ প্রোথিত হয়েছিল জাতীয় কংগ্রেসের রাজত্বকালেই। রাম জন্মভূমি বিতর্ক শুরু হওয়ার ক্ষেত্রে তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী রাজীব গান্ধির ভূমিকা ছিল গুরুত্বপূর্ণ। এমনকি নব্বই-পূর্ববর্তী ভারতে সংখ্যালঘু জনগোষ্ঠীর আর্থ- সামাজিক উন্নয়ন যে নেহাৎই কথার কথা তা সাচার কমিটির রিপোর্টে বহু আলোচিত। এই নয়া উদারবাদী জমানায় আগ্রাসী ও জঙ্গি হিন্দুত্বকে কাজে লাগিয়ে সংঘ পরিবার দেশ জুড়ে এক হিন্দু জাতীয় পরিচিতির রাজনীতিকে ঘনীভূত করে যার ভরকেন্দ্রে ছিল রাষ্ট্র চিহ্নিত ‘ সাধারণ ‘ ( জেনারেল ক্যাটাগরি) এবং মতাদর্শগত ভাবে তার অনুপ্রেরণা ছিল ব্রাহ্মণ্যবাদ। দিল্লির রাজনীতিতে ১৯৯৬ সালে প্রথম বার তারপর আবার ১৯৯৮-৯৯ পর্বে বিজেপি প্রাসঙ্গিক হয়ে উঠলেও নির্বাচনী রাজনীতির বাধ্যতার কারণে তাকে বিভিন্ন বিপরীত মতাদর্শের রাজনৈতিক দলের সঙ্গে জোট বাঁধতে হয়, ফলে পূর্ণমাত্রায় হিন্দুত্বের রাজনীতির অনুশীলন সেই পর্বে সম্ভব হয়ে ওঠেনি।
(৬)
কেন্দ্রীয় ভাবে বা দেশ জুড়ে সম্ভব না হলেও ফ্যাসিবাদের এক গবেষণাগার গড়ে তোলা সম্ভব হয় গুজরাট মডেলের মাধ্যমে। ২০০১ সালে নরেন্দ্র মোদি গুজরাটের মুখ্যমন্ত্রী নির্বাচিত হওয়ার পর ২০০২ সালে গোধরায় সবরমতী এক্সপ্রেসের অগ্নিকাণ্ডকে ঘিরে শুরু হয় গুজরাট গণহত্যা। এ প্রসঙ্গে আহমেদাবাদ ফরেনসিক সায়েন্স ল্যাবরেটরির পক্ষে এক রিপোর্ট প্রকাশিত হয় যাতে বলা হয়েছিল বাইরে থেকে ট্রেনে আগুন লাগানো সম্ভব নয়। ব্রাহ্মণ্যবাদী হিন্দু ফ্যাসিবাদ কী ধরনের হিংসা ছড়াতে পারে তার নমুনা আমরা প্রত্যক্ষ করি গুজরাট নরমেধ যজ্ঞে। কীভাবে এক নির্দিষ্ট পরিকল্পনার মাধ্যমে হিংসা ঘটানো হয়েছিল তার বহু প্রমাণ লিপিবদ্ধ আছে রানা আইয়ুবের বিখ্যাত গ্রন্থ ‘ গুজরাট ফাইলস’ এবং সাম্প্রতিক কালে বিবিসি নির্মিত ডকুমেন্টারিতে। এই গণহত্যার একবছর পর থেকে আমরা সেইসময় গুজরাটের স্থানীয় ব্যবসায়ী গৌতম আদানি, রিলায়েন্স গোষ্ঠীর মুকেশ আম্বানি, পরে টাটা গোষ্ঠীর রতন টাটার সাহচর্যে ‘ ভাইব্রান্ট গুজরাট’ মডেলের ক্রমবিকাশ দেখতে পাই যা আদতে ছিল ব্রাহ্মণ্যবাদী হিন্দু ফ্যাসিবাদ ও কর্পোরেট লুণ্ঠনের আদর্শ মিশেল। গুজরাটে একদিকে কর্পোরেটদের দেয় করের ৪০ শতাংশ ছাড় দেওয়া হয়, চব্বিশ ঘন্টার জন্য ভর্তুকি মূল্যে বিদ্যুৎ, প্রাকৃতিক সম্পদ ব্যবহারের অধিকার, নাম মাত্র মূল্যে জমি, কোনোরকম শ্রম আইন মুক্ত বিশেষ অর্থনৈতিক অঞ্চল অবাধ কর্পোরেট লুঠের পথ প্রস্তুত করে। এর ফলে ক্ষুদ্র, অতি ক্ষুদ্র ও মাঝারি শিল্পগুলি ধ্বংস হয়। অন্যদিকে শিক্ষা ও স্বাস্থ্য বাজেট এতটাই কমে যায় যে গুজরাট হয়ে ওঠে পুষ্টিহীন, শিক্ষার সুযোগহীন, চিকিৎসার সুযোগহীন এক রাজ্য। মানব উন্নয়ন সূচক অনুযায়ী দেশের মধ্যে পিছিয়ে থাকা এক রাজ্য। গুজরাটে সংখ্যালঘুদের জন্য সংবিধান স্বীকৃত যে সমস্ত সুযোগ সুবিধা আছে তা রীতিমত ঘোষণা করে বন্ধ করে দেওয়া হয়,দলিতদের উপর অত্যাচার ‘ উন্নত ‘ গুজরাটের অন্যতম বৈশিষ্ট্য। সবচেয়ে বড়ো কথা হল রাজ্যের সমস্ত সরকারি প্রতিষ্ঠানে ব্রাহ্মণ্যবাদী মতাদর্শের সমর্থকদের নিয়ন্ত্রণ প্রতিষ্ঠিত। এই মডেলই আজ বড়ো মাত্রায় দেশ জুড়ে প্রতিষ্ঠা করার চেষ্টা চলছে।
(৭)
আজ ভারতবর্ষে যে ফ্যাসিবাদ ঘনায়মান তার বৈশিষ্ট্যগুলোকে চিহ্নিত করা জরুরি। প্রথমত এই ফ্যাসিবাদ চরিত্রগত ভাবে ব্রাহ্মণ্যবাদী হিন্দুত্ব। দেশ জুড়ে এক ব্রাহ্মণ্যবাদী হিন্দু জাতীয় পরিচিতি সত্তা গড়ে তোলা তার লক্ষ্য, যার ভিত্তি এই বর্ণবাদী আধা-সামন্ততান্ত্রিক ব্যবস্থা। হিন্দি-হিন্দু-হিন্দুস্তান নামক স্লোগানের মধ্যে দিয়ে হিন্দু রাষ্ট্রের দিকে যাত্রা শুরু করা তার এই মুহূর্তের প্রধান রাজনৈতিক কাজ। দ্বিতীয়ত এই ফ্যাসিবাদের মূল বিষয়টি ধর্মীয়। সংখ্যালঘু মুসলমানদের ‘ অপর’ প্রতিপন্ন করার জন্য এবং জনসমাজে তাদের গণশত্রু চিহ্নিত করা তার ফ্যাসিবাদী প্রকল্পের অন্যতম শর্ত। এইজন্য যেমন তাদের শারীরিক ভাবে আক্রমণ করতে হবে, তাদের সন্ত্রস্ত করতে হবে, তেমনি ক্ষমতা কাঠামো থেকে বিযুক্ত করতে হবে। সিনেমায়,নাটকে,সাহিত্য ও সংস্কৃতিতে তাদের বহিরাগত ও শত্রু চিহ্নিত করাও ব্রাহ্মণ্যবাদী হিন্দু ফ্যাসিবাদের সমর্থকদের কাছে অবশ্য কর্তব্য হিসাবে চিহ্নিত। তৃতীয়ত উগ্র হিন্দুত্ববাদী ভাবাদর্শের অতীত গরিমা ও শ্রেষ্ঠত্ব প্রতিষ্ঠার জন্য তাকে যেমন নতুন ইতিহাস ‘ নির্মাণ ‘ করতে হবে তেমনি প্রচলিত শিক্ষা সিলেবাস বদল করে যুক্তি ও প্রমাণের বদলে বিশ্বাস ও আনুগত্যকে শেখার মাপকাঠি স্থির করতে হবে। চতুর্থত অর্থনৈতিক ক্ষেত্রে সাম্রাজ্যবাদ এবং তার অংশ কর্পোরেট ফিনান্স ক্যাপিটালের অবাধ অনুপ্রবেশ ও লুণ্ঠনের সুযোগ করে দিতে হবে। এটা না করতে পারলে ফ্যাসিবাদ ও কর্পোরেটতন্ত্রের মেলবন্ধন সম্ভব হবে না। নয়া কৃষিনীতি, নয়া শ্রমকোড, দেশের প্রাকৃতিক ও খনিজ সম্পদের লুঠের সুযোগ, রাষ্ট্রায়ত্ত সংস্থার বিলগ্নিকরণ এই ব্রাহ্মণ্যবাদী হিন্দু ফ্যাসিবাদের চরিত্র লক্ষ্মণ। এই লুঠের বিরুদ্ধে সংগ্রামরত জনগণকে দমন করতে সে যে যুদ্ধ ঘোষণা করতে পিছপা নয় তার প্রমাণ আজকের বস্তার সহ মধ্য ও পূর্ব ভারত। বস্তুত, অবাধ বিশাল বাজার, বিপুল সংখ্যক সস্তা শ্রমিক এবং সকল প্রাকৃতিক সম্পদের ওপর নিরঙ্কুশ দখল—সংকটাপন্ন সাম্রাজ্যবাদ বর্তমানে এই তিনটি বিষয়ের জন্য আগের চেয়ে অনেক বেশি বেপরোয়া। কোনোরকম প্রতিরোধ, দরাদরিকে অনুমোদন দিতে সে রাজি নয়। এ জন্য তার প্রয়োজন এমন শাসক, যে তার নয়া-সামন্ততান্ত্রিক মতাদর্শকে কাজে লাগিয়ে সাম্রাজ্যবাদের স্বার্থ সবচেয়ে ভালো ভাবে পূরণ করতে পারবে (শ্রমজীবী জনগণের নজর মূল শত্রুর থেকে ঘুরিয়ে কাল্পনিক শত্রুর দিকে নিয়ে যেতে পারবে) এবং কোনোরকম গণতান্ত্রিক অধিকারের প্রতি যে শ্রদ্ধাশীল নয়। বর্তমানে ভারতে বিজেপি সেই কাজটাই করছে এবং নরেন্দ্র মোদি এ যাবৎ কালের মধ্যে সেরা মুৎসুদ্দি শাসক হিসেবে নিজেকে প্রতিষ্ঠা করেছে। তাই এই ফ্যাসিবাদী শক্তি সাম্রাজ্যবাদের সবচেয়ে পছন্দের। তাকে রক্ষার জন্য সব রকমের চেষ্টা সে চালাচ্ছে। অর্থাৎ ব্রাহ্মণ্যবাদী হিন্দু ফ্যাসিবাদ ও সাম্রাজ্যবাদের মধ্যে নির্দিষ্ট ধরনের মিথোজীবিতার সম্পর্ক বর্তমান। পঞ্চমত ফ্যাসিবাদের পক্ষে জনসমর্থন তৈরি করতে তাকে প্রতিনিয়ত কাল্পনিক শত্রু ও সম্ভাব্য রক্ষাকর্তা নির্মাণ করতে হয়। এইজন্য প্রয়োজন হয় মিডিয়ার উপর সম্পূর্ণ নিয়ন্ত্রণ ও গোয়েবলসীয় ফর্মুলায় অন্তহীন প্রচার অভিযান। এ কথা অস্বীকার করার জায়গা নেই যে ভারতে এই বিষয়টা সফল ভাবে সম্পন্ন হয়েছে। একদিকে রয়েছে কর্পোরেট সংস্থাগুলি নিয়ন্ত্রিত ২৪×৭ মিডিয়া চ্যানেল যা ‘ গোদি মিডিয়া ‘ নামে পরিচিত, অন্যদিকে রয়েছে ‘ মন কি বাত ‘-এর মতো একমুখী রাষ্ট্রীয় প্রচারযন্ত্র। এই ধরনের প্রোপাগান্ডা নাগরিকদের কাছে কী ধরনের আনুগত্য চায় তার সবচেয়ে বড়ো প্রমাণ চন্ডীগড়ের সেই নার্সিং কলেজ যেখানে মন কি বাত না শোনার অপরাধে ২০ জনকে ৭ দিনের জন্য হস্টেলের বাইরে না বেরোতে দেওয়ার হুকুম দেওয়া হয়। করোনা অতিমারির সময় করোনা নির্মূল করতে থালা বাজানোর কর্মসূচি যেভাবে নেওয়া হয়েছিল তা ফ্যাসিবাদের পক্ষে গণ উন্মাদনা সৃষ্টির এক আদর্শ উদাহরণ। ষষ্ঠত একটা কথা ভুললে চলবে না যে ভারতের সংবিধানের মধ্যে ব্রাহ্মণ্যবাদী হিন্দুত্বের ঝোঁক লুকিয়ে ছিল,তার ঔপনিবেশিক শাসন থেকে প্রাপ্ত যে আইন কাঠামো বিদ্যমান, তাকে ব্যবহার করেই এই ফ্যাসিবাদের বিকাশ ঘটছে। হিন্দুত্ববাদীরা সংবিধানের মধ্যে থাকা বিভিন্ন ধারা-উপধারাকে ব্যবহার করেই তাদের প্রকল্পিত হিন্দু রাষ্ট্রের ভিত তৈরি করতে উদ্যোগী হয়েছেন। সপ্তমত ব্রাহ্মণ্যবাদী হিন্দু ফ্যাসিবাদকে প্রতিষ্ঠা করার জন্য আধুনিক প্রযুক্তিকে কাজে লাগিয়ে এক নজরদারি রাষ্ট্রের কাজ তৈরির কাজ চলছে পুরো দমে। আধারের সঙ্গে প্যান কার্ডের ডিজিটাল সংযুক্তি, বিভিন্ন অ্যাপের মাধ্যমে নজরদারি, ডিজিটাল তথ্য প্রযুক্তি আইনের সংশোধন, বিভিন্ন ধরনের তথ্য ভাণ্ডার তৈরির লক্ষ্য নাগরিককে নিরন্তর রাষ্ট্রের নজরদারিতে আনা,তার মগজের উপর নিয়ন্ত্রণ প্রতিষ্ঠা।
(৮)
ধর্মীয় বিদ্বেষ, বর্ণবাদী নিপীড়ন, শোষণ, হিংসা ও সন্ত্রাস দিয়ে গড়ে ওঠা ব্রাহ্মণ্যবাদী ফ্যাসিবাদই আজ শ্রমজীবী মানুষের সামনে সবচেয়ে বড়ো বিপদ। এই ফ্যাসিবাদের চরিত্রলক্ষণগুলো চিহ্নিতকরণের মাধ্যমে তার বিরুদ্ধে সঙ্কীর্ণতা মুক্ত, বৃহত্তর জোটের প্রয়োজনীয়তা উপলব্ধি করে সেই মোতাবেক কর্মসূচি নেওয়াই আজ প্রগতিশীল শক্তির সবচেয়ে বড়ো দায়িত্ব।