Home অর্থনীতি মহার্ঘভাতা অধিকার : কিন্তু….

মহার্ঘভাতা অধিকার : কিন্তু….

মহার্ঘভাতা অধিকার : কিন্তু….
2

মালবিকা মিত্র

ডি.এ. প্রসঙ্গে প্রথম বামফ্রন্ট সরকারের অর্থমন্ত্রী অশোক মিত্রের সঙ্গে কিছু একান্ত আলোচনার প্রাসঙ্গিক স্মৃতি মনে পড়ছে। পার্টির জেলা দফতর থেকে মন্ত্রীকে নিয়ে আমি একটি জনসভার উদ্দেশে যাত্রা করেছিলাম। পথে প্রায় চল্লিশ মিনিট আলোচনা হয়। ডি.এ. ছাড়াও ছিল রাজ্য লটারির যৌক্তিকতা প্রসঙ্গ। কথাগুলো মনে এল সংবাদপত্রের শিরোনামে এখন ডি.এ. প্রসঙ্গ দেখে।

বিচারপতি হরিশ ট্যান্ডন ও বিচারপতি রবীন্দ্রনাথ সামন্তের ডিভিশন বেঞ্চ দ্বর্থ্যহীন ভাষায় ঘোষণা করেন : তিন মাসের মধ্যে কেন্দ্রীয় হারে ডি.এ. দেওয়া শুরু করতে হবে রাজ্যকে। তারপরেই ডি.এ. আন্দোলন পালে বাতাস পায়। আমি একজন অবসরপ্রাপ্ত সরকারি গ্রুপ ‘এ’ অফিসার। স্বভাবতই আমি নিজেও আদালতের এই ঘোষণার সুবিধাভোগী। আমিও খুব খুশি।

বিচারপতি রবীন্দ্রনাথ সামন্তের পর্যবেক্ষণ : সম্মানজনকভাবে জীবনধারণের জন্য মূল্যবৃদ্ধির হারের সঙ্গে সামঞ্জস্য রেখে মহার্ঘভাতা দেওয়া হয়। সম্মানজনকভাবে জীবনধারণ যেহেতু মৌলিক অধিকারের মধ্যে পড়ে, তাই সেই বিচারে মহার্ঘভাতাও আইনি অধিকার থেকে মৌলিক অধিকারে উত্তীর্ণ হতে পারে।

মাননীয় বিচারপতি, সংবিধানের অধিকারগুলি কি আংশিক না সর্বজনীন? সংবিধানের কোনো অধিকার কি জনসংখ্যার মুষ্টিমেয়-র স্বার্থে প্রযোজ্য হতে পারে? মহার্ঘভাতা ভোগ করে জনসংখ্যার কত শতাংশ? পূর্ণ সরকারি ও সরকার পোষিত কর্মচারীরা জনসংখ্যার ৫%-ও হবে কি?

(১) ‘সম্মানজনকভাবে জীবনধারণ’, কার মৌলিক অধিকার? নাগরিকের নাকি সরকারি, আধা-সরকারি অফিসার কর্মচারীর? মোট নাগরিকদের কত শতাংশ মহার্ঘভাতা পান? যারা সরকারি চাকরি করেন না তাদের ‘সম্মান নেই’ নাকি ‘জীবনধারণের অধিকার’ নেই? যারা বার্ধক্য ভাতা, বিধবা ভাতা, লোকশিল্পী ভাতা, পুরোহিত ও ইমাম ভাতা, কৃষকবন্ধু ভাতা, শ্রমিক কল্যাণ ভাতা এসব পেয়ে থাকেন, তাদের সম্মান, জীবনধারণ? একই চাকরি ক্ষেত্রে চুক্তি শিক্ষক, পার্শ্ব শিক্ষক, চুক্তি ও ঠিকা কর্মচারী, এদের সম্মান ও জীবনধারণ? এদের মৌলিক অধিকার?

(২) আচ্ছা, মহার্ঘভাতা প্রদান তো এসি মোটরের দাম বৃদ্ধির কারণে নয়, ডিপিএস বা অ্যাডামাসে পঠন খরচের জন্য নয়, এএমআরআই, সিএমআরআই-এর চিকিৎসা-ব্যয় বৃদ্ধির জন্যও নয়। প্রাত্যহিক নিত্যপ্রয়োজনীয় সামগ্রীর মূল্যবৃদ্ধির জন্য। সেই ন্যূনতম সামগ্রীর ক্ষেত্রে একজন অফিসার ও পিয়নের ব্যয়ে বিশেষ পার্থক্য নেই। নিশ্চয়ই বার, নাইট ক্লাব, শ্যাম্পেনের কথা ভেবে মহার্ঘভাতা নয়। তাহলে এ কেমন ডি.এ.? সরকার যদি ১০ শতাংশ ডি.এ. ঘোষণা করে তবে একজন সর্বোচ্চ পদের অফিসার পাবেন ২০ হাজার টাকা অতিরিক্ত, যখন একজন সর্বনিম্ন পদাধিকারী পাবেন ১৯০০ টাকা অতিরিক্ত। অর্থাৎ বেতন বৈষম্য বাড়বে। এইটিকে আদালত মৌলিক অধিকার বলতে চায়, নাকি সকল নাগরিকের জন্য এই অধিকার সুনিশ্চিত করতে চায়।

(৩) ঠিক এই প্রশ্নের সামনে অর্থমন্ত্রী অশোক মিত্রকে বলেছিলাম নতুন ডি.এ. নীতির ফলে তখন সর্বোচ্চ ১৩০০ টাকা ও সর্বনিম্ন ৫০ টাকা বেতন বাড়বে। এর মাধ্যমে বেতন বৈষম্য, আয়ের ব্যবধান বাড়বে। অজিত ভট্টাচার্যের নেতৃত্বে স্কুল-কলেজের শিক্ষাকর্মীরা লাগাতার আন্দোলন শুরু করে। এটা কি বাম সরকারের নীতিবিরুদ্ধ নয়? অর্থমন্ত্রীর জবাব ছিল, আমি ব্যক্তিগতভাবে মনে করি পে স্কেল পদমর্যাদার সূচক হতেই পারে। কিন্তু মহার্ঘভাতা একটা থোক টাকা ভাতা হিসেবে প্রদান করা উচিত। কারণ চাল, ডাল, তেল, আলু, পেঁয়াজ, ওষুধ পদমর্যাদা অনুযায়ী কেউ বেশি ইনটেক করে না। কিন্তু আপনার আমার পার্টি নেতৃত্ব, কর্মচারী সংগঠন সেটা মানবে না। ঠিকই, এটা করলে বেতন বৈষম্য কমতো। কথাগুলো আজ বড়ো প্রাসঙ্গিক হিসেবে মনে পড়ছে।

(৪) একথা সত্যি, উঁচুতলায় মূল্যবৃদ্ধির আঁচ লাগে না, তাদের বাড়তি দামে কেনাকাটা করার মধ্যে একটা আত্মতৃপ্তি থাকে। মানুষকেও বলতে শোনা যায় “এই স্কুল মাস্টার, প্রফেসর, ডাক্তার, আর সেক্টর ফাইভের লোকেরা বাজার হাই করে রেখেছে। দু’হাজার টাকা দামের ইলিশ, সেও পড়ে থাকে না। ফলে একজন এলডিসি বা গ্রুপ ডি-র কাছে মহার্ঘ ভাতা যতটা প্রয়োজন, উঁচুতলার কাছে ততটা না। সে বর্দ্ধিত আয়কে জিপিএফ, মিউচুয়াল ফান্ড, গোল্ড, প্লাটিনাম, ডায়মন্ড, বিদেশ ভ্রমণে ইনভেস্ট করে। বাজারে বাড়তি অর্থ ফিরে আসে না। বাজারে রক্ত সঞ্চালন হল না। ফলে সরকার ২৩ হাজার কোটি টাকার রক্ত সঞ্চালন করলেও বাজারে সঞ্চালন হলো অতি সামান্য ৩/৪ হাজার কোটি টাকা মাত্র।

(৫) আরও অমানবিক মৌলিক অধিকারটি ভাবুন। অফিসে অফিসে স্থায়ী এড হক বেতনের চুক্তিভিত্তিক কর্মচারীটির কথা। সে ৬ হাজার টাকা মাসিক বেতনে অফিসের লক্ষ লক্ষ টাকার ডি.এ., এরিয়ার পেমেন্ট হিসাব করে, চিনির বলদ। এদের ‘সম্মান’ বা ‘জীবনধারণ’ কি এই রায়দানে স্বীকৃতি পাবে? মাত্র একজন সহকর্মী ফোন করে জানালো, সরকারি কর্মচারীদের যে অংশের ডি.এ. জরুরি তারা সেই তিমিরেই। আর আমাদের অস্বাভাবিক বৃদ্ধিটা সত্যিই লজ্জা দেয়। শুধু তো বেতন বৈষম্য বৃদ্ধি নয়, সামাজিকভাবেও আমরা বিযুক্ত হয়ে শত্রু হিসেবে চিহ্নিত হয়েছি, আরও হবো।

৬) আদালত কি সরকারি কর্মচারীদের জন্য সরকারি ন্যায্যমূল্যের খাদ্য বিক্রয় কেন্দ্র, ওষুধ বিক্রয় কেন্দ্র, সরকারি বিদ্যালয়, সরকারি হাসপাতাল ব্যবহার বাধ্যতামূলক করার নির্দেশ দিতে পারেন না? সরকারি কর্তার সন্তানরা পঠন-পাঠন করলে, চিকিৎসা করলে এমনিতেই এগুলোর স্বাস্থ্য ফিরতো। কর্তা বা তার পরিবার এগুলোর ভোক্তা নয়। আসলে মহার্ঘভাতা বাড়ালে বাজার তেজি হয়না, এটাই সত্য। সিংহভাগ অর্থ বিপথগামী হয়। বরং নিচুতলার কর্মীর যেটুকু বেতন বাড়ে, ডি.এ. বাড়ার অজুহাতে বাজার দর আরও একটু বেড়ে যায়। ফলে বেতনের অঙ্ক বাড়লেও ভোগব্যয় বাড়লেও মোট ভোগ বিশেষ একটা বাড়ে না।

আমি যথেষ্ট লাভবান হবো সন্দেহ নেই। কিন্তু বাজারে সম্মানটা হারাবার ভয়, বুঝলেন। অর্থকৌলীন্য নিয়ে সামাজিক কৌলীন্য বিসর্জন দিলাম। দৃষ্টিশক্তি কমলেও শ্রবণশক্তি এখনও সম্পূর্ণ হারাইনি, কথাবার্তা যে কানে আসে, এখানেই সমস্যা।

Share Now:

Comment(2)

  1. এটা অবাক লাগে ভাবতে যে একজন গ্রুপ এ র‍্যাঙ্কের অফিসার কত অসাড় ভাবনার অংশীদারীত্ব করেন!!! সরকারী কর্মচারীরা কি সরকারের কনট্র্যাক্টচুয়্যাল নিয়োগের দায়িত্ব নেবেন? সরকার কেন সরকারী স্থায়ী পদ খালি থাকা সত্বেও নিয়োগ করেন না? কেন আজকের চাকুরিজীবীর সামান্য অংশ সরকারী পরিসেবা ক্ষেত্রে বিপুল যজ্ঞ সামলাতে বাধ্য হন? কেন দান খয়রাতির নিচুমানের ভোটসর্বস্ব রাজনীতিকে তোল্লা দিতে দিতে ন্যূনতম একটা বেসিল অর্থনৈতিক পলিসিরও তোয়াক্কা করেন না সরকার? জনগনকে ভোটের জন্য কিছু সুবিধা পাইয়ে দেবার নাম করে ভিখারিতে পরিণত করতে কেন সরকারের বাধে না? জনগণকে অপমানিত করার কোন অধিকার সরকারকে জনগণ দিয়েছে? বেসরকারী সংগঠিত এবং অসংগঠিত ক্ষেত্রে কেন সরকারের কোন নিয়ন্ত্রণ নেই? এসব প্রশ্নগুলো তো সরকারী কর্মচারীরাই তুলছেন। তাঁদেরকে জনগণের মধ্যে না রেখে বিভাজন করার নিচুমানের রাজনীতি এই লেখায় আছে বটে তবে অর্থনীতির সামান্য জ্ঞানের পরিচয় এই লেখায় নেই। একজন মজুর গড় সামাজিক যে মজুরী তা পাবার অধিকার রাখে আর সেই মজুরি সরকারই নির্ধারণ করে দেন, কর্মচারীরা নিজে নির্ধারণ করে না। এখন যদি মজুরকে খাটিয়ে তার উপযোগী সরকার স্বীকৃত বেতন না দেন তাহলে কি তা ন্যায্য হয়? দ্রব্যমূল্য বৃদ্ধির সূচক তো সমগ্র ভারতবর্ষের একটি স্বীকৃত সূচক। একজন শ্রমসময় বিক্রয়কারী শ্রমিককে সরকার যে চুক্তিতে নিয়োগ করেছেন সেই চুক্তি ভঙ্গ করার দায় কর্মচারী নেবে কেন? সরকারী শ্রমিক কর্মচারীকে কতটা ছোট করে দেখলে এসব লেখা যায়? অথবা কোন বিশেষ অভিসন্ধী থাকলে আলাদা কথা। কাজের ধরণ, যোগ্যতা ভিত্তিক কাজ এসবের একটা মূল্য আছে। লেখিকা একজন গ্রুপ ডি এবং গ্রুপ এ র মধ্যে যে বেতন বৈষম্য তা নিয়ে কখনো ভেবেছেন যে কেন এমনটা সরকার করেন? এই সমাজে এই বৈষম্যই নীতি তা সে যতই অসহনীয় হোক। এই নীতিও কিন্তু জনগণ নির্ধারণ করেনি। নির্বাচিত সরকার সংসদে এসব নীতি তৈরি করেছেন। সরকারকে একটু বলুন না; সবার জন্য কাজ দিক, ভিক্ষা নয়- কাজ। যে কাজের যা মজুরি তা মিটিয়ে দিক। তাতে লেখিকার যদি বেশি পড়ে তা তিনি দান করুন বা না নিন ত্রাণ তহবিলে দিন যা ইচ্ছে করুন তবে আপামর কর্মচারীদের যে দুর্দসা বোঝার ক্ষামতা বা ইচ্ছা কোনটাই লেখিকার নেই সেই খাটি খাই মানুষকে অপমানিত করবেন না, জনগণের শত্রু বানানোর চেষ্টা করবেন না। মনে রাখতে হবে আমাদের সঠিক মজুরি পেলে বাজার কিন্তু আরো গতিশীলই হবে, পাড়অর দোকানগুলো মাছি তাড়াবে না, চাষীরাও এর দ্বার উপকৃত হবেন; যে সরকার শিক্ষা স্বাস্থ্য সবকিছুকেই প্রাইভেট সেক্টরে তুলে দিতে বদ্ধপরিকর সেই সরকারকে বলুন সরকারী স্বাস্থ্য, শিক্ষা ইত্যাদিতে এমত পরিকাঢামো করতে, নিয়োগ করতে যাতে তা একশ শতাংশ মানুষের জীবনে ইতিবাচক প্রভাব ফেলে। হাত থাকতেও ভাত পায় না যে জনগণ ভোটের বেলায় তাদের কাছে হাত পাতার রাজনীতি নিপাত যাক।

  2. এই যুক্তিই তো তৃণমুল দিতে চাইছে। এভাবে জল ঘোলা করতে আরেকদল নেমে পরেছে। প্রত্যেক চাকুরের বা অচাকুরের জীবন ধারণের নির্দিষ্ট মাপকাঠি আছে। এভাবে গুলিয়ে দেবার অপচেষ্টা ছাড়া কিছু নয়।

LEAVE YOUR COMMENT

Your email address will not be published. Required fields are marked *