Home রাজনীতি রিষড়ার গোষ্ঠী সংঘর্ষ, আরএসএস ও ওয়েলিংটন জুটমিলের শ্রমিকরা-একটি প্রতিবেদন

রিষড়ার গোষ্ঠী সংঘর্ষ, আরএসএস ও ওয়েলিংটন জুটমিলের শ্রমিকরা-একটি প্রতিবেদন

রিষড়ার গোষ্ঠী সংঘর্ষ, আরএসএস ও ওয়েলিংটন জুটমিলের শ্রমিকরা-একটি প্রতিবেদন
0

নিজস্ব প্রতিবেদন

‘ওরা বারি মসজিদের সামনে রামনবমীর জুলুস নিয়ে দাঁড়িয়ে ডিজে বক্স বাজাচ্ছিল ছিল প্রায় ৪৫ মিনিট। তারপর ইফতারের নামাজের সময় ওদেরকে ওখান থেকে সরে যেতে বলায় ওরা মসজিদে আক্রমণ করে…’, প্রায় ঘুরিয়ে ফিরিয়ে এমনি বক্তব্য মসজিদের পাশের ওয়েলিংটন মিল মহল্লায় বসবাসরত শ্রমিক ও তাঁদের পরিবারগুলির।

ঈদের বাকি আর মাত্র দু’দিন। টানা দশদিন সমস্ত কিছু বন্ধ থাকবার পর আবার মিল সংলগ্ন অঞ্চলে দোকানপাটগুলি একে একে খুলতে শুরু করেছে। একেই এই অঞ্চলের ক্ষুদ্র পুঁজির ব্যবসাদারদের অবস্থা খারাপ। মিল বন্ধ হওয়ার পর থেকে লাটে উঠেছিল বিক্রিবাট্টা। প্রচুর দোকান বন্ধও হয়ে গেছে। মিলের গেটের লাগোয়া চা-এর দোকানটা উঠে গেছে। ওখানে এখন মিলেরই কিছু শ্রমিক রমজান মাস উপলক্ষ্যে ফল নিয়ে বেচতে বসে। তবুও সবটাই কোনোরকমে ঠিকঠাক ভাবে চলে গেলেও রামনবমী যাওয়ার পর থেকেই পুরো অঞ্চল জুড়ে থমথমে পরিবেশ। শুধু পুলিশ আর ডোরা-কাটা বন্দুক বাহিনী টহল দিচ্ছে। সেখানকার দোকানের মালিকদের বক্তব্য অনুযায়ী –এইসময় তাঁরা ব্যবসায় কম সে কম দশ থেকে পনের হাজার টাকার প্রফিট করেন। কিন্তু এইবার এইরকম অশান্তির ফলে তাদের ব্যবসা গোটা মরশুম জুড়ে লসে রান করছে। তাঁদের প্রশ্ন একটাই – কিনবে কে? মিল বন্ধ টাকা নেই মহল্লার শ্রমিকদের হাতে। তার উপর আবার ‘গোদের উপর বিষফোঁড়া’র মতন এসব অশান্তি। দশদিন বন্ধ দোকান।

এইতো এই বছরের ফেব্রুয়ারি মাসের প্রথম থেকে ফের শুরু হয়েছিল মিল খোলার দাবিতে শ্রমিকদের বিক্ষোভ-আন্দোলন। চলেছিল শ্রীরামপুর DLC-অফিস ঘেরাও থেকে মিলের বাইরে মাইকিং-পোস্টারিং। শ্রমিকেরা বলেছিলেন, মাধ্যমিক-উচ্চমাধ্যমিক পরীক্ষা শেষ হলেই তাঁরা জিটি রোড অবরোধ করবে। মালিকপক্ষ এবং সরকার তাঁদের বিশ্বাস নিয়ে বারবার খেলছে। এই মিল বন্ধ প্রায় তিন বছর হতে যায়। সমানে মালিকপক্ষ তাঁদের ঘুরিয়ে আসছে – এই মিটিং হবে, এই মিল খুলবো! এই করেই। বহুবার পোক্ত আন্দোলনের সৃষ্টি হলেও তা শেষ পর্যন্ত টেকেনি। বলা ভালো টিকতে দেওয়া হয়নি! কখনো পুলিশ দিয়ে রাতের অন্ধকারে শ্রমিকদের মিথ্যে মামলায় মালিকপক্ষ গ্রেফতার করিয়েছে আবার কখনো ট্রেড ইউনিয়নে ‘হাতের নেতা ও গুন্ডা’ ঢুকিয়ে দিয়ে শ্রমিকদের আন্দোলন ভেতর থেকে ভেঙে দেওয়া হয়েছে। তবুও শ্রমিকেরা হাল ছাড়েননি। মিল খোলার স্বপ্ন এখনও দেখেন; ওঁরা মনে করে মিল আজ না হোক কাল খুলবেই।

যেদিন ওই অঞ্চলে রামনবমীকে উপলক্ষ্য করে ইচ্ছাকৃত অশান্তির সৃষ্টি হল ধর্মের নামে ভাগ-বাটোয়ারার স্বার্থে, সেদিন মিলের বস্তির হিন্দু-মুসলমান শ্রমিক মিলেমিশে সারা রাত পাহারা দিয়েছে। যেন কেউ না বস্তির ভেতরে ঢুকে কোনোরকম অশান্তির তৈরি করতে পারে। অনেকেই মনে করছেন, বেশির ভাগ শ্রমিক দেশে-গ্রামে ফিরে যাওয়ায় এই ঝামেলা বস্তির ভেতর থেকে এড়ানো গেছে। আরএসএস এখানেও তাদের শাখা খোলাবার চেষ্টা করেছিল মিল বন্ধ হওয়ার পর থেকে।

এই মিল বস্তিতে এখনও যে সমস্ত শ্রমিক থাকেন তাঁদের মধ্যে কিছু শ্রমিক ‘ভাউচার’  শ্রমিক (টাকা নাও বাড়ি যাও) হিসেবে পাশের হেস্টিংস মিল কিংবা শ্রীরামপুরের ইন্ডিয়ান জুটমিলে কাজ করেন। নয়তো অন্যের টোটো-ভ্যান চালান। একদিন কাজ না থাকলে কারোর সংসারে হাঁড়ি চড়ে না মোটে। গত দশদিন সমস্ত কিছু বন্ধ থাকবার ফলে এমন ভাবেই কেটেছে তাঁদের। এইসময় জুড়ে শ্রমিকেরা বস্তির ভেতরে একে অপরের সাথে দেওয়া-নেওয়া করেই কোন রকমে পেটে দানাপানি ঢুকিয়েছে। অনেক মুসলমান শ্রমিক রোজা বন্ধ করতে বাধ্য হয়েছে। স্বাভাবিক পরিবেশ পরিস্থিতি না থাকবার কারণে। তার উপর তো জল না আসা, কারেন্ট চলে যাওয়া, পর্যাপ্ত পরিমাণে বাথরুম না থাকা সহ আরো নানাবিধ সমস্যা রয়েইছে। এমনকি মিলের ভেতরে শ্রমিক পরিবারের সন্তানদের জন্যে যে ইস্কুলটি চলত সেটাও বন্ধ করে দেওয়া হয়েছে। এসব পৌরসভা চেয়ারম্যান থেকে মালিক কেউই গুরুত্ব দিয়ে দেখেনি কোনদিন। এই নিয়ে শ্রমিকরা যেখানেই গেছে তাঁদের শুনতে হয়েছে – মিলের জমি আমাদের হাতে পুরোপুরি চলে এলে আমরা সব দেখব তারপর থেকে। যা নিয়েও শ্রমিকেরা বড়োই দুশ্চিন্তায় রয়েছেন। কারণ তাঁদেরকে ওই অঞ্চল থেকে নানান রকম অজুহাত দেখিয়ে ইচ্ছাকৃত অশান্তি তৈরি করে উঠিয়ে দেওয়ার চেষ্টা চলছে বহুদিন ধরে। এই নিয়ে সেখানকার শ্রমিকদের বক্তব্য –মালিক ওই অঞ্চলগুলি পুরোপুরি হাতে নিয়ে সেখানে বড়ো-বড়ো আবাসন-শপিংমল, মাল্টিপ্লেক্স সিনেমা হল, দামি দামি রেস্তোরাঁ গড়ে তুলতে চাইছে। যেরকমটা বহু মিলের মালিকপক্ষ করেছে। কারখানা বন্ধ করে কোর্ট কেসের ফয়সালায় সেখানকার আশপাশের শ্রমিকদের থাকবার জমি দখল করে বড়ো বড়ো আবাসন-শপিংমল গজিয়ে তুলেছে। ফাটকা মুনাফার অঙ্ক সাজিয়ে। আর সরকার? পুলিশ-প্রশাসন? শ্রমিকদের ওখান থেকে গায়ের জোরে হটিয়ে দিতে এরা সকলেই মালিকপক্ষকে সাহায্য করেছে। তাই সেখানকার শ্রমিকেরা যথেষ্ট সজাগ রয়েছেন। শাসকশ্রেণির নোংরা রাজনীতির ফাঁদে পা দিয়ে নিজেদের মধ্যে জাত-ধর্ম নিয়ে তারা ঝামেলা-অশান্তি চাইছেন না কোনো মতে। একেই তো ঈশ্বর থেকে সরকার কেউই শ্রমিকদের এমন অসহায় করুণ অবস্থা দেখতে কিংবা শুনতে পান না কোনো মতে। তারপরেও কেন শ্রমিকেরা সরকারের স্বার্থে ঈশ্বরের হয়ে লড়াই করবে? এতে তো আখেরে মিলের মালিক পক্ষের লাভ হবে। শ্রমিকেরা অসন্তুষ্ট এখানকার পুলিশ-প্রশাসনের কাজকর্ম এবং মূল ধরার সংবাদমাধ্যম ও সামাজিক মাধ্যমে মিথ্যে খবর তুলে ধরা নিয়ে। শ্রমিকদের এই অসন্তুষ্টি হওয়ার কারণ যথেষ্ট রয়েছে। এতদিন মিল খোলার দাবিতে এতগুলি আন্দোলন মিলেমিশে শ্রমিকেরা করেছেন; সে খবর ছাপতে আসেনি কেউ। আর এখন মিথ্যে খবর, রাজনৈতিক এজেন্ডামূলক খবর তুলে ধরা হচ্ছে। অথচ মিলের মহল্লার হিন্দু-মুসলমান শ্রমিকদের ঐক্যবদ্ধ আন্দোলন, যৌথ প্রয়াসের কাজগুলি ইচ্ছাকৃত চেপে দিয়েছে। এমনকি পুলিশ-প্রশাসন তাঁদের বিবৃতিতে –‘এই অশান্তি বহিরাগতদের পাকানো’, এমন লিখলেও এখানকার ছেলেপুলেদের মিথ্যে মামলা সাজিয়ে গ্রেফতার করছে। যেমনটা ঠিক মিল খোলার দাবিতে আন্দোলন করলে কিংবা মিলের মালিকপক্ষের বিরুদ্ধে কিছু বললে, পুলিশ-প্রশাসন শ্রমিকদের সাথে করে থাকে।

হুগলি জেলার চন্দননগরে রয়েছে আরএসএস-এর বড়ো ঘাঁটি। বহুদিন ধরেই আরএসএস এই অঞ্চলগুলিতে টার্গেট করেছিল নিজেদের শাখা খুলবে বলে। কিন্তু তা হয়ে উঠেনি। এই অঞ্চলে নেই আরএসএস শ্রমিক সংগঠন ‘ভারতীয় মজদুর সংঘ’-এর ইউনিটও। অবশেষে শ্রমিকদের মধ্যে, শ্রমিক মহল্লায় বিদ্বেষের বাসা না বাঁধতে পেরে আরএসএস এই অঞ্চলের পাশের কিছু বস্তিকে টার্গেট করেছে –ইতিমধ্যে দুটি বস্তিতে আরএসএস এর শাখার বিস্তারও হয়েছে। যে বস্তিগুলোতে মূলত থাকে -কাজ না জানা ভবঘুরে মানুষজন। যাদের সাথে কোনোরকম ভাবেই উৎপাদনের কোন যোগসাজস নেই। যাদের মধ্যে কখনওই গড়ে উঠেনি মিলেমিশে চলবার ভেতরকার চেতনাও। অর্থাৎ যারা নিজেদের পেটের টানে সমস্ত ধরনের কাজ করতে পারে। পেটের টানে যারা চুরি-ডাকাতি কিংবা আঞ্চলিক নেতার হয়ে গুন্ডাগিরিও করে থাকে। ভোটের আগে এদেরকে টাকা দিয়েই রাজনৈতিক দলের আঞ্চলিক নেতারা রিগিং-বুথজ্যাম ইত্যাদি করিয়ে থাকে। এদের থাকবার জায়গাগুলিতে গেলে বোঝা যায় – এরা সরকার এবং পুলিশ দুই দিকের চাপে চিড়ে চ্যাপ্টা হয়ে গেছে। মুখের দিকে তাকালে দেখা যায় –এক আকাশ দারিদ্র্যের ছাপ অসহায়তা ও চোখের ভেতরে পুরু হয়ে জমতে থাকা রাগ-বিদ্বেষ। যদিও এই বিদ্বেষ তাঁদের মধ্যে আসে শ্রেণিগত তীব্র শোষণের ফলেই কিন্তু তা তারা বুঝতে অপারগ উৎপাদনী কাজের ধারেপাশে না থাকবার ফলে। মিলেমিশে না চলতে পারবার কারণে। সরকার কিংবা বিরোধীরাও সেই সুযোগে এদের কিছু টাকার লোভ দেখিয়ে নিজেদের ফায়দা লোটার বিভিন্ন কাজে ব্যবহার করে থাকে। আবার ব্যবহার ফুরিয়ে গেলে পুলিশ দিয়ে এঁদের জেলেও ভরে ফেলে নানান রকম কেসে জড়িয়ে। ফের পুলিশেরাও এদেরকে তাদের নানান রকম কাজে ’সাপ্লাই’ কিংবা টিপার হিসেবেও ব্যবহার করে। আরএসএস এখন এদেরকে ধরেই সেখানে নানান রকম অশান্তি-ঝুটঝামেলা তৈরির কাজ চালাচ্ছে। যদিও তা হিন্দুত্ববাদী -আদর্শগত ভাবে একদম নয়। বরং পেটের খিদে মেটানোর টাকার লোভ দেখিয়েই।

 

শ্রমিকদের কথা অনুযায়ী –সেদিন রামনবমীর জুলুসে বাইরের ও ওখানকার ছেলেরাই ছিল। শ্রমিক মহল্লার থেকে কেউ যায়নি ওই জুলুসে। শুধু তাই নয়; শ্রমিকেরা মনে করেন, পুলিশ-প্রশাসন চাইলে এই অশান্তি রুখতে পারতো। সরকার চাইলে এর বিরুদ্ধে পদক্ষেপ আগে থেকেই করতে পারতো এখানে। কিন্তু করেনি মূলত দুটি উদ্দেশ্যকে লক্ষ্য রেখে – এক, মালিকপক্ষের এখানকার মানুষজনকে হটিয়ে পুরো জমি দখলের স্বার্থ; দুই,ভোট রাজনীতির ভাগাভাগি। সমাজে বিভাজন সৃষ্টি করে নিজেদের আখের গোছানোর তালে। রামনবমীর দশদিন আগে থাকতে তাই এই অঞ্চলের শাসকদলের নেতা-মন্ত্রী চলে যায় অঞ্চল ছেড়ে। বিরোধী নেতারাও বেরিয়ে যায় অঞ্চল ছেড়ে ওইদিন সকালে। শ্রমিকেরা ফোন করেও অশান্তির সময় পায়নি কাউকে। তারপর অশান্তি শেষে ময়দানে নেমে কেবল একে অপরকে দোষারোপ আর খাওয়াখাওয়ি। নিজেদের রাজনৈতিক ফায়দা তুলতে। গরিব মানুষের মাথায় কাঁঠাল ভেঙে নিজেদের পেট ভরাতে সব উঠে পড়ে লেগে আছে! তাই মানুষের কী কী ক্ষতি হলো, কী কী সমস্যা আরও বাড়লো আর তার সুরাহাই বা কী -তা নিয়ে কোন উচ্চবাচ্য করেনি কেউ।

আজ এসবের ফলে হয়তো সাময়িক ভয়-ভীতি সৃষ্টি করে শাসকশ্রেণি নিজেদের ক্ষণিকের ফায়দা তুলে নিতে পারছে। কিন্তু বৃহত্তর ক্ষেত্রে শাসকশ্রেণির এই নোংরা রাজনীতি, শ্রমিকশ্রেণি তথা সাধারণ মানুষের হাতের মুঠোর মধ্যে বন্দি হচ্ছে। যার থেকে শাসকের ভবিষ্যত্ আরো সঙ্গীন হয়ে পড়ছে। শাসকের সমস্ত ধরনের নোংরা কুটকাচালি, হানাহানি আজ সাধারণ মানুষ ধরে ফেলেছে। গতকাল অবধি যারা শাসকের পক্ষ নিত, বলত, ‘কাটার বাচ্চাদের সব দোষ’, আজ শাসকশ্রেণির এই রকম জাত-ধর্ম ভেদাভেদের অশান্তি-নোংরা রাজনীতির বোমাবাজি যতোই তাঁদের দুয়ারে ধেয়ে আসছে, তাদের একটা বড়ো অংশ এই রাজনৈতিক দলগুলির বিরুদ্ধে অবস্থান নিতে শুরু করছে।

সামনেই ঈদ; ঈদের আগেই এমন অশান্তি। ঈদের আগের ব্যবসা, ঈদ ভালো করে কাটানোর স্বপ্ন না দেখলেও -বন্ধ ওয়েলিংটন জুটমিলের শ্রমিকেরা এবং আশপাশের দোকানদাররা এখনো স্বপ্ন দেখেন, একদিন ওয়েলিংটন জুটমিল ফের খুলবে আর এই নোংরা রাজনীতি ওখান থেকে সেদিন পুরোপুরি বন্ধ হবে। রুজিরুটির অভাব মিটলেই কেবল এসবের অবসান ঘটবে। শ্রমিকেরা  ‘সাম্রাজ্যবাদ কী কিংবা ফ্যাসিবাদের ইতিহাস’ সম্পর্কে অতশত তত্ত্ব কথা না বুঝলেও তাঁরা যথেষ্ট পরিমাণে বোঝেন তাঁদের শত্রু কারা।

Share Now:

LEAVE YOUR COMMENT

Your email address will not be published. Required fields are marked *