এই নিবন্ধটি ইংরাজিতে লিখেছেন জিন্দাল গ্লোবাল ল স্কুলের ছাত্র শ্রী ঋষি। এটি গত বছরের নভেম্বর মাসে nazariyamagazine.in ওয়েবসাইটে প্রকাশিত হয়। আমরা এর গুরুত্ব অনুভব করে ভাবানুবাদ প্রকাশ করছি।
২০১৪ সালে, ভারতের সুপ্রিম কোর্ট লিঙ্গ স্ব-নির্ধারণের আইনি অধিকারকে স্বীকৃতি দিয়েছে। এই প্রথম,ভারতীয় বিচার ব্যবস্থায় রূপান্তরকামী ব্যক্তিদের অধিকার আইনত স্বীকৃতি পায়। পরবর্তী কালে ২০১৮ সালে, একই আদালত ভারতীয় দণ্ডবিধির ৩৭৭ নম্বর ধারার কিছু অংশ ‘অসাংবিধানিক’ ঘোষণা করে বাতিল করে; যেগুলি প্রাপ্তবয়স্কদের মধ্যে সমকামী সম্পর্ককে অপরাধ হিসেবে চিহ্নিত করেছিল। এই দুটি রায় ভারতীয় ভিন্ন যৌনতার আন্দোলনে সাফল্যের বিশিষ্ট উদাহরণ হিসাবে বিবেচিত হয়। তারপর গত দশকে ভারতীয় বিচারবিধি দ্রুত অগ্রসর হয়েছে, ২০১৯ সালে এসেছে রূপান্তরকামী ব্যক্তি (অধিকার সুরক্ষা) আইন, যা ২০১৪-র ঐতিহাসিক রায়কে আরও প্রভাবিত করে। বর্তমানে ভারতবর্ষে প্রতি বছর নানান শহরে অসংখ্য ‘প্রাইড’ মার্চ হয়, যেখানে ভিন্ন যৌনতার(এলজিবিটিকিউএ) পরিচয়কে উদযাপন করা হয়। যদিও এই আন্দোলনের বিকাশের সাথে সাথে, এর প্রতিরোধমূলক চেহারাটা দুর্বল হচ্ছে। লিঙ্গ এবং যৌন নিপীড়ন ভারতীয় সমাজে এখনও তার দাঁত-নখ বসিয়ে আছে। প্রান্তিক লিঙ্গের মানুষের মুক্তির পথ এখনও পরিষ্কার নয়। জঙ্গি আন্দোলনের পরিবর্তে; নির্দিষ্ট এজেন্ডা বা দাবিদাওয়া পূরণের লক্ষ্যে আন্দোলন পরিচালিত হচ্ছে। তাই আন্দোলনের পরবর্তী পদক্ষেপ বা দাবি, সমকামী বিবাহ বৈধকরণ। কিন্তু সমকামী আন্দোলনের ইতিহাসে একটি স্পষ্ট প্যাটার্ন লক্ষ করা গেছে। মূলত এনজিও এবং তাদের বুর্জোয়া প্রতিনিধিরা আইনি সংস্কার ও আইনি পরিবর্তনের জন্য অর্থনৈতিক দাবিদাওয়ার আন্দোলনে একে সীমাবদ্ধ রেখেছে৷ আন্দোলন এভাবে আরও এনজিও-গুলির মাধ্যমে আইনি অধিকারকে বাস্তবায়নের দিকে এগিয়ে যায়, যার চূড়ান্ত পরিণতি হয় আরও একটি আইনি সংস্কারের দাবিতে। আন্দোলনটি কিছু প্রগতিশীল দাবিকে ঊর্ধ্বে তুলে ধরতে পারতো, কিন্তু বাস্তবে তা একটি বুর্জোয়া সংস্কারবাদী আন্দোলনে রূপান্তরিত হয়েছে যা সাম্রাজ্যবাদী লগ্নিপুঁজি দ্বারা সমর্থিত এবং চালিত; উত্তর-আধুনিক মতাদর্শে পরিচালিত। ভারত জুড়ে সমকামী জনগণের প্রকৃত মুক্তির লক্ষ্যে একটি আন্দোলন গড়ে তোলার পরিবর্তে, এই এনজিও-নেতৃত্বাধীন সাম্রাজ্যবাদী আন্দোলনের নেতৃত্ব লিঙ্গ ও যৌন নিপীড়নের বিরুদ্ধে সংগ্রামকে বিপথগামী করেছে এবং এটিকে এমন এক দিকে পরিচালিত করেছে যেখানে লিঙ্গ ও যৌন নিপীড়নের প্রকৃত মুক্তি নেই। বরং তাকে ব্রাহ্মণ্যবাদী হিন্দুত্ববাদী রাষ্ট্রের হাতে নিয়ন্ত্রিত আইনব্যবস্থার উপর নির্ভরশীল করে তুলেছে। এই প্রক্রিয়ায়, ফ্যাসিবাদী শক্তি ভিন্ন যৌনতার আন্দোলনের মধ্যে নিজের স্থান তৈরি করে নিয়েছে। লক্ষ্মীনারায়ণ ত্রিপাঠী ভিন্ন যৌনতার আন্দোলনের একজন বিশিষ্ট ব্যক্তি হয়ে উঠেছেন; যিনি অযোধ্যার রাম মন্দিরের হিন্দু ফ্যাসিস্ট চাহিদাকে সমর্থন করেন আবার সেই সাথে বর্ণব্যবস্থাকে সমর্থন করেন। আন্দোলনের মধ্যে যে অভ্যন্তরীণ দ্বন্দ্ব এবং বৃহত্তর ভারতীয় জনগণের সংগ্রামের সাথে এর যে বিচ্ছিন্নতা রয়েছে,তা তুলে ধরা খুবই প্রয়োজন। পাশাপাশি ভারতীয় ভিন্ন যৌনতার জনগণকে এই সাম্রাজ্যবাদী, এনজিও-নেতৃত্বাধীন আন্দোলনকে তীব্র ভাবে প্রত্যাখ্যান করার এবং ভারতের নিপীড়িত ও শোষিত জনগোষ্ঠীর সাথে ঐক্যে সংগঠিত করার প্রয়োজন রয়েছে। ভারতকে রূপান্তর করার জন্য প্রয়োজন বৃহত্তর শ্রমিক ও কৃষক শ্রেণির পরিবর্তনকামী সংগ্রাম, সংস্কার নয়। ভিন্ন যৌনতার আন্দোলনের পথ নির্ধারণ করতে গেলে ঐতিহাসিকভাবে ভারতে লিঙ্গ এবং যৌন নিপীড়নের বিশেষত্বকে বুঝে নেওয়া দরকার।
বিশ্বায়িত পরিচয় নয়, ভারতীয় প্রেক্ষাপটে ‘ভিন্ন যৌনতা’কে বুঝতে হবে
পশ্চিমের ভিন্ন যৌনতার আন্দোলনগুলি উপনিবেশের লিঙ্গ বিষয়ক বোঝাপড়া বাড়াতে গভীর ভাবে সাহায্য করেছে৷ মার্কস দেখিয়েছেন যে পুঁজি কেবল মূলধন নয় বরং এটি একটি সামাজিক সম্পর্ক যা উৎপাদনে উদ্বৃত্ত মূল্য থেকে তৈরি হয়, যার মাধ্যমে এটি ক্রমাগত আরও পুঁজি উৎপাদন করে। যেহেতু পুঁজিবাদ এখন সাম্রাজ্যবাদের পর্যায়ে রয়েছে, তাই ‘উন্নত’ বিশ্বের একচেটিয়া পুঁজিপতিদের কাছ থেকে প্রাক্তন উপনিবেশগুলিতে পুঁজির অবিরাম রফতানি হচ্ছে ৷ এই পুঁজি নিজের সাথে বিকৃত সামাজিক সম্পর্ক নিয়ে আসে যা লিঙ্গ-সম্বন্ধিত বোঝাপড়া সহ জীবনের সমস্ত ক্ষেত্রকে প্রভাবিত করে। আরও পুঁজি উৎপাদনের লক্ষ্যে বাস্তব জগত সম্বন্ধে আমাদের মধ্যে বিকৃতি তৈরি করে। এই বিকৃতিগুলির বিশিষ্টতা খুঁজে পাওয়ার জন্য আমাদের দক্ষিণ এশিয়ার ইতিহাসের দিকে তাকাতে হবে, যাতে ভিন্ন যৌনতা পরিভাষাটির এবং বিশ্বব্যাপী এর ঐতিহাসিক প্রকৃতি সম্পর্কে আমাদের ধারণা পরিষ্কার হয়।
অন্যান্য সমস্ত সমাজের মতো দক্ষিণ এশিয়াতেও সময়ের সাথে তাল মিলিয়ে লিঙ্গচেতনার বিকাশ ঘটেছে কিছু বিশেষত্ব সহ। পুরুষ এবং মহিলার সরল লিঙ্গপরিচিতির বাইরে লিঙ্গগোষ্ঠী হিসাবে হিজরা, কিনার, জোগাপ্পা, খোজা, আরাওয়ানি প্রভৃতির অস্তিত্বের ঐতিহাসিক উল্লেখ রয়েছে। এই লিঙ্গগোষ্ঠীগুলির বিভিন্ন সদস্যের শুধুমাত্র পৌরাণিক অস্তিত্বের পরিপ্রেক্ষিতে সামন্ততান্ত্রিক সমাজে ভূমিকা ছিল না বরং সামন্ত শাসক শ্রেণির প্রশাসনে একটি সক্রিয় ভূমিকা ছিল৷ অনেক হিজরা সামন্ততান্ত্রিক ব্যবস্থায় জমিদারদের জন্য খাজনা সংগ্রহকারী হিসাবে নিযুক্ত ছিল, এমনকি উপহারের মাধ্যমে উৎপাদনের নানা উপকরণও সংগ্রহ করেছিল। খোজারা সম্রাটদের পাশাপাশি তাদের হারেম, উভয়েরই প্রহরার কাজে নিযুক্ত হত, এই ভাবে তারা মুঘল প্রশাসনে একটি গুরুত্বপূর্ণ সামাজিক ভূমিকা পালন করেছিল। এই ভূমিকাকে কেন্দ্র করে সমাজে সমাজে তাদের নিজস্ব সংস্কৃতিও প্রতিষ্ঠিত হয়। মুঘল মনসবদারি ব্যবস্থা ছিল এমন একটি ব্যবস্থা যা সরকারি বা সামরিক কর্মকর্তার অবস্থান নির্ধারণ করত জ্যাট মানের ভিত্তিতে। খোজারা অনেকেই মুঘল মনসবদারি ব্যবস্থার মধ্যে উচ্চজ্যাট পদ ধরে রেখেছিলেন। এর থেকেই তাদের প্রভাব প্রতিপত্তি সম্বন্ধে ধারণা করা যায়। মনসবদারি ব্যবস্থাটি নির্ধারণ করতো কীভাবে করের মাধ্যমে আহরণ করা সামন্ততান্ত্রিক উদ্বৃত্ত অভিজাতদের মধ্যে বিলিবণ্টন হবে। এটমাদ খান এবং ফিরোজ খানের মতো খোজাদের ৩০০০-এরও বেশি জ্যাট মান ছিল। এমনকি খোজা আগাহের মতো অন্যরা গ্যারিসনের কমান্ডার হয়ে উঠেছিলেন। খোজারা মুঘল দরবারে আরও অন্যান্য উপায়েও সক্রিয় ভূমিকা পালন করেছিল, হয় সম্রাট এবং তাদের পরিবারের গৃহকর্মী হিসাবে বা দরবারে খোজা সরবরাহ করার দালাল হিসাবে। এছাড়াও, এই লিঙ্গসম্প্রদায়গুলির সাথে অনেক পৌরাণিক বিশ্বাস যুক্ত ছিল। অনেককে দেবতা হিসেবে বিবেচনা করা হত এবং বহু মন্দিরে একমাত্র তাদেরই প্রবেশাধিকার দেওয়া হত, যাতে তারা মন্দির রক্ষণাবেক্ষণ করতে পারে। সামন্ততান্ত্রিক সমাজের উৎপাদন ব্যাবস্থায় যে এই লিঙ্গগোষ্ঠীগুলির একটি গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা ছিল তা খুবই স্পষ্ট। ফ্রান্সিসকো পেলসার্ট-এর মতো ইউরোপীয়রা এই বিষয়টি দেখে হতবাক হয়েছিলেন। এগুলি ইউরোপীয় সমাজের বিপরীতে দক্ষিণ এশীয় সমাজে লিঙ্গের বিকাশের পার্থক্যরেখা টানে।
যেমনটি পূর্বে উল্লেখ করা হয়েছে, পুঁজি নিজেই একটি সামাজিক সম্পর্ক। কিন্তু উদ্বৃত্ত পুঁজির উৎপাদন একটি নির্দিষ্ট উৎপাদন সম্পর্কের ভিত্তিতে ঘটে,বা সহজ ভাষায়: শ্রেণি সম্পর্কের ভিত্তিতে ঘটে। ইউরোপীয় সমাজে, বণিক পুঁজি ধীরে ধীরে শিল্পপুঁজিতে বিকশিত হয়, যা শিল্প বিপ্লব হিসাবে পরিচিত। বাস্তবে এই পরিবর্তন ইউরোপীয় সমাজে বৃহত্তর বুর্জোয়া বিপ্লবের সাথে মিলে যায়, যা ইউরোপীয় সামন্ততন্ত্রকে নির্মূল করে এবং পুঁজিবাদের সুত্রপাত করে। বুর্জোয়া গণতান্ত্রিক বিপ্লব কেবল জীবনের অর্থনৈতিক দিককে রূপান্তরিত করেনি বরং জীবনের সমস্ত ক্ষেত্রগুলিতে ছড়িয়ে পরে।এ সময় পরিবার একটি কঠোর একগামী এবং বিষমকামী কাঠামোতে রূপান্তরিত হয় যেখানে প্রতিটি লিঙ্গের ভূমিকা উৎপাদন প্রক্রিয়ায় গভীর ভাবে আবদ্ধহয়; যেমন, উদ্বৃত্ত (পুরুষলিঙ্গ) এবং শ্রমের পুনরুৎপাদন (মহিলা এবং শিশু)। এখানে, পুঁজিবাদ সামন্তবাদকে উৎখাত করার মধ্যে দিয়ে একটি প্রগতিশীল শক্তি হিসাবে কাজ করেছিল আবার নতুন সামাজিক সম্পর্কও তৈরি করেছিল। এই প্রক্রিয়াটি বিশ্বের অন্যান্য দেশে ঘটতে দেওয়া হয়নি। ইউরোপীয় পুঁজিবাদ দেশীয় প্রতিযোগিতা থেকে বিকাশ লাভ করে শিল্পপুঁজির পর্যায় থেকে একচেটিয়া পুঁজিতে বিকাশ লাভ করে, যেখানে লগ্নিপুঁজিকে বিশ্বের বাকি অংশে রফতানি করা হয়েছিল। পুঁজিবাদের এই পর্যায়কেই বলা হয় সাম্রাজ্যবাদ। সাম্রাজ্যবাদ উপনিবেশগুলিতে উৎপাদন সম্পর্কের পরিবর্তন ঘটিয়ে একটি বিকৃত রূপ প্রবর্তন করে যেখানে সামন্ততন্ত্রকে নির্মূল করার পরিবর্তে, সাম্রাজ্যবাদী লগ্নিপুঁজি সামন্ততন্ত্রের সাথে মিলিত হয়ে সমাজের মধ্যে সামন্ততন্ত্রকে টিকিয়ে রাখে। ‘উন্নয়ন’ এর মুখোশ পরে তার শোষণ চালাতে থাকে যাতে শিল্পের প্রয়োজনীয় কাঁচামাল উত্তোলন ও রফতানি করা যায়। ঔপনিবেশিক ভারতে পুঁজিবাদের একটি বিকৃত পশ্চাদপসরণের রূপ দেখা যায়, যেখানে সামন্ততন্ত্রকে উৎখাত করার পরিবর্তে, বিদেশি পুঁজি সামন্ততন্ত্রের উপর ভর করে উৎপাদনের নতুন বিকৃত সম্পর্ক তৈরি করে। ইউরোপে পুঁজিবাদ প্রাথমিক ভাবে একটি প্রগতিশীল ভূমিকা পালন করেছিল। কিন্তু ইউরোপে পুঁজিবাদের যে পথে বিকাশ ঘটেছে ভারতে তার পথ সম্পূর্ণ বিপরীতে।
ঔপনিবেশিক ব্যবস্থার লক্ষ্য সমাজকে এমন ভাবে রূপান্তরিত করা যাতে তার নিজস্ব স্বার্থ অক্ষুণ্ন থাকে এবং উপনিবেশ থেকে সম্পদ আহরণের জন্য সর্বোত্তম পরিস্থিতি তৈরি করে৷ সুতরাং উপনিবেশগুলিকে লুঠপাট চালানোর ‘আদর্শ’ দ্বীপে রূপান্তরিত করার লক্ষ্যে ঔপনিবেশিক আইন-কানুনে একাধিক সংস্কার আনা হয়েছিল; বিশেষত এই সংস্কারগুলি আসে লিঙ্গ-সংক্রান্ত বিষয়ে। ‘পুরুষ’ এবং ‘মহিলা’-র ইউরোপীয় ধারণার মধ্যে পড়ে না এমন বহু লিঙ্গগোষ্ঠীর বিরুদ্ধে একাধিক ধাক্কা আসে এই সংস্কারের মধ্যে দিয়ে। অপরাধমূলক উপজাতি আইন, ১৮৭১- তাদের উৎপাদন প্রক্রিয়া থেকে বিচ্ছিন্ন করে এবং তাদের অস্তিত্বকে আইনি ভাবে নিষিদ্ধ করে। উল্লেখ করা প্রয়োজন যে ১৮৫৭ সালের মহাবিদ্রোহের পরে এই আক্রমণটি আরও তীব্র হয়েছিল, যে যুদ্ধে ঔপনিবেশ বিরোধী, জাতীয়তাবাদী অংশ এবং কৃষক বাহিনী পরাজিত হয়েছিল।এর পরই পুরনো সামন্ততান্ত্রিক সমাজকে আরও ভাল ভাবে রূপান্তরিত করার লক্ষ্যে বড়ো আকারের সামাজিক সংস্কার করা হয়েছিল। আমদানি করা সাম্রাজ্যবাদী পুঁজির মতো, লিঙ্গ বিষয়ক ধ্যানধারণাও আমদানি করা হয় এই সংস্কারের মধ্যে। কিন্তু অন্যান্য লিঙ্গভিত্তিক গোষ্ঠী এবং প্রান্তিক সামাজিক গোষ্ঠীগুলিকে অবৈধ বা নিষিদ্ধ ঘোষণা করলেই তো তারা সমাজ থেকে নির্মূল হয়ে যায় না। সামন্ততন্ত্রকে ইউরোপীয় সমাজে যেভাবে নিশ্চিহ্ন করা হয়েছিল, সে ভাবে ভারতে কখনওই উৎখাত করা হয়নি। বরং ভারতীয় সমাজ এই দ্বন্দ্বের মধ্যে আটকা পড়েছে, যেখানে সামন্ততান্ত্রিক শ্রেণির সাথে সাম্রাজ্যবাদী শক্তির জোট জীবনের সমস্ত ক্ষেত্রেই প্রতিফলিত হয়। সহজ ভাবে বলতে গেলে, এটি এমন একটি সমাজ তৈরি করে যা গভীর ভাবে এক বিপরীত জোড়ের যুগ্মরূপ বা বাইনারি। একই সাথে সামন্ততন্ত্রের অধীনে বিকশিত লিঙ্গগোষ্ঠীর উপস্থিতিও লক্ষ্য করা যায়, যেমন হিজরা; যাদের নিজস্ব কিছু প্রথাও আছে আবার বৃহত্তর সামন্ততান্ত্রিক সমাজেও তাদের এক অবস্থান আছে।এর প্রতিফলন পাওয়া যায় হিজরা গুরু-চেলা প্রথায় ও হিজড়ের আশীর্বাদ দান করার প্রথায়। হিজরারা গর্ভবতী মহিলার সাধ, শিশুদের অন্নপ্রাসন, বিবাহের মতো অনুষ্ঠানে নৃত্য, গান এবং আশীর্বাদ প্রদান-এর মতো বিভিন্ন ক্রিয়াকলাপ সম্পাদন করে৷ তারা মূলত অনুষ্ঠানে আশীর্বাদ প্রদান করে এবং সেই আশীর্বাদের বিনিময়ে তাদের নগদ টাকা বা পণ্য উপহার প্রদান করা হয়। এই অনুশীলন, বিনিময় প্রথা সবই গভীর ভাবে সামন্ততান্ত্রিক। হিজরারা জীবিকার জন্য ভিক্ষা করার পাশাপাশি দেহ ব্যবসাতেও যুক্ত থাকতে বাধ্য হয়।ফলে তাদের মধ্যে অনেক লুম্পেন সর্বহারা শ্রেণির বৈশিষ্ট্যও দেখা যায়, তবে এই বিষয়ে আরও তদন্তের প্রয়োজন আছে। হিজরাদের এই ভিক্ষা করার পুরো ব্যবস্থার সাথেই যুক্ত আছে সামন্ততান্ত্রিক মূল্যবোধ। ভিক্ষা না দিলে তাদের দ্বারা অভিশপ্ত হওয়া এবং তাদের অসন্তুষ্ট করা অত্যন্ত অশুভ বলে বিবেচিত হয়।
১৯৪৭ সালে ভারতের ক্ষমতা হস্তান্তরের পরে এই প্রান্তিক লিঙ্গগোষ্ঠীগুলির অবস্থার কোনো উন্নতিই হয়নি। উপনিবেশিক ভারতে এই প্রান্তিক লিঙ্গের মানুষগুলির ওপর যে আক্রমণ ও শোষণ শুরু হয়, মুৎসুদ্দি বুর্জোয়া এবং জমিদার শ্রেণির হাতে তা অব্যাহত থাকে। বিভিন্ন উপনিবেশে এটা পরিলক্ষিত হয়েছে যে সামন্ততান্ত্রিক লিঙ্গগোষ্ঠীগুলির অবস্থানের ঠিক বিপরীতে সিসজেন্ডার গোষ্ঠীগুলির অবস্থানের মধ্যে তীব্র দ্বন্দ্ব কাজ করছে। নাইজেরিয়ান গবেষক ওয়েরুঙ্কি ওয়ুমির বলছেন, আফ্রিকার বিভিন্ন দেশে থাকা ইয়োরুবা সম্প্রদায়ের মধ্যে, লিঙ্গের বহুবিধ স্তর বিন্যাস ছিল। বর্তমানে লিঙ্গের যে বোঝাপড়া সমাজে রয়েছে তা উপনিবেশের ফসল যা জটিল বহুমাত্রিক লিঙ্গের ধারণাকে ব্যাখ্যা করতে অক্ষম। সমস্ত দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়াতেও অনুরূপ পরিস্থিতি লক্ষ্য করা যায়। ফিলিপাইনসে বিগাসলোকদের মধ্যে, জাভার মানুষের মধ্যে, ইবানদের মধ্যে বিভিন্ন লিঙ্গগোষ্ঠী পাওয়া যায় যেমন বাকলা, বিসু, ওয়ারোক এবং মানং-বালি। কিন্তু ‘উন্নত’ প্রথম বিশ্বের পুঁজিবাদী সমাজে পরিবারতন্ত্র শিথিল হওয়ার সাথে সাথে লিঙ্গভিত্তিক নিপীড়ন ভিন্ন যৌনতা সম্পর্কে বোঝাপড়ার পরিবর্তন ঘটাচ্ছে।
পরিবর্তনের মূলে সাম্রাজ্যবাদ?
পূর্বের উপনিবেশগুলিতে লিঙ্গভিত্তিক পরিচিতি ও গোষ্ঠীগুলি নতুন বাস্তবতার সম্মুখীন হতে শুরু করেছে। প্রথম বিশ্বের দেশগুলিতে সমকামী আন্দোলন জঙ্গিরূপ ধারণ করেছিল, যার মধ্যে উল্লেখযোগ্য স্টোনওয়াল দাঙ্গা। এই ধরনের বিক্ষোভ-আন্দোলনগুলি পশ্চিমি পুঁজিবাদী সমাজের মধ্যে কিছু পরিবর্তন, আইনি সংস্কার এনেছে। কিন্তু পুঁজিবাদ তার সাম্রাজ্যবাদের পর্যায় থেকে সরে দাঁড়ায়নি, বরং নয়া উপনিবেশবাদের মোড়কে বিশ্বের বড়ো অংশের জনগণের সাথে তার শোষণমূলক সম্পর্ক বজায় রেখেছে। ‘উন্নয়নশীল’ দেশগুলিতে সমকামী ও লিঙ্গভিত্তিক গোষ্ঠীদের অধিকারের প্রশ্নটি বর্তমানে খুবই প্রাসঙ্গিক হয়ে উঠেছে। সাম্রাজ্যবাদী লগ্নিপুঁজি একেই কাজে লাগিয়ে সমকামী আন্দোলনকে বিভ্রান্ত করার চেষ্টা করছে। উদাহরণস্বরূপ, আইনি সহায়তার গ্রুপ এইডস ভেদভাব বিরোধী আন্দোলন – ১৯৯৪ সালে ভারতীয় দণ্ডবিধির ৩৭৭ অনুচ্ছেদের বিরুদ্ধে আবেদন করেছিল। তবে দীর্ঘ আইনি লড়াইয়ের পর তা খারিজ করা হয়৷ এদিকে, যখন সাম্রাজ্যবাদী পুঁজিদ্বারা সমর্থিত এনজিও-গুলি একই আবেদন জানায় সুপ্রিম কোর্টে, তখন তা স্বীকৃতি পায়। ২০০০-এর দশকে জাতিসংঘও ভারতে বহু সম্মেলন করেছে রূপান্তরকামী এবং সমকামী কর্মীদের বক্তব্য রাখার জন্য। বিশ্ব সামাজিক ফোরাম, নব্য-উদারতাবাদকে প্রতিরোধ করার এজেন্ডা সামনে রাখলেও, পরিবর্তনের দূত হিসেবে প্রাথমিক ভাবে এনজিও-গুলির উপর নির্ভর করে। এছাড়াও সমকামী আন্দোলনে জড়িত বড়ো এনজিও-গুলিকে নানা মঞ্চে নিয়ে এসে, আন্দোলনের মুখ হিসেবে তুলে ধরতে চায়। সমকামী আন্দোলনের নেতৃত্বে এনজিও-গুলির উপস্থিতি, আন্দোলনকে আইনি সংস্কারবাদী পথে পরিচালিত করেছে। তারা রাষ্ট্রকে এক প্রগতিশীল শক্তি হিসাবে দেখে আন্দোলনকে অর্থনীতিবাদের মধ্যে সীমাবদ্ধ রাখছে। এটিএনজি-গুলির বৃহত্তর কর্মপদ্ধতির সঙ্গে সমতুল্য, যারা শিক্ষাবিদ এবং বুর্জোয়া শ্রেণিকে প্রগতিশীল সংগ্রামের নেতৃত্বে নিয়ে আসে এবং পুঁজির বিনিয়োগকে মানবিক মুখোশ দেওয়ার চেষ্টা করে। মূলত এদের উদ্যোগেই ভারতীয় প্রান্তিক লিঙ্গের গোষ্ঠীগুলিকে নতুন করে নামকরণ করা হচ্ছে। হঠাৎ, প্রাক-ঔপনিবেশিক লিঙ্গগোষ্ঠীগুলির বিভিন্ন আইনি নথিপত্রে নন-বাইনারি, তৃতীয় লিঙ্গ বা রূপান্তরকামী হিসেবে চিহ্নিত হচ্ছে ৷ কিন্তু এই আন্দোলনটি কীভাবে আরও হিংসার পুনরুৎপাদন ঘটাচ্ছে এবং গোটা বিষয়টিকে বিকৃত করছে, তার একটি বস্তুগত দিকও রয়েছে। এর পরিচালক শক্তি সাম্রাজ্যবাদী পুঁজির থেকেই এ সবের জন্ম হয়ে চলেছে।
এটিও লক্ষ্য করা উচিত যে, বহু সামাজিক সমস্যার মধ্যে ভিন্ন যৌনতার মানুষদের অধিকার রক্ষা বর্তমানে একটি জ্বলন্ত সমস্যা। এবং এনজিও-গুলির থেকে যে ধরনের আইনি সংস্কারের জন্য চাপ দেওয়া হচ্ছে তা সাম্রাজ্যবাদী পুঁজি ও সামন্ত শ্রেণির জোটকে প্রতিফলিত করে। এমনকি আইনি সংস্কারের পরে এমন ভাবে লিঙ্গগোষ্ঠীগুলির কর্মসংস্থান করা হয়, যেগুলি তাদের পুরনো সামন্ত সমাজের ভূমিকার অনুরূপ। উদাহরণস্বরূপ, প্রাক-ঔপনিবেশিক সমাজে খোজাদের কর সংগ্রাহক হিসেবে নিযুক্ত করা হত। বর্তমানে সরকারি কর্মকর্তারা তাদের করদাতাদের ‘অপমান’ করার জন্য প্রেরণ করে। ভারতের কিছু প্রদেশে হিজড়েদের দেহরক্ষী এবং গৃহকর্মী হিসাবে নিযুক্ত করার একটি বিস্ময়কর দাবি রয়েছে। বিহারের রাজনীতিবিদ কালী হিজরা দাবি করেছেন যে মুঘল সমাজে তাদের যে মর্যাদা ছিল, তাদের সম্প্রদায়কে তা ফিরিয়ে দেওয়ার প্রয়োজন রয়েছে৷ ভিন্ন যৌনতার সম্প্রদায়গুলির মধ্যে জাতিবর্ণবাদী প্রবণতা নিয়ে একটি সমালোচনা তৈরি হচ্ছে। এই প্রবণতা যে শুধু ভিন্ন যৌনতার পরিসরের মধ্যেই সীমিত থাকছে তা নয়, তাকে রাজনীতির মধ্যেও নিয়ে আসা হচ্ছে। বর্ণ-ভিত্তিক অস্পৃশ্যতার সাথে সমকামী ভীতি এবং সমস্ত ‘তৃতীয় লিঙ্গ’ ব্যক্তিদের সাথে অন্যান্য পিছিয়ে থাকা জাতির (OBC) অবিশ্বাস্য তুলনা করা চলছে। এছাড়া ভিন্ন যৌনতার আত্মীয়তার ভিত্তিতে পরিচালিত পরিবারগুলি ভেঙ্গে দিয়ে রাষ্ট্র দ্বারা নিয়ন্ত্রিত ‘পুনর্বাসন কেন্দ্রগুলি’তে তাদের স্থানান্তরিত করার চেষ্টা চলছে। অনেক এনজিও নিজেরাই এই ধরনের কেন্দ্র চালানোর কাজ শুরু করেছে এবং বিভিন্ন বিষয়ে তাদের কর্মকাণ্ডকে প্রসারিত করছে। ভারতীয় সমাজের মধ্যে নিপীড়িত জনসাধারণের বড়ো অংশ এই আন্দোলনে অনুপস্থিত। লিঙ্গ স্বনির্ধারণের আন্দোলনটি বাস্তবে কিছু সমকামী আইনজীবী এবং কিছু এনজিও দ্বারা পরিচালিত হয়েছিল। তারা নিজেদের ছোটো গোষ্ঠীর বাইরে কাউকে এতে যুক্ত করেনি। যদিও আন্দোলনের সাফল্যকে ‘ভারতীয় ভিন্ন যৌনতার আন্দোলন’- এর বিজয় হিসাবে ঘোষণা করা হয়। এই আন্দোলন কেবল সামন্ততান্ত্রিক ও প্রতিক্রিয়াশীল শক্তি দ্বারা দিকভ্রষ্টই নয়, এটি এমন এক নেতৃত্বের অধীনে আটকে পড়েছে, যা নিজেই সামন্ততান্ত্রিক ও প্রতিক্রিয়াশীল চরিত্রের কারণ এবং আন্দোলন থেকে বৈপ্লবিক চরিত্রকে সচেতন ভাবে দূরে সরিয়ে রেখেছে।
আইনি সংস্কারগুলি প্রকৃতপক্ষে বুর্জোয়া সুবিধাবাদের প্রতিনিধিত্ব করে, ফলে ধারাবাহিক ভাবে ভিন্ন যৌনতার আন্দোলনের মূল দাবিগুলি অপূর্ণ থেকে যাচ্ছে৷ সাংবিধানিক কাঠামোতে যে সমকাম ভীতি আছে, ৩৭৭ নম্বর ধারা তারই প্রতীক ছিল এবং ২০১৮ সালে এটির অবলুপ্তি ভারতের ভিন্ন যৌনতার সম্প্রদায়ের কাছে একটি ঐতিহাসিক বিজয় হয়ে ওঠে। কিন্তু এটিই প্রমাণ করে যে এই আন্দোলনে কোনো শ্রেণির রাজনীতি নেই৷ ২০১৮ সালে যেদিন আদালত ৩৭৭ নম্বর ধারার কিছু অংশকে ‘অসাংবিধানিক’ বলে রায় দিয়েছিল এবং চারিদিকে আন্দোলনের বিজয় উদযাপন করা হচ্ছিল; সেদিন সারা দিল্লি জুড়ে হিজরা এবং কিন্নর ভিক্ষুকরা পুলিশের বর্বরতার শিকার হয়েছে বলে অভিযোগ করে।অত্যাচারিত এক সাক্ষী বলেন, ‘দুই-তিনজন পুলিশ আমাদের তুলে হেফাজতে নিয়ে গেল, আমাদের উল্টো করে ঝুলিয়ে নির্যাতন করা হয়। ওরা দীর্ঘ সময় ধরে আমাদের সাথে দুর্ব্যবহার করে এবং তারপরে তারা আমাদের ধর্ষণ করে। আমরা শুধু বসে বসে নিজেদের মধ্যে কথা বলছিলাম…এটা কি অপরাধ?’। ৩৭৭ নম্বর ধারা ভারতীয় সমকামভীতির মূর্ত রূপ হিসেবে থাকলেও, অধিকাংশ শ্রমজীবী, দলিত, আদিবাসী ভিন্ন যৌনতার মানুষের ওপর রাষ্ট্র যে নিপীড়ন চালায়, তার পেছনে তারা অজুহাত দেয় ভবঘুরে বিরোধী ও প্রকাশ্য স্থান নোংরা করা ও গোলমাল করার বিরুদ্ধে থাকা আইনগুলির, পাশাপাশি ‘আদর্শ’ সমাজের মধ্যে ভিন্ন যৌনতার মানুষদের ঢুকতে না দেওয়ার বিষয়টাতো রয়েছেই। অনেকেই এটা উপলব্ধি করতে ব্যর্থ হন যে, আইনি স্বীকৃতির সংগ্রামটি কেবল ধনী সমকামী পুরুষদের একটি অংশের স্বার্থে পরিচালিত, নির্দিষ্ট ধরনের আকাঙ্ক্ষার জন্য আইনি অনুমোদন চাওয়ার লড়াই ছিল, যা কিনা ভিন্ন যৌনতার আন্দোলনের প্রতীকী জয় হিসেবে সামনে আনা হচ্ছে। এই রাজনীতি শুধুমাত্র বুর্জোয়াদের সুবিধার্থে পরিচালিত হচ্ছে তাই নয়, বরং ভারতের বেশিরভাগ সমকামী জনগণের বিরুদ্ধে রোজ ঘটে চলা হিংসাকে আড়াল করার কাজও করছে৷ ভিন্ন যৌনতার মানুষদের সমাজের প্রান্তে ঠেলে দেওয়া হয় এবং নিজেদের টিকিয়ে রাখার জন্য তারা ভিক্ষা, দেহব্যবসা এবং নারী পাচার করতে বাধ্য হয়; যেখানে তারা নিয়মিত রাষ্ট্রের হিংসার শিকার হয়৷ এই আন্দোলনের নেতৃত্ব সচেতনভাবে এই দিকগুলি লুকিয়ে রাখে এবং সাম্রাজ্যবাদের স্বার্থসিদ্ধির রাজনীতিকে আত্মকেন্দ্রিক রাজনীতির মুখোশে ঢেকে রাখে৷ আন্দোলনের রাজনীতিতে ধীরে ধীরে উত্তর-আধুনিক আত্মকেন্দ্রিকতার দর্শন প্রভাব বিস্তার করতে শুরু করেছে। সমকামী গোষ্ঠীদের প্রকৃত সমস্যাগুলিকে সমগ্র সমাজের সমস্যা থেকে বিচ্ছিন্ন করে ব্যক্তির সমস্যা হিসেবে তুলে ধরা হচ্ছে। এটি শ্রেণি সংগ্রাম থেকে বিচ্ছিন্ন একটি আন্দোলন এবং আত্মতুষ্টির মধ্যে আন্দোলনের বিকাশকে আটকে রাখা হয়েছে।
ব্যক্তিস্বাতন্ত্র্য, যৌন নৈরাজ্য এবং সাম্রাজ্যবাদী সাংস্কৃতিক বিকৃতি
‘ব্যক্তিগত অভিজ্ঞতা’কে অতিরিক্ত গুরুত্ব দেওয়াটা একটি চলমান প্রবণতা, যা ব্যক্তির সামাজিক সম্পর্কের বিষয়টিকে নয়া-উদারনীতিবাদ যেভাবে বিকৃতি করে চলেছে, তারই অংশ। বাজারের সম্প্রসারণের জন্য পণ্য বিক্রি করার স্বার্থে আরও আরও পরিচিতিসত্তার নির্মাণ জরুরি। নয়া-উদারনৈতিকতাবাদ ক্রমাগত নতুন পরিচিতিসত্তা তৈরি করার মাধ্যমে বিষয়টিকে সহজতর করে, এমনকি সেগুলো সম্পূর্ণ ভাবে সংজ্ঞায়িত না হলেও। ব্যক্তি বাস্তব সমাজের মধ্যে একটি বিচ্ছিন্ন সত্তা হয়ে ওঠে এবং ব্যক্তির অভিজ্ঞতাকে সামগ্রিকতার ঊর্ধ্বে তুলে ধরা হয়। এর মধ্য দিয়ে আরও ব্যক্তিস্বাতন্ত্রবাদী রাজনীতির জন্ম হয়। বাস্তবের বস্তুগত উপলব্ধির বদলে স্রেফ এলোমেলো অভিজ্ঞতার মধ্য দিয়ে ‘কুইয়ার তত্ত্ব’ ক্রমাগত নতুন নতুন লিঙ্গ, যৌন, রোমান্টিক ইত্যাদি পরিচিতির জন্ম দিতে থাকে। এর জন্য বাজার শয়ে শয়ে নানা ধরনের কুইয়ার পতাকা সরবরাহ করে এবং এই পরিচিতির দিকে ঝুঁকে থাকা জনগণের জন্য নানা পণ্য বানাতে থাকে। এই ক্রিয়াকলাপ, নিপীড়নের রূপ হিসেবে জনগণের জীবনে লিঙ্গ পরিচয় কী ধরনের ভূমিকা পালন করে, তা গুলিয়ে দেয়। শুধু তাই নয়, ইচ্ছামতো তৈরি করা পরিচিতিসত্তার লাইন ধরে, বাক্সের মধ্যে বাক্স, তার মধ্য বাক্স বানিয়ে সকল নিপীড়নের স্বতন্ত্রীকরণ করে দেয়। উদাহরণস্বরূপ, ভারতীয় রূপান্তরকামী আইন, হিজরা, কিন্নর, ট্রান্সজেন্ডার, ইন্টারসেক্স, জেন্ডারকুইয়ার ব্যক্তি প্রভৃতি সকল লিঙ্গগোষ্ঠীকে কেবল একটা শব্দে ব্যাখ্যা করেছে—রূপান্তরকামী বা তৃতীয় লিঙ্গ। এর মধ্য দিয়ে আইনটি নিজেই বিভ্রান্তি তৈরি করেছে। অথচ এই ধরনের অনেক শব্দেরই একটি বস্তুগত ভিত্তি আছে, তারা প্রত্যেকেই তৃতীয় লিঙ্গের থেকে আলাদা; যার কোনো সুগঠিত সংজ্ঞাই নেই। জেন্ডারকুইয়ার শব্দটি ট্রান্সজেন্ডার ব্যক্তি থেকে শুরু করে নন-বাইনারি অনেক কিছুরই প্রতিনিধিত্ব করতে পারে, এমনকি তার নিজস্ব বৈশিষ্ট্যের জেরে এই দুটি থেকে আলাদাও হতে পারে। সমকামী আন্দোলনের মধ্যে এরকম বিভ্রান্তিকর গোষ্ঠী তৈরি করে আন্দোলনের অভিমুখ বারবার পরিবর্তন করছে সাম্রাজ্যবাদীরা। আন্দোলনের অভিমুখ, ব্যক্তি কীভাবে যৌন নিপীড়নকে প্রত্যক্ষ করে এবং লিঙ্গগোষ্ঠীর পৃথক পৃথক নামকরণ বিষয়ে ‘অনুভব’ করে, তার দিকে। লিঙ্গগোষ্ঠীর নামকরণই যেন নিজেদের প্রকাশ করার, প্রতিরোধ করার এবং মুক্তির পথ হয়ে উঠেছে। এই ঘটনাগুলি কেবল ব্যক্তিকেই বিচ্ছিন্ন করে না, বৃহত্তর সমাজ থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে থাকা ভিন্ন যৌনতার আন্দোলনকে মানুষের বৃহত্তর সংগ্রাম থেকে বিচ্ছিন্ন করে রাখে। সহজ ভাবে বলতে গেলে, নিজেদের পৃথক নামকরণ করা, সর্বনাম পরিবর্তন করার অনুশীলন লিঙ্গ নিপীড়ন থেকে ক্ষণিকের সান্ত্বনা এনে দিলেও; তা কখনওই লিঙ্গ বৈষম্য থেকে মুক্তির পথ হতে পারে না।
পূর্বেই উল্লেখ করা হয়েছে, সাম্রাজ্যবাদী পুঁজি কীভাবে সামাজিক বাস্তবতাকে বিকৃত করে এবং নিজের সঙ্গে কিছু সাম্রাজ্যবাদী সংস্কৃতি নিয়ে আসে যা সকল শ্রেণিকে গভীর ভাবে প্রভাবিত করে। ভিন্ন যৌনতার আন্দোলনের ক্ষেত্রে এটি ব্যক্তি স্বতন্ত্রতা এবং নামকরণ করার রীতিকে ঘিরে একটি সংস্কৃতি তৈরি করেছে যা অল্প কয়েকজনের আকাঙ্ক্ষার উপর নির্ভরশীল। যেহেতু সাম্রাজ্যবাদী এই সংস্কৃতি যৌন হিংসাকে ব্যক্তির যৌন আকাঙ্খার উপর নির্ভরশীল এক ‘অভিজ্ঞতায়’ পরিণত করেছে, তাই ব্যক্তির যৌন আকাঙ্খাও আত্মকেন্দ্রিক হয়ে ওঠে এবং জন্ম দেয় যৌন অরাজকতার৷ পিতৃতান্ত্রিক সমাজে যৌনকর্মে সম্মতি দেওয়ার কথা ছেড়েই দিন, যৌনকর্মে জড়িত হওয়ার অধিকারও কেবল নির্দিষ্ট কিছু শ্রেণির হাতেই সীমাবদ্ধ। দিনের শেষে কতটা অবসর সময় থাকছে তার উপর যৌনজীবন উপভোগ করার বিষয়টি নির্ভর করছে। ভারতের মতো দেশের বুর্জোয়া শ্রেণির হাতে নিজের জন্য আরও বেশি অবসর-সময় কাটানোর ক্ষমতা রয়েছে, যা বেশির ভাগ ভারতীয় জনগণের ঠিক বিপরীত, তাই উপভোগ্য যৌনজীবন কাটানো, সেই যৌনতায় সম্মতি দেওয়া এবং একাধিক যৌনসঙ্গীর সঙ্গে সম্পর্ক রাখার ক্ষমতা একটি শ্রেণির প্রশ্ন। ভিন্ন যৌনতার রাজনৈতিক মহলে শ্রেণি সংগ্রামের রাজনীতির অভাবের ফলে বিভিন্ন প্রান্তিক লিঙ্গের গোষ্ঠীর মধ্যে যৌনবাসনা, এক নৈরাজ্যবাদী মোড় নিতে শুরু করেছে। যার প্রত্যক্ষ ফলাফল হল নৈরাজ্যবাদী যৌন সম্পর্ক। এই সম্পর্কে কেবল যৌনকর্মই প্রধান। যৌন জীবন নিজেই এক বাজারি পণ্যে পরিণত হয়েছে। টিন্ডার, বাম্বল, হিঞ্জ ইত্যাদি নিছক বাজারি পণ্য বা যৌন সম্পর্ক কেনা বেচার প্ল্যাটফর্ম। এই সম্পর্কগুলি সাম্রাজ্যবাদী পুঁজি দ্বারা প্রবর্তিত বিকৃত সংস্কৃতির প্রত্যক্ষ ফলাফল৷ বলাবাহুল্য কেবল একটি নির্দিষ্ট শ্রেণি ও কিছু বর্ণের মানুষেরাই এই সংস্কৃতির ধারক ও পোষক; বুর্জোয়া শ্রেণি। ভিন্ন যৌনতার পরিচিতিকে যৌন অরাজকতায় নামিয়ে আনা একটি বুর্জোয়া অনুশীলন; যা সামন্ততান্ত্রিক এবং সাম্রাজ্যবাদী শক্তি দৃঢ় ভাবে সমর্থন করে চলেছে।
সংস্কার এর আকাঙ্ক্ষা, ব্যক্তি-স্বাতন্ত্র্যবাদ-এর দাবি, সুবিধাবাদ সবই বুর্জোয়া শ্রেণির মধ্যেই সীমাবদ্ধ। যৌন নিপীড়ন থেকে ভারতীয় ভিন্ন যৌনতার মানুষদের মুক্তির পথে এই দাবিগুলিবাধা হয়ে দাঁড়াচ্ছে।
এগিয়ে চলার পথের কর্মসূচি
কুইয়ার আন্দোলনে প্রকৃত কমিউনিস্ট নেতৃত্বের অনুপস্থিতি আন্দোলনকে বৈপ্লবিক দিশা দিতে পারছে না। প্রকৃতপক্ষে, আন্দোলনে সাম্রাজ্যবাদ বিরোধী–সামন্ততন্ত্র বিরোধী লাইনের প্রয়োজন রয়েছে৷ সাম্রাজ্যবাদ ও সামন্ততন্ত্র বিরোধী শ্রেণি সংগ্রাম থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে কি আদৌ কুইয়ার-মুক্তি ঘটতে পারে? সাম্রাজ্যবাদী ও সামন্ততান্ত্রিক প্রতিক্রিয়াশীল নেতৃত্বকে অপসারণের মধ্য দিয়েই প্রকৃত কুইয়ার মুক্তির সূচনা হতে পারে৷ যারা প্রগতিশীল রাজনীতির সঙ্গে যুক্ত, তাদের সঙ্গে সকলরকম শোষণ ও আধিপত্যের সংঘর্ষ হতে বাধ্য, যে রাজনীতি সকল রকম শোষণ ও নিপীড়নের বিরুদ্ধে আলোকপ্রাপ্তির লক্ষ্যে কাজ করে, তা ঐতিহাসিক ভাবে কেবল শ্রেণি সংগ্রামের মধ্য দিয়েই টিকে থাকতে পারে। বর্তমানে, সাম্রাজ্যবাদ এবং ব্রাহ্মণ্যবাদী হিন্দু ফ্যাসিস্ট সরকার দ্বারা ভারতীয় জনগণ নিপীড়িত ও শোষিত। একদিকে ভিন্ন যৌনতার আন্দোলনে ইতিমধ্যে হিন্দুত্বের এজেন্ডার অনুপ্রবেশ ঘটতে শুরু করেছে, অন্যদিকে শ্রেণি দৃষ্টিকোণ অধরাই থাকছে।
সাম্রাজ্যবাদ নিজেই তার নিজের ধ্বংসের বস্তুগত এবং নৈতিক ভিত্তি তৈরি করে। লিঙ্গ এবং যৌন নিপীড়ন সম্পর্কে সঠিক দৃষ্টিভঙ্গি, আত্ম-সচেতনতা ক্রমাগত বৃদ্ধি পাচ্ছে। আরও বেশি সংখ্যক ভিন্ন যৌনতার ব্যক্তি সক্রিয় ভাবে আন্দোলনের সঙ্গে জড়িত হচ্ছেন, এমনকি আন্দোলনের গতিপথ নিয়ে সমালোচনা করছেন। কিন্তু পরিবর্তন কোন পথে বা লিঙ্গ নির্যাতন থেকে মুক্তির পথ কী, সে সম্বন্ধে নির্দিষ্ট লাইন এখনও পরিষ্কার নয় তাদের। ভারতের সর্বহারা শ্রেণির সংগ্রামের সাথে ঐক্যবদ্ধ না হওয়া অবধি ভিন্ন যৌনতার মুক্তি সম্ভব নয়। লিঙ্গ এবং যৌন নিপীড়নের ইতিহাস ঘাঁটলেই বোঝা যায়, নিপীড়িত মানুষের সামাজিক ও অর্থনৈতিক জীবনেই তার বস্তুগত ভিত্তি উপস্থিত। বস্তুগত অবস্থার পরিবর্তন এবং উৎপাদন সম্পর্কের বদল আনার মধ্যেই মুক্তির পথ লুকিয়ে আছে। ভারতে, অসম্পূর্ণ গণতান্ত্রিক বিপ্লবকে সম্পূর্ণ করাই এই ধরনের পরিবর্তনের পথ। অতএব, ভিন্ন যৌনতার আন্দোলনকে উত্তর-আধুনিক সাম্রাজ্যবাদী লাইনগুলি থেকে তার ফোকাস সরিয়ে আনতে হবে। যা কেবল সাম্রাজ্যবাদবিরোধী রাজনীতির পথদিশার মাধ্যমেই করা যেতে পারে। সংস্কার নয়, ক্ষণিকের সান্ত্বনা নয়, নামকরণের রাজনীতি নয়; ভিন্ন যৌনতার সত্যিকারের মুক্তির জন্য চাই প্রকৃত গণতান্ত্রিক বিপ্লব।