পিপলস ম্যাগাজিন ডেস্ক: নিজেদের অরণ্যের বাসস্থানে আবারও প্রবেশ করার অধিকার পেতে গত ১৫ মার্চ থেকে বিক্ষোভ দেখাচ্ছেন কর্নাটকের নাগারহোল জাতীয় উদ্যানের আদিবাসীরা। এক দশকেরও আগে তাদের ১০ লক্ষ টাকা এবং ৩ একর জায়গা দিয়ে অরণ্য থেকে সরিয়ে দেওয়া হয়। কিন্তু এতদিনে নতুন পরিবেশ সম্পর্কে তাদের মোহভঙ্গ হয়েছে। তাছাড়া, তারা জীবিকার জন্য কোনো নিয়মিত কাজও জোটাতে পারছেন না।
তারা তাদের চিরাচরিত দেবদেবীকে পুজো করার জন্য বনের মধ্যে নিজেদের ছেড়ে যাওয়া বাসস্থানে ঢোকার চেষ্টা করলে তারা অনুমতি পাননি। আদিবাসীদের অভিযোগ, গতবছর যখন তারা বনে ঢুকে পড়েছিলেন, তখন তাদের ঘিরে ধরে বেদম মারধর করে পুলিশ ও বনকর্তারা।
দেশের বহু আদিবাসী সম্প্রদায় জাতীয় উদ্যান ও ব্যাঘ্র সংরক্ষণ প্রকল্পের মধ্যে বসবাস করে। নাগারহোল জাতীয় উদ্যানে আদিবাসী সম্প্রদায়ের সঙ্গে বিরোধী কফি বাগিচা মালিক, বেসরকারি বণ্যপ্রাণ-ব্যবসায়ী গোষ্ঠী ও বন দফতরের।
আদিবাসীদের মধ্যেকার ক্ষুব্ধ যুবসমাজ একজোট হয়ে ‘কমিউনিটি নেটওয়ার্ক এগেইনস্ট প্রোটেকটেড এরিয়াস’(সিএনএপিএ)গঠন করেছে।
এই সংগঠনটি কাজিরাঙ্গা(অসম), নাগরাহোল(কর্নাটক), রাজাজি(ঋষিকেশ), মুদুমালাই(তামিলনাড়ু), গির(গুজরাট) ও আরও বেশ কিছু ব্যাঘ্রপ্রকল্পের মধ্যে বসবাসরত সম্প্রদায়ের তরুণকর্মীদের একজোট করেছে। তারা আদিবাসী সম্প্রদায়ের জন্য জমির অধিকার চাইছে, আগামী দিনে যাতে উচ্ছেদ না হতে হয় তার নিশ্চয়তা চাইছে, ওইসব এলাকায় স্কুল, রাস্তার মতো জনপরিষেবা দাবি করছে।
৩৯ বছর বয়সিউ সৌদাম্মা জেনু, কুরুবা সম্প্রদায়ভুক্ত। এই সম্প্রদায় অন্যান্য কাজের পাশাপাশি গাছ থেকে মধু নিষ্কাশনে দক্ষ। ২০১১ সালে নাগরাহোল জাতীয় উদ্যান থেকে ৭০ কিলোমিটার দূরে বনের ধারে পুনর্বাসনে যেতে বাধ্য হন তিনি। একটি গণমাধ্যমে সৌদাম্মা জানিয়েছেন, তাদের গ্রামের ৪২টি পরিবারের মধ্যে মাত্র ২০টি পরিবার পুনর্বাসনে যেতে রাজি হয়েছিল। “আমি যেতে চাইনি। বাড়ি ভেঙে দেওয়া হবে এই ভয় দেখিয়ে তার পরিবারকে উচ্ছেদ করা হয়। বন দফতরের কর্মীরা ভয় দেখায়, ওরা আমাদের এলাকায় বাঘ ও হাতি ছেড়ে দেবে। আমাদের বনের ধারে সরিয়ে দেওয়া হয় এবং একটা বাড়ি দেওয়া হয়। আমার ছেলেমেয়েরা কোডাগুতে কফি বাগানে কাজ করতে যায়, দিনে ৩০০ টাকা করে পায়। পুনর্বাসন শিবিরের এলাকায় আমি কোনো কাজ পাইনি। আমি আমাদের বনের বাড়িতে ফিরতে চাই। ওরা বলেছিল, ১০ লক্ষ টাকা করে দেবে। কিন্তু জমির জন্য ৭ লক্ষ টাকা কেটে নিয়ে ৩ লক্ষ টাকা দিয়েছে। কেউ কেউ দেড় লক্ষ টাকাও পেয়েছে”।
সৌদাম্মার ২ ছেলে, ১ মেয়ে। ছেলেরা দশম শ্রেণি পাস করেনি। মেয়েটি একাদশ শ্রেণিতে পড়ছে।
তিনি আরও বলেন, বন দফতর তাদের মিথ্যে বলেছিল। ওরা বলেছিল, আদিবাসীদের পুজোর জায়গা এবং শ্মশানে যেতে দেবে। কিন্তু যেতে দিচ্ছে না। এর জন্য এক মাস সময় দরকার। আগের বছর যখন বন দফতরের কর্মীরা তাদের বনের মধ্যে খুঁজে পায়। তখন তারা প্রবল রেগে যায়। মারধর করে। সে সময় রান্না চলছিল, রান্নার বাসন উল্টে দেয়। তাদের নিয়ে পুনর্বাসন শিবিরে চলে যায়। কমিউনিটি হলে একদিন আটকে রাখে এবং ব্যাপক মারধর করে।
সচেতনতা বাড়াতে পাঁচদিনের পদযাত্রা
নাগারহোলের আন্দোলন নিয়ে জন সচেতনতা বাড়াতে আদিবাসী সম্প্রদায় নাগারাহোল থেকে বেঙ্গালুরু পর্যন্ত পাঁচদিনের পদযাত্রা করে। তা ২০ মার্চ শেষ হয়েছে। তবে এই প্রতিবাদ যে কেবল নাগারহোলেই সীমাবদ্ধ তা নয়। গোটা বনাঞ্চল জুড়েই প্রতিবাদ চলছে। ২০০১ সালে নাগারহোল জাতীয় উদ্যানে ১৭০০ পরিবার থাকত। সেই সংখ্যাটা ক্রমেই কমেছে।
এ নিয়ে আন্দোলনের জন্য এলাকায় একটি সংগঠনও গড়ে উঠেছে। বেঙ্গালুরুর সাংবাদিক সম্মেলনে ওই সংগঠনের পক্ষ থেকে বলা হয়, “১৯৮৩ থেকে ১৯৯৬ সালের মধ্যে বহু আদিবাসী সম্প্রদায়কে কোনো ক্ষতিপূরণ ছাড়াই বনাঞ্চল থেকে উচ্ছেদ করা হয়। আমাদের বা গ্রাম সভার সম্মতি ছাড়াই ওরা আমাদের বাসস্থানকে ব্যাঘ্র্ সংরক্ষণ প্রকল্প বা সংরক্ষিত এলাকায় পরিণত করেছে। নতুন পরিবেশে মানাতে না পেরে বহু মানুষ কম বয়সেই মারা গেছে। আমাদের সংস্কৃতি ও পরিচয় মুছে দেওয়া হচ্ছে। এত বছর ধরে আমরা প্রকৃতি, পশুপাখি ও অরণ্যের সঙ্গে বসবাস করেছি। আমাদের চিরাচরিত জ্ঞান আমাদের বেঁচে থাকতে ও পরস্পরকে রক্ষা করতে সাহায্য করেছে”।
গত ২২ ও ২৩ মার্চ, বেঙ্গালুরুর ইন্ডিয়ান সোশাল ইনস্টিটিউটে সিএনএপিএ ২ দিনের সেমিনার আয়োজন করে। সেখানে বিভিন্ন জাতীয় উদ্যানের আদিবাসীরা নিজেদের অভিজ্ঞতা ও সমস্যার কথা তুলে ধরেন। অরুণাচল প্রদেশ, তামিলনাড়ু, উত্তারখণ্ড, অসম, ওড়িশা, গুজরাট ও কর্নাটক থেকে বক্তারা অংশগ্রহণ করেন।