Home রাজনীতি রুশ-ইউক্রেন যুদ্ধের এক বছর: আমেরিকা ও রাশিয়ার সাম্রাজ্যবাদী ছায়াযুদ্ধের বিশ্লেষণ

রুশ-ইউক্রেন যুদ্ধের এক বছর: আমেরিকা ও রাশিয়ার সাম্রাজ্যবাদী ছায়াযুদ্ধের বিশ্লেষণ

রুশ-ইউক্রেন যুদ্ধের এক বছর: আমেরিকা ও রাশিয়ার সাম্রাজ্যবাদী ছায়াযুদ্ধের বিশ্লেষণ
0

পিপলস ম্যাগাজিন ডেস্ক: এক বছর পেরোনো এই যুদ্ধে এখনও পর্যন্ত দু’পক্ষ মিলিয়ে ৭০-৮০ হাজার থেকে শুরু করে ২ লক্ষ পর্যন্ত সৈন্য ও সাধারণ মানুষের মৃত্যু হয়েছে। দু’পক্ষের সামরিক বাহিনীই ব্যাপক ভাবে নাগরিক পরিকাঠামোর ওপর আক্রমণ করছে, যার ফলে ধ্বংসের পরিমাণ বিপুল ভাবে বাড়ছে। বহু ইউক্রেনীয় জনগণকে নিজেদের বাড়ি থেকে তাড়িয়ে দেওয়া হয়েছে এবং তারা অর্থনৈতিক ভাবে উচ্ছেদ হয়েছেন। ডনবাস অঞ্চলের লুগানস্ক ও ডোনেৎস্কের সরকার রুশ সামরিক শক্তির সাহায্যে নিজেদের স্বাধীন ঘোষণা করা ও এলাকায় নিয়ন্ত্রণ স্থাপনের পর সেখানে মার্কিন/ন্যাটো বাহিনীর সাহায্যে ইউক্রেন একটানা বামো-গুলিবর্ষণ করে চলেছে।

ইউক্রেনের ব্যাপক শ্রমজীবী জনগণ দুর্ভোগ পোয়ালেও সেখানকার একচেটিয়া পুঁজিপতি, বিশেষত অস্ত্র নির্মাতা ও ফাটকাবাজরা বিপুল মুনাফা করছে। বৃহদাকার লগ্নি পুঁজিপতি ও একচেটিয়া সংস্থাগুলি ইউক্রেন যুদ্ধের সুযোগ নিয়ে তেল ও শস্যের মতো গুরুত্বপূর্ণ পণ্যের বাজারে ফাটকা খেলে চলেছে। ইউরোপে রাশিয়ার প্রাকৃতিক গ্যাসের সরবরাহে মার্কিন নিষেধাজ্ঞা থাকায় জ্বালানির সমস্যায় সেখানকার সাধারণ মানুষ গোটা শীত জুড়ে ভুগছেন।

সামরিক শিল্প গোষ্ঠীগুলি, বিশেষত মার্কিন অস্ত্র নির্মাতারা ইউক্রেনের দীর্ঘ যুদ্ধ থেকে সবচেয়ে বেশি ফায়দা লুটছে। যুদ্ধবাজ বিডেন সরকার একাই ইউক্রেনে ৭৬৮০ কোটি ডলার ঢেলেছে, যার মধ্যে ৬১% রুশ আতঙ্কে ভোগা জেলেনস্কি সরকার ও তার ফ্যাসিবাদী বাহিনী আজভ ব্যাটেলিয়নকে দেওয়া হয়েছে সরাসরি অস্ত্র, সামরিক সরঞ্জাম ও অন্যান্য নিরাপত্তা-সংক্রান্ত সামগ্রীর জন্য ঋণ হি্সেবে। পাশাপাশি ন্যাটোতে থাকা আমেরিকার অন্যান্য বন্ধুরা যেমন, জার্মানি, ফ্রান্স, ব্রিটেন ইউক্রেনে ট্যাঙ্ক, ক্ষেপণাস্ত্র, ড্রোন ও অন্যান্য সামরিক সরঞ্জাম পাঠাচ্ছে। এর একমাত্র লক্ষ্য ইউক্রেনের যুদ্ধকে দীর্ঘস্থায়ী করে অস্ত্র ব্যবসায়ীদের মুনাফার সুযোগ করে দেওয়া।

বিডেন তার সাম্প্রতিক ইউক্রেন সফরে জেলেনস্কি সরকারকে আরও সামরিক সাহায্য দেওয়ার প্রতিশ্রুতি দিয়ে যুদ্ধ চালিয়ে যেতে উৎসাহিত করেছে। এতে পরিষ্কার বোঝা যাচ্ছে, আমেরিকা/ন্যাটো তাদের সাম্রাজ্যবাদী প্রতিদ্বন্দ্বী রাশিয়ার বিরুদ্ধে যুদ্ধে ইউক্রেনকে পুতুল হিসেবে ব্যবহার করছে। মার্কিন সামরিক পরামর্শদাতারা দীর্ঘদিন ধরেই ইউক্রেন সেনার সঙ্গে যুক্ত হয়ে রয়েছেন, অন্যদিকে মার্কিন বাহিনী পোল্যান্ডে প্রস্তুত হয়ে অপেক্ষা করছে। মার্কিন সামরিক কর্তারা সরাসরি রাশিয়ার বিরুদ্ধে যুদ্ধের ইচ্ছা প্রকাশ করছে। মার্কিন/ন্যাটোর উস্কানিতে প্রভাবিত হয়ে জেলেনস্কি সরকার বারবার রাশিয়ার আলাপ-আলোচনা ও শান্তির আ্হবান প্রত্যাখ্যান করছে।

বিডেনের যুদ্ধে ইন্ধনের উত্তরে রাশিয়া আমেরিকার সঙ্গে তাদের অস্ত্র সংবরণ চুক্তি মাঝপথে ঝুলিয়ে দিয়েছে এবং তাদের রণনৈতিক অস্ত্র ব্যবস্থাকে যুদ্ধের সাজে সজ্জিত করে রেখেছে। রাশিয়ার সীমান্তের কাছে রুশভাষী অঞ্চলে ইউক্রেন ও আমেরিকার বোমাবর্ষণকে আটকে দিতে রাশিয়া তার সামরিক কার্যকলাপকে বাড়িয়ে চলেছে। তারা তাদের পারমাণবিক শক্তিকে চূড়ান্ত তৎপর থাকার নির্দেশ দিয়েছে। যা নিয়ন্ত্রণহীন পারমাণবিক যুদ্ধের আশঙ্কা বাড়িয়ে তুলেছে।

১৯৯১ সালে সোভিয়েত ইউনিয়ন ভেঙে যাওয়ার পর থেকে তিন দশক ধরে পূর্ব ইউরোপে আমেরিকা যে সম্প্রসারণবাদ চালাচ্ছে, এই যুদ্ধ মূলত তারই ফলাফল। ১৯৯০-৯১ সালের মিনস্ক চুক্তিতে আমেরিকা ও ন্যাটো ঘোষণা করেছিল, তারা সাবেক ইউএসএসআরের নেতৃত্বে হওয়া ওয়ারশ চুক্তিতে যুক্ত কোনো দেশকে তারা ন্যাটোয় যুক্ত করবে না। কিন্তু তা লঙ্ঘন করে আমেরিকা, ন্যাটো সামরিক জোটকে জার্মানির পূর্ব সীমান্ত থেকে সম্প্রসারিত করে মধ্য ইউরোপে নিয়ে এসেছে। পোল্যান্ড, চেক রিপাবলিক, হাঙ্গেরি, লিথুয়ানিয়া, বুলগেরিয়া, রোমানিয়া ও এবং অন্যান্য ওয়ারশ চুক্তির দেশগুলিকে নিজেদের সঙ্গে যুক্ত করে রাশিয়ার পশ্চিম সীমান্তের দিকে এগিয়ে চলেছে। রাশিয়া দীর্ঘদীন ধরেই ন্যাটোর সামরিক জোটের সম্প্রসারণকে আগ্রাসন এবং ইউক্রেনকে ন্যাটোয় যুক্ত করাকে বিপদ সীমা বলে মনে করে এসেছে।

রাশিয়ার বিরুদ্ধে আমেরিকা/ন্যাটো ইউক্রেনে যে ছায়াযুদ্ধ চালাচ্ছে, তা একচেটিয়া পুঁজিবাদী ব্যবস্থার চলমান সংকট ও মৃতপ্রায় অবস্থারই প্রকাশ। সাম্রাজ্যবাদী শক্তিগুলি নিজেদের বিনিয়োগ ও আধিপত্যের এলাকা বাড়ানোর জন্য অবিরত দুনিয়াকে পুনর্বিভাজনের চেষ্টা করে, একথা লেনিন বলেছিলেন। ইউক্রেনে আমেরিকার ছায়াযুদ্ধ চালানোর পেছনে অন্যতম রণনৈতিক কারণ হল, রাশিয়ার প্রাকৃতিক গ্যাসের বিশাল ইউরোপীয় বাজার দখল করা এবং ডনবাস অঞ্চলের বিরল মৃত্তিকা মৌলের খনিজ সম্পদের ওপর নিয়ন্ত্রণ নেওয়া।

পুঁজিবাদের তীব্র হতে থাকা দুনিয়া জোড়া সংকট, বিশেষত আমেরিকা ও অন্যান্য পুঁজিবাদী দেশের দীর্ঘস্থায়ী আর্থিক নিশ্চলতা এবং আর্থিক মন্দার দিকে এগোনো—আমেরিকাকে সাম্রাজ্যবাদী প্রতিদ্বন্দ্বীদের বিরুদ্ধে যুদ্ধে উস্কানি দেওয়ার দিকে ঠেলে দিচ্ছে। ইউক্রেনে কোটি কোটি ডলার ঢালার সাথে সাথে আমেরিকা জাপান, দক্ষিণ কোরিয়া, ফিলিপিনস ও এশিয়ার অন্যান্য দেশে তাদের সামরিক উপস্থিতি বাড়াচ্ছে। যা চিনের বিরুদ্ধে তাদের যুদ্ধের নাটকের প্রস্তুতির অঙ্গ।

পাশাপাশি একথাও ভুললে চলবে না, ইউক্রেনের ওপর রাশিয়ার এই আগ্রাসন- তাদের সাম্রাজ্যবাদী স্বার্থেরই প্রকাশ। নিজেদের বাজার ধরে রাখতেই সে দেশের একচেটিয়া পুঁজিপতিরা ইউক্রেনের জনগণের উপর এই আক্রমণ চালিয়েছে।

আন্তর্জাতিক সর্বহারার কর্তব্য এই সাম্রাজ্যবাদী যুদ্ধের বিরুদ্ধে দুনিয়া জুড়ে কর্মসূচি নেওয়া এবং বিবদমান দুই পক্ষ যাতে আলোচনার টেবিলে বসে সমস্যার সমাধানের পথে এগোয়, তার জন্য সব দিক দিয়ে চাপ সৃষ্টি করা। ইউক্রেন ও রাশিয়ার শ্রমজীবী জনগণের স্বার্থই দুনিয়ার সর্বহারা শ্রেণির স্বার্থ।

Share Now:

LEAVE YOUR COMMENT

Your email address will not be published. Required fields are marked *