পিপলস ম্যাগাজিন ডেস্ক: অক্সফ্যাম ব্রিটিশ অর্থানুকূল্যে চলা ২১টি অসরকারি সংগঠনের একটি আন্তর্জাতিক জোট। ১৯৪২ সাল থেকে এই সংস্থা দুনিয়ার দারিদ্র্য দূরীকরণের লক্ষ্যে কাজ করছে। দুনিয়ার আর্থ-সামাজিক অবস্থা সম্পর্কে একটা স্পষ্ট ধারণা পাওয়ার জন্য সাম্রাজ্যবাদীরা এই ধরনের বহু সংগঠন বানিয়েছে। এদের গবেষণা থেকে পাওয়া তথ্যের উপর ভিত্তি করে তারা তাদের রণকৌশল তৈরি করে। ফলে এদের তথ্যগুলি অনেকটাই সত্যের কাছাকাছি থাকে। এই কাজে অক্সফ্যামের সুনাম রয়েছে।
অক্সফ্যাম ‘ধনীতমদের উদ্বর্তন’ নামে নতুন একটি রিপোর্ট প্রকাশ করেছে। তাতে তারা জানিয়েছে, দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পর আজকের মতো দারিদ্র্য ও অসাম্য বৃদ্ধি কখনও হয়নি। ধনী ও গরিবের মধ্যে ফারাক এতটাই বেড়ে গেছে যে, অক্সফ্যামের সিইও এই রিপোর্ট প্রকাশের ভাষণে বলেছেন, ‘গোটা পুঁজিবাদী ব্যবস্থা গভীর বিপদের মধ্যে রয়েছে’।
এই নতুন রিপোর্ট, সেই সব অজস্র প্রমাণের একটি, যা প্রমাণ করে পুঁজিবাদ একটি দুর্নীতিগ্রস্ত ব্যবস্থা যা শ্রমজীবীদের রক্ত চুষে ধনীদের উপকার করে। ১৫০ বছর আগে পুঁজি গ্রন্থের প্রথম খণ্ডের ২৫তম অধ্যায়ে মার্কস যেমন বলেছিলেন, “…অতএব এক প্রান্তে সম্পদের সঞ্চয়ন হল সঙ্গে সঙ্গে বিপরীত প্রান্তে দুর্দশা, শ্রমের যন্ত্রণা, দাসত্ব, অজ্ঞতা, পাশবিকতা ও মানসিক অবনতির সঞ্চয়ন”। দুর্ভাগ্যজনক ভাবে, এই উদ্ধৃতিটি অতীতের যে কোনও সময়ের তুলনায় আজ অনেক বেশি প্রাসঙ্গিক।
কর্পোরেট মুনাফা ও পুঁজিবাদের সংকট
গত দশকে তৈরি হওয়া যাবতীয় নতুন সম্পদের অর্ধেক দখল করেছিল ধনীতম ১%। বাকি অর্ধেক ভাগ হয়েছিল বাকি ৯৯%-এর মধ্যে। এই ফারাক এখন আরও বেড়ে গেছে। ২০২০ থেকে, অর্থাৎ অতিমারির শুরু থেকে—তৈরি হওয়া নতুন সম্পদের দুই-তৃতীয়াংশই ওপরের ১% দখল করে বসেছে। অত্যন্ত কম সময়ে তারা তাদের মুনাফা প্রায় দ্বিগুন করে নিয়েছে। গত তিন বছরে তৈরি হওয়া ৪২ লক্ষ কোটি ডলার সম্পদের মধ্যে ২৬ লক্ষ কোটি ডলারই ওই ১% অতিধনী দখল করেছে। বাকি মানব সমাজের হাতে রয়েছে মাত্র ১৬ লক্ষ কোটি ডলার।
দুনিয়ার বিলিওনেয়াররা ঐতিহাসিক মুনাফা উপভোগ করে চলেছে। গত দশকে বিলিওনেয়ারের সংখ্যা এবং তাদের দখল করা সম্পদের অংশ দ্বিগুন হয়েছিল। ২০২০ থেকে বিলিওয়নেয়ারদের মুনাফা প্রতিদিন ২৭০ কোটি ডলার করে বেড়েছে। যদি এই তথ্য বিশ্লেষণ করা যায়, তাহলে দেখা যাবে- মানবা সমাজের নীচের দিকের নব্বই শতাংশ ১ ডলার সম্পদ উপার্জন করলে, একজন বিলিওনেয়ার উপার্জন করছে ১৭ লক্ষ ডলার।
ধনীরা যখন ইতিহাসের সবচেয়ে বেশি সম্পদ উপভোগ করছে, তখন সকল দেশের শ্রমজীবী মানুষের অবস্থাটা ক্রমেই বিবর্ণ হয়ে চলেছে। আন্তর্জাতিক অর্থ ভাণ্ডারের পূর্বাভাস অনুযায়ী, আগামী বছর বিশ্ব অর্থনীতির এক-তৃতীয়াংশ মন্দার কবলে পড়বে। অর্থনীতির হাল খারাপ হলে, সব দেশের পুঁজিবাদী সরকারগুলো সেই বোঝা শ্রমজীবী ও গরিব মানুষের ঘাড়ে চালান করবে। অক্সফ্যাম বলছে, দুনিয়ার সরকারগুলোর চার ভাগের তিন ভাগ আগামী পাঁচ বছরে তাদের সামাজিক খাতে খরচ কাটছাঁট করবে। তার পরিমাণ হতে পারে ৭ লক্ষ ৮০ হাজার কোটি ডলার।
দুনিয়ার শ্রমজীবী জনগণ ইতিমধ্যেই তাদের জীবনযাত্রার মানের ব্যাপক অবনমন দেখে ফেলেছে। এই প্রথম রাষ্ট্রপুঞ্জের বিশ্ব মানবোন্নয়ন সূচক পরপর দু’বছর নেমে গেছে। বস্তুত, প্রতি দশটি দেশের মধ্যে নটিতেই এই সূচক নেমে গেছে।
এর বেশিটাই হয়েছে মূল্যবৃদ্ধির জন্য। আইএমএফের তথ্য অনুযায়ী, ২০২২ সালে দুনিয়ায় মূল্যবৃদ্ধি ছিল ৮.৮%। এই সংখ্যাটা কমে ৬.৬ হতে পারে এ বছর, কিন্তু সেটাই অতিমারি-পূর্ব সময়ের প্রায় দ্বিগুন। দুনিয়া জুড়ে ১৭০ কোটি শ্রমিক-কর্মচারীর প্রকৃত মজুরি মূল্যবৃদ্ধির ফলে কমে গেছে।
সমস্ত রকম হিসেবেই জীবনযাত্রার খরচ বাড়ছে। খ্যাদ্যপণ্যের দামের রেকর্ড বৃদ্ধি হয়েছে। রাষ্ট্রপুঞ্জের খাদ্য ও কৃষি সংগঠন(এফএও)-এর খাদ্য সূচক দেখাচ্ছে দুনিয়া জুড়ে সাধারণ খাদ্যপণ্যের গড় দাম ১৪% বেড়েছে। রাষ্ট্রপুঞ্জের খাদ্যমূল্য সূচক ইতিহাসের সর্বোচ্চ অঙ্কে পৌঁছেছে(১৯৬১ থেকে এই রেকর্ড রাখা শুরু হয়েছে)।
আগামী বছরে বহু সুষম খাদ্যের দাম বাড়ার আশঙ্কা রয়েছে। যেমন, ২০২২ সাল জুড়ে বহুবার গমের দাম ব্যাপক বেড়েছে। চালের দামও বেড়েছে, তা আরও বাড়ার সম্ভাবনা।
একই ভাবে, শক্তিমূল্য বা এনার্জি প্রাইস কিছুটা কমা শুরু হলেও, তা গত পাঁচ বছরের গড় দামের থেকে ৭৫ % বেশি থাকবে বলেই মনে করা হচ্ছে। সেটাও এ বছর মূল্য স্তর যে উচ্চতায় থাকবে বলে মনে করা হচ্ছে, তার ভিত্তিতে বলা, যার কোনো নিশ্চয়তা নেই। আন্তর্জাতিক শক্তি সংস্থা বলেছে, সদ্য বিদ্যুৎ সংযোগ পাওয়া দুনিয়ার ৭ কোটি ৫০ লক্ষ, পয়সার অভাবে বিদ্যুৎবিচ্ছিন্ন হয়ে পড়বে। তাতে ২০২৩ প্রথম এমন বছর হবে, যেখানে বিদ্যুৎহীন মানুষের সংখ্যা আগের চেয়ে বড়ে যাবে।
দুনিয়ার লক্ষ লক্ষ মানুষ বিদ্যুৎ ও অন্যান্য সামগ্রীর মধ্যে কোনো একটিকে বেছে নিতে বাধ্য হচ্ছেন। আমেরিকার ২৫% পরিবার বিদ্যুতের বিল দেওয়ার জন্য খাদ্য ও ওষুধের খরচ কমাতে বাধ্য হচ্ছেন। ব্রিটেনে(যেখানে বিদ্যুতের দাম ৬৫% বেড়েছে), ৩০ লক্ষেরও বেশি পরিবার এই শীতে ঘর গরম করার খরচ জোটাতে পারেননি।
এর মধ্যে, পুঁজিপতিরা এই সংকট থেকে মুনাফা করেই চলেছে। অক্সফ্যাম জানাচ্ছে, সবচেয়ে বড়ো খাদ্য ও শক্তি সংস্থাগুলির ৯৫%-ই গত বছর তাদের মুনাফা দ্বিগুন করেছে। এই শিল্পগুলি অপ্রত্যাশিত ৩০,৬০০ কোটি ডলার আয় করেছে। যার মধ্যে ২৫,৭০০ কোটি ডলার তাদের ধনী অংশীদারদের মধ্যে বণ্টিত হয়েছে।
নির্দিষ্ট ভাবে শক্তি সংস্থাগুলি অস্বাভাবিক মুনাফা করছে। মার্কিন তেল সংস্থা এক্সন ৫,৬০০ কোটি ডলার মুনাফা করেছে- অর্থাৎ ঘণ্টায় ৬০ লক্ষ ডলার-এর মধ্যে দিয়ে সে ইতিহাসে কোনো এক বছরে সবচেয়ে বেশি লাভ করা অংশীদারি তেল সংস্থা হয়ে উঠেছে। এর মার্কিন প্রতিযোগী শেভ্রনও তাদের মুনাফা দ্বিগুন করেছে এবং ব্রিটিশ সংস্থা বিপি, তাদের ইতিহাসে সবচেয়ে বেশি মুনাফা কামিয়েছে।
সব মিলিয়ে আরও একবার, পুঁজিবাদ যে দেউলিয়া, অসাম্য যে সাধারণ বৈশিষ্ট্য, তা প্রমাণিত। অর্থনীতির অধিকাংশটাই যখন অল্প সংখ্যক মানুষের হাতে থাকে, তখন সম্পদ অসম ভাবে বণ্টিত হতে বাধ্য। সংকট যত বাড়বে, বিশ্ব অর্থনীতি যত নীচের দিকে নামবে, অসাম্য ততই বাড়বে। পুঁজিপতিরা সবসময়ই নিজেদের মুনাফার পক্ষে কথা বলবে এবং সংকটের ভারহ যাবে শ্রমজীবীদের ঘাড়ে পড়ে, তার ফন্দি আঁটবে।
অক্সফ্যাম বলেছে, এই সমস্যার একমাত্র ‘সমাধান’ নাকি নতুন সম্পদ কর বসানো। কিন্তু সকলেই বোঝেন আজকের পরিস্থিতিতে তা ডুবন্ত জাহাজের ছিদ্র ব্যন্ডেড লাগানোর সমতুল্য। লোভের বুনিয়াদের ওপর তৈরি একটা ব্যবস্থাকে সংস্কার করে তাকে লোভমুক্ত করে ফেলা যায় না।