পিপলস ম্যাগাজিন ডেস্ক: সোমবার ৬ ফেব্রুয়ারি ভোরে, একটি বিধ্বংসী ভূমিকম্পে মধ্যপ্রাচ্য কেঁপে ওঠে। তুরস্কের আনাতোলিয়ান অঞ্চলের গাজিয়ানটেপের ঠিক পশ্চিমে এই ভূমিকম্পের কেন্দ্রস্থল। রিখটার স্কেলে ৭.৮ মাত্রার ভূমিকম্পটি, আধুনিক সময়ে তুরস্কে আঘাত হানা ভূমিকম্প গুলির মধ্যে সবচেয়ে শক্তিশালী। ১৩০ টি পারমাণবিক বোমার সমান শক্তিশালী এই ভূমিকম্প, ৫০০০ কিলোমিটার দূরে অবস্থিত গ্রিনল্যান্ডেও অনুভূত হয়।
ভূমিকম্প এবং এর ১৪৫ টি অভিঘাত দক্ষিণ-পূর্ব তুরস্ক এবং উত্তর-পশ্চিম সিরিয়ায় ধ্বংসযজ্ঞ চালিয়েছে। হাজার হাজার মানুষ আহত হয়েছে, প্রাথমিকভাবে বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার (WHO) অনুমান ছিল যে, যখন ধ্বংসাবশেষ পরিষ্কার হবে, তখন অন্তত ২০,০০০ মৃতদেহ উদ্ধার হতে পারে। প্রকৃতপক্ষেই, বর্তমানে সেই সংখ্যাটি বেড়ে দাঁড়িয়েছে ২৫,০০০।
এই ধরনের হৃদয়বিদারক ঘটনার পেছনে, বরাবরের মতো, তাৎক্ষণিক কারণ হিসেবে , প্রাকৃতিক উৎসকেই বড়ো করে দেখানো হয়। তবে মৃত্যু এবং দুর্ভোগের এই ভয়াবহতার পেছনে কিছু মানুষের ভূমিকাও যথেষ্ট। মুনাফাখোর, দুর্নীতিকারি এবং সাম্রাজ্যবাদী যুদ্ধবাজদের ষড়যন্ত্র, ভূমিকম্পের ঘটনাকে চরম বিপর্যয়ে পরিণত করেছে। ভূমিকম্পের পর রাষ্ট্রপতি এরদোগান , পরিস্থিতি সামাল দিতে তথাকথিত ‘জাতীয় ঐক্য’-এর আবেদন জানাচ্ছেন। মেহনতি জনগনকে এই আবেদনকে নিন্দাভরে প্রত্যাখ্যান করতে হবে। প্রকৃত অপরাধীদের দিকে আঙুল তুলে তাদের অব্যবস্থাপনার অবসান ঘটাতে সংগঠিত হতে হবে।
ভূমিকম্পের ভয়াবহতা ও সামগ্রিক পরিস্থিতি
ভূমিকম্পটি তুরস্ক এবং সিরিয়া, উভয়ের দেশের কঠিন সময়ে, নিষ্ঠুর ভাবে আঘাত হেনেছে। তুরস্ক দীর্ঘদিন আকাশছোঁয়া মুদ্রাস্ফীতি সহ্য করে চলেছে; জীবনযাত্রার মানের অবনতি ঘটছে এবং গণতান্ত্রিক অধিকারের উপর শাসকগোষ্ঠীর তরফ থেকে আক্রমণ তীব্রতর হচ্ছে। এদিকে, সিরিয়া এখনও গৃহযুদ্ধের কারণে রক্তক্ষরণ করে চলেছে, যার পেছনে ইন্ধন যুগিয়ে চলছে সাম্রাজ্যবাদী আগ্রাসন। ভূমিকম্পে মানুষের বাড়িঘর ছেড়ে পালিয়ে যাওয়া এবং তাদের জীবনের জন্য দৌড়ানোর ভয়ংকর দৃশ্য ছেয়ে গিয়েছে সোশ্যাল মিডিয়াতে। ভিডিও ফুটেজের মাধ্যমে দেখা যাচ্ছে , তুরস্কের সানলিউরফা প্রদেশ, মালাত্যম, ইস্কেন্ডারুন এবং অগণিত অন্যান্য শহর ও নগরগুলির বহুতল অ্যাপার্টমেন্ট ব্লকগুলির ওপর ভূমিকম্পের ধ্বংসলীলা, যা অসংখ্য মানুষের প্রাণ নিয়ে গেছে।
কয়েক হাজার মানুষ হঠাৎ করে গৃহহীন হয়ে পড়েছে, প্রবল ঠান্ডায়, মরিয়া হয়ে হারিয়ে যাওয়া বন্ধুবান্ধব এবং আত্মীয়দের খুঁজে বের করার চেষ্টা করে চলছে। ঐতিহাসিক গাজিয়ানটেপ ক্যাসেল সহ অনেকগুলি ঐতিহ্যবাহী সাংস্কৃতিক স্থানও ধ্বংস বা ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে।
সিরিয়ার উত্তর-পশ্চিম অংশ, যা কয়েক হাজার বাস্তুচ্যুত শরণার্থীদের আবাসস্থল, সেই দেশও ভূমিকম্পের শিকার হয়েছে। ইদলিব প্রদেশের বাসিনা সহ অন্যান্য গ্রামগুলি অস্তিত্বহীন হয়ে পড়েছে, ড্রোনচিত্রে যা এখন ধ্বংসস্তূপ ছাড়া কিছুই নয়।
আলেপ্পোতে, একটি শহরে হাজার হাজার হতাহতের খবর পাওয়া গেছে, যে স্থান বছরের পর বছর যুদ্ধের কারণে ইতিমধ্যেই বিচ্ছিন্ন হয়ে পড়েছে। সোমবারের আগে আশেপাশের এলাকাগুলি ধ্বংসস্তূপই ছিল। হাসপাতালের মতো প্রয়োজনীয় বিল্ডিং সহ যা কিছু জরাজীর্ণ কাঠামো অবশিষ্ট ছিল, তা ভূমিকম্পের প্রভাবে এখন সম্পূর্ণ ধ্বংসস্তূপে পরিণত হয়েছে।
ভূমিকম্পে কোনক্রমে বেঁচে যাওয়া ব্যক্তিরা জল এবং বিদ্যুতহীন অবস্থায় রয়েছে। সরকারি এবং বেসরকারি উদ্ধারকারী দলগুলি, প্রতিকূল আবহাওয়া ও পরিবেশের মোকাবিলা করে, ধ্বংস হওয়া বাড়িঘর থেকে লোকজনদের বের করছে। গৃহযুদ্ধের ক্ষয়ক্ষতি এবং সরকার ও বিদ্রোহী গোষ্ঠীর মধ্যে অব্যাহত লড়াই ক্ষতিগ্রস্তদের জন্য সাহায্য পাঠানো কঠিন করে তুলেছে। বিশেষ করে সিরিয়ার উত্তর-পশ্চিমে বিদ্রোহী-নিয়ন্ত্রিত এলাকায়, যেখানে ক্ষয়ক্ষতি ও রাস্তাঘাটের বেহাল অবস্থার কারণে তুরস্ক থেকে আর পৌঁছানো যায় না, এবং যেখানে সিরিয়া সরকার দক্ষিণ থেকে সাহায্য পৌঁছানোর অনুমতি দিতে অনিচ্ছুক।
কেবল প্রাকৃতিক দুর্যোগ নয়
তুর্কি ও সিরিয়ায় ধ্বংসের ভয়াবহতা শুধুমাত্র অস্বাভাবিক ভূমিকম্পের দ্বারা ব্যাখ্যা করা যায় না। স্পষ্টতই, গৃহযুদ্ধের হত্যাকাণ্ড সিরিয়াকে বিশেষভাবে দুর্বল করে তুলেছিল। কিন্তু তুরস্কের ক্ষেত্রে, এই ধ্বংসলীলার একটি বড় কারণ, দুর্নীতিগ্রস্থ শাসন ব্যবস্থা এবং মুনাফাখোর বেসরকারি নির্মাণ সংস্থাগুলি।
এই ভূমিকম্প প্রত্যাশিত ছিল। তুরস্ক, উত্তর এবং পূর্ব আনাতোলিয়ান চ্যূতির মধ্যে অবস্থিত, যা একটি অত্যন্ত ভূমিকম্প প্রবণ অঞ্চল। তুর্কি ভূতাত্ত্বিক নাসি গোর মার্কিন টেলিভিশনে একটি সাক্ষাৎকারে বলেছেন, “আমি সহ সমস্ত সজ্ঞান ভূ-বিজ্ঞানীরা বলেছিলাম যে এই ভূমিকম্পটির অশনি সঙ্কেত কয়েক বছর আগে থেকেই দেখা দিচ্ছিল; আমরা যা আশঙ্কা করেছিলাম তাতে কেউ কর্ণপাত করেনি। ”
দেশটি বছরের পর বছর ধরে বেশ কয়েকটি বিধ্বংসী ভূমিকম্পের শিকার হয়েছে, যার মধ্যে একটি ছিল ১৯৯৯ সালে। কোকাইলি প্রদেশের ইজমিটের কাছে একটি ভূমিকম্পের কেন্দ্র ছিল, যে ভূমিকম্পে প্রায় ১৮,০০০ মানুষ মারা যায়। ঐ ভূমিকম্পের পর নিরাপত্তা বিধি লংঘনকারী বিল্ডিং নির্মাণ সংস্থা ও কোম্পানির দুর্নীতি প্রকাশ্যে এসে পড়ে। যার ফলে জনগণের ক্ষোভের সৃষ্টি হয় ও সরকার কিছু নির্মাণ কোম্পানির কর্তাদের (মাফিয়া) গ্রেফতার করতে বাধ্য হয়। এমনই একজন গ্যাংস্টার, ভেলি গোসার, তিন সপ্তাহ লুকিয়ে থাকার পর গ্রেফতার হয়। গ্রেফতারের পরে এক সাক্ষাৎকারে, সে কংক্রিটে সামুদ্রিক বালি মেশানোর মতো খরচ কমানোর বিবিধ ব্যবস্থার কথা স্বীকার করেছিল।
এরকম কিছু বিচ্ছিন্ন ধরপাকড় হলেও, তুর্কির বৃহত্তর নির্মাণ ক্ষেত্রে ব্যাপক দুর্নীতির চক্র চলতে থাকে। এদিকে, অযোগ্য উদ্ধার ও ত্রাণ কার্য পরোক্ষভাবে এক রাজনৈতিক সংকটের সূচনা করেছিল, যার চরম পরিণতি হয় ২০০২ সালে বুলেন্ট ইসেভিটের ডি.এস.পি. সরকারের পতনের সাথে।
১৯৯৯-এর ভূমিকম্পের পরে, সংস্কারের প্রতিশ্রুতি দেওয়া হয়েছিল এবং ভূমিকম্প থেকে বাড়ি-ঘরগুলিকে রক্ষা করার জন্য নতুন আইনি প্রবিধান প্রণয়ন করা হয়েছিল। যাইহোক, বৃহৎ কর্পোরেট সংস্থা ও সরকারের বিভিন্ন পলিসি এই নতুন প্রবিধানগুলিকে কর্যত পঙ্গু করে রেখে দেয়।
এরদোগান এবং নির্মাণ সংস্থার চক্র
এরদোগানের শাসনকালে ২০১৮ সালে কিছু আইন পাস করা হয়েছিল। এই আইনের বলে, এমন নির্মাণ সংস্থাগুলিকে লাইসেন্স দেওয়া হয়েছে যেগুলি বিল্ডিং কোড মেনে চলে না—সরকারকে দেওয়া ফি-এর বিনিময়ে। সরকারি ভাবে অনুমোদিত এই ঘুষ ব্যবস্থার সুবাদে ১৩ মিলিয়ন বিতর্কিত নির্মাণ কাঠামো বৈধ করা হয়েছিল। এরদোগানের বিরুদ্ধে ২০১৬ সালের সামরিক অভ্যুত্থানের প্রচেষ্টার পরে, এই প্রক্রিয়াটি ব্যাপকভাবে ত্বরান্বিত হয়। এর পরে বিপুল সংখ্যক রাষ্ট্রীয় ভবন এবং সরকারি জমি জায়গা বেসরকারিকরণ করা হয় ও সামরিক বাহিনীর হতে তুলে দেওয়া হয়। দক্ষিণ পূর্ব তুর্কিতে, ২০০৭ সালের পর নির্মিত হাসপাতাল, পুলিশ স্টেশন, স্কুল, পৌরসভা ভবন, সেতু এবং বিমানবন্দরের মতো রাষ্ট্রীয় সম্পত্তি এখন ভূমিকম্পে ব্যাপক ক্ষতির সম্মুখীন হয়েছে।
এই মর্মান্তিক ঘটনার রক্তের দাগ, এরদোগানের হাতেও রয়েছে। ইস্তাম্বুলের মেয়র থেকে তুরস্কের প্রধানমন্ত্রী হওয়ার সমস্ত পথে, তিনি তুরস্কের নির্মাণ শিল্পের কর্পোরেট মাফিয়াদের সাথে ঘনিষ্ঠ সম্পর্ক গড়ে তুলেছিলেন। ২০০০ এবং ২০১০ – এর দশকে তুরস্কের ব্যাপক অর্থনৈতিক উন্নতির পিছনে এই নির্মাণ শিল্প একটি প্রধান চালিকা শক্তি ছিল, যার উপর ভর করে এরদোগান এবং তার এ.কে.পি. দল তাদের কর্তৃত্বের অনেকটাই কায়েম করে।
সব মিলিয়ে, এটা একেবারেই পরিষ্কার যে এরদোগান এবং তার অনুচরেরা নির্মাণ শিল্পের পুঁজিপতিদের লাভজনক চুক্তি পাইয়ে দিয়ে পুরো তুরস্ককে লুট করতে উৎসাহিত করেছিলেন। রাষ্ট্রপতি হিসাবে তিনি একাধিক আইন পাস করেছিলেন যাতে তিনি অর্থনৈতিক ও রাজনৈতিক ভাবে লাভবান হতে পারেন।
দুর্যোগ সামলানোর ভন্ডামি
আজ, এরদোগান তুরস্কের ক্ষতিগ্রস্ত এলাকায় তিন মাসের জরুরি অবস্থা ঘোষণা করেছেন। এটি তার সরকারকে অবাধ ক্ষমতা প্রদান করছে। অবিলম্বে এরদোগান একাধিক আইন প্রবর্তন করে প্রধান বিরোধী দল, এইচ.ডি.পি.কে নিষিদ্ধ করতে চান, যা কার্যকর হলে মে মাসের সাধারণ নির্বাচনে এরদোগানের হাতে আবার তুরস্কের শাসনভার উঠে আসবে । রাষ্ট্রপতি এরদোগান AKP-এর প্রতি সমর্থন জোগাড় করার জন্য কয়েক মাস ধরে কূটকৌশল চালিয়ে যাচ্ছেন। যার মধ্যে রয়েছে, নতুনভাবে জনকল্যাণ খাতে বিপুল তহবিল ঘোষণা করা (যে দেশে সরকারি হিসেবে মুদ্রাস্ফীতির হার ৬৪ শতাংশের বেশি), রাজনৈতিক প্রতিপক্ষকে দমন করা, এবং তুরস্কের সংখ্যালঘু কুর্দ ও তুরস্কে বসবাসকারী সিরিয়ান উদ্বাস্তুদের প্রতি উচ্ছৃঙ্খল বিদ্বেষ প্রকাশ করা।
সাম্প্রতিক ভুকম্পের পর তার সরকার একটি দুর্বল অবস্থানে রয়েছে, এবং তিনি এটি স্পষ্টতই টের পাচ্ছেন। তিনি আশা করছেন যে ‘জাতীয় ঐক্য’-এর জিগির তুলে রাজনৈতিকভাবে অনুকূল মেজাজ তৈরি করা যেতে পারে, যা তাকে তার রাষ্ট্রপতির অবস্থান নিশ্চিত করতে সহায়তা করবে। তিনি তার রাজনৈতিক শত্রুদের আরও চূর্ণ করার জন্য জরুরি অবস্থার ক্ষমতা অপব্যবহার করার বিষয়ে উন্মত্ত হয়ে উঠেছেন।
কিন্তু এটি একটি বিপজ্জনক পদক্ষেপ হবে। অর্থনৈতিক সংকটে মানুষ ইতিমধ্যে চরম দুর্ভোগে ছিল। যদি কোনো ইঙ্গিত পাওয়া যায় যে, এরদোগান রাজনৈতিক লাভের জন্য এই ভূমিকম্পকে কাজে লাগাচ্ছেন; তাহলে এই বিপর্যয়ের ফলে ব্যাপক রাজনৈতিক পালাবদল হতে পারে।
সাম্রাজ্যবাদী দেশগুলি ইতিমধ্যে ভূমিকম্পকে ঘিরে কুমিরের কান্নার ঘৃণ্য প্রদর্শনে লিপ্ত হয়েছে। বিশেষ করে সিরিয়া এমন একটি দেশ যা এই একই সাম্রাজ্যবাদীদের হাতে বছরের পর বছর নারকীয় যুদ্ধ এবং অর্থনৈতিক নিষেধাজ্ঞার শিকার হয়েছে। স্বভাবতই, এই ভূমিকম্পের কাছে সিরিয়া অসহায় ছিল।
যখন অনেক পশ্চিমি দেশ থেকে উদ্ধারকারী দল অবিলম্বে তুরস্কের দিকে রওনা দিয়েছে তখন সিরিয়ায় একটি সম্পূর্ণ ভিন্ন গল্প চলছে। সিরিয়ায় আসাদ সরকারের সাথে অব্যাহত যুদ্ধ এবং শত্রুতা চালিয়ে যাওয়া পশ্চিমি দেশগুলি সিরিয়ার সরকারের সাথে সমঝোতায় যেতে অস্বীকার করছে।
এই বিপর্যয়, পুঁজিবাদের উন্মাদনা এবং নিষ্ঠুরতার আরও একটি প্রমাণ।