Home শিক্ষা শিক্ষা বেসরকারিকরণের নয়া ফন্দি: বিদেশি প্রতিষ্ঠানের ভারত অভিযান

শিক্ষা বেসরকারিকরণের নয়া ফন্দি: বিদেশি প্রতিষ্ঠানের ভারত অভিযান

শিক্ষা বেসরকারিকরণের নয়া ফন্দি: বিদেশি প্রতিষ্ঠানের ভারত অভিযান
1
ইন্দ্রনীল দাস

নয়া জাতীয় শিক্ষানীতি-২০২০ প্রয়োগের দিকে আরো এক ধাপ এগোলো বর্তমান শাসকদল। বছরের শুরুতেই UGC বিদেশি বিশ্ববিদ্যালয়গুলিকে এই প্রথম ভারতে তাদের ক্যাম্পাস প্রতিষ্ঠা করার অনুমতি দিল। কার্যক্রম নির্ধারণ, ভর্তি প্রক্রিয়া, ফি নির্ধারণ, শিক্ষক নিয়োগ প্রভৃতি বিষয়ে এই বিশ্ববিদ্যালয়গুলিকে মুক্তহস্তে ক্যাম্পাসের যাবতীয় সিদ্ধান্ত নেওয়ার ছাড়পত্র দেওয়া হয়েছে। এর ফলে দেশে হার্ভার্ড, স্ট্যানফোর্ড, এম আই টি, ইয়েল, অক্সফোর্ড প্রভৃতি বিশ্ববিদ্যালয় ক্যাম্পাস খোলার সুযোগ পাবে। ঘটনাটি নিয়ে অনেকেই উচ্ছ্বসিত। তবে বাস্তবে এই সিদ্ধান্ত যে শিক্ষাকে আরও তীব্রভাবে বেসরকারিকরণের দিকে ঠেলে দেবে, তা আর বলার অবকাশ রাখে না। ভারতের মতো দেশ, যেখানে প্রতিবছর বৃহৎ সংখ্যক ছাত্রছাত্রী স্কুলছুট হচ্ছে আর্থিক অবস্থার কারণে, সেখানে এই সিদ্ধান্তের পর নির্দিষ্ট কিছু শ্রেণির ছাত্রছাত্রীরাই শিক্ষার সুযোগ পেতে চলেছে। এর সাথে গজিয়ে উঠবে অসংখ্য কোচিং সেন্টার, উচ্চশিক্ষার লোনের ব্যবস্থা।

দেশের অনেকাংশে এই সিদ্ধান্তকে সাদরে স্বাগত জানানো হচ্ছে। তবে, আমরা এই সিদ্ধান্তের গভীরে অনুসন্ধান করে কিছু প্রশ্ন ছুঁড়তে চাই।

[১] ভর্তি প্রক্রিয়া, মানদণ্ড বজায় রাখা এবং ফি কাঠামো নির্ধারণের ক্ষেত্রে বিশ্ববিদ্যালয়গুলির সম্পূর্ণ স্বাধীনতা থাকবে, যদিও কমিশন ফি কাঠামোকে ‘যুক্তিসঙ্গত এবং স্বচ্ছ’ রাখার পরামর্শ দিয়েছে। অর্থাৎ, বিদেশি বিশ্ববিদ্যালয়গুলি আধুনিক পাঠ্যক্রম, উন্নত ল্যাব উপকরণ, ঝাঁ চকচকে পরিকাঠামো, ‘বিলিতি’ ট্যাগ দেখিয়ে যথেচ্ছ ফি বাড়াতে পারে। এবার হার্ভার্ড, স্ট্যানফোর্ড, এম আই টি, ইয়েল, অক্সফোর্ড প্রভৃতি বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়াশোনা করার যে খরচ, তা শ্রমজীবী ঘরের ছাত্রছাত্রীদের পক্ষে বহন করা কোনোভাবেই সম্ভব না। উদাহরণস্বরূপ, অক্সফোর্ডে যেকোনো বিজ্ঞান বিষয়ে স্নাতক ডিগ্রি পেতেই খরচ হয় প্রায় ৩০,০০,০০০ টাকা। যে দেশে এখনো প্রতি ঘণ্টায় গড়ে ২ জন কৃষক অনাহার অর্থাভাবে আত্মহত্যা করে, সেখানে এই বিদেশি শিক্ষাকেন্দ্রের অধিকার কাদের জন্য সংরক্ষিত থাকবে?

[২] ভারতের জনসংখ্যার প্রায় ২৭% ১ থেকে ১৪ বছর বয়সি। ভারতের শিক্ষাক্ষেত্র দেশি বিদেশি পুঁজির বিনিয়োগ ও বৃদ্ধির জন্য অবাধ সুযোগ প্রদান করে। ২০২০ অর্থবর্ষে ভারতে শিক্ষার ‘বাজার মূল্য’ ১১৭ বিলিয়ন ইউ এস ডলার ছিল এবং ২০২৫ অর্থবর্ষ নাগাদ তা ২২৫ বিলিয়ন ইউ এস ডলারে পৌঁছাবে বলে আশা করা হচ্ছে। ভারতীয় কারিগরিবিদ্যা বাজারের আকার ২০২১ সালের ৭০০-৮০০ মিলিয়ন ইউ এস ডলার থেকে ২০৩১ সালের মধ্যে ৩০ বিলিয়ন ইউ এস ডলারে পৌঁছাবে বলে মনে করা হচ্ছে। এই বিপুল মূলধনের বাজার স্বাভাবিকভাবেই সমস্ত পুঁজিপতিদের পাখির চোখ। তাই জিও বিশ্ববিদ্যালয়, বাইজু’স, আনআকাদেমি, গুগল, আমাজন, আপস্কিল, ইউডেমি — সবাই এই বাজারে নিজের পুঁজি খাটানোর চেষ্টায় ঝাঁপিয়ে পড়ছে। তাদের প্রধান লক্ষ্য শিক্ষা বিক্রয় করে সর্বোচ্চ মুনাফা আদায়। অর্থের বদলে শিক্ষার এই ভাঁওতাবাজির শিকার হতে চলেছে দেশের যুবসমাজ। তাদের ‘মৌলিক অধিকার’ শিক্ষার দায়বদ্ধতা কে নেবে?

[৩]  সাম্রাজ্যবাদী পুঁজি পরিচালনার জন্য উপযোগী উন্নত ও  পর্যাপ্ত শ্রমশক্তি নেই ভারতে। বর্তমানের Machine Language, Artificial Intelligence, Virtual Reality, Augmented Reality প্রভৃতি নির্ভর উন্নত বাজার পরিচালনার জন্য প্রয়োজন খুবই দক্ষ শ্রমশক্তি। ১৯৯১ থেকেই বিদেশি শিক্ষাকেন্দ্রগুলিকে ভারতে অনুমোদন দেওয়ানোর বহু প্রচেষ্টা চলছিল। দীর্ঘদিনের ছাত্র আন্দোলন, বিরোধী দলের চাপের জন্য এগুলি কার্যকর হতে পারেনি। তবে বিশ্বপুঁজির এই গভীর সংকটকালে পুঁজিপতিদের অনুগত বিজেপি সরকার নতুন জাতীয় শিক্ষানীতি ২০২০ প্রয়োগের মাধ্যমে বিদেশি পুঁজির অনুপ্রবেশের রাস্তা প্রশস্ত করছে। জীবনধারণের জন্য প্রয়োজনীয় শিক্ষাদান এই ব্যবস্থার উদ্দেশ্য নয়। নিজের মুনাফার জন্য প্রয়োজনীয় শোষণ চালানোর পর মানুষের সুস্থ সমাজ জীবন, মানসিক স্বাস্থ্য, অবসর জীবনের দায়িত্ব নেবে তো এই শিক্ষাব্যবস্থা?

[৪] উচ্চশিক্ষাকে কেন্দ্র করে যে বিপুল ফাইনান্স পুঁজির ব্যবসা চলছে, তা আমেরিকা বা ইউরোপের যেকোনো দেশের দিকে তাকালেই বোঝা যায়। বিদেশী বিশ্ববিদ্যালয়ে উচ্চশিক্ষার আকাঙ্ক্ষায় বহু অভিভাবক বিপুল রাশির লোন করে কোচিং সেন্টার, ইংরেজি স্কুল, প্রাইভেট টিউশনে ছাত্রছাত্রীদের ভর্তি করবে। ইঁদুরদৌড়ে সামিল হয়ে বাড়বে পিঠের ব্যাগের ওজন, হতাশা, আত্মহত্যা। বর্তমানে একজন ভারতীয় শিশুর মাথায় জন্মের সময় থেকে প্রায় ১,৪৫,০০০ টাকার আন্তর্জাতিক দেনা। সরকারি শিক্ষাব্যবস্থার যেটুকু অবশিষ্ট আছে, তাও অকার্যকর হয়ে গেলে লোন নিয়ে পড়াশোনা করাটাই চল হয়ে পরবে না তো?

[৫] এদিকে সরকার বিভিন্ন স্টুডেন্ট লোন স্কিম চালু করছে। যার অর্থ এই সমস্ত শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান স্টুডেন্ট লোনের অজুহাত দেখিয়ে ইচ্ছে অনুযায়ী ফি বৃদ্ধি করতে পারে এবং সেক্ষেত্রে প্রতিবাদের অধিকারটুকুও থাকবে না।  এই ঋণ প্রকল্পগুলির মাধ্যমে আসলে বিভিন্ন  সরকার ঘুরপথে শিক্ষার বেসরকারিকরণকে উৎসাহিত করছে। যদিও দেখা যাচ্ছে, এই লোনের সুবিধা কিন্তু সবাই পাচ্ছে না। উদাহরণ হিসাবে, পশ্চিমবঙ্গের স্টুডেন্ট ক্রেডিট কার্ড স্কিমে মাত্র ১৭% আবেদনকারীর লোন অনুমোদিত হয়েছে। এবার নির্দিষ্ট সুদের হারে এই ধরনের লোন অনুমোদন পেলে, তা শোধ করতে হবে শিক্ষার্থীকেই। বর্তমান শিক্ষাব্যবস্থা কি সমস্ত ছাত্রছাত্রীর জীবিকার দায়িত্ব নেবে?

[৬] এই ক্যাম্পাসগুলিতে ছাত্রছাত্রীদের মত প্রকাশ, ইউনিয়ন করা, সংগঠন করা, ছাত্র সংসদ প্রভৃতি ক্ষেত্রে আদৌ কোনো স্বাধীনতা থাকবে বলে মনে হয় না। ছাত্র রাজনীতির প্রয়োজনীয়তা রয়েছে, ছাত্রছাত্রীদের বিভিন্ন ন্যায্য দাবিদাওয়া  প্রতিষ্ঠান কর্তৃপক্ষের নজরে আনায় হোক বা কর্তৃপক্ষের ছাত্রবিরোধী পদক্ষেপের বিরোধিতা করায় হোক। প্রশ্নহীন, অনুগত কেরানি নির্মাণের এই শিক্ষাব্যবস্থা কি ছাত্রছাত্রীদের অধিকার সুরক্ষিত করবে?

[৭] বিদেশি বিশ্ববিদ্যালয়গুলি বিরাট আকারের প্যাকেজ, স্কলারশিপ প্রভৃতির টোপ দিয়ে আমাদের দেশের ছাত্রছাত্রীদের দেশের বাইরে নিয়ে যাবে। তা দীর্ঘদিন ধরে চলা ‘Brain Drain’ কেই আরও বাড়িয়ে তুলবে না তো?

[৮] আমাদের দেশে বিভিন্ন অনগ্রসর অংশের ছাত্রছাত্রীদের জন্য কিছু বিশেষ সুবিধা প্রদান করা হয়, যাকে সংরক্ষণ বলা হয়। এই সমস্ত বিদেশি বিশ্ববিদ্যালয়ে সেই সমস্ত অনগ্রসর অংশের সংরক্ষণ, স্কলারশিপ প্রভৃতি সুবিধা থাকবে কিনা সন্দেহ। প্রসঙ্গত, কেন্দ্র সরকার এর মধ্যেই একে একে সংখ্যালঘু স্কলারশিপ বন্ধ করে দিচ্ছে। উচ্চশিক্ষায় অংশগ্রহণের ক্ষেত্রে এই সমস্ত সংখ্যালঘু, আদিবাসী, দলিত, নারী প্রভৃতি সমাজের অনগ্রসর অংশের স্বার্থ কি পূর্বোক্ত প্রতিষ্ঠানে রক্ষা করা হবে?

[৯] বলা বাহুল্য এই সমস্ত বিশ্ববিদ্যালয়গুলিতে শিক্ষার মাধ্যম হবে ইংরেজি। ফলে ছোটো থেকেই শিশুদের ইংরেজি স্কুলে পঠনপাঠন করানোর ঝোঁক থাকবে অভিভাবকদের(যা ইতিমধ্যেই জাঁকিয়ে বসেছে)। আঞ্চলিক ও মাতৃভাষায় জ্ঞানচর্চা এমনিই কম হয়। এতে আরও উৎসাহ কমবে। শিক্ষার পাঠক্রম নির্মাণের সম্পূর্ণ দায়িত্ব যদি বিদেশি বিশ্ববিদ্যালয়ের হাতে থাকে, তাহলে তা কতটা আমাদের দেশের জন্য উপযোগী হবে তা ভেবে দেখার বিষয় নয় কি?

দিনদিন এটা খুবই স্পষ্ট হচ্ছে যে, শিক্ষার যে উদারিকরণ-বেসরকারিকরণ-বিশ্বায়ন ১৯৯১তে শুরু হয়েছিল, নয়া জাতীয় শিক্ষানীতি-২০২০ তারই শেষ অধ্যায়। কেন্দ্রের বিজেপি-আর এস এস সরকার একে কেবল ত্বরান্বিত করছে। নয়া জাতীয় শিক্ষানীতি-২০২০-র বিরোধিতা না করলে আগামী দিনে শিক্ষা ওপর একে একে আমাদের এবং সকল খেটে খাওয়া মেহনতি মানুষের ন্যূনতম অধিকারও ছিনিয়ে নেওয়া হবে।

 

তথ্যসূত্র:

১। https://www.ibef.org/industry/education-presentation

২। https://www.imarcgroup.com/higher-education-market-india

৩। https://www.newsclick.in/foreign-varsities-can-set-campuses-india-ugc-announces-draft-norms

৪। https://indianexpress.com/article/explained/foreign-universities-ugc-norms-earlier-bids-stalled-why-this-one-most-ambitious-8364293/

Share Now:

Comment(1)

  1. We have to reserve atleast 25% seats for economically backward local people and those institutions should be built it underdeveloped places so that inclusive growth both social and economical can be achieved.

LEAVE YOUR COMMENT

Your email address will not be published. Required fields are marked *