Home কৃষি অতিমারি-খরা-অতিবৃষ্টি: আবারও খাদ্য সংকটের আশঙ্কা
0

অতিমারি-খরা-অতিবৃষ্টি: আবারও খাদ্য সংকটের আশঙ্কা

অতিমারি-খরা-অতিবৃষ্টি: আবারও খাদ্য সংকটের আশঙ্কা
0
          ইন্দ্রনীল দাস

করোনা অতিমারির রেশ কাটতে না কাটতেই দেশের কৃষকরা আরও এক গভীর সমস্যার কবলে পরেছেন।  বর্তমানে বেশিরভাগ রাজ্যের কৃষকরা  সঠিক ফলন না পাওয়ার চিন্তায় দিন কাটাচ্ছেন। বলা বাহুল্য এর ফলে আবারও ব্যাপক আর্থিক ক্ষয় ক্ষতির আশঙ্কা করছেন তারা।

চলতি বছরের মার্চ মাসে অপ্রত্যাশিত ভাবে দেশ জুড়ে তাপমাত্রা বৃদ্ধি পায়। মার্চ মাস হচ্ছে গম কাটার সময়। তাপমাত্রা বৃদ্ধি পাওয়ায় স্বাভাবিক ভাবেই গমের উৎপাদনও কম হয়েছে।

প্রকৃতির মার এখানেই থেমে থাকেনি। সেপ্টেম্বর মাসে যখন বর্ষার ধান পাকার সময়, তখনই সেপ্টেম্বরের শেষ সপ্তাহে দেশের পশ্চিমের রাজ্যগুলিতে দেখা যায় অস্বাভাবিক বৃষ্টিপাত। ফসল কাটার বিলম্বের জন্য ফলন ৭-৮ কুইন্টাল কমে গেছে এবং কীটনাশক বিরোধী স্প্রে কিনতে খরচও বেড়েছে অনেক।

রাজ্যগুলির হাল হকিকত

আবহাওয়ার এই অনিশ্চয়তা কৃষি খাতের জন্য ক্রমশই  মাথাব্যথার কারণ হয়ে উঠছে। পঞ্জাব কৃষি বিভাগের ডিরেক্টর, গুরবিন্দর সিং অনুমান করেছেন সে রাজ্যের উৎপাদনে ২% থেকে ৫%  ক্ষতি হবে। হরিয়ানাতে ক্ষতির পরিমাণ প্রায় ১০% হতে পারে।

পঞ্জাব এবং হরিয়ানা ছাড়াও; উত্তরপ্রদেশে – যা দেশের দ্বিতীয় বৃহত্তম ধান উৎপাদনকারী রাজ্য- অক্টোবর মাসে অকাল ভারী বৃষ্টিপাত হয়েছিল। তখন কৃষকরা ফসল কাটার জন্য প্রস্তুত ছিল। আই.এম.ডি. -এর সর্বশেষ তথ্য থেকে জানা যাচ্ছে উত্তরপ্রদেশের ৭৫টি জেলার মধ্যে ৬৫টি তেই  অতিরিক্ত বৃষ্টিপাত হয়েছে। এ বছর উত্তরপ্রদেশে মোট ধান জমির পরিমাণ ৫.৯ মিলিয়ন হেক্টর। মৌসুমের শুরুতে,বৃষ্টিপাতে ঘাটতি হয়, যার ফলে ১.৫ মিলিয়ন হেক্টর জমিতে বপন ক্ষতিগ্রস্ত হয়। আগস্ট এবং সেপ্টেম্বরে পর্যাপ্ত বৃষ্টিপাত হলে এই ঘাটতি পুরণ হয়, কিন্তু ফসল কাটার ঠিক আগেই অক্টোবরের প্রথম দশ দিনে অতিবৃষ্টির ফলে প্রায় ২.৫ লাখ হেক্টর ধানের জমি ক্ষতিগ্রস্ত হয়।

এর ফলে আমাদের ধান উৎপাদন ২০২১ সালের ১৬ মিলিয়ন টন থেকে এই বছর কমে ১৪.৫ থেকে ১৫ মিলিয়ন টনে দাঁড়াবে বলে অনুমান, অর্থাৎ প্রায় ১০% উৎপাদন ক্ষতি।

খাদ্যশস্যের সরকারি নীতি তার প্রতিফলন

যদিও কেন্দ্রীয় কৃষিমন্ত্রী নরেন্দ্র সিং তোমর সম্প্রতি সংসদে বলেছেন যে দেশে কোনো খাদ্যশস্যের সংকট নেই কিন্তু কৃষিতে চরম আবহাওয়ার প্রভাব সরকারি নীতিতে প্রতিফলিত হচ্ছে।  উৎপাদন ঘাটতিতে উদ্বেগ এবং অভ্যন্তরীণ চাহিদা বৃদ্ধির পরিপ্রেক্ষিতে কেন্দ্র, ৯ সেপ্টেম্বর, অর্থাৎ প্রথম অগ্রিম ফসলের হিসাব ( First Advance Estimate ) প্রকাশের প্রায় দুই সপ্তাহ আগে, ভাঙ্গা চাল রফতানি নিষিদ্ধ করেছিল। একইভাবে, এই বছরের শুরুর দিকে, মার্চ মাসে উচ্চ তাপমাত্রায় ফসলের উৎপাদন প্রভাবিত হওয়ার আশঙ্কা  করে দেশের গম রফতানি নিষিদ্ধ করেছিল সরকার। আই.এম.ডি .অনুসারে, ১৯০১ সালের পর থেকে ২০২২ এর মার্চ ছিল সবচেয়ে উষ্ণ।

বছরে ৬৯ মিলিয়ন হেক্টর ফসল জমি নষ্ট হয়েছে

পার্লামেন্টের সাম্প্রতিক বর্ষা অধিবেশনে কৃষি মন্ত্রকের পেশ করা তথ্য অনুযায়ী, ভারী বৃষ্টিপাত এবং বন্যা সহ জল-আবহাওয়া সংক্রান্ত বিপর্যয়গুলিতে ২০১৫-২০১৬ এবং ২০২১-২২ এর মধ্যে ভারতের চাষযোগ্য এলাকার ৩৩.৯ মিলিয়ন হেক্টর ক্ষতিগ্রস্থ হয়েছে। স্বল্প এবং ঘাটতি বৃষ্টিপাতের ফলে সৃষ্ট খরাও সমানভাবে ধ্বংসাত্মক ।  ২০১৬- ২০১৭ থেকে ২০২১- ২২ এর মধ্যে প্রায় ৩৫ মিলিয়ন হেক্টর চাষযোগ্য এলাকা (যেখানে ফসলের ক্ষতি ৩৩% এবং তার বেশি) ক্ষতিগ্রস্থ হয়েছিল।

রাজস্থান, কর্নাটক, মধ্যপ্রদেশ এবং মহারাষ্ট্র সবচেয়ে বেশি ক্ষতিগ্রস্ত রাজ্যগুলির মধ্যে অন্যতম; এগুলি খরা এবং অতিরিক্ত বৃষ্টিপাতের ফলে ফসলের ক্ষতির সম্মুখীন হয়েছিল। অন্যান্য যে সব রাজ্যে  বন্যা এবং ভারী বৃষ্টি ফসলের ক্ষতির প্রধান কারণ ছিল, তাদের মধ্যে রয়েছে-  বিহার, পশ্চিমবঙ্গ, উত্তর প্রদেশ, অসম, গুজরাট এবং ওড়িশা। এই ক্ষতিগ্রস্ত রাজ্যগুলির বেশিরভাগই ভৌগলিকভাবে সংযুক্ত নয়, যা ইঙ্গিত দেয় যে জলবায়ুর পরিবর্তনশীলতার সমস্যা এবং কৃষিতে এর প্রভাব থেকে কেউ রেহাই পাবে  না ও এই সমস্যা ক্রমশ বিস্তারলাভ করছে।

আই.এম.ডি. রিপোর্ট প্রকাশ করেছে যে সাতটি রাজ্যে গত ৩০ বছরে গড় বৃষ্টিপাতের পরিমাণ হ্রাস পেয়েছে, অন্যদিকে ১২টি রাজ্যে একই সময়ে গড় বৃষ্টিপাতের পরিমাণ বৃদ্ধি পেয়েছে। এই বছরের বর্ষা নিয়ে আবহাওয়া দফতরের. বিশ্লেষণ একই প্রবণতা  দেখাচ্ছে।  এই রিপোর্ট বলছে যে ভারতের ৭০৩ টি জেলার মধ্যে মাত্র ৪০% -য় স্বাভাবিক গড় বৃষ্টিপাত হয়েছে।

সরকারি প্রকল্প সহযোগিতা

সরকারের বক্তব্য, বন্যা, খরা, তাপপ্রবাহ ইত্যাদির চরম জলবায়ুর  জন্য ইন্ডিয়ান কাউন্সিল অফ এগ্রিকালচার রিসার্চ (ICAR) এবং বিভিন্ন রাজ্য কৃষি বিশ্ববিদ্যালয় দ্বারা উদ্ভাবিত ১৭৭টি জাতের বীজের পরীক্ষা চালানো হচ্ছে।  আবহাওয়া-সম্পর্কিত চ্যালেঞ্জের প্রভাব কমাতে ৬৫০টি জেলার জন্য বিশেষ পরিকল্পনা গ্রহণ করছে কেন্দ্র। তবে এর কোনো সুদূরপ্রসারী প্রভাব আছে বলে মনে হচ্ছে না। ক্রমবর্ধমান প্রাকৃতিক দুর্যোগ মোকাবেলা করার জন্য সরকারকে সেচের জন্য ব্যয় বাড়াতে হবে। এর জন্য গ্রামীণ কাঠামোর উন্নতি, কৃষি সম্প্রসারণ পরিষেবাগুলিতে আরও ব্যয়, টেকসই চাষ, শস্য বহুমুখীকরণ ইত্যাদি প্রয়োজন।

কৃষকদের নিরাপত্তার ব্যবস্থা কোথায়?

২০১৫-১৬ কৃষি শুমারি অনুসারে প্রান্তিক এবং ক্ষুদ্র কৃষকরা ভারতের মোট কৃষকের ৮৬% এবং চরম আবহাওয়ার ঘটনাগুলির জন্য এরাই সবচেয়ে ক্ষতিগ্রস্ত। কৃষকরা একটি কার্যকর ফসল বীমা ব্যবস্থা চায়। মডেলটি এমন হওয়া উচিত যাতে এটি নিশ্চিত করে যে, একজন কৃষক, এমনকি এক একর জমিতে ফসলের ক্ষতির জন্য ক্ষতিপূরণ পাবেন। বিশিষ্ট কৃষি  অর্থনীতিবিদ আর.এস. দেশপান্ডে শস্য বিমার সম্পূর্ণ সংস্কারের আহ্বান জানিয়েছেন। তবে যথাযথ গবেষণা ছাড়াই প্রতিটি ঘটনার জন্য জলবায়ু পরিবর্তকে দায়ী করলে, উৎপাদন সম্প্রসারণের ক্ষেত্রেও বাধা পড়তে পারে, যা প্রান্তিক কৃষকদের ক্রমাগত দুর্বল অবস্থায় ফেলবে।

Share Now:

LEAVE YOUR COMMENT

Your email address will not be published. Required fields are marked *