দেবজিৎ ভট্টাচার্য
সিরিয়া প্যালেস্টাইন গাজা নয় এবার খোদ আকাশ পথে ড্রোনের সাহায্যে ঘন ঘন বোমা নিক্ষেপ করা হচ্ছে আদিবাসীদের বাসভূমিতে। এমনটাই দাবি ছত্তীসগঢ়ের বস্তার জেলার আদিবাসী মানুষের।
ছত্তীসগঢ়ে আদিবাসীদের জল-জমি-জঙ্গল বাঁচানোর লড়াই প্রায় চার দশকের। বিভিন্ন সংবাদ মাধ্যমের খবর অনুযায়ী সেখানে নিষিদ্ধ সিপিআই(মাওবাদী)পার্টি বিকল্প সরকার প্রতিষ্ঠা করেছে। যাকে তারা বলে ‘রেভলিউশনারি পিপলস কমিটি’ বা জনাতানা সরকার। প্রতিদিন সেখানে ভারত সরকার তাদের উপর আক্রমণ নামিয়ে আনছে। ওই অঞ্চলের প্রাকৃতিক সম্পদ দেশি-ইবিদেশি বৃহৎ কর্পোরেটদের হাতে তুলে দিতেই এই আক্রমণ বলে দাবি করে মাওবাদীরা।
ছত্তীসগঢ়ে মাওবাদী এলাকাগুলিতে এখন ট্যাক্টিকাল কাউন্টার অফেন্সিভ ক্যাম্পেনিং(TCOC) বা রণকৌশলগত প্রতি আক্রমণ চালাচ্ছে মাওবাদীরা। বস্তারের আইজি সুন্দররাজের মতে এই অভিযান মূলত ফেব্রুয়ারি থেকে জুন অবধি চলে । এ হল মাওবাদী ক্যালেন্ডার অনুযায়ী শত্রুপক্ষের ঘাঁটিতে আক্রমণের সময়। বস্তারের আইজির মতে, এই ক্যাম্পেনিং মাওবাদীরা ২০১৩ সাল থেকেই চালিয়ে আসছে।
২০১৭ থেকে ভারতের আরএসএস-বিজেপি সরকারের ইতিহাস দেখি তবে দেখতে পাবো ঠিক এইসময়ই ভারত সরকারও তাদের নীতি অনুযায়ী এই অঞ্চলের উপর আক্রমণ তীব্র করছে।
এ বছরের শুরু থেকেই আরএসএস-বিজেপি সরকার তাদের হিন্দুত্ববাদী এজেন্ডা অনুযায়ী ‘আক্রমণাত্মক’ রূপ নিয়ে একেক রকম প্রচার চালিয়ে খেটে খাওয়া মানুষের উপর আক্রমণ নামাচ্ছে, এমন অভিযোগ অনেকেরই। ভারতে মানবাধিকার লঙ্ঘনের ঘটনা বাড়ছে বলে সম্প্রতি উদ্বেগ জানিয়েছেন আমেরিকার সেক্রেটারি অব স্টেটস অ্যান্টনি ব্লিনকেন।
বিভিন্ন গণতান্ত্রিক আন্দোলনের কর্মীদের দাবি অনুযায়ী ভারতের আরএসএস-বিজেপি সরকার এ বছরের শুরু থেকেই বিজেপি শাসিত রাজ্যগুলিতে হিজাব বিতর্ক ও খ্রিস্টান সম্প্রদায়ের মিশনারি স্কুলগুলিকে আক্রমণের মাধ্যমে সংখ্যালঘু মানুষের আইডেন্টিটিকে টার্গেট করে তাদের ভেতরকার ধর্মীয় ‘সত্তা’জাগিয়ে দেশজুড়েই এক সম্প্রদায়িক অচলাবস্থার সৃষ্টি করেছে। তাদের মতে, আকাশ ছোঁয়া মূল্যবৃদ্ধি, অসংখ্য মানুষের কাজ হারানোর ফলে মানুষের রুজিরুটির অভাব থেকে নজর ঘোরানোর জন্যই আসলে এমনটা করা হচ্ছে। এমনকি আরএসএস-বিজেপি সরকার এতেই থেমে থাকেনি, ‘কাশ্মীর ফাইলস’ মতন রাজনৈতিক স্বার্থের হিংসাত্মক সিনেমাকে মদত দিয়ে সংখ্যাগুরু হিন্দুদের ভেতরের হিন্দুত্ববাদী সেন্টিমেন্ট জাগিয়ে তোলার চেষ্টা চালিয়েছে। যাতে সংখ্যালঘু খেটে খাওয়া মুসলিম সম্প্রদায়ের মানুষের প্রতি বিদ্বেষ ছড়িয়ে হিন্দু সম্প্রদায়ের গরিব খেটে খাওয়া শ্রমজীবী মানুষের মস্তিস্ক থেকে সরিয়ে দেওয়া যায় তাদের কাজ হারানোর এবং অস্বাভাবিক মূল্যবৃদ্ধির আসল কারণগুলি। অর্থাৎ আরএসএস-বিজেপি সরকারের একচেটিয়া কর্পোরেট প্রেমের জনবিরোধী ফলাফল থেকে তাদের নজর ঘুরিয়ে দেওয়া যায়।
সাম্প্রতিককালে, হনুমান জয়ন্তীর মিছিল ঘিরে দিল্লিকে অচল করা এবং সারা দেশ জুড়ে সম্প্রদায়িক হিংসার সংক্রমণ ছড়িয়ে দেওয়া হয়েছে। দিল্লির জাহাঙ্গিরপুরির সংখ্যালঘু বস্তিতে কেজরিওয়াল সরকারের সহায়তায় অমিত শাহর পুলিশ প্রশাসন বুলডোজার দিয়ে গরিব মুসলিম দিনমজুরদের ২০ টি দোকানপাট গুড়িয়ে দিয়েছে নিমেষে যেমনটা ঠিক উত্তরপ্রদেশ, মধ্যপ্রদেশেও চলছে। পশ্চিমবঙ্গেও হাওড়া, বাঁকুড়া,ভাটপাড়া সহ বিভিন্ন জায়গায় রামনবমীতে হিন্দুত্ববাদী সংগঠন ও তৃণমূলের বহু নেতাদের বিজেপির সাথে পাল্লা দিয়ে সশস্ত্র মিছিলকে কেন্দ্র করে অশান্তি হয়েছে। পশ্চিমবঙ্গেও ‘মিছিলে ঢিল ছোড়া’ কে কেন্দ্র করে যেমন বিশৃঙ্খল পরিস্থিতি তৈরি হয়েছিল ঠিক সেই কায়দায় দিল্লির জাহাঙ্গিরপুরিকে অচল করা হয়েছে এবং পুরো বিষয়টাই পারিকল্পনা মাফিক সারা দেশ জুড়ে চলছে, এমনটাই অভিযোগ শোনা যাচ্ছে দেশের বুদ্ধিজীবী, ধর্মনিরপেক্ষ বিশিষ্ট -গণতান্ত্রিক মানুষের তরফ থেকে।
সিপিআই(এমএল) লিবারেশন ও বেশ কিছু বামপন্থী শ্রমিক সংগঠন এবং সিপিআই(এম) নেত্রী বৃন্দা কারাটের বাম হাতে সুপ্রিম কোর্টের হলফনামা, ডান হাত সরকারের বুলডোজারের সামনে না থাকলে আরও বহু কিছুই হতে পারত সেই মুহূর্তে। সিপিআইএমের দৈনিক পত্রিকা গনশক্তির মাধ্যমে বৃন্দা কারাট জানিয়েছেন “এই বুলডোজার দিল্লির কোনো এমএলএ, এমপি ছাড়াই রুখে দেওয়া গেছে, দিল্লি কেজরিওয়াল সরকার এই বুলডোজার চালাতে বিজেপির স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী অমিত শাহকে সাহায্য করেছেন। যারা প্রথম থেকেই একটা সম্প্রদায়ের মানুষের উপর যেরকম সেরকম ভাবে আক্রমণ নামিয়ে আনছে…”
বৃন্দা কারাটের এই বক্তব্য ধরে দেখলে দেখতে পাওয়া যাচ্ছে ২০২০ সালেও দিল্লির কেজরিওয়াল সরকার শাহিনবাগ আন্দোলন বন্ধ করতে আরএসএস বিজেপির লাগানো ‘দাঙ্গা’য় (সেটা ছিল মুসলিম নিধন) চুপ ছিল উল্টে দাঙ্গার প্রয়োচনায় দিল্লি পুলিশের উমর খালিদ ও শার্জিল ইমামকে মিথ্যে মামলায় কালা আইন ইউএপিএ-তে কেন্দ্রের আরএসএস-বিজেপি সরকারের জেলে ভরাকে সমর্থন জানিয়েছিলেন জনসম্মুখে।
প্রসঙ্গত, যখন পশ্চিমবঙ্গের দেউচা আদিবাসীদের জমি অধিগ্রহণের বিরুদ্ধে তৃণমূল কংগ্রেস সরকারের বিপক্ষে গিয়ে বিজেপি, কংগ্রেস ও সিপিআইএম দেউচার আদিবাসীদের পক্ষ নিচ্ছে, ২০০৬ আদিবাসী আইন তুলে ধরছে তখন বস্তারে আদিবাসীদের ক্ষেত্রে ঠিক এর উল্টোটা দেখা যাচ্ছে।
দক্ষিণ বস্তারের আদিবাসীদের অভিযোগ অনুযায়ী গত ১৫ তারিখ সেখানকার কংগ্রেস সরকার ও কেন্দ্রের বিজেপি সরকার মারফত ড্রোনের সাহায্যে আকাশপথে বোমা নিক্ষেপ করা হয়েছে। বাজারি মিডিয়ায় সিরিয়া গাজার খবরগুলি কিছুটা উঠে এলেও চমকপ্রদ ভাবে জায়গা পায়নি এই খবর।
বস্তারের কিছু আঞ্চলিক সংবাদ মাধ্যমের থেকে জানা যাচ্ছে সেখানকার আদিবাসীরা জানিয়েছে, “গত ১৫ তারিখ রাত ১টা থেকে ২টা ভেতরে আকাশপথে ড্রোনের সাহায্যে দক্ষিণ বস্তারের ঘন জঙ্গলে ৩৫-৪০ বোমা নিক্ষেপ করা হয়েছে”। এই বোমা নিক্ষেপের ফলে মাটিতে বড়ো বড়ো গর্ত হয়ে গেছে ও সেখানকার গাছপালার ক্ষয়-ক্ষতি হয়েছে।
বস্তারের আদিবাসীদের আরো অভিযোগ, “ভারত সরকার এই বোমা তাদের উপরেই নিক্ষেপ করেছে, তাদের রুজিরুটির অধিকার কেড়ে নিতে বস্তারের জল-জমি-জঙ্গলের ক্ষতি করতে”। দিনের বেলায় এই বোমা নিক্ষেপ করলে তাদের প্রাণও যেতে পারতো এমনটাই আদিবাসীদের একাংশ মনে করছেন কারণ ওই জঙ্গলের ভেতরেই আদিবাসীরা তাদের পেটের তাগিদে তেন্দুপাতা কোড়াতে, মহুয়া তুলতে যায় প্রতিদিন দিনের বেলাতে।
স্বাভাবিক ভাবেই এই নিয়ে কোন সংসদীয় রাজনৈতিক দলের কোন বিবৃতি দেখা যায়নি এখনও পর্যন্ত তবে সেখানকার সিপিআই(মাওবাদী)পার্টির ‘পূর্ব বস্তার এরিয়া কমিটির’ পক্ষ থেকে একটি বিবৃতি দেওয়া হয়েছে। তাদের তরফ থেকে সেই বিবৃতিতে জানানো হয়েছে, “ভারত সরকার কর্তৃক রাতের অন্ধকারে আকাশ পথের বোমা নিক্ষেপের ফলে তাদের আসল নৃশংস চেহারা আবারও ফুটে বেরিয়ে এসেছে, তারা যে বস্তারের আদিবাসীদের প্রতিরোধে ভীত তা প্রমাণিত হয়েছে।”
বস্তারের আঞ্চলিক খবরের সূত্রানুযায়ী, গ্রামবাসীরা বলেছে “ভারত সরকার তাদের বহুদিন ধরেই মেরে ফেলতে চাইছে, তাদের মারতেই ওই বোমা আকাশ পথে নিক্ষেপ করেছে”। যদিও বস্তার জেলা আইজি সুন্দররাজ গ্রামবাসীদের সমস্ত অভিযোগ নসাৎ করেই এর দায় পুরোপুরি মাওবাদীদের ঘাড়ে চাপিয়েছেন এবং তিনি আরও জানিয়েছেন, “মাওবাদীরা ট্যাক্টিকাল কাউন্টার অফেন্সিভ ক্যাম্পেনিং(TCOC)-এর অংশ হিসেবেই এই সমস্ত কথা বলছে, গ্রামবাসীদের বিভ্রান্ত করতে।”
বস্তার অঞ্চলটি দীর্ঘদিন ধরেই সংঘর্ষ-কবলিত। সেখানে নিয়মিত রাষ্ট্রীয় বাহিনীগুলির সঙ্গে মাওবাদীদের লড়াই চলে। ড্রোন দিয়ে নজরদারিও নতুন কিছু নয়। কিন্তু কয়েক বছর যাবৎ মাঝেমধ্যে আকাশ থেকে বোমাবর্ষণের কখব সামনে আসছে। এটা নতুন বিষয়। কোনো রাষ্ট্র তার নিজের দেশের মধ্যে আকাশপথে বোম ফেলছে, সত্যি হলে এটা চমৎকৃত করার মতো বিষয়, কোনো সন্দেহ নেই। বিদেশি রাষ্ট্রের সঙ্গে যুদ্ধের প্রকরণ দেশের মধ্যে ব্যবহার করাটা এক আতঙ্কজনক পরিস্থিতির দিকে নির্দেশ করে। দেশের প্রগতিশীল, ধর্মনিরপেক্ষ, গণতান্ত্রিক শক্তি এক্ষেত্রে কী প্রতিক্রিয়া ব্যক্ত করে সেদিকে নজর রাখতেই হবে।