পিপলস ম্যাগাজিন ডেস্ক: ইউক্রেন এবং সে দেশে রাশিয়ার ‘আক্রমণ’ নিয়ে আমেরিকা যে প্রচার চালাচ্ছে, তাকে খণ্ডন করা প্রয়োজন। ইউক্রেনে নিজেদের হস্তক্ষেপ এবং যুদ্ধের উস্কানিমূলক কাজকর্মকে আড়াল করার জন্যই তারা রাশিয়াকে ভিলেন বানিয়ে ভয়ঙ্কর এক আসন্ন যুদ্ধের পরিবেশ তৈরি করতে নিজেদের প্রচার যন্ত্রকে কাজে লাগিয়ে প্রচার চালাচ্ছে। এই মার্কিন নির্মিত খবরই গোটা দুনিয়া এবং ভারতের বড়ো বড়ো গণমাধ্যমগুলো প্রচার করছে। এই প্রচারের মধ্যে কোথাও গভীর বিশ্লেষণ নেই, কোথাও মার্কিন হস্তক্ষেপের ইতিহাস এবং ইউরোপ বর্তমানে সাম্রাজ্যবাদী শক্তিগুলির মধ্যে যে ভাবে বণ্টিত হয়ে রয়েছে, তা পাল্টানোর জন্য সাম্রাজ্যবাদীদের মধ্যেকার লড়াই সংক্রান্ত তথ্যগুলি নিয়ে চর্চা নেই।
সাম্রাজ্যবাদীদের বিভ্রান্তিকর প্রচারের জবাব দিতে এবং ইউক্রেনের পরিস্থিতিকে ভালো ভাবে বুঝতে গেলে আমাদের অবশ্যই কিছু তথ্য মাথায় রাখতে হবে-
১. দনবাস অঞ্চলটি ইউক্রেনের পূর্বাংশে এবং রাশিয়ার পশ্চিম সীমান্তে অবস্থিত। সোভিয়েত ইউনিয়নের সময়ে(সমাজতন্ত্রের কালে) এটি একটি সমৃদ্ধ শিল্পাঞ্চল হিসেবে গড়ে ওঠে। সোভিয়েত ইউনিয়ন তৈরি হওয়ার আগেই দনবাস অঞ্চলটিতে ভাষা, সংস্কৃতি, ইতিহাস সব দিক থেকে রুশ জনগণের প্রাধান্য ছিল। ১৯৩০-এর দশকে শিল্পায়নের জন্য রুশ শ্রমিকদের ওই অঞ্চলে পাঠানো হয়, ফলে দনবাসে রুশদের সংখ্যা আরো বেড়ে যায়।
২. ১৯৫৩ সালে পুঁজিবাদের পুনরুত্থান শুরু হয় সোভিয়েত ইউনিয়নে। তার ধারাবাহিকতায় ১৯৯১ সালে তা ভেঙে যায়। সোভিয়েত ইউনিয়ন ভেঙে যাওয়ার পর রাশিয়া, ইউক্রেন ও বেলারুশ মিলে কমনওয়েলথ অফ ইনডিপেন্ডেন্ট স্টেটস(সিআইএস) গঠন করে(বেলারুশ ইউক্রেনের উত্তরের দেশ)। ১৯৯১ সালে মিনস্কের(বেলারুশের একটি শহর) বৈঠকে এই তিনটি দেশ একটি বিশেষ সামরিক অঞ্চল তৈরির সিদ্ধান্ত নেয়, যা কিনা মার্কিন-নেতৃত্বাধীন ন্যাটোর বাইরে থাকবে।
৩. ২০১৪ সালে তথাকথিত ‘ময়দান বিপ্লবের’ নামে আমেরিকা ইউক্রেনে সামরিক অভ্যুত্থান ঘটায় এবং পুতুল সরকার স্থাপন করে। ক্ষমতায় আসার পর ওবামার মদতপুষ্ট কিভ(ইউক্রেনের রাজধানী) সরকার দনবাস অঞ্চলের অসামরিক জনগণকে লক্ষ করে নির্বিচারে বোমাবর্ষণ করে। দনবাস অঞ্চলের রুশ জনগণের ওপর গণহত্যা চালিয়ে ১৪ হাজারেরও বেশি মানুষকে মেরে ফেলে। ইউক্রেনের সঙ্গে হাত মিলিয়ে ওবামা সরকার যে ঘৃণ্য অপরাধগুলি করেছে, তার মধ্যে এটাই সবচেয়ে বড়ো মাপের।
৪. ২০১৪ সালে দনবাসের জনগণ সশস্ত্র হয় এবং কিভের আক্রমণকে প্রতিরোধ করে। এই যুদ্ধ থেকেই গণপ্রজাতন্ত্রী দোনেৎস্ক ও গণপ্রজাতন্ত্রী লুহানস্ক ঘোষিত হয়(দোনেৎস্ক ও লুহানস্ক দুটিই দনবাসের দুটি শহর)। ২০১৪ ও ২০১৫ সালের মিনস্কের আলোচনায় ইউক্রেন দনবাসের বিশেষ সায়ত্তশাসনের মর্যাদাকে স্বীকৃতি দেয়। ইউক্রেন ও রাশিয়ার সেনাবাহিনী সহ সকল বিদেশি সৈন্য দনবাস ত্যাগ করবে, এই মর্মে সব পক্ষই সহমত হয়।
৫. ইউক্রনের নয়া–নাৎসি গোষ্ঠী(অতি দক্ষিণপন্থী)এবং সেখানকার বর্তমান প্রেসিডেন্ট ভলোদিমির জেলেনস্কি রুশ-বিরোধী নাৎসি। গত বছর তিনি দনবাসকে ‘মুক্ত’ করার কথা ঘোষণা করেন এবং রুশ অধিবাসীদের ‘রাশিয়ার চলে যেতে’ বলেন। গত বছর থেকে কিভ সেনাবাহিনীর অনেকগুলি ব্রিগেড দিয়ে দনবাসকে ঘিরে রেখেছে।
৬. ২০২১ সালের ১৬ ডিসেম্বর রাষ্ট্রপুঞ্জ ‘নাৎসিবাদ, নয়া-নাৎসিবাদ এবং বর্তমান রূপের জাতিবিদ্বেষকে উস্কে দেয়, এমন সকল কার্যকলাপের বিরুদ্ধে লড়াইয়ে’ প্রস্তাব গ্রহণ করে। মাত্র দুটি দেশ এই প্রস্তাবের বিরোধিতা করে, ইউক্রেন ও আমেরিকা।
৭. আমেরিকা ইউক্রেনকে ন্যাটোর অন্তর্ভূক্ত করতে চায়, কারণ সেটা হলে রুশ সীমান্তে আমেরিকার ক্ষেপণাস্ত্র ছড়িয়ে রাখার বন্দোবস্ত আরও শক্তিশালী হবে। ইতিমধ্যেই স্লোভেনিয়া ও রোমানিয়ায় মার্কিন ক্ষেপণাস্ত্র রাখা রয়েছে, আমেরিকার আলাস্কার কাছে রুশ সীমান্ত রয়েছে, পোল্যান্ডে আমেরিকার সামরিক ঘাঁটি রয়েছে এবং লিথুয়ানিয়া, এস্তোনিয়া ও লাতভিয়ায় আমেরিকার সামরিক অস্ত্রশস্ত্র রয়েছে। ২০১৯ সালে আমেরিকা রাশিয়ার সঙ্গে মাঝারিপাল্লার পারমাণবিক অস্ত্র তৈরি ও স্থাপন সংক্রান্ত চুক্তি থেকে নিজেকে সরিয়ে নেয়, এই চুক্তি তার আগে অবধি দু’পক্ষকে পরস্পরের সীমান্তে ক্ষেপণাস্ত্র স্থাপন করা থেকে বিরত রেখেছিল।
৮. জানুয়ারির শেষ সপ্তাহ থেকে কিভ ধারাবাহিক ভাবে দনবাসকে ঘিরে সেনা বাড়াচ্ছিল। অন্য একটি রিপোর্ট অনুযায়ী সেখানে ইউক্রেন বাহিনীর ১৩টি ব্রিগেড জড়ো হয়েছে এবং দোনেৎস্কের কিছু এলাকা তারা দখলও করে নিয়েছে। এমন খবরও পাওয়া যাচ্ছে যে, ইউক্রেনের সেনা শিবিরে মার্কিন সামরিক পরামর্শদাতা ও বেসরকারি সামরিক ঠিকেদাররা(ব্ল্যাকওয়াটার অ্যাকাডেমির মতো) রয়েছে। ২১ ফেব্রুয়ারি ইউক্রেনিয়ান বাহিনী ২৪ ঘণ্টায় দোনেৎস্ক ও লুহানস্কের ওপর ১৫০০ বার গোলাবর্ষণ করে। তাতে বেশকিছু অসামরিক পরিকাঠামো ও পাওয়ার প্ল্যান্ট ধ্বংস হয়ে যায়।
৯. সাত বছরের সংযমের পর এই সপ্তাহেই রাশিয়া গণপ্রজাতন্ত্রী লুহানস্ক ও গণপ্রজাতন্ত্রী দোনেৎস্ককে স্বীকৃতি দেয়। বহুদিন ধরেই এটা এই দুই স্বাধীন প্রজাতন্ত্রের দাবি ছিল। এর ফলে এই দুই অঞ্চল ইউক্রেনের সায়ত্তশাসিত অঙ্গ অবস্থা থেকে বিচ্ছিন্ন প্রজাতন্ত্রে পরিণত হল। এই দুই স্বাধীন রাষ্ট্রকে স্বীকৃতি দেওয়ার পর রাশিয়া স্পষ্ট ভাবে ঘোষণা করে যে এদের দখল করার কোনো বাসনা রাশিয়ার নেই। ২২ ফেব্রুয়ারি এই দুই রাষ্ট্র আনুষ্ঠানিক ভাবে তাদের এলাকায় ‘ইউক্রেন সরকারের সামরিক আগ্রাসন’কে প্রতিরোধ করার জন্য সামরিক সহায়তার অনুরোধ জানায়। এর ফলে ইউক্রেনের বাহিনী টানা গোলাবর্ষণ করে, তাতে দনবাস অঞ্চলে বসবাসরত ৪০,০০০ রুশ নাগরিক ঘর ছেড়ে রাশিয়ার মূল ভূখণ্ডে চলে যেতে বাধ্য হয়।
১০. ২৪ ফেব্রুয়ারি রাশিয়া ইউক্রেনের বিরুদ্ধে ‘বিশেষ সামরিক অভিযান’-এর নির্দেশ দিয়েছে। দনবাস অঞ্চলে দোনেৎস্কের বাহিনী ও ইউক্রেন সেনার মধ্যে লড়াই তীব্র হওয়ার মধ্যেই এই সিদ্ধান্ত নিয়েছে রাশিয়া। ইউক্রেনের সামরিক লক্ষ্যবস্তুগুলির ওপর রুশ আক্রমণের উদ্দেশ্য সে দেশকে দখল করা নয়। পুতিনের কথা অনুযায়ী, “ইউক্রেনের কোনো এলাকা দখল করার পরিকল্পনা আমাদের নেই। আমরা কোনো কিছু জোর করে চাপিয়ে দেব না”। কিভের মার্কিন পুতুল সরকার দনবাস অঞ্চল এবং সেখানকার দুই স্বাধীন প্রজাতন্ত্রের ওপর যে ব্যাপক আক্রমণ নামিয়েছে, তার জবাবেই রাশিয়া ইউক্রেনের সামরিক লক্ষ্যবস্তুগুলির ওপর আক্রমণ চালাচ্ছে।
১১. রাশিয়াকে ইউক্রেনে ‘হানা’ দেওয়ার জন্য উস্কানি দেওয়ার মার্কিন পরিকল্পনার অঙ্গ হল দনবাস আক্রমণ। আমেরিকার লক্ষ্য হল অশান্তি ও যুদ্ধ বাধানো, যাতে তারা অস্ত্র বিক্রি করতে পারে এবং ক্রমাগত ইউক্রেনকে সামরিক সাহায্য বাড়ানোকে ন্যায্যতা দিতে পারে। বিশ্ব জুড়ে জনমতের ক্ষেত্রে রাশিয়াকে বিচ্ছিন্ন করা, জার্মানি এবং আমেরিকার অন্যান্য মিত্রশক্তিকে রাশিয়ার সঙ্গে বাণিজ্যিক সম্পর্ক বিশেষত তেল কেনা বন্ধ করতে চাপ দেওয়ার লক্ষেই আমেরিকা রাশিয়ার ‘হামলা’ নিয়ে জোরেশোরে প্রচার করছে। আমেরিকা দীর্ঘদিন ধরে ‘নর্দ স্টিম ২’ কার্যকর করার বিরোধিতা করছে(রাশিয়া থেকে জার্মানি ও ইউরোপে দ্বিগুন পরিমাণ প্রাকৃতিক গ্যাস পাঠানোর পাইপলাইন)।
১২. দুনিয়ার নানা প্রান্ত থেকে সব পক্ষের কাছে আক্রমণ বন্ধ করা, আলোচনা চালানো এবং সংঘর্ষ থামিয়ে শান্তিচুক্তির পথে হাঁটার জন্য আহ্বান জানানো হচ্ছে। যে কোনো আগামী আলোচনা, অঞ্চলের সমস্ত দেশের শান্তিপূর্ণ সহাবস্থানের লক্ষে নতুন চুক্তির ভিত্তি হবে ২০১৫ সালে মিনস্কের রাশিয়া, ইউক্রেন, জামার্নি ও ফ্রান্সের চুক্তি। অন্যদিকে রাশিয়ার চাহিদা হল, ইউক্রেনকে ন্যাটোতে যুক্ত না করা এবং দনবাসে গণহত্যাকারী যুদ্ধ বন্ধ করা।
সংক্ষেপে
ইউক্রেনের বর্তমান অস্থিরতা সাম্রাজ্যবাদীদের মধ্যেকার দ্বন্দ্ব তীব্র হয়ে ওঠার প্রকাশ। নির্দিষ্ট ভাবে বলতে গেলে, মার্কিন সাম্রাজ্যবাদ এবং ন্যাটোয় তাদের মিত্র দেশগুলির উস্কানি এবং যুদ্ধের দামামা বাজানোর লক্ষ্য হল, ভাবে ইউরোপে বাণিজ্য ও বিনিয়োগের ক্ষেত্রে এবং সামগ্রিক ভাবে দুনিয়ার বর্তমান সাম্রাজ্যবাদী বিভাজনকে পরিবর্তন করা; পাশাপাশি বিভিন্ন সাম্রাজ্যবাদী শক্তির প্রভাব ও আধিপত্যের এলাকার পুনবির্ভাজন। অন্যদিকে, রাশিয়ার দনবাসকে রক্ষা করা এবং ইউক্রেনের সামরিক লক্ষ্যবস্তুগুলির ওপর হামলা করার লক্ষ্য হল, বর্তমান ব্যবস্থাকে সংহত করা যা কিনা তাদের স্বার্থের অনুকূলে রয়েছে।
এই যুদ্ধের অগ্নিশিখা ইউক্রেন ও গোটা ইউরোপে ছড়িয়ে পড়ার বিপদ সামনে রয়েছে, তা হলে সেটা অঞ্চলের শ্রমিক ও জনগণের ব্যাপক দুর্ভোগের কারণ হয়ে উঠবে। ইউক্রেনের অবিরাম আক্রমণের ফলে দোনেৎস্ক ও লুহানস্কের জনগণ সবচেয়ে বেশি দুর্ভোগ সহ্য করছেন। অতএব এই দুই এলাকার মানুষ তাদের জাতীয় আত্মনিয়ন্ত্রণের অধিকার ঊর্ধ্বে তুলে ধরা ও যত বেশি সম্ভব আন্তর্জাতিক সমর্থন সংগ্রহের জন্য ন্যায্য লড়াই লড়ছেন। ভুগছেন ইউক্রেনের জনগণও, কারণ দোনবাসের বিরুদ্ধে যুদ্ধ করে সে দেশের ফ্যাসিবাদী সরকার দেশের সম্পদ নষ্ট করছে, গণহন্তারক যুদ্ধ, আগ্রাসন ও এলাকা দখলের জন্য তারা নিজের দেশের জনগণ ও সেনাদের মৃত্যুর কারণ হয়ে উঠছে।
সাম্রাজ্যবাদী দেশগুলির অশান্তির ফলে সর্বহারা ও অন্যান্য নিপীড়িত শ্রেণিগুলির শোষণ তীব্র হচ্ছে, এতে বিভিন্ন দেশের সর্বহারা বিপ্লবীদের কাছে পচাগলা পুঁজিবাদী ব্যবস্থার মুখোশ খুলে দেওয়ার অনুকূল পরিস্থিতি তৈরি হচ্ছে। বিপ্লবী কমিউনিস্ট পার্টিগুলিকে নিজেদের শ্রেণির উদ্যোগ ও শক্তি বাড়াতে হবে, ফ্যাসিবাদী শক্তি ও সাম্রাজ্যবাদী দেশগুলির যুদ্ধের বিরুদ্ধে লড়তে হবে এবং সংশ্লিষ্ট দেশগুলিতে বিপ্লবী সংগ্রামকে এগিয়ে নিয়ে যেতে হবে।