একশো চার বছর পার। এতবার এতরকম ভাবে এতরকম জায়গায় বিশ্লেষণ, কাঁটাছেড়া হবার পরেও টপিকটা নির্জীব হয়না, পুরাতন হয় না। সভ্যতার দৌড় যত এগোয়, ইতিহাস তত বেশি নৈপুণ্য নিয়ে ধরা দেয়। এটি ঐতিহাসিক স্বীকার্য। নভেম্বর বিপ্লবের ক্ষেত্রে ব্যাপারটি আরও উৎকৃষ্ট সত্য। মার্ক্সবাদী সাহিত্য সমালোচক টেরি ঈগলটন, তার একটি লেখায় শিল্প সাহিত্যের ঐতিহাসিক ক্রমবিকাশ প্রসঙ্গে লিখতে গিয়ে লিখছেন, আধুনিক বিশ্বের ইতিহাস, সভ্যতার যে কতকগুলি উল্লম্ফনের মধ্যে দিয়ে আবাহিত হয়েছে তার প্রথম ও দ্বিতীয় যদি হয় পশ্চিমের ইউরোপীয় রেনেসাঁ ও ইংল্যান্ডেরর শিল্প বিপ্লব, তবে তৃতীয়টি একান্ত অবশ্যই রুশ দেশে নভেম্বর মাসে ঘটে যাওয়া সমাজতান্ত্রিক বিপ্লব।
১৯১৭ সালের রুশ নভেম্বর বিপ্লবের মধ্যে দিয়ে প্রথম জন্ম নেওয়া সমাজতান্ত্রিক রাষ্ট্র সোভিয়েত ইউনিয়ন পৃথিবীর ইতিহাসের নিজস্ব মেদঝাড়া গতির একটি অনিবার্য অভিব্যক্তি ছিল। যেটি একইসাথে ইতিহাসেরই কতকগুলি মৌলিক প্রশ্নের সমাধাকে তার রক্তক্ষয়ী ভাঙন এবং অতি অবশ্যই নতুন সমাজের গড়নের মধ্যে দিয়ে নিজেকে সূচিত করে। ইতিহাস রক্তক্ষয়ী। রক্তক্ষয়ীই। এই সত্যটি পরিষ্কার অনুভূত করা কিংবা প্রকাশ করা এখনকার সুখ্যাত, কুখ্যাত, হরেক রকম ভাবে খ্যাত বুদ্ধিজীবীদের কাছে অস্বস্তিকর হতে পারে। তার নানানরকম এযুগীয় ব্যাখ্যা হাজির হতে পারে। কিন্তু সেই বাল্যখিল্যতা নিয়ে শব্দ খরচ করে নভেম্বর বিপ্লবের গুরুত্বকে অপমান করা অপরাধ। বরং ঠিক যে গুণগত অভিব্যক্তিটি নভেম্বর বিপ্লবকে যুগের পর যুগ ধরে প্রাসঙ্গিক করে রেখেছে, এবং আজও রাখছে, সেটি নিয়ে আলোচনা জরুরি। রক্তক্ষয়ী ভাঙনে আটকা নয়, প্যারি কমিউনের ঐতিহাসিক অভিজ্ঞতা থেকে নির্দিষ্ট শিক্ষা নিয়ে নতুন সমাজ গঠন। রূপদান। হাজার হাজার বছর ধরে পায়ের তলায় পিষে মরতে থাকা অথচ তাদেরই শ্রম দিয়ে তৈরি পুঁজির পাহাড়ে গুটিকয়েক লোকের বিলাসী কুকর্মে মত্ত থাকা সমাজটিকে ভেঙে এমন সমাজ তৈরি করা যায় এবং তাকে টিকিয়ে রাখা যায়, যা শ্রমিকদের স্বার্থে চলবে। এই সত্যটিকে পৃথিবীর সামনে প্রতিষ্ঠা করা।
ইতিহাস লিখব না। লেখাটির পাঠকবৃত্ত সে ইতিহাস জানেন। আজকের দিনে নভেম্বর বিপ্লবের উক্ত গুণগত অভিব্যক্তির ঐতিহাসিক তাৎপর্যটা লেখার চেষ্টা করব।
ইউরোপীয় রেনেসাঁর প্রারম্ভিক যুগ থেকেই খুব নিখুঁত ভাবে সারা পৃথিবী জুড়ে দার্শনিক মহলে ‘নতুন সমাজ গড়তে হবে’ এই চর্চাটি তীক্ষ্ণ হতে থাকে। ইউটোপিয়ান মতাদর্শগুলি চর্চিত হয়। ‘সকলেই সমান’ গোছের কিছু প্রত্যয়ী দার্শনিকরা নতুন সমাজ ঠিক কেমন হবে সেসব নিয়ে খুব চিন্তিত হন। অনেক বুদ্ধিমান লোক আবার বুদ্ধি খাটিয়ে সম্রাট সম্রাজ্ঞীদের কাছ পর্যন্ত যান, নিজের বুদ্ধি নিয়ে। অন্যদিকে ইউরোপ জুড়ে ব্যাপক সামন্ততন্ত্র বিরোধী যুদ্ধ ততদিনে আকার নিতে শুরু করেছে। সামন্ততন্ত্র ভেঙে যন্ত্রসভ্যতার প্রবেশ ঘটছে পশ্চিমী দেশগুলিতে। বিকেন্দ্রীভূত পুঁজি জমতে থাকে। শিল্প গড়ে উঠতে থাকে। সমাজ গ্রাম থেকে শহর, কৃষি থেকে শিল্পনির্ভরতা বাড়ায়। ব্যাপক গণপরিযানে পশ্চিমের দেশগুলি নতুন করে নিজেকে সাজিয়ে তুলতে থাকে। বড় বাজারগুলি গড়ে ওঠে। বিভিন্ন বাজারগুলির মধ্যে যোগাযোগ নিকট হয়। বাজারে টিকতে পুঁজি তার বর্ধনশীল উৎপাদনকে ধীরে ধীরে লাগামছাড়া করে দিতে থাকে। কিন্তু সমস্যা যেটা থেকে যায়, চিন্তাশীলরা ইউটোপিয়া থেকে আর এগোতে না পারার ফলে ‘সবাই সমান’ গোছীয় ব্যাপারটা আর দাঁড়ায় না। পুঁজিবাদ নিয়ে কাঁটাছেঁড়া চলতে থাকে অর্থনীতিবিদ, সমাজ বিজ্ঞানীদের মহলে। পুঁজিবাদই সর্বেসবা গোছের নিদান আসে। এবং এরই মধ্যে ইতিহাস এক কাণ্ড ঘটিয়ে ফেলে। এক জার্মান এবং আর এক ইংলিশ, দুই বুড়ো কতকগুলি জাঁদরেল থিওরি দিয়ে পুঁজিবাদ যে সর্বেসর্বা নয়, তা ইতিমধ্যেই পাঁকগ্রস্ত, ক্ষয়শীল- তা দর্শন, বিজ্ঞান, গণিত, অর্থনীতি, সমাজতত্ত্ব ইত্যাদি বিবিধ শাস্ত্রের কৌণিক ধার দিয়ে প্রমাণ করে ছাড়েন। এবং শুধু তাই নয়, যে ইউটোপিয়া পায়ের তলায় মাটি পাচ্ছিল না, এনারা সেই ভবিষ্যৎ নতুন সমাজের নিদান দেন জরুরি বৈজ্ঞানিক ভিত্তিতে। দেখান আজকের কারখানাগুলিতে রক্ত ঝড়াতে থাকা শ্রমিকরাই হবে এই আগামীর কান্ডারী। এবং তা হবে ইতিহাসের নিজস্ব গতির নিজস্ব অভিব্যক্তি।
তাঁরা শুধু তাদের এই বক্তব্যকে তাত্ত্বিক চর্চ্চায়ই সীমাবদ্ধ রাখলেন বরং তাঁরা সজোরে ঘোষণা করলেন যে দুনিয়াটাকে ব্যখ্যা করাটা প্রধান কাজ নয়, আসল কাজ হলো তাঁকে বদল করা। এই দুনিয়া বদলের স্বপ্ন নিয়ে, একটা শোষনহীন সমাজ গড়ে তোলার লক্ষ্যে তাঁরাই প্রথম গড়ে তুললেন শ্রমজীবী মানুষদের প্রথম আন্তর্জাতিক। এই সংগঠনগুলোর পক্ষ থেকে একদিকে যেমন তাঁরা দেশে দেশে শ্রমিক শ্রেণির আন্দোলনকে অকুন্ঠভাবে সাহায্য করলেন পাশাপাশি সেই আন্দোলনগুলোর (বিশেষতঃ প্যারি কমিউনের)সাফল্য এবং ব্যর্থতাকে বিশ্লেষণ এবং সংশ্লেষণ করে বাস্তব অবস্থার বাস্তব বিশ্লেষণের মধ্যে দিয়ে ইতিহাসকে ছেনে তুলে আনলেন সর্বহারা একনায়কত্বের মূর্ত রূপটি এবং ক্ষমতা দখলের প্রশ্নেও নিয়ে এলেন একগুচ্ছ শিক্ষামালা। বস্তুত এই শিক্ষামালাই বলশেভিক বিপ্লবের সাফল্যের তাত্ত্বিক বনিয়াদটিকে গড়ে দিয়েছিল। ভ্লাদিমির ইলিচ লেনিন নির্দিষ্ট দেশকালের নিরিখে যাকে তাত্ত্বিকভাবে আরো সমৃদ্ধ করলেন। ফলতঃ প্যারি কমিউনের সীমাবদ্ধতাকে অতিক্রম করলেন রুশদেশের শ্রমিকরা। যে কাণ্ড সারা বিশ্বকে কাঁপিয়ে দিয়েছিল। শ্রমিকরা রাষ্ট্র পরিচালনা করতে পারে। নিজেদের দেশ গড়তে পারে। তারা গড়ছেন। গড়লেন। রুশ শ্রমিকরা যে ইতিহাস নির্মাণ করলেন, তার ভিত্তির ওপর দাঁড়িয়ে তাকে আরও একধাপ এগিয়ে দিলেন চিনের শ্রমিক-কৃষকরা। পিছিয়ে থাকা দেশে জনগণের শাসন প্রতিষ্ঠার নতুন পথ তারা দুনিয়াকে দেখালেন। মার্কস-লেনিনের অবদানকে সে দেশে সৃজনশীল ভাবে প্রয়োগ করলেন তারা। প্রতিষ্ঠা করলেন শ্রমিক শ্রেণির নেতৃত্বে কৃষি বিপ্লবের তত্ত্ব।
ভারতবর্ষের ইতিহাসও ন্যায়যুদ্ধের গৌরবে ভরা। ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানি এদেশে একচেটিয়া বাণিজ্যের অধিকার, ধীরে ধীরে ঔপনিবেশিক শাসন প্রতিষ্ঠা, এগুলির স্বাভাবিক প্রতিঘাত প্রকাশ পেতে থাকে। স্থানীয় সামন্তপ্রভুদের বিরুদ্ধে ভারতের কোণায় কোণায় আমিষ বিদ্রোহ দানা বাঁধে। অত্যাচারিতরা যুদ্ধে নামেন। সন্ন্যাসী ফকির বিদ্রোহ, ওয়াহাবি, ফরাজি, সাঁওতাল বিদ্রোহ, নীল বিদ্রোহ, কোল বিদ্রোহ, মুণ্ডা বিদ্রোহ, মোপালা বিদ্রোহ সশস্ত্র চেহারা নিয়ে ব্রিটিশ সাম্রাজ্যের ভিত এদেশীয় সামন্তব্যবস্থার ভিত নাড়িয়ে দেয়। ব্রিটিশ বিরোধী স্বদেশি আন্দোলন দানা বাঁধে। সশস্ত্র আকার নেয়। বাংলা, বিহার, ওড়িশা, পাঞ্জাব, মহারাষ্ট্র উত্তাল হয়ে ওঠে। সামগ্রিক ভাবে ওই সময়টির পর্যালোচনা করলে এই সময়ের যাবতীয় বিদ্রোহ, অ্যান্দোলনগুলির দুটি চরিত্র পাওয়া যাবে। এক তার কৃষক চরিত্র অর্থাৎ সামন্ত বিরোধিতা, আর এক হল জাতীয়তাবাদী চরিত্র অর্থাৎ ব্রিটিশ বিরোধিতা। কিন্তু খেদ রয়ে গেল সেই। কৃষক বিদ্রোহগুলি নিকট লক্ষ্যহীনতায় ভুগলো, অপরদিকে ব্রিটিশ বিরোধী স্বদেশি আন্দোলন জমিদার আর ইংরেজদাস এদেশীয় বড় পুঁজির মালিকদের দল কংগ্রেসের দালালির একচেটিয়া ‘সত্যাগ্রহের’ দিকে ঝুঁকলো। যারা এর বাইরে গিয়ে সশস্ত্র সংগ্রামের মধ্যে দিয়ে দেশের স্বাধীনতার স্বপ্ন দেখছিলেন তাদের মধ্যেও একটা বড়ো অংশ এই স্বাধীনতা আন্দোলনের সঙ্গে এ দেশের কৃষি বিপ্লবের প্রশ্নটির আন্তঃসম্পর্ককে সঠিকভাবে উপলব্ধি করতে পারলেন না। ঠিক এই ঐতিহাসিক সময় পর্যায়েই, যখন একদিকে প্রথম মহাযুদ্ধের সমাপ্তি ঘটছে, ভারতীয়রা ব্রিটিশ বাহিনীর হয়ে যুদ্ধে বিধ্বস্ত হচ্ছে, অন্যদিকে এদশের কৃষক বিদ্রোহগুলি মুখ থুবড়ে পড়েছে, স্বদেশি আন্দোলনে যুগান্তর, অনুশীলনের মত সৎ সাহসী, সঠিক কর্মসূচি পালনে প্রাজ্ঞরা পথ হাতড়াচ্ছেন, সেই সময়েই রুশ দেশে ১৯১৭ সালের নভেম্বর মাসে শ্রমিকরা ক্ষমতা দখল করলেন। নতুন রাষ্ট্র, শ্রমিকদের রাষ্ট্র সোভিয়েত ইউনিয়ন গড়ে তুললেন। বিশের দশকের ভারতবর্ষের সংগ্রামী ইতিহাসে প্রথম সমাজতান্ত্রিক ভাবধারা জন্ম নিল। কমিউনিস্ট পার্টি তৈরি হল। সমাজতান্ত্রিক এইচএসআরএ তৈরি হল। দেশের বড় বড় শিল্পকেন্দ্রগুলিতে শ্রমিকরা আন্দোলনে উত্তাল হলেন। ব্রিটিশদের সাথে আলোচনা করে ভাগাভাগি করে মিটমাট করে তাদেরকে এদেশে নিশ্চিন্তে রেখে, ইংরেজদাস এদেশীয় বড় পুঁজিপতিদের শাসনের আওতাধীনেই যে ‘বিকল্প’ স্বরাজের জলে গান্ধি দেশবাসীকে ডোবাচ্ছিলেন, তার বদলে শ্রমিক কৃষকদের হাতে গড়ে উঠবে নতুন স্বাধীন মুক্ত ভারতবর্ষ- এই আওয়াজ উঠতে শুরু করল। অর্থাৎ, লক্ষ্য করুন, নভেম্বর বিপ্লব এদেশীয় বিপ্লবীদের ইতিহাসটা ধরিয়ে দিল। আবারও, ভাঙনের রক্তক্ষরণকে গড়নের জয়গাথার দিকে সূচিত করার দিশা দিল। যেটা কিনা অধরা ছিল। এবং এই অভিব্যক্ত দিশাটাই নভেম্বর বিপ্লবের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ গুণগত অবদান।
প্রশ্ন হল নভেম্বর বিপ্লব দিয়ে গেল যা, তার বর্তমানিক কী? তা কি তার তাত্ত্বিক অবদানেই সীমাবদ্ধ। বিশ্বজুড়ে যে দুটি বৈরী পক্ষকে তা আমাদের চিনিয়ে দিয়েছিল, তার বর্তমানিক কী? আজকের পৃথিবী তো ঘোলা জল। শ্রমিক পক্ষের নাম করেই শ্রমিক শোষণের পাহাড়ে লাফানো মোটামুটি ডাইনোসর গোছের। পাশে শান্তি আন্দোলন, শান্তি দিয়ে বিপ্লব, মারামারি থেকে দূর বহুদূর শ্রমিক পক্ষ ছাতা গজিয়েছে। অবশ্য শ্রমিক পক্ষের ধ্বজাধারী এই শান্তিশিবির সেকালেও ছিল। কিন্তু নভেম্বর বিপ্লব যে বলশেভিক মেনশেভিক যেকোনো প্রচ্ছদেই হোক, শিবির ভাগ করে দিয়েছিল, এখন তার প্রকাশ কি আদৌ আছে? যে বিকল্প শ্রমিকের দেশের ছবি তা দেখিয়েছিল, তা কি সম্পূর্ণ ধ্বংসপ্রাপ্ত? আলোচনাটা করা যাক। সংক্ষেপে।
ভারতের ইতিহাসে চল্লিশের দশক খুব ঘটনাবহুল এবং ঐতিহাসিক। অষ্টাদশ, ঊনবিংশ শতাব্দীর যে কৃষক বিদ্রোহগুলি তার নিকট সীমা ভাঙতে পারেনি, এই দশকের সেই একই চরিত্রসম্পন্ন কৃষক সংগ্রাম তার অনিবার্য ঐতিহাসিক ঐতিহ্যকে ধরে রেখে ক্ষমতা দখলের সংগ্রামে অংশ নেয়। তেভাগা আন্দোলন জঙ্গি অর্থনৈতিক আন্দোলন, তাতে সন্দেহ নেই। কিন্তু কৃষক আন্দোলনের ঐতিহ্য বহনকারী এই আন্দোলন তার আকারগত সীমাবদ্ধতা এবং নেতৃত্বের অপারগতার কারণেই ক্ষমতা দখলের দিশায় যায়নি। উল্টোদিকে তেলেঙ্গনার আন্দোলন প্রথম থেকে সরকারি বাহিনী হটিয়ে নিজেদের অর্থাৎ জনতার রাজ প্রতিষ্ঠার লড়াই ছিল। এক কোটি জনগণ নিয়ে, ৪০ হাজার বর্গমাইল জমি নিয়ে তা জনতার ‘লাল এলাকা’ তৈরি করেছিল। সশস্ত্র উপায়েই। এরপরের ষাটের দশক, যা পৃথিবী জোড়া বিপ্লবী সংগ্রামের উত্তাল সময়, তা থেকে সত্তরের দশকের নকশালবাড়ি আন্দোলন(যা চিন বিপ্লবের পথকে মূলগত ভাবে ভারতবর্ষের মুক্তির পথ বলে মনে করেছিল) কৃষক সংগ্রামকে তার আপাত সীমাবদ্ধতা থেকে টেনে বার করে এনে ক্ষমতা দখল এবং রাষ্ট্র ক্ষমতা দখলের দিকে নিয়ে গিয়েছিল। প্রকাশ্যে বলেছিল সংসদীয় প্রহসনকে লাথি মেরে ভেঙে দেবার কথা। শুধু ভেঙেই ক্ষান্ত থাকা নয়, নতুনটাকে গড়া। সে শুধু গান্ধি, বিদ্যাসাগর, রামমোহন, বিবেকানন্দের মূর্তি ভেঙেই ক্ষান্ত থাকেনি; ভগৎ সিং, মঙ্গল পান্ডের মূর্তি গড়তে বলেছিল। এ কাজে তাদের প্রাণিত করেছিল, সে সময় চিনে চলমান সাংস্কৃতিক বিপ্লবের কর্মকাণ্ড। আজকের দিনে সারা পৃথিবী জুড়ে চিনের জনগণতান্ত্রিক বিপ্লবের শিক্ষাকে নিজের নিজের দেশের নির্দিষ্ট পরিস্থিতিতে প্রয়োগ করে লড়াই করছেন বিভিন্ন দেশের সংগ্রামী জনগণ। বহু প্রশ্ন, বিতর্ক, ভুল, অসামঞ্জস্য এবং আত্মত্যাগের মধ্যে দিয়েও এই শোষণের পাহাড়কে ভেঙে বিকল্প নির্মাণের কথা তারা বলে যাচ্ছে সমানে। বাকিদের মত পোস্টারে, দেওয়ালে, আর শুধু পথসভায় নয়। সন্ন্যাসী ফকির বিদ্রোহ, সাঁওতাল বিদ্রোহ, মুণ্ডা বিদ্রোহ, নীল বিদ্রোহ, তেভাগা সংগ্রাম, তেলেঙ্গানা সংগ্রাম, নকশালবাড়ি সংগ্রামের ঐতিহাসিক সাক্ষ্য ও ঐতিহ্য বহন করে রক্তক্ষয়ী গেরিলা যুদ্ধের ময়দানে। হাজার হাজার মৃত্যু, গ্রেফতারি, বিপর্যয় পেরিয়ে আজও ভারত, ফিলিপিন্স, কানাডা, ফ্রান্স থেকে ব্রাজিল, পেরু, নেপাল, চিলি, বলিভিয়া, তুরস্ক, আফগানিস্তানে সেই বলশেভিক বিপ্লবের ঐতিহ্য বহন করে যুদ্ধ চালিয়ে যাচ্ছে ও বিকল্প নির্মাণে পালটা বিপ্লবী সরকার গড়ার লড়াই চালিয়ে যাচ্ছে গেরিলারা। তারাই আজকের বলশেভিক।
শিবির মিশে যায়নি। শিবির এখনও আছে। শ্রমিক, কৃষকের নেতৃত্বে যে বিকল্প সমাজ গড়ার লড়াই নভেম্বর বিপ্লবের মধ্যে দিয়ে বলশেভিকরা সূচিত করেছিল, সেই সংগ্রামী শিবির এখনও লড়ে যাচ্ছে। অন্যদিকে পরিস্থিতি নেই, সময় আসেনি, শান্তিপূর্ণ পথে করতে হবে, সংসদে যেতে হবে, কমিউনিষ্ট পার্টি গড়ে ওঠেনি, একবিংশ শতকের গণতন্ত্রের বাস্তবতায় দাঁড়িয়ে মার্ক্সবাদকে নতুনভাবে আগে মতাদর্শগতভাবে পুনরুজ্জীবিত করতে হবে, মানুষ এখনও নির্বোধ তাকে আগে জাগাতে হবে মার্কা সংগ্রামকে যুদ্ধকে যেকোনো অছিলায় টেনে আটকে রাখা থেকে শুরু করে প্রকাশ্যে পুঁজির দালালি মণ্ডিত শিবিরটিও এখনও আছে। তারাও সংগ্রামরত, এই সমাজটিকে টিকিয়ে রাখতে। নভেম্বর বিপ্লব যে গুণগত ঐতিহাসিক অভিব্যক্তি সারা পৃথিবীকে উপহার দিয়েছিল, তার ধারাবাহিকতা আজও বর্তমান। নভেম্বর বিপ্লব বর্তমানিক। আজকের বলশেভিকরা তার যাবতীয় শিক্ষা, ঐতিহ্য, দায়িত্ব বহন করছে। আর কেউ নন।