অবশেষে আমাদের অন্নদাতাদের চলমান সংগ্রাম জয়যুক্ত হল। একবছর ব্যাপী মরণপন লড়াই, ৭০০ কৃষকের মৃত্যু, রাষ্ট্রীয় সন্ত্রাস ও কুৎসার মোকাবিলা করে কৃষকরা তাদের জয় ছিনিয়ে নিতে সমর্থ হয়েছেন। তাদের প্রতিরোধের সামনে নতজানু হয়েছে ফ্যাসিস্ট সরকার। এই জয় যে মানুষেরা এই স্বৈরাচারী, অগণতান্ত্রিক, কর্পোরেট দালাল সরকারের বিরুদ্ধে নানান ভাবে প্রতিবাদ- আন্দোলন করছেন তাদের কাছে এক অনুপ্রেরণাও বটে। আন্দোলনের নেতৃত্ব সংযুক্ত কিষাণ মোর্চার প্রতিক্রিয়া এক্ষেত্রে খুবই গুরুত্বপূর্ণ। তারা একদিকে নরেন্দ্র মোদির সিদ্ধান্তকে স্বাগত জানিয়েছেন তেমনি স্পষ্ট ভাষায় বলেছেন যতক্ষণ না সংসদীয় রীতিনীতি মেনে আইনগুলি প্রত্যাহার হচ্ছে ততক্ষণ তারা দিল্লি সীমান্তে অবস্থানে থাকবেন। একই সঙ্গে তারা মনে করিয়ে দিয়েছেন বিদ্যুৎ বিল ( সংশোধনী) ২০২০ প্রত্যাহার এবং ফসলের ন্যূনতম সহায়ক মূল্য নিশ্চিতকরণের কথা।
চলমান কৃষক আন্দোলনের বিজয় অর্জনের গুরুত্ব বহুমাত্রিক। এই আন্দোলন প্রথম থেকেই নরেন্দ্র মোদির নেতৃত্বাধীন ফ্যাসিবাদী শাসনের বিরুদ্ধে জনগণের মনে আশার সঞ্চার করেছিল। ২০১৪ সালে ক্ষমতাসীন হওয়ার পর থেকে মোদি সরকার কর্পোরেট স্বার্থবাহী ( বিদেশি ও মুৎসুদ্দি পুঁজিপতি) একের পর এক নীতি অভূতপূর্ব দ্রুততায় লাগু করতে শুরু করে। এক্ষেত্রে পরিষ্কার ভাবে বলা প্রয়োজন নব্বই-এর দশকে বিশ্বব্যাঙ্ক,আইএমএফ, বিশ্ব বাণিজ্য সংস্থা প্রভৃতি আন্তর্জাতিক অর্থলগ্নি প্রতিষ্ঠানগুলির অভিভাবকত্বে উদারীকরণ – বেসরকারিকরণ-ভুবনায়নের মোড়কে ভারতের শাসকশ্রেণি যে আর্থিক সংস্কার কর্মসূচি চালু করে ( যার ভগীরথ ছিলেন নরসিমা রাও- মনমোহন সিং জুটি) নরেন্দ্র মোদি সরকারের গৃহীত কার্যক্রম তার ধারাবাহিকতা হলেও, প্রয়োগের প্রশ্নে মোদি সরকার অনেক বেশি দ্রুত ও নৃশংস।
বিভিন্ন অর্থনৈতিক ক্ষেত্রে বিদেশি পুঁজির অবাধ অনুপ্রবেশের লক্ষ্যে যাবতীয় বিধি নিষেধ প্রত্যাহার,রাষ্ট্রায়ত্ত সংস্থার বেসরকারিকরণ,জিএসটি, বিমুদ্রাকরণ, শ্রমকোড– এই ধারাবাহিক আক্রমণে জনজীবন বিপর্যস্ত হয়ে পড়ে।এই আক্রমণকে সমন্বিত করার জন্য একদিকে কেন্দ্রীয় সরকারের ক্ষমতা বৃদ্ধি করা হয়, অন্যদিকে দেশের যুক্তরাষ্ট্রীয় কাঠামো দুর্বল করে রাজ্যসরকারগুলিকে আরো শক্তিহীন করা হয়।এই জনবিরোধী নীতিগুলিকে মসৃণ ভাবে লাগু করার জন্য রাষ্ট্রীয় স্বয়ংসেবক সংঘ নির্ধারিত হিন্দুরাষ্ট্রের স্বপ্নকে মদত জোগানো হয়।সংখ্যালঘু মুসলমানদের দ্বিতীয় শ্রেণির নাগরিকে পরিণত করার লক্ষ্যে ঘৃণার মতাদর্শ ফেরি( গোমাংস নিষিদ্ধ করা,লাভজেহাদ,প্রকাশ্যে নামাজ পাঠে বাঁধা) করা হয়। কাশ্মীরে ৩৭০ ধারা প্রত্যাহার,সিএএ- এনআরসির মত বিভেদকামী বিষয়গুলিকে সামনে আনা হয়। একদিকে শ্রমিক,কৃষক, ক্ষুদ্র ব্যবসায়ী তথা বৃহত্তর জনসমাজ ভয়ংকর আর্থিক বিপর্যয়ের সন্মুখীন হয়,অন্য দিকে মহিলা,আদিবাসী,দলিত ধর্মীয় ও জাতিগত সংখ্যালঘুরা হিন্দুরাষ্ট্রের মতাদর্শ দ্বারা পদদলিত হতে থাকে।কোভিড অতিমারি পরিস্থিতিকে কাজে লাগিয়ে সরকার তাদের আক্রমণ আরো তীব্র করে যার সবচেয়ে বড়ো উদাহরণ কৃষি আইন ও শ্রমকোড।
মোদি সরকারের এই ধারাবাহিক আগ্রাসনের বিরুদ্ধে প্রথম সফল প্রতিরোধ গড়ে তোলে সংযুক্ত কিষাণ মোর্চার নেতৃত্বে গড়ে ওঠা আন্দোলন। তাদের দিল্লি অভিযান এবং সীমান্তে শিবির তৈরি করে ধারাবাহিক অবস্থান স্বাধীনতা পরবর্তী কৃষক আন্দোলনের ক্ষেত্রে এক নির্ণায়ক মুহূর্ত। আরেকটি বড়ো বিষয় হল কর্পোরেট মিডিয়া ধারাবাহিক প্রচার সত্বেও এই আন্দোলন তার স্বপক্ষে সমাজের অন্য স্তরের মানুষদের সমাবেশিত করতে পারে। মোদি সরকার প্রথমদিকে কৃষকদের বিরুদ্ধে লাগাতার কুৎসা ও রাষ্ট্রীয় সন্ত্রাসের মাধ্যমে আন্দোলনকে বাগে আনার ব্যর্থ চেষ্টা করে।কিন্তু নেতৃত্ব যথেষ্ট রাজনৈতিক পরিপক্কতা দেখিয়ে আন্দোলনকে দেশব্যাপী একটা ইসু করে তুলতে সমর্থ হয়। এমনকি ভারতের বাইরেও আন্দোলনের পক্ষে যে ধরনের জনসমর্থন তৈরি হয়েছিল তা অভাবনীয়। এই আন্দোলন প্রকৃত অর্থেই একটা গণআন্দোলন হিসাবে গড়ে উঠেছে। নেতৃত্ব যেমন ধারাবাহিক ভাবে রাস্তার লড়াইতে ভরসা রেখেছে (সত্যাগ্রহ,রেল রোকো,চাক্কা জ্যাম,ভারত বনধ) তেমনি আবার বিভিন্ন নির্বাচনে বিজেপিকে ভোট না দেবার আহ্বান জানিয়ে সংসদীয় রাজনীতিতে শাসক দলকে দুর্বল করার চেষ্টা করেছে। তারা যেমন অনশন,শান্তিপূর্ণ অবস্থান করেছে তেমনি পঞ্জাব,হরিয়ানা ও উত্তর প্রদেশের বিভিন্ন অঞ্চলে বিজেপির সাংসদ,বিধায়ক ও অন্যান্য পদাধিকারীদের সামাজিক বয়কট করে তাদের রাজনৈতিক অস্তিত্ব বিপন্ন করে তুলেছে। এই আন্দোলন নরেন্দ্র মোদি সরকারকে কতটা বেসামাল করে তুলেছিল তার প্রমাণ বিল সংসদে আইনে পরিণত হবার পরেও তারা আইনগুলির প্রয়োগ অনির্দিষ্ট কালের জন্য স্থগিত করে দেয়। সংযুক্ত মোর্চার নেতৃত্ব কোন রাজনৈতিক দলকে এই আন্দোলনকে ব্যবহার করতে দেয়নি বরং বিজেপি বিরোধী রাজনৈতিক দলগুলিকে বাধ্য করেছে তাদের আন্দোলনকে সমর্থন করতে। আজ নরেন্দ্র মোদির দেশবাসীর কাছে ক্ষমা প্রার্থনা সেই সফল আন্দোলনের অনিবার্য পরিণাম।
কৃষি আইনের প্রত্যাহারের সিদ্ধান্ত অবশ্যই আগামীদিনে দেশের রাজনীতিকে প্রভাবিত করবে। এ ক্ষেত্রে নির্বাচনী রাজনীতি একটা ফ্যাক্টর। উপুর্যুপরি বিভিন্ন নির্বাচনে বিজেপির পরাজয় ও সামনের উত্তর প্রদেশ, পঞ্জাব ও হরিয়ানা বিধানসভা নির্বাচনে পরাজয়ের আশঙ্কা আজকের সিদ্ধান্তের ক্ষেত্রে একটা কারণ কিন্তু একমাত্র নয়। সবচেয়ে বড়ো বিষয় হল ভারতে কর্পোরেট পুঁজির স্বার্থরক্ষা করার ক্ষেত্রে নরেন্দ্র মোদির কোন বিকল্প নেই– এই প্রচারের ফানুসে আজকের সিদ্ধান্ত এক জোর ধাক্কা। এবার কর্পোরেট লবিও তার যোগ্যতা নিয়ে প্রশ্ন তুলবে।আগামীদিনে বিজেপি দলের মধ্যে নরেন্দ্র মোদি ও অমিত শাহ জুটির কর্তৃত্ব নিয়েও প্রশ্ন উঠবে।
এই জয়ের সবচেয়ে বড়ো প্রভাব পড়বে আগামীদিনে ফ্যাসিবাদ বিরোধী, জনস্বার্থবাহী চলমান আন্দোলনগুলির ক্ষেত্রে। কৃষকরা জয়যুক্ত হয়েছে কারণ তারা অনেক চড়াই – উতরাইয়ের মধ্য দিয়ে ঐক্যবদ্ধ লড়াই করতে সমর্থ হয়েছে। কৃষকদের আন্দোলন শুধু তিনটি কৃষক স্বার্থ বিরোধী আইন প্রত্যাহারের মধ্যে সীমায়িত ছিল না।তাদের আন্দোলন একই সঙ্গে ছিল প্রজাতন্ত্রকে ফিরে পাওয়ার লড়াই, বিচারব্যবস্থার একদেশদর্শিতাকে প্রশ্ন করার সাহস।এই আন্দোলন একই সঙ্গে উন্মোচিত করেছে কর্পোরেট সংস্থা ও ভারতের রাজনৈতিক দলগুলির অশুভ আঁতাতকে। মোদি জমানায় যেভাবে দুটি নির্দিষ্ট কর্পোরেট গোষ্ঠী ( পড়ুন আম্বানি ও আদানি) দেশের ভাগ্যনিয়ন্তা হয়ে উঠছে তার বিরুদ্ধেও এক সফল প্রত্যাঘাত এই আন্দোলন। আজকের জয় আগামীদিনের আন্দোলনগুলিকে অনুপ্রেরণা জোগাবে।
একথা সবার জানা যে কৃষিক্ষেত্রে প্রত্যক্ষ বা পরোক্ষভাবে দেশের ৫৫ শতাংশ লোক নিযুক্ত এবং কৃষি ক্ষেত্র ধারাবাহিক বিপন্নতার শিকার। কৃষি আইন প্রত্যাহারের ফলে ভারতের কৃষিতে কর্পোরেট রাজ প্রতিষ্ঠার নীল নকশাকে আটকাতে সম্ভব হলেও ভারতের কৃষি ব্যবস্থার মূলগত সংকটের সমাধান হবে না। আমূল ভূমিসংস্কার,খাসজমির বন্টন, কৃষি মজুরি বৃদ্ধি, পরিকাঠামো উন্নয়ন, কৃষিতে ভর্তুকির মত বিষয়গুলি আগামীদিনে কৃষক আন্দোলনের ভরকেন্দ্রে আসবে– এই আশা করা যায়। আজ ফসলের ন্যূনতম মূল্য নিশ্চিত করার দাবিটাও একই ভাবে জীবন্ত থাকছে।
এই জয় আন্দোলনের ক্ষেত্রে এক নতুন সম্ভাবনার জন্ম দিচ্ছে। বিশেষ করে শ্রমকোড,নাগরিকত্ব সংশোধনী আইন ( এন আর সি,সিএএ),রাষ্ট্রায়ত্ত সংস্থাগুলির বিলগ্নিকরণ ও বেসরকারিকরণের বিরুদ্ধে যে আন্দোলনগুলি এখন দুর্বল অবস্থায় আছে , সেগুলি এই জয় থেকে শিক্ষা নিয়ে আগামীদিনে আরো বড় মাত্রায় সংগঠিত হবার পরিস্থিতি তৈরি হল এই সিদ্ধান্তের ফলে। সর্বোপরি হিন্দি- হিন্দু- হিন্দুস্তানের নামে সাংস্কৃতিক জাতীয়তাবাদের প্রতিটি আগ্রাসনকে চ্যালেঞ্জ জানাতে এই জয় প্রাণিত করবে।
Relevant article. India’s agriculture policy and many other policies are dictated by US backed corporate house. So, we have to wage war against all anti-people laws and policies.