প্রত্যাশিত ভাবেই রাষ্ট্রায়ত্ত বিমান পরিষেবা সংস্থা এয়ার ইন্ডিয়াকে টাটা গোষ্ঠী কিনে নেওয়ার পর কর্পোরেট মহল, বাজার অর্থনীতির সোচ্চার সমর্থক ও মেইনস্ট্রিম মিডিয়াতে উল্লাসের ঝড় উঠেছে। এর প্রধান কারণ বিলগ্নিকরণ, আংশিক নিয়ন্ত্রণ, রাষ্ট্রায়ত্ত সংস্থাগুলিকে কর্পোরেট গঠনতন্ত্রের অংশ করার মত প্যাঁচ পয়জারের বদলে সরাসরি রাষ্ট্রীয় সম্পদকে বিক্রি করে দেওয়া গেছে। দীর্ঘ সময় ধরে চেষ্টা করার পর অবশেষে ক্রেতা মিলেছে। এই বিক্রি আমাদের মনে করিয়ে দিচ্ছে অটলবিহারী বাজপেয়ীর আমলে একাধিক বক্সাইট খনি ও অ্যালুমিনিয়ম উৎপাদন ইউনিট সহ বালকো(ভারত অ্যালুমিনিয়ম কোম্পানি)-কে অনিল আগরওয়ালের স্টারলাইট(বেদান্ত)গ্রুপের কাছে বিক্রি করে দেওয়ার কথা। একই সঙ্গে এটাও খুব অপ্রত্যাশিত নয় যে বিএসএনএল, চিত্তরঞ্জন সহ রেলের বিভিন্ন উৎপাদন ইউনিট, প্রতিরক্ষা শিল্প ও ব্যাঙ্ক, জীবনবিমা বেসরকারিকরণের চলমান প্রক্রিয়ার বিরুদ্ধে অন্তত সোসাল মিডিয়ায়, পত্রপত্রিকা, ট্রেড ইউনিয়নগুলির নিক্তি মাপা প্রতিবাদে বা রাজনৈতিক দলগুলির বিবৃতিতে যে বিরোধ আমরা দেখেছিলাম তার সিকিমাত্র এয়ার ইন্ডিয়ার বেলায় দেখা যাচ্ছে না। এই নিবন্ধকারের মতে এই প্রতিবাদহীনতার পেছনে একাধিক কারণ বর্তমান। প্রথমত মিডিয়ার কল্যাণে ও রাষ্ট্রের প্রচারে এটা বহুদিন ধরে আলোচিত যে এয়ার ইন্ডিয়ার মাথায় পর্বত প্রমাণ ঋণ ও সেটা মেটাতে হচ্ছে সরকারের অর্থভান্ডার থেকে। অন্য সময় অস্বীকার করলেও সরকার এয়ার ইন্ডিয়ার ক্ষেত্রে কিভাবে এক সাদা হাতি পুষতে জনগনের টাকা জলের মত বেড়িয়ে যাচ্ছে তা নিয়ে প্রকাশ্যে হা হুতাশ করেছেন। সাধারণভাবে মোদি জমানা কুখ্যাত হয়েছে তথ্য গোপনের ব্যাপারে। জাতীয় নমুনা সমীক্ষা হোক বা অর্থনীতি সংক্রান্ত সার্ভে রিপোর্ট – দীর্ঘদিন ধরে এগুলির প্রকাশ স্থগিত হয়ে রয়েছে। কিন্তু সেই সরকারের পক্ষ থেকে বলা হয়েছে(সরকার পক্ষ থেকে এই ব্যাপারে বিবৃতি দিয়েছেন রাষ্ট্রায়ত্ত সংস্থা বেসরকারিকরণের প্রক্রিয়া চালনা করার দায়িত্ব প্রাপ্ত আধিকারিক তুহিনকান্ত পান্ডে) গত দশ বছরে সরকার এয়ার ইন্ডিয়াতে ১.১০ কোটি টাকা ঢেলেছে কিন্তু ঋণের পরিমাণ ৬১,০০০ কোটি টাকা ছাপিয়ে গেছে। প্রত্যেক দিন এই সংস্থার ক্ষতির পরিমাণ ২০ কোটি টাকা। তাই সরকারি কোষাগারের ধারাবাহিক রক্তক্ষরণ বন্ধের জন্য বা এককথায় দেনা মুক্তির জন্য এয়ারইন্ডিয়া বিক্রি অনিবার্য। টাটাদের ভূমিকাকে গৌরবান্বিত করার জন্য এমনটাও বলার চেষ্টা হচ্ছে যে তারা আসলে দেশের ভালোর জন্য আইসিইউতে চলে যাওয়া সংস্থা কিনে নিলেন। এই প্রচার এতটাই জোরালো যে এই প্রশ্নটা কেউ করছেন না যে মুনাফার মতাদর্শে চলা একটা কর্পোরেট সংস্থা কেন সরকারের ক্ষতির বোঝা নিজের কাঁধে নেবে! দ্বিতীয়ত দুঃখের কথা হলেও এটা সত্যি যে নব্বই-এর দশকে গৃহীত সংস্কারের রাজনীতি ও অর্থনীতির ফল স্বরূপ রাষ্ট্রায়ত্ত সংস্থাগুলোকে ক্রমে ক্রমে বেসরকারি হাতে তুলে দেওয়ার যে আগ্রাসী নীতি উপুর্যুপরি সরকারগুলি নিয়ে এসেছে তাকে প্রতিহত করতে মূলধারার ট্রেড ইউনিয়নগুলি নিদারুণ ভাবে ব্যর্থ। পাঁজিপুঁথি দেখে বছরে এক বা দুবার শিল্প ধর্মঘট ও কিছু প্রতীকী প্রতিবাদ ছাড়া কোনো ধরনের প্রতিরোধ সংগ্রাম গড়ে তুলতে না-পারার কারণে পরাজয় তাদের একমাত্র ভবিতব্য হয়েছে। গত তিরিশ বছরে বেসরকারি করণের জন্য সরকারগুলি যে ‘স্লো বাট স্টেডি’ নীতি গ্রহণ করেছে তার ফলে ভারতের শাসকশ্রেণি তাদের পরিকল্পনায় প্রায় পুরোটাই সফল। এই সময় যে শ্রমিকরা রয়ে গেছেন তাদের জন্য আরও ভালো বেতনক্রম বা আকর্ষণীয় ভিআরএস প্যাকেজ আদায় করা ছাড়া আজ ট্রেড ইউনিয়নের কোন কাজ নেই। তৃতীয়ত যেহেতু এয়ার ইন্ডিয়া আগে টাটার পরিচালনাধীন সংস্থা ছিল তাই অনেকে বলছেন ঘরের জিনিষ ঘরে এল। এই নির্বোধ যুক্তি অনুযায়ী তাহলে কোল ইন্ডিয়ার পরিচালনাধীন খনিকে তাদের পূর্বতন মালিকদের ফিরিয়ে দিতে হয়! এক্ষেত্রেও আলোচনার স্বার্থে দু’একটি পুরানো কথা মনে করিয়ে দেওয়া জরুরি। ১৯৪২ সালে টাটা এয়ারলাইনস প্রতিষ্ঠা করেন টাটা গ্রুপের তৎকালীন প্রধান জে আর ডি টাটা। ১৯৪৬ সালে এর নাম পরিবর্তন করে হয় এয়ার ইন্ডিয়া। প্রথমে তারা দেশের মধ্যে বিমান পরিষেবা দিলেও ১৯৪৮ সালে এয়ার ইন্ডিয়া ইন্টারন্যাশনাল যাত্রা শুরু করে। ১৯৫৩ সালে পরিকল্পিত অর্থনীতির অংশ হিসাবে এয়ার ইন্ডিয়ার জাতীয়করণ হয়। কিন্তু এই তথ্যটাও জেনে রাখা জরুরি যে জাতীয়করণের আগেও এয়ার ইন্ডিয়াতে সরকারের অংশিদারি ছিল ৪৯%, টাটাদের ২৫% ও বাকি ২৬% পাবলিক শেয়ার। পরবর্তীতে জাতীয়করণের যে মতাদর্শ(যা সদ্য ঔপনিবেশিক শাসন থেকে মুক্তি পাওয়া দেশের অর্থনৈতিক পুনর্গঠনের জন্য জরুরি ছিল), সেই অনুযায়ী এয়ার ইন্ডিয়া সরকারের হাতে আসে। চতুর্থ এয়ার ইন্ডিয়ার টাটার হাতে যাওয়ার ক্ষেত্রে বিরোধিতা প্রায় না হওয়ার আরেকটা কারণ হল মিডিয়া ও সোসাল মিডিয়াতে গড়ে তোলা এক সযত্ন লালিত মিথ। এটা অনেকেই বিশ্বাস করেন যে অম্বানি- আদানি যে রকম আগ্রাসী কর্পোরেট হাঙর, টাটা গ্রুপ মোটেও সেরকম নয় তারা অনেক বেশি মানবিক, জনদরদি। রতন টাটার দানধ্যানের গল্পকে দীর্ঘ দিন ধরে মানুষের মনে চারিয়ে দেওয়া হচ্ছে। এই মিথ তৈরিতে একটা বড়ো ভূমিকা রয়েছে সংসদীয় বামপন্থীদের। ফলে মানবিক টাটার হাতে গেলে খুব খারাপ হবে না – এরকম একটা আশাবাদও রয়েছে। টাটারা আদতে কতটা মানবিক সে আলোচনা করার ইচ্ছে আপাতত মুলতুবি রেখে শুধু এটা বলতে চাই কর্পোরেট হাঙরদের মধ্যে ভালো মন্দ বিভাজন করা এক চরম প্রতিক্রিয়াশীল ধারণা।
আলোচনার সুবিধার্থে নিবন্ধটিকে কয়েকটি ভাগে বিভক্ত করা হয়েছে। প্রথমে বিক্রি প্রক্রিয়াটা কিভাবে সম্পন্ন হল তা নিয়ে আলোকপাত করা হয়েছে। দ্বিতীয়ভাগে এই বিক্রির মাধ্যমে সরকার আদৌ ঋণ মুক্ত হল না কি তার ঘাড়েই চেপে থাকলো তার উপর দৃষ্টি দেওয়া হয়েছে। তৃতীয় ভাগে টাটারা সত্যি এক আইসিইউতে চলে যাওয়া সংস্থা কিনলো না কি তারা কম পয়সায় একটা অত্যন্ত লাভজনক চুক্তি করল তা বোঝার চেষ্টা হয়েছে। চতুর্থ ভাগে এয়ার ইন্ডিয়ার এই ঋণের জালে পড়ার কারণ কি কর্মীদের অদক্ষতা, অযোগ্যতা না কি সরকারের পলিসির ব্যর্থতা তা দেখতে চাওয়া হয়েছে। আলোচনা শেষ হয়েছে ভারতে বিমান পরিষেবার বাজারে এই বিক্রির দীর্ঘস্থায়ী প্রতিক্রিয়া নিয়ে।
এয়ার ইন্ডিয়া বিক্রির সরকারি চেষ্টার ইতিহাস বহু পুরানো। ২০০০ সালের মে মাসে তৎকালীন অটলবিহারী বাজপেয়ী সরকার প্রথম প্রস্তাব দেন সংস্থার ৭০ শতাংশ শেয়ার বিলগ্নিকরণ করতে, কিন্তু দু’বছর পর পরিকল্পনাটি পরিত্যক্ত হয়। এরপর ইউপিএ সরকারের পক্ষ থেকে ২০০৭ সালে এয়ারইন্ডিয়া ও ইন্ডিয়ান এয়ারলাইনসের যুক্ত হওয়ার পরেও যখন সংকটমোচন ঘটল না তখন তৎকালীন অসামরিক বিমান মন্ত্রকের মন্ত্রী অজিত সিং বলেন বেসরকারিকরণ ছাড়া এয়ার ইন্ডিয়াকে বাঁচানোর আর কোন রাস্তা অবশিষ্ট নেই। কিন্তু বিভিন্ন রাজনৈতিক সমস্যা আক্রান্ত ইউপিএ সরকার এটাকে নিয়ে এগোনোর সিদ্ধান্ত নেয়নি। ২০১৭ সালে মোদি সরকার এয়ার ইন্ডিয়া বিক্রি করতে সক্রিয় হয়ে ওঠে। কিন্তু কেউ এই সংস্থাকে কিনতে আগ্রহ দেখায়নি। অনেকে মনে করেন সেই পরিকল্পনায় যেহেতু সরকার ৭৬% শেয়ার বেসরকারি হাতে ছেড়ে দিয়ে বাকিটা নিজের হাতে রাখতে চেয়েছিল তাই কোন কর্পোরেট সংস্থা আগ্রহ দেখায়নি। আবার প্রক্রিয়া শুরু হয় ২০২০ সালে যেখানে দরপত্রে ১০০% বিক্রির কথা প্রথমেই উল্লেখ করা ছিল।
একথাটা পরিষ্কার বুঝে নেওয়া প্রয়োজন এবারেও এয়ার ইন্ডিয়াকে কেনার ব্যাপারে আগ্রহী ক্রেতার সংখ্যা ছিল কম।৭ টি সংস্থা আগ্রহ দেখায় যার মধ্যে ৫ টি নির্দিষ্ট যোগ্যতা না থাকার কারণে প্রাথমিক পর্বেই বাতিল হয়ে যায়। শেষমেষ টিকে থাকে দুটো সংস্থা। প্রথমটি স্পাইস জেটের ম্যানেজিং ডিরেক্টর অজয় সিং-এর নেতৃত্বে গঠিত একটি কনসোর্টিয়াম। এরা দর দেয় ১৫,১০০ কোটি টাকা। যার মধ্যে ২,২৬৫ কোটি টাকা নগদ এবং ১২,৮৩৫ কোটি টাকার ঋণের দায়িত্ত্ব। অপরদিকে টাটারা দর দেয় ১৮,০০০ কোটি টাকা। এর মধ্যে নগদ ২,৭০০ কোটি টাকা এবং ১৫,৩০০ কোটি টাকা ঋণের দায়িত্ব। দুটো প্রস্তাবের মধ্যে টাটাদের প্রস্তাব তুলনামূলক বিচারে ভালো থাকার কারণে টাটারা জিতে যায়। চুক্তিপত্র সম্পাদনের পর দেখা যাচ্ছে টালাস প্রাইভেট লিমিটেড(টাটাদের ১০০ শতাংশ মালিকানা) এয়ার ইন্ডিয়া, এয়ার ইন্ডিয়া এক্সপ্রেস(লো কস্ট ইন্টারন্যাশানাল ক্যারিয়ার) এবং ‘AISATS’ সংস্থায় এয়ার ইন্ডিয়ার যে ৫০ শতাংশ হোল্ডিং ছিল তা পাচ্ছে। এটাই চুক্তির মোদ্দা কথা। এখানে আরেকটা কথার উল্লেখ আছে যে ৩১ ডিসেম্বর পর্যন্ত (চুক্তি সম্পূর্ণ কার্যকর হতে এই সময়টা লাগবে) সরকার এয়ার ইন্ডিয়ার অপারেশনাল কস্ট হিসাবে দিন প্রতি ২০ কোটি টাকা দেবে। এই সময় পর্বে সংস্থার আরও কোনো ক্ষতি হলে তার দায়ও সরকার নেবে। চুক্তিতে লেখা আছে এই সরকারি সংস্থার ১৪,০০০ কর্মীর স্বার্থ দেখা হবে। কিন্তু সেই বেতন সুরক্ষা একবছর পর্যন্ত। তারপর স্বেচ্ছা অবসর প্রকল্প আনা হবে।
এবার আমরা এয়ার ইন্ডিয়া বিক্রির ব্যাপারে সবচেয়ে সংবেদনশীল অংশে প্রবেশ করব। বিষয়টা হল টাটা কিনে নেওয়ার পর সরকার কি ঋণ মুক্ত হল? আরো সহজ কথায়, সরকার যে বারবার বলেছে সাধারণ মানুষের টাকার অপচয় বন্ধ করতে সংস্থাকে বিক্রি করতে হবে। সেই সমস্যাটা কি মিটলো? এককথায় এর উত্তর না এবং না। কর্পোরেট দুনিয়ার কাজকর্ম সম্পর্কে যারা ওয়াকিবহাল তারা জানেন যে সংস্থার ঘাড়ে দেনার বোঝা ৬১,৫৬২ কোটি টাকা তাকে পূর্ণ দায় সমেত কেনা তো দূরের কথা কেউ ছুঁয়েই দেখবে না। টাটাদের ক্ষেত্রেও তার কোন অন্যথা হয়নি। টাটারা এই পর্বত প্রমাণ দেনার মাত্র ২৫%-এর দায়(১৫,৩০০ কোটি টাকা) নিয়েছে মাত্র। বাকি টাকাটা সরকার অর্থাৎ আম জনতাকেই শোধ করতে হবে।
এয়ার ইন্ডিয়ার মোট ঋণের পরিমাণ ৬১,৫৬২ কোটি টাকা। এর থেকে ১৫,৩০০ কোটি টাকা বাদ দিলে ৪৬,২৬২ কোটি টাকা। এই বিপুল পরিমাণ টাকা শোধ করবে ভারত সরকার অর্থাৎ আমার-আপনার করের টাকায় এই ধার শোধ হবে। ধার শোধের জন্য সরকার এক স্পেশাল পারপাস ভেহিকেল তৈরি করেছে। এয়ার ইন্ডিয়ার জমি,বিল্ডিং ও অন্য স্থাবর সম্পত্তি বিক্রি করে যে টাকা পাওয়া যাবে তাও যাবে এই অ্যাকাউন্টে। এই টাকা যতদিন না শোধ হবে ততদিন আম আদমির টাকা থেকে এর পূরণ চলবে। এই গল্পের আরেকটা দিক আছে যা সবার জানা দরকার। টাটারা যে ১৫,৩০০ কোটি টাকা ঋণ শোধের দায়িত্ব নিয়েছে তা যতদিন না শোধ হবে ততদিন টাটারা এয়ার ইন্ডিয়া চালিয়ে যে মুনাফা অর্জন করবে তার থেকে সে কোনো কর্পোরেট ট্যাক্স সরকারকে দেবে না। এটাও সরকারি কোষাগারের ক্ষতি যা আবার শেষ বিচারে সাধারণ নাগরিকের ক্ষতি। তাই বলা যায় ঋণ মুক্তির বহু বিজ্ঞাপিত গল্পটার বেশিটাই অসত্য।
তৃতীয় ভাগে আমরা দেখার চেষ্টা করব টাটারা সত্যিই এক আইসিইউতে চলে যাওয়া একটা কারখানা কিনে দেশের সংকটমোচনে এগিয়ে এল না কি এই চুক্তির মাধ্যমে তারা এক অত্যন্ত লাভজনক সওদা করতে সমর্থ হল। এককথায় এটার কোন উত্তর নেই। বাজারের সাধারণ নিয়ম হল পণ্যের চাহিদা থাকলে বিক্রেতা ভালো দাম পাবেন এবং চাহিদা না থাকলে কম দাম পাবেন। করোনা অতিমারী শুরু হওয়ার আগে থেকেই বিমান পরিষেবার ব্যবসা সারা পৃথিবীতে চরম মন্দার মুখে, অতিমারী পরিস্থিতিকে আরো শোচনীয় করে তুলেছে। এয়ার ইন্ডিয়া কিনতে আগ্রহী ক্রেতার সংখ্যা খুব কম হওয়ার এটা প্রধান কারণ। দামের ক্ষেত্রে বেস প্রাইস ১২,৫০০ কোটি ছিল অথচ ১৮,০০০ কোটি টাকার বেশি দাম উঠলো না, এটা অবশ্যই এয়ার ইন্ডিয়ার দিক থেকে বড়ো ক্ষতি। আর টাটাদের আরেকটা বড়ো লাভ হল তাদের নগদ দিতে হচ্ছে মাত্র ২,৭০০ কোটি টাকা। আর ১৫,৩০০ কোটি টাকার ধার মেটানোর যে দায়িত্ব তারা নিয়েছে সেখানেই আসল লাভটা লুকিয়ে আছে। এই টাকা যারা ধার দিয়েছে তারা টাকা পাওয়ার জন্য ঋণের একটা বড়ো অংশ ছাড় দেবে। সাধারণ হিসাব অনুযায়ী সেটা ১৫৭০ কোটি টাকার কম হবে না। আবার যেহেতু তারা ঋণ ও তার সুদ শোধ করবেন তাই চুক্তিমতো সরকারের কাছেও করছাড় পাবেন। সব মিলিয়ে টাটার দায় আনুমানিক ২,০০০ কোটি টাকা কমে যাবে। বদলে টাটারা পাচ্ছে ১৪১ টি এয়ারক্রাফট(১১৮ টি ভালো অবস্থায়), ৪,৪০০ টি ডোমেস্টিক রুট, ১৮০০ টি আন্তর্জাতিক স্লট, ৯০০ ডোমেস্টিক স্লট এবং প্রশিক্ষিত কর্মীবাহিনী। তাই টাটারা কোনো মরণাপন্ন সংস্থা কেনেনি বরং এক লাভজনক সওদা করতে সমর্থ হয়েছে।
বিগত সময়ে আমাদের অভিজ্ঞতা হল যখনই কোনো রাষ্ট্রায়ত্ত সংস্থাকে বিক্রি বা বিলগ্নিকরণ করার পরিকল্পনা করা হয় তখন সুপরিকল্পিত ভাবে প্রচার করা হয় কর্মচারীদের অদক্ষতার কথা, তাদের ফাঁকিবাজির কথা,সরকারি সংস্থার খারাপ পরিষেবার কথা। আর চিৎকৃত স্বরে বলা হতে থাকে বেসরকারিকরণ হলে সব সমস্যার সমাধান হয়ে যাবে। যদি আমরা বিমান পরিষেবার প্রশ্নটিকে দেখি তাহলে দেখব ভারতে ‘ওপেন স্কাই’ পলিসি চালু হবার পর সবচেয়ে আলোচিত দুটি সংস্থা কিংফিশার এয়ারলাইনস(বিজয় মাল্য)ও জেট এয়ারলাইনস চূড়ান্ত অদক্ষতা, ত্রুটিপূর্ণ পরিচালন ব্যবস্থা ও সীমাহীন দুর্নীতির কারণে ধ্বংস হয়ে গেছে। এবার আমরা ফিরে আসি এয়ার ইন্ডিয়ার কথায়। খুব স্পষ্ট করে একথা বলা প্রয়োজন টাটাদের পরিচালনাধীন সংস্থা জাতীয়করণের আগে মোটেই একটা দারুণ লাভজনক সংস্থা ছিল না। ১৯৫১ সালের আর্থিক হিসাব পেশ করতে গিয়ে কোম্পানির সাধারণ সভায় জেআরডি টাটা বলেন — ‘ The directors regret to record that the year’s operation resulted in a loss of Rs 5.13 lakhs’। এর আগে ১৯৪৯ সালের একটা হিসাবে দেখা যাচ্ছে অবচয় মূল্য ১১ লক্ষের জায়গায় ৬ লক্ষ ধরে কোম্পানির লাভ ২ হাজার টাকা। এই হিসাবটা অস্বাভাবিক নয় কারণ মাত্র দেড় দশক আগে তৈরি হওয়া পরিষেবা, নিজস্ব বিমানের অভাব, পুঁজির অভাব তখন কোম্পানির কাছে সবচেয়ে বড়ো প্রতিবন্ধকতা ছিল। তাই দেখা যায় জাতীয়করণের সময় কোম্পানির সম্পদ থেকে অবচয় মূল্য বাদ দিয়ে কোম্পানির মূল্য হচ্ছে ২.৮ কোটি টাকা। একই সঙ্গে আজ এ কথাটা খুব জোরের সঙ্গে বলা প্রয়োজন এয়ার ইন্ডিয়ার ভালো পরিষেবা, দুর্দান্ত খাবার, আধুনিক অন্দরসজ্জা প্রভৃতির কারণে একটা গ্লোবাল ব্র্যান্ড হয়ে ওঠা কিন্তু জাতীয়করণের পর। এই ইতিহাসটা আজ ভুলিয়ে দেবার চেষ্টা হচ্ছে। আন্তর্জাতিক স্তরে এয়ার ইন্ডিয়াকে তখন আদর করে বলা হত ‘palace on the Sky’। যদি আমরা এয়ার ইন্ডিয়ার ১৯৯১-৯২ সালের ব্যালেন্স শিট খুলি তাহলে দেখব মুনাফার পরিমাণ ৩৩৩ কোটি টাকা ও ক্যাশ রিজার্ভের পরিমাণ ২০০০ কোটি টাকা। তাহলে কর্মীদের অযোগ্যতা ও পরিচালনা সরকারি হওয়ার কারণে এয়ার ইন্ডিয়া ডুবে গেল- এই যুক্তি ধোঁপে টিকছে না।
যে কোন সংস্থাকে প্রতিযোগিতায় টিকে থাকতে হলে তার আধুনিকীকরণ জরুরি। তাই ১৯৯৫- ৯৬ সালে এয়ার ইন্ডিয়া ও এয়ারলাইনসের পক্ষ থেকে নতুন বিমান করার পরিকল্পনা করা হয়। কিন্তু আশ্চর্যের বিষয় সরকারের অনুমতি মেলে না। একই ঘটনা আমরা দেখেছি বিএসএনএলের ব্যাপারে। সঠিক সময়ে থ্রিজি লাইসেন্স না পাওয়ার কারণে সংস্থাটি প্রতিযোগিতার বাজার থেকে পিছিয়ে পড়ে। তার বহু দিন পরে ২০০৫-০৬ সালে কোন রকম সমীক্ষা ছাড়াই বাস্তবতার সঙ্গে সম্পর্কহীন এক সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়। এয়ার ইন্ডিয়া ও ইন্ডিয়ান এয়ারলাইনসের জন্য মিলিত ভাবে ৩৮,১৪৯ কোটি টাকার(তখন ১ মার্কিন ডলারের মূল্য ৪৪ টাকা) বরাত দেওয়া হয়। এর মধ্যে ছিল ৫০ টি বোয়িং, ১৮ টি সিএফএসএম ইঞ্জিন যুক্ত এয়ারক্রাফট। এই বিশাল টাকার অঙ্কের বরাত দেওয়ার সঙ্গে ২০০৯ সালে স্বাক্ষরিত ভারত- মার্কিন পারমানবিক চুক্তির সরাসরি যোগ আছে বলে অনেকে মনে করেন। এই বরাতই এয়ার ইন্ডিয়া ও ইন্ডিয়ান এয়ারলাইনসের পতনের প্রধাণ কারণ। এই বরাতকে ন্যায্যতা দেবার জন্য অর্থনৈতিক দিক থেকে লাভজনক নয় এমন বহু উড়ান শুরু করা হয় যেমন নন- স্টপ মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র উড়ান। পরবর্তীতে ক্যাগ এই একবারে এত টাকার বরাত দেওয়ার সিদ্ধান্ত নিয়ে প্রশ্ন তোলে। আর হঠাৎ করে বিমান সংখ্যা বাড়লেই যে মার্কেট শেয়ার বেড়ে যাবে– ব্যবসায় এমনটা হয় না। যেমন ২০০৫-৬ সালে ইন্ডিয়ান এয়ারলাইনসের বিমান চালনা করার ক্ষমতা ৬৭% থেকে বেড়ে হয় ৯৭%, কিন্তু মার্কেট শেয়ার ৩৭% থেকে কমে ১৭% হয়। এই বরাতজনিত ঋণ ও তার উপর চাপানো সুদের বোঝা থেকে এয়ার ইন্ডিয়া আর বেরোতে পারলো না।
এর পরের সিদ্ধান্তটি হল এয়ার ইন্ডিয়া ও ইন্ডিয়ান এয়ারলাইনসের মার্জার বা সংযুক্তিকরণ। এখানে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ কথা হল মার্জার যদি করার পরিকল্পনা থাকে তাহলে তার আগে দুটো সংস্থা আলাদা আলাদা ভাবে বিশাল অঙ্কের বরাত দিল কেন? স্বাভাবিক বুদ্ধি বলে দুটি সংস্থা এক হওয়ার পরে প্রয়োজনের ভিত্তিতে বরাত দিলে তাতে একটা সামঞ্জস্য থাকত। আর একাধারে দুটো সংস্থা এক হল কিন্তু ৪ বছর ধরে এয়ারলাইনস ও এয়ার ইন্ডিয়া আলাদা আলাদা টিকিট বিক্রি করে। ফলে সাধারণ যাত্রী পরিষেবার দিকে কোন সুবিধা পেলো না তাই তারা বিমানে চাপার ক্ষেত্রে এয়ার ইন্ডিয়াকে তাদের প্রথম পছন্দ ভাবলেন না।
ভারতে ‘ওপেন স্কাই’ পলিসি চালু হবার পর রাষ্ট্রায়ত্ত সংস্থার স্বার্থ রক্ষার্থে আলাদা কোন ব্যবস্থা নেওয়া হয়নি।অথচ পৃথিবীর সব দেশ এই সুযোগ নিজ নিজ দেশের সংস্থাকে দিয়েছিল। বরং তথ্য প্রমাণ থেকে জানা যায় উড়ানের সময় সারণি তৈরির সময় তুলনায় গুরুত্বপূর্ণ টাইম স্লটগুলো বেসরকারি কোম্পানিগুলোকে দেওয়া হচ্ছে। একে বরাতজনিত ঋণের বোঝা, তার সুদ ও অন্যদিকে সরকারি অবহেলা এয়ার ইন্ডিয়াকে ডুবিয়ে দিল। এই ঋণের বোঝা কতটা মারাত্মক তা বোঝা যায় যদি আমরা সাম্প্রতিক ২০১৯-২০ সালের হিসাব দেখি। এই আর্থিক বর্ষে সংস্থার অপারেটিং প্রফিট ১৭৮৭ কোটি টাকা কিন্তু দায় তার থেকে কয়েকগুন বেশি। এই পলিসি ব্যর্থতার বিষয়টা কিন্তু কোনো ভাবেই আলোচনার মধ্যে আসছে না।
আলোচনার শেষ পর্বে আমরা দেখে নেব এই বিক্রি ভারতের অসামরিক বিমান পরিষেবা ব্যবসায় কী ধরনের প্রভাব ফেলবে। এক্ষেত্রে উল্লেখ করা প্রয়োজন আগে থেকেই ভারতে টাটাদের বিমান পরিষেবার দুটো সংস্থা আছে– ভিস্তারা ও এয়ার এশিয়া। যদিও তাদের মার্কেট শেয়ার খুবই কম। কিন্তু এয়ার ইন্ডিয়া তার সঙ্গে যুক্ত হলে ছবিটা পুরো পাল্টে যাবে। যদি ২০২০ সালের হিসাবটাকেই ধরি তাহলে বিমান ব্যবসায় মোট আয় হয়েছিল ৯৫,৭০০ কোটি টাকা, যার মধ্যে এয়ার ইন্ডিয়া, ভিস্তারা ও এয়ার এশিয়ার আয় হচ্ছে ৪০,৫০০ কোটি টাকা। অর্থাৎ বাজারের ৪৩% টাটাদের দখলে। আবার দেশের মধ্যে বিমান পরিষেবার একনম্বরে থাকা সংস্থা ইন্ডিগোর সঙ্গে টাটারা যদি কোন সমঝোতায় আসে তবে এই দুটো সংস্থা ৮৮% বাজার দখল করবে। এই বিষয়টা চূড়ান্ত একচেটিয়াকরণের দিকে যাবে। এটাই টেলিকমে হয়েছে। আজ প্রকৃত অর্থে ভারতে মোবাইল পরিষেবা ও ইন্টারনেটের বাজার রিলায়েন্স জিও ও ভারতী এয়ারটেলের হাতে কেন্দ্রীভূত। এই একচেটিয়াকরণ, সংস্কার-পরবর্তী অর্থনীতির অনিবার্য পরিণাম। এয়ার ইন্ডিয়ার বিক্রির সবচেয়ে বড়ো তাৎপর্য এটাই।