Home শিক্ষা “স্কুলটুল সব বন্ধ। করবো কী? কিছু তো করে খেতে হবে!”

“স্কুলটুল সব বন্ধ। করবো কী? কিছু তো করে খেতে হবে!”

“স্কুলটুল সব বন্ধ। করবো কী? কিছু তো করে খেতে হবে!”
0

তীর্থরাজ ত্রিবেদী

(প্রথম বর্ষের ছাত্র)

বাংলা বিভাগ, যাদবপুর বিশ্ববিদ্যালয়  

প্রায় এক বছরের বেশি সময় ধরে সমস্ত স্কুল, কলেজ বন্ধ। ক্লাসঘরে বসে পড়াশোনার বদলে শুরু হয়েছে অনলাইনে ভিডিও কনফারেন্সের মাধ্যমে সমস্ত পড়াশোনা, পরীক্ষা। ইমেলের মাধ্যমে জমা দিতে হচ্ছে অ্যাসাইনমেন্ট, প্রজেক্ট। মাধ্যমিক, উচ্চ মাধ্যমিকের মতন গুরুত্বপূর্ণ পরীক্ষা বাতিল করে রহস্যময় পদ্ধতিতে মূল্যায়নের সিদ্ধান্ত নিয়েচেন সরকার বাহাদুর। অনেকে মনে করছেন এই করোনার আকালে এ ছাড়া পড়াশোনা চালানোর আর কোনও রাস্তা নেই, দ্বিতীয়ত এখন ব্যাগ বয়ে কষ্ট করে স্কুলে যেতে হচ্ছে না, ঘরে বসেই দিব্যি আরাম করে ক্লাস করা যাচ্ছে, পরীক্ষা দেওয়া যাচ্ছে; তাই অনলাইন ক্লাস মোটের উপর সুখের দিনই এনে দিয়েছে। কিন্তু যারা এটি মনে করছেন তারা আসলে গোটা ভারতবর্ষকে সঠিক ভাবে চেনেনই না। শহরের আর্থিক ভাবে স্বচ্ছল পরিবারের ছাত্রদের একটা ছোট্ট অংশ বাদ দিলে, বাকি ভারতবর্ষের কোটি কোটি গরিব পরিবারের ছাত্রদের ভবিষ্যৎ কিন্তু এই অনলাইন শিক্ষার ফলে একেবারে ধ্বংসের মুখে, যারা এর জন্য প্রয়োজনীয় স্মার্ট ফোন, কম্পিউটার কিংবা প্রতি মাস পিছু গড়ে ৫০০ টাকা করে ইন্টারনেটের খরচ বহন করতে সক্ষম নন। এই একবছরে গোটা ভারতের এই বিপুল অংশের ছাত্রছাত্রীদের চিত্রটা কিন্তু ইতিমধ্যেই বদলাতে শুরু করেছে। যারা মনে করছেন ‘অনলাইন শিক্ষার জন্য না হয় একটু বেশিই খরচ করা হল, তাতে আর এমন কি’, তাদের জন্য কিছু খুচরো পরিসংখ্যান দেব।

২০১৭-১৮ সালের ন্যাশনাল স্যাম্পল সার্ভের তথ্য অনুযায়ী ভারতবর্ষের গ্রামের মাত্র ১৫ শতাংশ পরিবার ইন্টারনেট ব্যবহার করতে পারেন। শহরে এই সংখ্যাটা ৪২ শতাংশ। অর্থাৎ খেয়াল করে দেখুন, কেবলমাত্র অনলাইনে ক্লাস হবার ফলে গ্রামের ৮৫ শতাংশ ছাত্র আর শহরের ৫৮ শতাংশ ছাত্র ইতিমধ্যেই তাদের পড়াশোনা করার অধিকার থেকে বঞ্চিত হয়েছেন। পরিসংখ্যানের বাইরে প্রকৃত অবস্থাটা কিন্তু আরও ভয়াবহ। উপরন্তু ইন্টারনেট ব্যবহার করার মত আর্থিক সংগতি যাদের রয়েওছে, তাদেরও সকলেই যে অনলাইনে নিশ্চিন্তে ক্লাস করতে পারছেন এমন কিন্তু নয়। বহু গ্রামে ইন্টারনেট কানেকশন পাওয়াই দুষ্কর ব্যাপার। তাছাড়া ভারতবর্ষের অনেক গ্রামে এখনও বিদ্যুৎ পৌঁছয়নি। ফলে ইন্টারনেট তো দুরের কথা, ফোনে চার্জ দেওয়াই সম্ভব হয় না। কেন্দ্রীয় সরকারের ২০১৭-১৮ সালের তথ্য জানাচ্ছে যে দেশের মাত্র ৪৭ শতাংশ গ্রামে দিনে ১২ ঘন্টা বা তার বেশি সময় বিদ্যুৎ সংযোগ থাকে। আর ১৬ শতাংশ গ্রামে দিনে ৮ ঘন্টাও বিদ্যুৎ পাওয়া যায় না।

আমাদের রাজ্য পশ্চিমবঙ্গের পরিস্থিতি আরও ভয়াবহ। সরকারি পরিসংখ্যান দেখাচ্ছে যে আমাদের রাজ্যে মাত্র ৭.৯ শতাংশ গ্রামীণ পরিবার এবং ৩৬ শতাংশ শহরের পরিবার ইন্টারনেট ব্যবহার করতে পারেন। গ্রামের মাত্র ৩ শতাংশ পরিবারে আর শহরের ২৩ শতাংশ পরিবারে কম্পিউটার আছে। সমাজে অর্থনৈতিকভাবে পিছিয়ে পড়া পরিবারগুলি এবং সেই সঙ্গে ব্যাপক অংশের মেয়েরা ইন্টারনেট ব্যবহার করার সুযোগ থেকে বঞ্চিত।

অতয়েব ইতিমধ্যেই শহর, শহরতলির বস্তির, গ্রামগঞ্জের অধিকাংশ ছাত্রছাত্রী শিক্ষার জগৎ থেকে সম্পূর্ণ বাইরে। যাকে বলে ‘স্কুল ছুট’, ‘কলেজ ছুট’। আমার নিজের অভিজ্ঞতা থেকেই কলকাতা শহরের মধ্যেই এক অত্যন্ত গমগমে এলাকার বেশ কিছু ছাত্রদের আমি দেখেছি, যারা ক্লাস ১২-এ পড়ে। স্কুল, কলেজ বন্ধ থাকায় পড়াশোনার পাট চুকিয়ে ওদের ক্লাসের প্রায় সকলেই শহরের বিভিন্ন ছোটো বড়ো কারখানা, দোকানে অস্থায়ী মিস্ত্রি কিংবা কর্মী হয়ে কাজে ঢুকে পড়েছে। খাস মহানগরে এই চিত্র। নিজে গ্রামের ছেলে হওয়ার দরুণ আমি স্বচক্ষে আমার ও আমার গ্রামের চারপাশে প্রচুর ক্লাস ৭, ক্লাস ৮-এর বাচ্চা বাচ্চা ছেলেমেয়েদের দেখেছি দর্জির কারখানায় সেলাইয়ের কাজে ঢুকে পড়তে। কারণ জিজ্ঞেস করলে উত্তর এসেছে ‘স্কুলটুল সব বন্ধ। এখন করব কী? কিছু তো করে খেতে হবে!’ ভাবুন, ১২/১৩ বছর বয়সের বাচ্চা ছেলেমেয়েদের মুখ থেকে এই কথা। অনলাইন ক্লাস এদের স্কুল, কলেজ থেকে বের করে দিয়েছে। বাংলা তথা ভারতের গ্রাম সমাজে ‘বাল্যবিবাহ’ একটা জ্বলন্ত সমস্যা। এ নিয়ে হাজার রকমের সরকারি চিন্তাভাবনা, প্রকল্পের জুড়ি মেলা ভার। অথচ এই স্কুল, কলেজ বন্ধ থাকার ফলে গ্রামে প্রচুর এমন অল্প বয়সি মেয়েদের বিয়ে দিয়ে দেওয়া হচ্ছে। যা নিয়ে কারোর কোনও মাথাব্যাথা নেই।

আমাদের গ্রামবাংলার অধিকাংশই সব কৃষক পরিবার। অথচ কৃষিতে এখন সারের দাম, বীজের দাম, বিষের দাম, তেলের দাম, জলের দাম, মজুরি ইত্যাদি আরও সবকিছু মিলিয়ে যা খরচ হয়, লাভ তো দূরের কথা, দিনের শেষে সেই খরচটুকুও ওঠে না। চাষবাস ব্যাপারটা এমন অলাভজনক হয়ে ওঠার ফলে অধিকাংশই কৃষক পরিবার তাদের ছেলেমেয়েদের পড়াশোনা করান, কোনওমতে একটু পড়াশোনা করে কিছু একটা কাজ জোটাবার আশায়। অথচ অনলাইন শিক্ষার খরচ বহন করার আর্থিক ক্ষমতা তাদের নেই। ফলে স্কুল, কলেজ বন্ধ থাকায় তাদেরও ভবিষ্যৎ সম্পূর্ণ অন্ধকারে।

যতটা লিখে বোঝাতে পারছি, চিত্রটা কিন্তু আসলে এর থেকে আরও বহুগুন বেশি ভয়ংকর। গত বছরের শেষের দিকে লকডাউন উঠে গিয়ে বাস, ট্রেন, সিনেমা হল, বাজার হাট, রাজনৈতিক পার্টিগুলির বড়ো বড়ো জমায়েত সবকিছু খোলা হল। অথচ স্কুল, কলেজের উপর থেকে লকডাউন হটলো না। বিধানসভা নির্বাচনের প্রাক্কালে রাজনৈতিক পার্টিগুলির এত বড়ো বড়ো জনসমাবেশ, হরেক রকম মেলা, ধর্মীয় উৎসব দিব্যি নিশ্চিন্তে অনুষ্ঠিত হল। বিধানসভার ফল প্রকাশের পর, নতুন সরকার গঠনের পর তারপর তাদের টনক নড়লো। এবং আবার আংশিক লকডাউন শুরু হল রাজ্য জুড়ে। কিন্তু এই সব কিছুর মধ্যে সবচেয়ে অদ্ভুত এবং আশ্চর্যজনক যেটা, তা হল এত প্রতিশ্রুতির জোয়ার, চুরির অভিযোগ, কে বেশি জনদরদি এই সমস্ত কিছু প্রমাণ করার বাজারে একজনও নেতানেত্রী, মন্ত্রীরা এত ছাত্রছাত্রীদের ভবিষ্যৎ যে কঠিন অন্ধকারে তলিয়ে যাচ্ছে, তা নিয়ে কোনও উচ্চবাচ্য করলেন না। ছাত্রছাত্রীদের ভবিষ্যৎ নিয়ে এতটাই উদাসীন যে এমনকি সরকার গঠনের পরেও আজ পর্যন্ত কোনও নেতানেত্রী আমাদের অনিশ্চিত ভবিষ্যত নিয়ে একটিও বাক্য খরচ করছেন না।

ছাত্রছাত্রীদের ভবিষ্যতের সঙ্গে জড়িত আমাদের দেশের ভবিষ্যৎ। একটা গোটা প্রজন্ম যদি শিক্ষা থেকে বঞ্চিত হয়, আজ থেকে ২৫/৩০ বছর পর তার বিষফল ফলতে শুরু করবে। শিক্ষিত মানবসম্পদের অভাবে মুখ থুবড়ে পড়বে দেশের অগ্রগতি। নেতানেত্রী, নীতি নির্ধারকেরা এইসব কথা আর কবে বুঝবেন? কঠোর ভাবে স্বাস্থ্য বিধি মানা হোক। প্রয়োজনে স্কুল, কলেজ ক্যাম্পাসগুলিকে নিয়মিত স্যানিটাইজ করার ব্যবস্থা করা হোক। ছাত্রদের জন্য জেলা হাসপাতাল ও নার্সিংহোমগুলিতে রাখা হোক বিশেষ বেডের ব্যাবস্থা। কিন্তু অবিলম্বে ক্লাস শুরু করা হোক। অনলাইনে নয়, ক্লাসরুমে।

Share Now:

LEAVE YOUR COMMENT

Your email address will not be published. Required fields are marked *