নয়া আটলান্টিক সনদ, জি৭ ও ন্যাটোর শীর্ষ বৈঠক- অতিমারির মধ্যেই তীব্র হচ্ছে সাম্রাজ্যবাদী দ্বন্দ্ব
কোভিড ১৯ অতিমারির ধ্বংসলীলার মধ্যেই তীব্র হতে চলেছে সাম্রজ্যবাদীদের মধ্যেকার কামড়াকামড়ি। জি সেভেনের তিনটি বৈঠক, ন্যাটোর শীর্ষ বৈঠক এবং ‘নয়া আটলান্টিক সনদ’ চুক্তি সেই দিকেই ইঙ্গিত করছে। ১০ জুন লন্ডনে ব্রিটেন ও ইংল্যান্ডের মধ্যে ‘নয়া আটলান্টিক সনদ’ চুক্তি সই হয়েছে। ১১ থেকে ১৩ জুন ইংল্যান্ডের কর্নওয়ালে হয়েছে জি সেভেনের বৈঠকগুলি। ১৪ জুন বেলজিয়ামের রাজধানী ব্রাসেলেসে হেড কোয়ার্টারে হয়েছে ন্যাটোর শীর্ষ বৈঠক। সবকটি ঘটনাকেই আমেরিকা ব্যবহার করেছে চিন ও রাশিয়ার বিরুদ্ধে অন্যান্য সাম্রাজ্যবাদীদের জোট মজবুত করার কাজে।
পরপর ঘটনাগুলির দিকে নজর দেওয়া যাক। ১০ জুন লন্ডনে বিডেন ও বরিস জনসনের মধ্যে যে ‘নয়া আটলান্টিক সনদ’ চুক্তি সই হয়েছে, তার তাৎপর্য গভীর। যদিও এটা নিয়ে ওই দেশগুলির গণ মাধ্যমে তেমন প্রচার হয়নি। গোটা দুনিয়াতে তো নয়ই।
১৯৪১ সালের আগস্ট মাসে ঐতিহাসিক ‘আটলান্টিক সনদ’ সই করেছিলেন মার্কিন প্রেসিডেন্ট রুজভেল্ট এবং ব্রিটিশ প্রধানমন্ত্রী চার্চিল। এই চুক্তি হয়েছিল নাৎসি জার্মানি সোভিয়েত ইউনিয়ন আক্রমণ করার ২ মাস পর। ওই চুক্তিতে দুই ‘মহান গণতন্ত্র’ ঠিক করে নিয়েছিল আগামী পৃথিবী কোন কোন মূল্যবোধের দ্বারা চালিত হবে। সেগুলির মধ্যে ছিল, শক্তির প্রয়োগ বন্ধ করা, জনগণের সায়ত্তশাসনের অধিকার এবং দুনিয়ার সম্পদের ওপর সকলের সমানাধিকার।
ইতিহাস দেখিয়ে দিয়েছে, এই মূল্যবোধগুলি কীভাবে কার্যকর করা হয়েছে। এবার ‘পুনর্জীবিত’ আটলান্টিক সনদে ‘আমাদের গণতান্ত্রিক মূল্যবোধগুলিতে যারা নষ্ট করতে চায়, তাদের বিরুদ্ধে দাঁড়িয়ে এই মূল্যবোধগুলিকে রক্ষা’ করার অঙ্গীকার করা হয়েছে। আর তা করার লক্ষ্যে আমেরিকা ও ব্রিটেন তাদরে মিত্র দেশগুলিকে নিশ্চিত করেছে তারা ‘পারমাণবিক অস্ত্র ব্যবহার বন্ধ করার লক্ষ্যে কাজ করবে’ এবং ‘ন্যাটো একটি পরমাণু অস্ত্রধর জোটশক্তি’ হিসেবেই থেকে যাবে।
১৩ জুন শেষ হওয়া জি ৭ শীর্ষ বৈঠকে দুনিয়া জুড়ে বাড়তে থাকা চিনের অর্থনৈতিক ও সামরিক প্রভাবের বিরুদ্ধে লড়ার লক্ষ্যে প্রস্তাব পাস হয়েছে।
জি ৭-এর সাতটি দেশ হল- আমেরিকা, গ্রেট ব্রিটেন, ফ্রান্স, কানাডা, জার্মানি, ইতালি ও জাপান। এবারের বৈঠকে গত ৪০ বছরে দুনিয়া জুড়ে ঘটে যাওয়া প্রতিটি ঘটনার পর্যালোচনা করা হয়েছে। দেখা গেছে, ১৯৭৯ সালে চিনের অর্থনীতি ইতালির চেয়েও ছোটো ছিল আর আজ চিন বিশ্বের দ্বিতীয় ধনীতম অর্থনীতি এবং তারা বিশ্ব রাজনীতির গতিপথ নির্ধারণে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখছে।
তাকে রোখার জন্য, জি ৭ গরিব ও মাঝারি অর্থনীতির দেশগুলির পরিকাঠামো উন্নতির লক্ষ্যে একটি কর্মসূচি হাতে নিয়েছে। যার নাম ‘বিল্ড ব্যাক বেটার ওয়ার্ল্ড’(বি৩ডব্লিউ)। ট্রাম্পের ‘মেক আমেরিকা গ্রেট এগেইন’-এর বিপরীতে বিডেনের শ্লোগান ‘বিল্ড ব্যাক বেটার’। চিনের ট্রিলিয়ন ডলার বেল্ট অ্যান্ড রোড পরিকাঠামো প্রকল্পকে ধাক্কা দেওয়াই বি৩ডব্লিউ কর্মসূচির লক্ষ্য।
নির্দিষ্ট ভাবে বলতে গেলে, এই পরিকল্পনার লক্ষ্য, লাতিন আমেরিকা, ক্যারিবিয়ান দ্বীপপুঞ্জ, আফ্রিকা ও ভারত-প্রশান্ত মহাসাগরীয় অঞ্চলের দেশগুলো। মূলত চারটি ক্ষেত্রে বেসরকারি পুঁজি বিনিয়োগের লক্ষ্য নেওয়া হয়েছে এই কর্মসূচিতে। জলবায়ু, স্বাস্থ্য সুরক্ষা, ডিজিটাল প্রযুক্তি এবং লিঙ্গ সাম্য। আর্থিক প্রতিষ্ঠানগুলি থেকে বিনিয়োগ সংগ্রহ করা ছাড়াও এই উদ্যোগে ৪০ বিলিয়ন ডলার বিনিয়োগের কথা বলা হয়েছে। পাশাপাশি জি৭-এর অন্তর্ভূক্ত প্রতিটি দেশ ‘আলাদা আলাদা ভৌগলিক অঞ্চলে মনোযোগ দেবে’ বলেও ঘোষণা করা হয়েছে। আমরা সকলেই জানি সাম্রাজ্যবাদী শক্তিগুলো দুনিয়াকে নানা ভাগে ভাগ করেই শোষণ চালায়।
জি৭-এর ঘোষণাপত্রে রাশিয়াকে বলা হয়েছে তারা যেন “অন্য দেশের গণতান্ত্রিক ব্যবস্থায় হস্তক্ষেপ সহ বিভিন্ন অস্থিরতা সৃষ্টিকারী আচরণ এবং বিদ্বেষপরায়ণ কাজকর্ম বন্ধ করে”, এবং চিনের প্রতি অভিযোগ করা হয়েছে, তারা ‘বাজারের বাইরে গিয়ে যে সব কাজকর্ম চালাচ্ছে, তা বিশ্ব অর্থনীতির অবাধ ও স্বচ্ছ গতিশীলতাকে নষ্ট করছে”।
১৪ জুন ন্যাটোর শীর্ষ বৈঠক হয়. বোঝাই যাচ্ছে, তার আগেই জি৭ বৈঠকের মধ্যে দিয়ে ফ্রান্স, ইতালি, জার্মানি, ব্রিটেনের মতো ইউরোপের মহা শক্তিধর দেশগুলি আমেরিকার সঙ্গে চুক্তিবদ্ধ হয়েই গিয়েছিল। এই দেশগুলি ন্যাটোরও বৃহৎ শক্তি। ন্যাটোর বৈঠকের শুরুই হয় এই বিবৃতি দিয়ে-“ঠান্ডা যুদ্ধের অবসানের পর রাশিয়ার সঙ্গে আমাদের সম্পর্ক এখন সবচেয়ে খারাপ অবস্থায় রয়েছে। রাশিয়ার আগ্রাসী কাজকর্মের জন্যই এমনটা হয়েছে”। এবং “চিনের সামরিক ক্ষমতাবৃদ্ধি, বাড়তে থাকা প্রভাব এবং জোরজবরদস্তি আমাদের নিরাপত্তাকে চ্যালেঞ্জের মুখে ফেলেছে”। কোনো সন্দেহ নেই যে এই বিবৃতি স্পষ্ট যুদ্ধ ঘোষণা। এতে উত্তেজনা কমানোর জন্য আলোচনার কোনো সুযোগই নেই। এই শীর্ষ বৈঠকের মধ্যে দিয়ে ন্যাটো জোটের ইতিহাসে এক ‘নতুন অধ্যায়’ শুরুর ঘোষণা করা হয়েছে। এবারের বৈঠকের অন্যতম আলোচ্যসূচিতে ছিল ‘ন্যাটো ২০৩০’।
এবারের বৈঠকে মূলত ইউরোপিয়ান ইউনিয়নকে চিনের বিরুদ্ধে শক্তিশালী অবস্থানে নিয়ে আসার লক্ষ্য ছিল আমেরিকার। তার হাত ধরেই জর্জিয়া ও ইউক্রেনের রাশিয়া বিরোধী সরকারগুলিকে সমর্থন করারও সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়েছে ব্রাসেলসে।
ন্যাটোর বৈঠকের মধ্যে দিয়ে আমেরিকার সঙ্গে ইউরোপের সম্পর্ক সব দিক থেকে শক্তিশালী করা হয়েছে। রাজনীতি, সামরিক, অর্থনীতি, প্রযুক্তিগত, মহাকাশ এবং অন্যান্য দিকগুলিতেও। লক্ষ্য, এই সম্পর্কের শক্তিকে বিশ্ব জুড়ে ছড়িয়ে দেওয়া। উত্তর আমেরিকা থেকে ইউরোপ, এশিয়া থেকে আফ্রিকা। এর পরিপ্রেক্ষিতে আমেরিকা খুব শিগগির রাশিয়ার বিরুদ্ধে ইউরোপে এবং চিনের বিরুদ্ধে এশিয়ায় পরমাণু বোমা এবং মাঝারি পাল্লার পারমাণবিক ক্ষেপণাস্ত্র জড়ো করবে।
এই কারণে ন্যাটোর বৈঠকে সামরিক বাজেট আরও বাড়ানোর সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়েছে। এমনিতে ন্যাটোর ৩০টি দেশের মোট সামরিক বাজেটের ৭০% একা আমেরিকাই খরচ করে। এবার আমেরিকা বাকিদেরও চাপ দিয়েছে সামরিক খাতে বাজেট বাড়ানোর জন্য।
এইসব ‘পরিকাঠামো উন্নয়ন’ মার্কা কথাগুলো যে আসলে দুনিয়া জুড়ে সাম্রাজ্যবাদের বিস্তারকে শক্তিশালী করার কৌশলকে আড়াল করার জন্য তৈরি করা হয়, সে সকলেই জানে। আসলে বিভিন্ন কারণে মার্কিন সাম্রাজ্যবাদ আজ কিছুটা দুর্বল. যে রাজনৈতিক পরিস্থিতিতে সে দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পর এক নম্বর সাম্রাজ্যবাদী শক্তি হিসেবে উঠে এসেছিল, তা এখন নেই। চিন তার ঘাড়ে নিঃশ্বাস ফেলছে। এই অবস্থায় এক নম্বর অবস্থানকে ধরে রাখার জন্য বিডেনের এই নয়া বেপরোয়া উদ্যোগ। যদিও ওয়াকিবহাল মহল মনে করছে, ঘোষিত বিবৃতিতে যাই লেখা থাক, বাস্তব পরিস্থিতি তেমন নয়। জি৭ এবং ন্যাটোর মধ্যে এমন অনেক ইউরোপীয় দেশ রয়েছে, যারা চিনের সঙ্গে সম্পর্ক খারাপ করতে চায় না। জি ৭-এ ইতালি বিবৃতির বক্তব্য নিয়ে আপত্তি করেছিল। মহামারির সময় তারা চিনের দ্বারা নানা ভাবে উপকৃত হয়েছে। অন্যদিকে ভূমধ্যসাগরীয় দেশগুলি চিনের সিল্ক রুটে যুক্ত হয়েছে। অনেকেই ঘোষণাপত্রের লেখা কার্যকর করার ক্ষেত্রে ‘ধীরে চলো’ নীতি নেবে, তা বলাই যায়। অন্যদিকে বাড়তে থাকা সাম্রাজ্যবাদ চিনও পিছু হঠার পাত্র নয়। তারা নিজেদের বাজার বাড়াতে কোনো বাধাই মানতে চাইছে না।
সব মিলিয়ে আমেরিকার পক্ষে পরিস্থিতি সহজে নিজের পক্ষে আনা সম্ভব হবে না। ১৬ জুন জেনেভায় পুতিনের সঙ্গে বিডেনের বৈঠকের পর যৌথ সাংবাদিক সম্মেলন না হওয়াটাও সে দিকেই ইঙ্গিত করছে। গোটা দুনিয়াই এখন যুদ্ধ পরিস্থিতির মধ্যে রয়েছে। সব কটি সাম্রাজ্যবাদী শক্তি যুদ্ধ এড়ানোর জন্য ভারসাম্যর খেলা খেলছে। যে কোনো সময় পরিস্থিতি পাল্টে যেতে পারে কারণ ‘সাম্রাজ্যবাদ মানেই যুদ্ধ’। এই যুদ্ধকে আটকানোর সবচেয়ে বড়ো দায়িত্ব দুনিয়ার শ্রমজীবী জনতার কাঁধে। কারণ হয় ‘বিপ্লব যুদ্ধকে ঠেকাবে অথবা যুদ্ধ বিপ্লবকে ত্বরাণ্বিত করবে’।