করোনার তৃতীয় ঢেউতে শিশুরা বেশি আক্রান্ত হবে- এমন আশঙ্কার কোনো ভিত্তি আছে?
পিপলস ম্যাগাজিন ডেস্ক: কোভিডের দ্বিতীয় ঢেউয়ের ধাক্কা কমে আসতেই ভারতের বিভিন্ন রাজ্য তৃতীয় ঢেউয়ের প্রস্তুতি শুরু করে দিয়েছে। আর সেক্ষেত্রে বিশেষ গুরুত্ব দেওয়া হচ্ছে শিশুদের সুরক্ষার ব্যাপারে।
উদাহরণ হিসেবে বলা যায়, পশ্চিমবঙ্গ সরকার শিশুদের জন্য ১০০০০টি নতুন বেডের উদ্যোগ নিয়েছে। তার মধ্যে বেশ কিছু ইনটেনসিভ কেয়ার ইউনিট তৈরির সিদ্ধান্তও হয়েছে।
উত্তর প্রদেশ সরকার ১০ বছরের কম বয়সিদের বাবা-মায়েক টিকাকরণে বাড়তি গুরুত্ব দিয়েছে। পাশাপাশি ১৫ জুন থেকে শিশুদের বিনা পয়সায় মেডিকেল কিট দেওয়া হচ্ছে। তাতে থাকছে কাশির সিরাপ, চুষে খাওয়ার ট্যাবলেট, অ্যান্টি ভাইরাল ওষুধ ইত্যাদি।
ঝাড়খণ্ডে তৃতীয় ঢেউয়ের সময় শিশুদের চিকিৎসার জন্য বিশেষ ম্যানুয়াল বানানো হয়েছে। সরকারের বক্তব্য, সে সময় শিশুদের চিকিৎসার জন্য ৬০০০ বেডের প্রয়োজন হতে পারে। তাদের দাবি রাজ্যের অন্তত ১৪ লক্ষ শিশুর কোভিডে আক্রান্ত হওয়ার সম্ভাবনা রয়েছে। যদিও গত মার্চ ও এপ্রিল মাসে সে রাজ্যে যত জন সংক্রমিত হয়েছেন, তাদের মধ্যে মাত্র ৫ শতাংশ ১৪ বছরের কম বয়সি শিশু।
কর্নাটক সরকার শিশুদের জন্য আলাদা বেড ও কোভিড কেয়ার সেন্টার তৈরির জন্য একটি টাস্ক ফোর্স গঠন করেছে।
কিন্তু এই সব উদ্যোগের পেছনে বৈজ্ঞানিক ভিত্তি কী? তৃতীয় ঢেউয়ের ব্যাপারে আমরা কী জানি এবং সেই ঢেউ জনগণের কোন অংশকে সবচেয়ে বেশি সংক্রমিত করতে পারে?
মহামারি বিশেষজ্ঞ চন্দ্রকান্ত লাহাড়িয়ার মতে, “এখনও অবধি কোনো বৈজ্ঞানিক বা মহামারিবিজ্ঞান সম্মত প্রমাণ মেলেনি যা থেকে বলা চলে যে, তৃতীয় ঢেউতে শিশুরা অন্যান্যদের থেকে অনেক বেশি পরিমাণে সংক্রমিত হবে”।
দ্য ল্যানসেটের ‘কোভিড-১৯ ইন্ডিয়া টাস্ক ফোর্স’-এর রিপোর্টও একই কথা বলছে। এখনও অবধি যত শিশু করোনায় আক্রান্ত হয়েছে, তাদের বেশিরভাগই উপসর্গহীন এবং যাদের উপসর্গ দেখা গেছে, তাদের ক্ষেত্রেও সেটা মৃদু উপসর্গ ছাড়া কিছু নয়।
কোনো প্রমাণ ছাড়াই রাজ্যগুলো আচমকা তৃতীয় ঢেউ নিয়ে যা ভাবে তাড়াহুড়ো করে পদক্ষেপ করছে, তার পেছনে অন্য কারণ আছে বলে মনে করছে ওয়াকিবহাল মহল। লাহাড়িয়ার মতে, এটা করলে রাজ্যগুলো লাভবান হতে পারে। তারা দেখাতে চাইছে যে, তারা নির্দিষ্ট পদ্ধতি অনুযায়ী পদক্ষেপ করছে।
তৃতীয় ঢেউয়ে শিশুদের আক্রান্ত হওয়ার সম্ভাবনার তত্ত্বটা কোথা থেকে উদয় হল?
বি৫আনীদের কাছে এর কোনো উত্তর নেই। কিন্তু তারা বলছেন, গত ১২ মে টাইমস অফ ইন্ডিয়া পত্রিকায় হৃদ-শল্য চিকিৎসক দেবী শেঠির একটি নিবন্ধ প্রকাশিত হয়। তিনি তৃতীয় ঢেউয়ের প্রস্তুতির জন্য তৈরি কর্নাটকের কোভিড ১৯ টাস্ক ফোর্সের প্রধান।
যেহেতু এখনও পর্যন্ত কেবল ১৮ বছরের বেশি বয়সিদেরই টিকা দেওয়া হচ্ছে, তাই শেঠি ওই নিবন্ধে কর্তৃপক্ষের কাছে আবেদন করেন, যাতে তাঁরা দ্রুত শিশুদের বাবা-মাদের টিকা দেওয়ার ব্যবস্থা করেন। কারণ, তাঁরমতে, ‘তৃতীয় ঢেউ প্রধানত শিশুদের আক্রমণ করবে’।
তাঁর বক্তব্য, প্রথম ঢেউ প্রধানত বয়স্কদের সংক্রমিত করেছে। দ্বিতীয় ঢেউ সংক্রমিত করেছে তুলনায় কম বয়সি চাকুরিজীবীদের। তৃতীয় ঢেউ আক্রমণ করবে শিশুদের কারণ বেশিরভাগ প্রাপ্ত বয়স্ক মানুষই ততদিনে হয় সংক্রমিত হয়ে যাবেন বা টিকা পেয়ে যাবেন।
তিনি লেখেন, প্রাপ্তবয়স্কদের আইসিইউ-তে চিকিৎসা করার থেকে শিশুদের চিকিৎসা করা আলাদা ব্যাপার। তিনি হিসেব দেন, যদি ধরে নেওয়া যায়, শিশুদের ২০% সংক্রমিত হবে এবং ৫%-এর ক্রিটিকাল কেয়ারের প্রয়োজন হবে, তাহলে দেশ জুড়ে ১.৬৫ লক্ষ আইসিইউ শয্যা লাগবে।
তবে তার এই দাবির বৈজ্ঞানিক ভিত্তি প্রসঙ্গে শেঠি কোনো ব্যাখ্যা দেননি। তাঁর নিবন্ধ প্রকাশিত হওয়ার ১০ দিন পর ‘ইন্ডিয়ান একাডেমি অফ পেডিয়াট্রিকস’ একটি বিবৃতি দেয়। তাতে তারা বলে, তৃতীয় ঢেউ বেশি করে শিশুদের আক্রমণ করবে, এমন সম্ভাবনা নেই বললেই চলে। তারা বলেন, “সংক্রমিত শিশুদের খুবই ক্ষুদ্র অংশের মাঝারি থেকে গুরুতর অসুখ হতে পারে। যদি আক্রান্ত মানুষের সংখ্যায় বিশাল বৃদ্ধি হয়, তাহলেই কেবল বহু সংখ্যায় মাঝারি থেকে গুরুতর অসুস্থ শিশুর দেখা মিলতে পারে”।
ঝাড়খণ্ড সরকারের সংশ্লিষ্ট কর্তাদের শিশুদের জন্য কোভিড চিকিৎসার ম্যানুয়াল তৈরি প্রসঙ্গে জানতে চাইলে তারা বলেন, অপ্রত্যাশিত পরিস্থিতির কথা ভেবেই তারা দেশে সবার আগে এমন ম্যানুয়াল তৈরি করেছেন। যদি তৃতীয় ঢেউ না আসে, তাহলে তারা এই ম্যানুয়ালকে কার্যকর করবেন না।
উত্তর প্রদেশ সরকার ১৮ বছরের নীচের বিভিন্ন বয়সের শিশুদের মেডিকেল কিট বিলোচ্ছে। ৫০ লক্ষ শিশুকে এই কিট দেওয়ার পরিকল্পনা রয়েছে। কিটে থাকছে প্যারাসিটামল ট্যাবলেট, কাশির সিরাপ, চুষে খাওয়ার উপযোগী মাল্টিভিটামিন ট্যাবলেট ও ড্রপ, ওআরএস এবং ইভেরমেকটিন। এর জন্য কত খরচ হচ্ছে, তা জানাতে চাননি সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষ।
বিজ্ঞানীদের মতে এই কিট বিলোনোয় কোভিড প্রতিরোধে কোনো সুবিধা হবে না। রোগ প্রতিরোধ বিশেষজ্ঞ এবং ইন্ডিয়ান ইনস্টিটিউট অফ সায়েন্টিফিক এডুকেশন অ্যান্ড রিসার্চের অধ্যাপক বিনীতা বলের মতে, ‘বাবা রামদেবের করনিল বণ্টনের সঙ্গে এর কোনো তফাৎ নেই’।
বস্তুত, ভারতে করোনার তৃতীয় ঢেউ কেমন হতে চলেছে, সে সম্পর্কে তথ্য প্রায় নেই বললেই চলে। অনেক বিজ্ঞানীর মতে এটা অনিশ্চিত সম্পর্কে পূর্বাভাস করার চেষ্টা ছাড়া কিছু নয়। কারণ ভাইরাসটি সম্পর্কে তেমন কিছুই এখনও জানা যায়নি।
মহারাষ্ট্রের সেবাগ্রামের মহাত্মা গান্ধি ইনস্টিটিউট অফ মেডিকেল সায়েন্সের মেডিসিনের অধ্যাপক এবং মেডিকেল সুপারিন্টেন্ডেন্ট এস.পি কালান্ত্রির মতে, “ভাইরাস এসব অঙ্কের নিয়ম মেনে চলে না। সে মাতালের মতো, সে নিজেই জানে না যে তার পরের পা-টা কোথায় পড়বে আর আমরা সেই পদক্ষেপের পূর্বাভাস করার চেষ্টা করছি”।
কবে তৃতীয় ঢেউ আসবে, তা নিয়ে এখনও কোনো ইঙ্গিত মেলেনি। তবে শিশুরাই তাতে মূলত আক্রান্ত হবে কিনা, তা অনেকগুলি বিষয়ের ওপর নির্ভর করছে বলে মনে করছেন বিজ্ঞানীরা। তাদের মতে, তৃতীয় ঢেউয়ের সময় কত মানুষের আক্রান্ত হওয়ার সম্ভাবনা থাকবে, তার দ্বারাই নির্ধারিত হবে শিশুদের আক্রান্ত হওয়ার সম্ভাবনা। তারা বলছেন, তৃতীয় ঢেউ আসার আগে যদি বেশির ভাগ প্রাপ্তবয়স্ক টিকা পেয়ে যান, তাহলে আক্রান্ত হওয়ার সম্ভাবনা থাকবে অনেক কম মানুষের। সেক্ষেত্রে শিশুদের সংক্রমিত হওয়ার সম্ভাবনাও অনেক কমে যাবে। তবে সেক্ষেত্রে তৃতীয় ঢেউ কবে আসছে, তার উপর অনেক কিছুই নির্ভর করছে।
অন্যদিকে যদি শিশুরা সংক্রমিতও হয়, তাহলেও তাদের মৃত্যুহার অনেক কম। মার্চে ল্যানসেটের প্রকাশিত একটি রিপোর্ট তা দেখা গেছে। ওই রিপোর্টে আমেরিকা, ইউকে, ইতালি, জার্মানি, দক্ষিণ কোরিয়া সহ সাতটি দেশের শিশু মৃত্যুর হারের বিশ্লেষণ করা হয়েছে।