Home মানবাধিকার রাষ্ট্রের হেফাজতে মৃত্যু, মানবাধিকার ও ভারত

রাষ্ট্রের হেফাজতে মৃত্যু, মানবাধিকার ও ভারত

রাষ্ট্রের হেফাজতে মৃত্যু, মানবাধিকার ও ভারত
0
রাজীব দত্ত, আইনজীবী

কাস্টোডিয়াল ডেথের ঘটনা আজ একবিংশ শতকে দাঁড়িয়ে আন্তর্জাতিক মানবাধিকার আইনের দৃষ্টিতে দেখলে,ডোডো পাখির মত বিলুপ্ত প্রাণী মনে হলেও তৃতীয় বিশ্বের দেশগুলিতে বিশেষ করে ভারতের প্রেক্ষিতে এটা খুবই সাধারণ ঘটনা।আগে জানি কাকে বলে, ‘কাস্টোডি’। ফৌজদারি কার্যবিধি আইনের,১৯৭৩ ধারা ১৬৭(১) মতে Section 167 in The Code Of Criminal Procedure, 1973

  1. Procedure when investigation cannot be completed in twenty four hours.

(1) Whenever any person is arrested and detained in custody and it appears that the investigation cannot be completed within the period of twenty- four hours fixed by section 57, and there are grounds for believing that the accusation or information is well- founded, the officer in charge of the police station or the police officer making the investigation, if he is not below the rank of sub- inspector, shall forthwith transmit to the nearest Judicial Magistrate a copy of the entries in the diary hereinafter prescribed relating to the case, and shall at the same time forward the accused to such Magistrate.

ফৌজদারি কার্যবিধি আইনের,১৯৭৩ ধারা ১৬৭(১) মতে কাস্টোডি দুই প্রকার-

১) পুলিশ কাস্টোডি(পুলিশ হেফাজত)

২) জুডিশিয়াল কাস্টোডি (বিচারবিভাগীয় হেফাজত)

এছাড়া জেল আইন,১৮৯৪ তেও কাস্টোডি বিষয়ে বলা আছে। এখানে বলা আছে-

Section 3 in The Prisons Act, 1894

  1. Definitions.—In this Act—

(1) “prison” means any jail or place used permanently or temporarily under the general or special orders of a State Government for the detention of prisoners, and includes all lands and buildings appurtenant thereto, but does not include—

(b) any place specially appointed by the State Government under section 541 of the Code of Criminal Procedure, 1882 (10 of 1882); or

(c) any place which has been declared by the State Government by general or special order, to be a subsidiary jail;

এবার দেখি কাকে বলে ‘কাস্টডিয়াল ডেথ’। সহজ ভাষায় বলা যেতে পারে,যখন কোন বন্দি পুলিশি হেফাজতে মারা যায় বা জেল বন্দি হিসাবে জেলে মারা যায় তাকে আমরা কাস্টোডিয়াল ডেথ বলি, এছাড়া মিলিটারি বা প্যারামিলিটারির ক্যাম্পেও আটক কোন বন্দির মৃত্যু ঘটলে সেটাকেও কাস্টোডিয়াল ডেথ বলা হয়।

অতি সম্প্রতি ২০২০ সালে ২৬ জুন ‘International Day In Support Of Victims Of Torture’ তে ‘National Campaign Against Torture’ নামে একটি আন্তর্জাতিক মানবাধিকার সংস্থা ‘India-Annual report on torture-2019’ প্রায় ২৪৫ পাতার একটা রিপোর্ট পেশ করে,তাতে ভারতে কাস্টোডিয়াল ডেথের  এক ভয়াবহ চিত্র উঠে এসেছে। মোট ১৭৩১ জন বন্দির কাস্টোডিয়াল ডেথ ঘটেছে। অর্থাৎ প্রতিদিন প্রায় পাঁচ জন ব্যক্তি কাস্টোডিয়াল ডেথের শিকার। তার সাথে এটাও লক্ষ্যণীয় এটা ‘অফিশিয়ালি রেকর্ডেড’, এর বাইরেও আরো বহু সংখ্যায় ঘটনা আছে,কারণ এতে মিলিটারি বা প্যারামিলিটারির ক্যাম্পেও আটক বন্দির মৃত্যুর ঘটনাগুলো ধরা হয়নি। যা ছত্তীসগঢ় রাজ্যর বস্তার,দান্তেওয়ারা বা মহারাষ্ট্রের গড়চিওয়ালি বা কাশ্মীরের ক্ষেত্রে খুবই সাধারণ ঘটনা। এই ১৭৩১ জন বন্দির মধ্যে ১৬০৬ জন বন্দির মৃত্যু ঘটেছে জেলে বা জুডিশিয়াল কাস্টোডিতে আর ১২৫ জন বন্দির মৃত্যু ঘটেছে পুলিশি হেফাজতে। পুলিশি হেফাজতে মৃত্যুর ক্ষেত্রে আমরা যদি রাজ্যওয়ারি সংখ্যা বিভাগ করে দেখি,তাতে দেখি- সর্বাধিক ১৪ জন বন্দির মৃত্যুর ঘটেছে উত্তরপ্রদেশে। এর পরই আছে তামিলনাড়ু আর পঞ্জাব,এখানে ১১ জন বন্দি মৃত্যু ঘটেছে। এরপর আছে বিহার। এখানে মোট ১০ জন বন্দির পুলিশি হেফাজতে মৃত্যু ঘটেছে। এছাড়া অন্য রাজ্যর মধ্যে মধ্যপ্রদেশে নয় জন বন্দি, গুজরাটে আট জন, দিল্লি ও ওড়িশাতে সাত জন, ঝাড়খণ্ডে ছয় জন, ছত্তীসগঢ়,মহারাষ্ট্র, রাজস্থানে পাঁচ জন বন্দির পুলিশি হেফাজতে মৃত্যু ঘটেছে। অন্ধ্রপ্রদেশ ও হরিয়ানায় চার জন। কেরালা,কর্নাটক,পশ্চিমবঙ্গে তিন জন। জম্মু-কাশ্মীর, উত্তরাখণ্ড, মনিপুরে দুই জন বন্দি।

অসম,হিমাচল প্রদেশ, তেলেঙ্গানা, ত্রিপুরায় এক জন বন্দির পুলিশি হেফাজতে মৃত্যু ঘটে।

১২৫ টি পুলিশি হেফাজতে মৃত্যুর মধ্যে ৯৩ জন বন্দির  অর্থাৎ প্রায় ৭৪.৪০%  মৃত্যুর কারণই হল লকআপে অত্যাচার, এছাড়া ২৪ জন বন্দির  অর্থাৎ প্রায় ১৯.২০%   মৃত্যুর কারণ রহস্যজনক। এছাড়া ১৬ জন বন্দির মৃত্যুর কারণ আত্মহত্যা, ৭ জন বন্দির মৃত্যুর কারণ অসুস্থতা আর ১ জনের আঘাতজনিত কারণ এবং বাকি ৫ জন বন্দির মৃত্যুর ক্ষেত্রে কোনো কারণ বর্নিত হয়নি। যা শতাংশ-এর বিচারে ৪ %।

এবার আমরা দেখব কি কি নির্যাতনের পদ্ধতি ব্যবহার হয়-

১)  বন্দিদের দেহে পেরেক ঠোকা,বিহারের গুফান আলম ও তসলিম আনসারির দেহে এই জাতীয় আঘাত পাওয়া গেছে।

২) পায়ের উপর রোলার চালানো ও পুড়িয়ে দেওয়া, জম্মু-কাশ্মীরের রিজওয়ান আসাদ পন্ডিতের দেহে এই জাতীয় আঘাত পাওয়া গেছে।

৩) ‘ফালাঙ্গা’ পদ্বতিতে অত্যাচার করা মানে পায়ের চেটোতে লাঠি,রড বা যে কোন ভোঁতা অস্ত্র দিয়ে আঘাত করা,কেরালার রাজকুমার নামে বন্দির দেহে এই জাতীয় আঘাত পাওয়া গেছে।

৪) পা দুটোকে জোর করে বিপরীত দিকে স্ট্রেজ করা, কেরালার রাজকুমার নামে বন্দির দেহে এই জাতীয় আঘাত পাওয়া গেছে।

৫) যৌনাঙ্গে আঘাত করা, হরিয়ানার ব্রিজপাল মৌর্য ও নার্জিনারি নামে দুই বন্দির দেহে এই প্রকার আঘাত পাওয়া গেছে। এখানে লক্ষ্যণীয়, নারী বন্দিদের উপরও একই অত্যাচার হচ্ছে।

এছাড়া বহু রকম অত্যাচার-এর পদ্ধতি ব্যবহার করা হয়, যেমনঃ-

ক) বিদ্যুৎ-এর শক দেওয়া, পেট্রোল ও লঙ্কাগুড়ো যৌনাঙ্গে দেওয়া।

খ) হাতকড়ায় বেঁধে মারধোর করা।

গ) দেহে সুঁচ ফোটানো।

ঘ) লোহার শিক গরম করে ছেঁকা দেওয়া।

ঙ) নগ্ন করে মারধোর করা, মুখে প্রস্বাব করা,পাছাতে শক্ত লোহার রড বা লাঠি বা যেকোনো ভোঁতা অস্ত্র ঢোকানো।

চ) হাত-পা বেঁধে ঝুলিয়ে মারা,জোর করে মুখ-মেহন করতে বাধ্য করা।

ছ) হাতের নখ উপড়ে দেওয়া,জোর করে থেঁতলে দেওয়া।

জ) দুটো টেবিলের দ্বারা দড়ি দিয়ে বেঁধে,লোহার রড দিয়ে মারধোর করা।

ঝ) গর্ভবতী মহিলার তল পেটে আঘাত আঘাত করা!

(২)

এবার আমরা দেখব কারা কাস্টোডিয়াল ডেথের শিকার,পুলিশি হেফাজতে থাকা ১২৫ জন বন্দির মধ্যে ৭৫ জন বন্দি অর্থাৎ প্রায়  ৬০% দরিদ্র ও সংখ্যালঘু সম্প্রদায় ভুক্ত। ১৩ জন বন্দি  দলিত-আদিবাসী সম্প্রদায়ের ও ১৫ জন বন্দি মুসলিম সম্প্রদায় ভুক্ত। ৩৫ জনকে পেটি কেসে ধরা হয়।

তিনজন কৃষক,দুইজন নিরাপত্তা রক্ষী,দুই জন গাড়ির ড্রাইভার,একজন দিনমজুর,একজন কাগজকুড়ানি আর একজন রিফিউজি।

আরো যেটা ভয়াবহ। সামাজিক ভাবে দুর্বল শ্রেণির মহিলারা নিয়মিত ভাবে বন্দি অবস্থায় ভয়ানক শারিরিক,মানসিক এবং যৌন নির্যাতনের শিকার হচ্ছে,২০১৯ সালে চার জন মহিলা বন্দির হেফাজতে মৃত্যু ঘটেছে।

(৩)

এখন আমরা কাস্টোডিয়াল ডেথের আইনগত দিকটা নিয়ে আলোচনা করব। প্রথমে আন্তর্জাতিক আইন নিয়ে আলোচনা করব।

১৯৮৭ সালে  UN Convention against Torture and Other Cruel, Inhuman or Degrading Treatment or Punishment (UNCAT) পাস হয়,কিন্তু ভারত এটা এখনো অনুমোদন দেয়নি। যদিও আগের ১৯৭৫ সালে রাষ্ট্রপুঞ্জে পেশ করা UN Convention against Torture-  এ ভারত অনুমোদন দেয়। পরবর্তীকালে ২০১০ সালে Prevention of  Torture Bill লোকসভাতে পেশ হয়, বহু আলোচনাও চলে, সেখানে বহুদিন পড়ে থেকে অবশেষে পাস হয়। এই বিলে টর্চারের মানে অনেক ব্যাপক অর্থে দেওয়া আছে। এই বিলে বলা হয়েছে, যদি কোন সরকারি কর্মচারী যদি কোনো সাধারণ মানুষের কাছে বা কোন তৃতীয় ব্যক্তির কাছে কোন তথ্য বার করার জন্য বা স্বীকারোক্তি আদায় করার জন্য তাকে ভয়ানক ভাবে আঘাত করে বা তার দেহের অঙ্গ বা জীবন নাশ করে বা তাকে শারিরিক বা মানসিক ভাবে অত্যাচার করে, এই গুলোকে সব টর্চার বা কাস্টোডিয়াল ভায়োলেন্স হিসাবে গণ্য করা হবে এবং দোষী ব্যক্তির দশ বছরের জন্য সশ্রম কারাদণ্ড হবে।

এরপর সেটা রাজ্যসভাতে যায়,রাজ্যসভা সেটাতে কিছু সংশোধনী করে সংসদের সিলেক্ট কমিটিতে পাঠায়, সংশোধনগুলো হল-১ ) টর্চারের অর্থ আরো বৃহৎ পরিসরে নেওয়া।

২)মহিলা ও শিশুদের ক্ষেত্রে আলাদা আইনের বিধান রাখা।

৩) ক্ষতিপূরণ বাবদ টাকার পরিমাণ বৃদ্ধি।

৪) একটা স্বাধীন অথরিটি তৈরি করা যারা এই বিষয়গুলো নিয়ে বিচার করবে,ইত্যাদি।

২০১৭ সালে ল কমিশন জানায় তারা এই বিলটিকে খুব গুরুত্বের সাথে দেখছে।

কিন্তু আজও আইন হিসাবে সেটি পাশ হতে পারেনি!

(৪)

এবার আমরা কাস্টোডিয়াল ডেথের ভারতীয় আইনের দিকটা নিয়ে আলোচনা করব। প্রথমে আমরা দেখব ভারতীয় আইনানুযায়ী একজন গ্রেফতার হওয়া বন্দির কী কী অধিকার আছে..

১) প্রথমেই ভারতীয় সাংবিধানিক আইন অনুযায়ী ধারা ২১ মতে জীবন ও ব্যক্তি স্বাধীনতার অধিকার।

২)ভারতীয় সাংবিধানিক আইন অনুযায়ী ধারা ২২(১) মতে প্রতিটা গ্রেফতার হওয়া ব্যক্তির জানার অধিকার আছে, কী কারণে তিনি গ্রেফতার হলেন। এই অধিকারটি ফৌজদারি কার্যবিধি আইনের,১৯৭৩ ধারা ৫০ মতে ও প্রযুক্ত।

৩) ভারতীয় সাংবিধানিক আইন অনুযায়ী ধারা ২২(২) মতে প্রতিটা গ্রেফতার হওয়া ব্যক্তিকে ২৪ ঘন্টার মধ্যে ম্যাজিস্ট্রেটের কাছে হাজির করতে হবে। ফৌজদারি কার্যবিধি আইনের,১৯৭৩ ধারা ৫৫ মতে ও গ্রেফতারকারি পুলিশগণেরও এটা দায়িত্ব যে গ্রেফতার হওয়া ব্যক্তিকে কোন রূপ ব্যাঘাত ছাড়াই ২৪ ঘন্টার মধ্যে ম্যাজিস্ট্রেটের কাছে হাজির করতে হবে।

৪) ফৌজদারি কার্যবিধি আইনের,১৯৭৩ ধারা ৫০ক মতে ও গ্রেফতারকারি পুলিশগণেরও এটা দায়িত্ব যে গ্রেফতার হওয়া ব্যক্তির নিকট আত্মীয়কে জানানো,যে সে গ্রেফতার হয়েছে।

৫) ফৌজদারি কার্যবিধি আইনের,১৯৭৩ ধারা ৫০(২) মতে ও গ্রেফতার হওয়া ব্যক্তির জামিন পাওয়ার অধিকার আছে।

৪) ফৌজদারি কার্যবিধি আইনের,১৯৭৩ ধারা ৫৫ মতে যদি কোন জুনিয়র পুলিশ অফিসার সিনিয়র পুলিশ অফিসারে হুকুম অনুযায়ী কোনো ব্যক্তিকে গ্রেফতার করে, তাহলে তাকে সেই হুকুমনামাটি গ্রেফতার হওয়া বন্দিকে দেখাতে হবে।

৫) ফৌজদারি কার্যবিধি আইনের,১৯৭৩ ধারা ৭৫  মতে পুলিশ যখন কোন ওয়ারেন্ট এক্সিকিউট করবে,তখন সেই গ্রেফতার হওয়া ব্যক্তিকে আগে থেকে জানাতে হবে ওয়ারেন্টের ব্যাপারে এবং পরেও সব ধারা,উপধারাগুলিও জানাতে হবে।

৬) ফৌজদারি কার্যবিধি আইনের,১৯৭৩ ধারা ৭৬ মতে পুলিশগণেরও এটা দায়িত্ব যে গ্রেফতার হওয়া ব্যক্তিকে কোন রূপ ব্যাঘাত ছাড়াই ২৪ ঘন্টার মধ্যে ম্যাজিস্ট্রেট-এর কাছে হাজির করতে হবে। তবে আসা-যাওয়া পথের দুরত্বটি ২৪ ঘন্টা থেকে বিযুক্ত হবে।

৭) প্রতিটি মানুষের নায্য বিচার পাওয়ার অধিকার আছে।

৮) ভারতীয় সাংবিধানিক আইন অনুযায়ী ধারা ২২(১) মতে প্রতিটা গ্রেফতার হওয়া ব্যক্তির জানার অধিকার আছে,নিজের আইনজীবী নিযুক্ত করার।

৯)ভারতীয় সাংবিধানিক আইন অনুযায়ী ধারা ১৪  মতে আইনের চোখে সবাই সমান এবং সবারই আইনি রক্ষাকবচ আছে। এছাড়া দ্রুত বিচারের অধিকার(Right to speedy trial)এই ধারাই প্রদান করে।

১০) ফৌজদারি কার্যবিধি আইনের,১৯৭৩ ধারা ৪১ঘ ধারা মতে পুলিশগণের দ্বারা জিজ্ঞাসাবাদের সময় গ্রেফতার হওয়া ব্যক্তির আইনজীবীর উপস্থিত থাকার অধিকার আছে।

১১) ফৌজদারি কার্যবিধি আইনের,১৯৭৩ ধারা ৩০৩ মতে বিচারচলাকালীন বা সাজা হয়ে যাবার পরও যে কোনো বন্দির আইনি সাহায্য পাবার অধিকার আছে।

১২) ভারতীয় সাংবিধানিক আইন অনুযায়ী ধারা ৩৯ক অনুযায়ী বিনামূল্যে আইনি সুযোগ-সুবিধা পাওয়ার অধিকার আছে।

১৩) ফৌজদারি কার্যবিধি আইনের,১৯৭৩ ধারা ৩০৪ মতে শুধু ম্যাজিস্ট্রেট কোর্টেই নয়,দায়রা মোকদ্দমা ক্ষেত্রেও বিনামূল্যে  আইনি সুযোগ-সুবিধা পাওয়ার অধিকার আছে।

১৪) বন্দির কিছু না বলারও অধিকার আছে, কোন স্টেটমেন্ট বা স্বীকারোক্তি দিতে বন্দি বাধ্য নয়। যদিও এটা আইনি কোনো ধারায় নেই।

১৫) ভারতীয় সাংবিধানিক আইন অনুযায়ী ধারা ২২(২) মতে কাউকে নিজের বিরুদ্ধে সাক্ষ্য দিতে বাধ্য করা যায় না।

১৬) ফৌজদারি কার্যবিধি আইনের,১৯৭৩ ধারা ৫৪ মতে, চিকিৎসা পরিষেবা বন্দির প্রাপ্য।

১৭) ফৌজদারি কার্যবিধি আইনের,১৯৭৩ ধারা ৫৫ক মতে বন্দির সমস্ত জীবন ও চিকিৎসার দায়িত্ব সংশ্লিষ্ট পুলিশ অফিসারের।

১৮) ফৌজদারি কার্যবিধি আইনের,১৯৭৩ ধারা ৩৫৮ মতে কেউ যদি বে-আইনি ভাবে গ্রেফতার হয়,তার ক্ষতিপূরণ পাওয়ার অধিকার আছে।

১৯) ফৌজদারি কার্যবিধি আইনের,১৯৭৩ ধারা ৪১ক মতে কগনিজেবেল অপরাধের ক্ষেত্রে, যার সাজা ৭ বছরের কম সেক্ষেত্রে পুলিশকে অবশ্যই অভিযুক্ত ব্যক্তিকে নোটিশ দিতে হবে।

২০) ফৌজদারি কার্যবিধি আইনের,১৯৭৩ ধারা ৪৬ মতে গ্রেফতার যতটা সম্ভব কম বল প্রয়োগ করে করতে হবে।

২১) ফৌজদারি কার্যবিধি আইনের,১৯৭৩ ধারা ৪৬ মতে কাউকে কখনওই বে-আইনি ভাবে আটক করা যাবে না।

২২) ফৌজদারি কার্যবিধি আইনের,১৯৭৩ ধারা ৪১খ তে বলা আছে, গ্রেফতারকারী পুলিশের নাম,পদ এবং ব্যাজ পরিষ্কার ভাবে দৃশ্যমান হতে হবে।

২৩) ফৌজদারি কার্যবিধি আইনের,১৯৭৩ ধারা ৪১ঘ মতে গ্রেফতারির সময় বন্দির বন্ধু,পরিবারের পাশে থাকার অধিকার আছে। গ্রেফতারির পর সংশ্লিষ্ট পুলিশ অফিসার থানায় গ্রেফতারি সংক্রান্ত তথ্য ইত্যাদি সব থানায় ডায়েরিতে লিখবেন। বন্দিকে ডাক্তারি পরীক্ষার জন্য পাঠাবেন। তার জন্য আইনজীবী নিযুক্ত হওয়ার অধিকার এবং জিজ্ঞাসাবাদ করার সময় আইনজীবীর উপস্থিত থাকার অধিকার আছে।

২৪) ফৌজদারি কার্যবিধি আইনের,১৯৭৩ ধারা ৪১গ মতে গ্রেফতার হওয়া বন্দির ব্যাপারে জেলা এবং রাজ্যর প্রধান দফতরে জানাতে হবে,এমনকি প্রয়োজন পড়লে তা দৃশ্যমান জায়গায় টাঙিয়েও রাখতে হতে পারে।

(৫)

এবার আমরা কাস্টোডিয়াল ডেথের ভারতীয় আইনের দিকটা নিয়ে আলোচনা করে দেখব।

কাস্টোডিয়াল ডেথ হলেই ভারতীয় দণ্ডবিধি আইন,১৮৭২ আইনের ৩৩০,৩৩১,৩৪৮ ধারা মতে মামলা শুরু হবে। এবার আমরা দেখব এই তিনটি ধারায় কী কী আছে। Voluntarily  causing  hurt to  extort confession  or to compel restoration of property.

  1. Voluntarily causing hurt to extort confession or to compel restoration of property.– Whoever voluntarily causes hurt, for the purpose of extorting from the sufferer or from any person interested in the sufferer, any confession or any information which may lead to the detection of an offence or misconduct, or for the purpose of constraining the sufferer or any person interested in the sufferer to restore or to cause the restoration of any property or valuable security or to satisfy any claim or demand, or to give information which may lead to the restoration of any property or valuable security, shall be punished with imprisonment of either description for a term which may extend to seven years, and shall also be liable to fine.

Illustriations

(a) A, a police-officer, tortures Z in order to induce Z to confess that he committed a crime. A is guily of an offence under this section.

(b) A, a police-officer, tortures B to induce him to point out where certain stolen property is deposited. A is guilty of an offence under this section.

(c) A, a revenue officer, tortures z in order to compel him to pay certain arrears of revenue due from Z. A is guilty of an offence under this section.

(d) A, a zamindar, tortures a raiyat in order to compel him to pay his rent. A is guilty of an offence under this section.

অর্থাৎ ধারা ৩৩০ মতে কেউ যদি ইচ্ছাকৃত ভাবে কোন বন্দি ব্যক্তি বা ব্যক্তিবর্গকে নিজ স্বার্থের জন্য বা কোনো স্বীকারোক্তি আদায়ের জন্য বা কোনো অপরাধের কিনারা করার জন্য বা কোন মূল্যবান দ্রব্য ফিরে পাবার জন্য আঘাত করে সেই ব্যক্তির সাত বছরের জন্য সশ্রম কারাদণ্ড এবং জরিমানা হতে পারে।

এই ধারার illustration a এবং b তে পুলিশের কথাই লেখা আছে।

Voluntarily causing grievous hurt to extort confession, or to compel restoration of property.

  1. Voluntarily causing grievous hurt to extort confession, or to compel restoration of property.– Whoever voluntarily causes grievous hurt for the purpose of extorting from the sufferer or from any person interested in the sufferer any confession or any information which may lead to the detection of an offence or misconduct, or for the purpose of constraining the sufferer or any person interested in the sufferer to restore or to cause the restoration of any property or valuable security, or to satisfy any claim or demand or to give information which may lead to the restoration of any property or valuable security shall be punished with imprisonment of either description for a term which may extend to ten years, and shall also be liable to fine.

অর্থাৎ ধারা ৩৩১ মতে কেউ যদি ইচ্ছাকৃত ভাবে কোন বন্দি ব্যক্তি বা ব্যক্তিবর্গকে নিজ স্বার্থের জন্য বা কোনো স্বীকারোক্তি আদায়ের জন্য বা কোনো অপরাধের কিনারা করার জন্য বা কোন মূল্যবান দ্রব্য ফিরে পাবার জন্য মারাত্মক  আঘাত করে সেই ব্যক্তির দশ বছরের জন্য সশ্রম কারাদণ্ড এবং জরিমানা হতে পারে।

Wrongful confinement to extort confession, or compel restoration of property.

  1. Wrongful confinement to extort confession, or compel restoration of property.– Whoever wrongfully confines any person for the purpose of extorting from the person confined or any person interested in the person confined any confession or any information which may lead to the detection of an offence or misconduct, or for the purpose of constraining the person confined or any person interested in the person confined to restore or to cause the restoration of any property or valuable security or to satisfy any claim or demand, or to give information which may lead to the restoration of any property or valuable security, shall be punished with imprisonment of either description for a term which may extend to three years, and shall also be liable to fine.

অর্থাৎ  ধারা ৩৪৮ মতে কেউ যদি ইচ্ছাকৃত ভাবে কোন বন্দি ব্যক্তি বা ব্যক্তিবর্গকে নিজ স্বার্থের জন্য বা কোনো স্বীকারোক্তি আদায়ের জন্য বা কোনো অপরাধের কিনারা করার জন্য বা কোন মূল্যবান দ্রব্য ফিরে পাবার জন্য বেআইনি ভাবে আটক করে রাখে সেই ব্যক্তির তিন বছরের জন্য সশ্রম কারাদণ্ড এবং জরিমানা হতে পারে।

এবার আমরা এই ব্যাপারে ভারতীয় সাক্ষ্যপ্রমাণ আইন,১৮৭২ আইনের ধারা ২৫ ও ২৬ ঈ বলছে দেখব।

Section 25 in The Indian Evidence Act, 1872

  1. Confession to police officer not to be proved.—No confession made to a police officer1, shall be proved as against a person accused of any offence.—No confession made to a police officer1, shall be proved as against a person accused of any offence.”

অর্থাৎ ধারা ২৫ মতে পুলিশের কাছে করা কোনো স্বীকারোক্তি আদালতে গ্রাহ্য নয়।

Section 26 in The Indian Evidence Act, 1872

  1. Confession by accused while in custody of police not to be proved against him.—No confession made by any person whilst he is in the custody of a police officer, unless it be made in the immediate presence of a Magistrate1, shall be proved as against such person.—No confession made by any person whilst he is in the custody of a police officer, unless it be made in the immediate presence of a Magistrate2, shall be proved as against such person.” 2[Explanation.—In this section “Magistrate” does not include the head of a village discharging magisterial functions in the Presidency of Fort St. George 3[*] or elsewhere, unless such headman is a Magistrate exercising the powers of a Magistrate under the Code of Criminal Procedure, 1882 (10 of 1882)4].

অর্থাৎ ধারা ২৬ মতে আসামি যখন পুলিশের হেফাজতে কাছে তখন আসামির করা কোনো স্বীকারোক্তি আদালতে গ্রাহ্য নয়। যদি না কোনো ম্যাজিস্ট্রেট সেই স্বীকারোক্তি দেওয়া কালীন পুলিশ হেফাজতে উপস্থিত থাকেন।

এবার আমরা দেখব ফৌজদারি কার্যবিধি আইনের,১৯৭৩ ধারা ৭৬ কী বলছে এই বিষয়ে।

Section 76 in The Code Of Criminal Procedure, 1973

  1. Person arrested to be brought before Court without delay. The police officer or other person executing a warrant of arrest shall (subject to the provisions of section 71 as to security) without unnecessary delay bring the person arrested before the Court before which he is required by law to produce such person: Provided that such delay shall not, in any case, exceed twenty- four hours exclusive of the time necessary for the journey from the place of arrest to the Magistrate’ s Court.

অর্থাৎ ফৌজদারি কার্যবিধি আইনের,১৯৭৩ ধারা ৭৬ মতে পুলিশগণেরও এটা দায়িত্ব যে গ্রেফতার হওয়া ব্যক্তিকে কোনো রূপ ব্যাঘাত ছাড়াই ২৪ ঘন্টার মধ্যে ম্যাজিস্ট্রেট-এর কাছে হাজির করতে হবে। তবে আসা-যাওয়া পথের দূরত্বটি ২৪ ঘন্টা থেকে বিযুক্ত হবে।

এবার আমরা দেখব পুলিশ আইন,১৮৬১ ধারা ২৯ কী বলছে।

Section 29 in [ The Police Act, 1861 ]

  1. Penalties for neglect of duty, etc.– Every police- officer who shall be guilty of any violation of duty or wilful breach or neglect of any rule or regulation or lawful order made by competent authority, or who shall withdraw from the duties of his office without permission, or without having given previous notice for the period of two months, 5 or who, being absent on leave, shall fail, without reasonable cause, to report himself for duty on the expiration of such leave,] or who shall engage without authority in any employment other than his police- duty, or who shall be guilty of cowardice, or who shall offer any unwarrantable personal violence to any person in his custody, shall be liable, on conviction before a Magistrate, to a penalty not exceeding three months’ pay, or to imprisonment with or without hard labour, for a period not exceeding three months, or to both.

অর্থাৎ ধারা ২৯ মতে যে কোনো পুলিশ অফিসার ডিউটি চলা কালীন কোনো নিয়ম ভাঙলে বা ইচ্ছাকৃত ভাবে নিয়ম লঙ্ঘন করলে বা উচ্চতর কর্তৃপক্ষ কৃত বানানো রুল-রেগুলেশনের প্রতি অবহেলা করলে,না জানিয়ে ডিউটিতে না আসলে,কোন রূপ নোটিশ ছাড়া পাঁচ মাস বা তার অধিক ডিউটিতে অনুপস্থিত থাকলে,বা পুলিশের ডিউটিতে থাকা কালীন অন্য কাজে নিযুক্ত থাকলে বা নিজ কাস্টডিতে থাকা ব্যক্তির অসংগত  ক্ষতি হলে, দোষী পুলিশ অফিসারের তিন মাসের বেতন অথবা বিনাশ্রমে তিন মাসের কারাদণ্ড বা দুটোই হতে পারে।

(৬)

এবার আমরা  কাস্টোডিয়াল ডেথের উপর সুপ্রিমকোর্ট- এর কিছু স্মরণীয় রায় নিয়ে আলোচনা করব।

১)Rudul Sah v. State of Bihar, (1983) 4 SCC 141.

এই মামলাটা যদিও সরাসরি কাস্টোড্রিয়াল ডেথ সম্পর্কিত নয়,কিন্তু এই মামলাতে প্রথম ক্ষতিপূরণ এর কথা উঠে আসে। মামলাটির সারমর্ম হল,১৯৫৩ সালে রুদুল শা তার স্ত্রীকে খুনের অভিযোগে গ্রেফতার হন। যদিও তিনি জেলবন্দি ছিলেন। তা সত্বেও দীর্ঘদিন ধরে মামলা চলার পর অবশেষে ১৯৬৮ সালে অতিরিক্ত দায়রা বিচারপতির বিচারে নির্দোষ বলে মুক্তি পাবার রায় পান এবং জেল থেকে ছেড়ে দেবার আদেশ হয়। কিন্তু পরবর্তী অর্ডার না আসার জন্য দীর্ঘ ১৪ বছর উনি বিনা বিচারে জেল বন্দি থাকেন। পরবর্তীকালে ১৯৮৩ সালে সুপ্রিম কোর্টে ভারতীয় সাংবিধানিক আইন অনুযায়ী ধারা ৩২ দ্বারা নিজের মৌলিক অধিকার ফিরে পারার জন্য ‘জনস্বার্থ মামলা’ বা Public Interest Litigation(PIL) দায়ের করা হয়। এই মামলার রায়ে মহামান্য সুপ্রিম কোর্ট ভারতীয় সাংবিধানিক আইন অনুযায়ী ধারা ২১ দ্বারা মৌলিক অধিকার অধিকার রক্ষার কথা বলে। শুধু তাই নয় আরো বলে কাউকে বেআইনি ভাবে আটক রাখা যাবে না। এই রায়ের সব থেকে গুরুত্বপূর্ণ দিক হল ‘ক্ষতিপূরণ পাওয়ার অধিকার’ অর্থাৎ ‘Right To Compensation’-এর কথা বলে। এই রায়ে বন্দির পুনর্বাসন, চিকিৎসা ও ক্ষতিপূরণ বাবদ ৩০০০০ টাকা দেবার কথা বলা হয়। রুদুল শা রায় মোতাবেক সব কিছু পান এবং সসন্মানে মুক্তি পান।

এরপর আমরা পরবর্তী রায় দেখব।

Saheli v. Commissioner of Police, 1989

এই মামলায় ১৪ নভেম্বর,১৯৮৭ সালে পুলিশ অফিসার লাল সিং এবং তার সাথে আরো দুজন পুলিশ স্থানীয় জোতদার শম্ভু দয়াল এবং তার ভাই প্রকাশ চন্দের সাথে অন্যায় ভাবে যোগসাজশ করে অসহায় ভাড়াটিয়া মা কমলেশ কুমারী আর তার নয় বছরের ছেলে নরেশের  উপর চরম অত্যাচার করে। কমলেশ কুমারীকে প্রবল মারধোর করা হয় এবং তার পোশাক-আশাক ছিঁড়ে দিয়ে শ্লীলতাহানি করা হয়। মাকে বাঁচাতে গেলে শিশু নরেশকেও মারধোর করা হয় এবং জোর করে মেঝেতে ছুঁড়ে ফেলে দেওয়া হয়। শুধু তাই নয় কমলেশ কুমারীর নামে অন্যায় ভাবে ভারতীয় দন্ডবিধি আইনের,১৮৭২ ধারা ৪৪১ মতে অনাধিকার প্রবেশের মামলা দায়ের করা হয়। তাকে তিহার জেলে পাঠিয়ে দেওয়া হয়। ১৯৮৭ সালে ১৬ নভেম্বর উনি জামিনে ফিরে আসেন। তার ছেলে নরেশ প্রতিবেশীদের কাছে ছিল এবং পুলিশি অত্যাচারের ফলে শারীরিক অবস্থা ছিল খুবই খারাপ। স্থানীয় চিকিৎসক চিকিৎসা করলেও বিশেষ লাভ হয় না। এরপর ১৯৮৭ সালে ১৮ নভেম্বর নরেশকে রাম মনোহর লোহিয়া হাসপাতালে ভর্তি করা হয়। কিন্তু আশ্চর্যজনক ভাবে কোন মেডিকো লিগ্যাল কেস নেওয়া  হয় না। কমলেশ কুমারীর আইনজীবীর অনেক চেষ্টায় ১৯৮৭ সালে ২৩ নভেম্বর সকাল ১১.৩০ নাগাদ এ.সি.পি.-র কাছে প্যাটেল নগর থানায় এফ আই আর নং- ১৪৩/৮৭ দায়ের হয়। কিন্তু এফ আই আর লেখার সময় কমলেশ কুমারী  বার বার বলেন, লাল সিং এবং অন্যান্য পুলিশ অফিসারদের অত্যাচারেই যে তার নাবালক পুত্র নরেশের মৃত্যু হয়েছে। অথচ সেই রকমও বিশেষ কিছু এফআইআর-এ ছিল না।

কিন্তু তা সত্বেও সুপ্রিম কোর্টের রায়ে  ক্ষতিপূরণ বাবদ ৭৫০০০ টাকা দেবার  আদেশ দেন। আরো একটা বিষয় লক্ষ্যণীয় যে কোর্ট দিল্লি প্রশাসনকে আদেশ দেয় যে ক্ষতিপূরণবাবদ টাকা দোষী অফিসারদের থেকে আদায় করা হবে।

পরবর্তী মামলাটা সরাসরি কাস্টোডিয়াল ডেথ ও তার ক্ষতিপূরণ সম্পর্কিত-

SMT NILABATI BEHARA ALIAS LALITA BEHARA V. STATE OF ORISSA AND OTHERS AIR 1993 SC 1960

এই মামলায় নীলাবতি বেহারা তার ২২ বছরের পুত্র সুমন বেহারার পুলিশি হেফাজতে মৃত্যুর জন্য সুপ্রিম কোর্টে একটি চিঠি লেখেন ও পিটিশনার তার পুত্রের মৃত্যুর জন্য ক্ষতিপূরণ দাবি করে।

সুপ্রিম কোর্ট এই চিঠিটাকে ভারতীয় সাংবিধানিক আইনের ধারা ৩২ অনুযায়ী  রিট পিটিশন হিসাবে গণ্য করে ও সুয়ামোটো মোকদ্দমা দায়ের করে।এই মামলার সারমর্ম হল পুলিশ পিটিশনারের পুত্র সুমন বেহারাকে চুরির অভিযোগে গ্রেফতার করে।পরের দিন রেল লাইনে তার দেহ পাওয়া যায়। পিটিশনারের আইনজীবী দাবি করেন পুলিশি অত্যাচারে সুমন বেহারার মৃত্যু হয়। কিন্তু পুলিশ এই ঘটনাকে চাপা দেবার জন্য তার দেহকে রেল লাইনে ফেলে দিয়ে আত্মহত্যা বা দুর্ঘটনার ঘটনা হিসাবে সাজাতে চাইছে। এছাড়া পোস্টমর্টেম রিপোর্টেও এটা প্রমাণিত যে অ্যান্টিমর্টেম ইনজুরি অর্থাৎ মৃত্যুর পূর্ববর্তী ইনজুরির বেশির ভাগই ব্লান্ড ইন্সট্রুমেন্ট মানে ভোঁতা অস্ত্র। আর এই সকল আঘাত লাঠি বা ঘুসির দ্বারাই হওয়া সম্ভব। ট্রেনের আঘাত মৃত্যুর পরে ঘটে। এক্ষেত্রে বিবাদি পক্ষের আইনজীবী যুক্তি দেখান,সুমন বেহারা ওই দিন রাত তিনটে নাগাদ পুলিশি হেফাজত থেকে পালিয়ে যায়। কিন্তু খোঁজাখুঁজিতে তাকে পাওয়া যায় না। পরবর্তীতে ট্রেনের ধাক্কায় তার মৃত্যু ঘটে। পুলিশি হেফাজতে হত্যা বা এই রকম কিছু ঘটনার কথা অস্বীকার করে।

সুপ্রিম কোর্ট রায়ে জানায় পুলিশি হেফাজত থেকে পালানো বা পুলিশের খোঁজাখুঁজির কোন প্রমাণ পাওয়া যায় না। তাছাড়া পুলিশ অনেক পরে দেহের দায়িত্ব গ্রহণ করে, তাও একজন রেল কর্মচারী জানানোর পরে। যেটা বিবাদি পক্ষের দাবির উপর সন্দেহ সৃষ্টি করে। এছাড়া ডাক্তারের সাক্ষীতে এটা আসে যে মৃত্যুর কারণ বেশির ভাগই ব্লান্ড ইন্সট্রুমেন্ট মানে ভোঁতা অস্ত্র। আর এই সকল আঘাত লাঠির দ্বারাই হওয়া সম্ভব। ট্রেনের আঘাতে এই সব আঘাত সম্ভব নয়। এই মামলায় কোর্ট পাবলিক ল আর প্রাইভেট ল-এর পার্থক্যও প্রদান করে। ক্ষতিপূরণের দায়িত্ব রাষ্ট্রকে দেয়,দোষী পুলিশদের নয়। মোট ১,৫০,০০০ টাকা ক্ষতিপূরণ এবং দোষী পুলিসদের বিরুদ্ধে ফৌজদারি মামলা শুরু করার আদেশ দেওয়া হয়।

পরবর্তী মামলাটা  সরাসরি কাস্টোডিয়াল ডেথ  সম্পর্কিত না হলেও তার পূর্ববর্তী পর্যায় মানে বেআইনি গ্রেফতারি নিয়ে।

Joginder Singh Vs State of U P

এই মামলার রায়ে সুপ্রিম কোর্ট  জানায় কোনরূপ যুক্তিপূর্ণ কারণ ছাড়া কাউকে গ্রেফতার বা আটক করে রাখা যাবে না। মামলাটির সারমর্ম হল পিটিশনার যে নিজেই একজন আইনজীবী,তাকে এস.এস. পি,গাজিয়াবাদ কিছু মামলার ব্যাপারে প্রশ্ন করার জন্য ডাকে। পিটিশনার ৭/০১/৯৪ তারিখে তার ভাইয়ের সাথে যান। কিন্তু ভাইদের পরে সরিয়ে দেওয়া হয়। পুলিশ পরে জানায় পিটিশনার তাদের সাথে বিভিন্ন কেসে সহযোগিতা করার জন্য ছিল। তবে কোর্ট রায়ে এই সকল গ্রেফতার বা আটককে বেআইনি বলে রায় দেয়।

পরবর্তী মামলাটা  সরাসরি কাস্টোডিয়াল ডেথ সম্পর্কিত এবং এই ক্ষেত্রের সবথেকে গুরুত্বপূর্ণ রায়-

Shri D. K. Basu, Ashok K. Johri vs State Of West Bengal, State Of U.P. AIR – 1997 SC – 610

পশ্চিমবঙ্গ লিগ্যাল এড সার্ভিসের চেয়ারম্যান ডি.কে. বাসু বহু পুলিশি হেফাজতে মৃত্যু দেখে সুপ্রিমকোর্টের প্রধান বিচারপতিকে চিঠি লেখেন। মহামান্য  সুপ্রিম কোর্ট এই চিঠিটাকে ভারতীয় সাংবিধানিক আইনের ধারা ৩২ অনুযায়ী  রিট পিটিশন হিসাবে গণ্য করে ও সুয়ামোটো মোকদ্দমা দায়ের করে।

এই মামলায় মহামান্য সুপ্রিম কোর্ট সর্বমোট এগারোটি গাইডলাইন বেঁধে দেয়।যা কাস্টোডিয়াল ডেথ আটকাতে অনেক সাহায্য করে। সেগুলি হলো-

১) গ্রেফতারকারী ও জেরাকারী পুলিশের নাম,পদ এবং ব্যাজ পরিষ্কার ভাবে দৃশ্যমান হতে হবে। এবং পুলিশ সেই সকল পুলিশ অফিসারদের নামের একটা রেজিস্টারও মেনটেন করবে, যারা এই সকল জেরা করছে।

২) গ্রেফতারকারী পুলিশ অফিসার একটি অ্যারেস্ট মেমো মেনটেন করবে। যাতে গ্রেফতার হওয়া ব্যক্তির নাম,তারিখ,গ্রেফতার হওয়ার জায়গা এবং সাক্ষীর সই থাকবে।

৩) গ্রেফতারকারী পুলিশগণেরও এটা দায়িত্ব যে গ্রেফতার হওয়া ব্যক্তির নিকট আত্মীয়কে বা বন্ধুকে  জানানো,যে সে গ্রেফতার হয়েছে,এমনকি কোথায় ডিটেন করা হয়েছে সেটাও জানানো। একটা অফিশিয়াল ডায়েরিতে সব রেকর্ড মেনটেন করতে হবে। কোন অফিসার গ্রেফতার করলেন,কাদের জানানো হয়েছে,ইত্যাদি সকল বিষয়।

৪) গ্রেফতার হওয়া বন্দির ব্যাপারে জেলা এবং রাজ্যর প্রধান দফতরে জানাতে হবে,এমনকি প্রয়োজন পড়লে তা দৃশ্যমান জায়গায় টাঙিয়েও রাখতে হতে পারে।

৫) গ্রেফতার হওয়া ব্যক্তির জানার অধিকার আছে, কী কারণে তিনি গ্রেফতার হলেন।

৬) পুলিশ একটা ডায়েরি মেনটেন করবে যাতে,

যে সে গ্রেফতার হয়েছে, এমনকি কোথায় ডিটেন করা হয়েছে সেটাও জানানো। একটা অফিশিয়াল ডায়েরিতে সব রেকর্ড মেনটেন করতে হবে। কোন অফিসার গ্রেফতার করলেন,কাদের জানানো হয়েছে,ইত্যাদি সকল বিষয়।

৭) একটি ইন্সপেকশন মেমো বানানো, যাতে গ্রেফতার হওয়া ব্যক্তির শরীরে কোন মেজর বা মাইনর ইনজুরি থাকলে সেটা ডিটেক্ট করা। এই কপিটা গ্রেফতারকারী পুলিশ আর গ্রেফতার হওয়া ব্যক্তি দুজনেই সই করবে।আর গ্রেফতার হওয়া ব্যক্তিকে একটা ফ্রি কপি দেওয়া হবে।

৮) বন্দিকে ডাক্তারি পরীক্ষার জন্য পাঠাতে হবে।আর প্রতি ৪৮ ঘন্টা ছাড়া ছাড়া ডাক্তারি পরীক্ষা করতে হবে।

৯) এই সকল কাগজপত্র ম্যাজিস্ট্রেটকে পাঠাতে হবে।

১০) পুলিশগণের দ্বারা জিজ্ঞাসাবাদের সময় গ্রেফতার হওয়া ব্যক্তির আইনজীবীর উপস্থিত থাকার অধিকার আছে।

১১) গ্রেফতার হওয়া বন্দির ব্যাপারে ১২ ঘন্টার মধ্যে  জেলা এবং রাজ্যর প্রধান দফতরে জানাতে হবে,এমন কি প্রয়োজন পড়লে তা দৃশ্যমান জায়গায় টাঙিয়েও রাখতে হতে পারে।

(৭)

এই সকল আলোচনা থেকে আমরা এটা পরিষ্কার দেখতে পাচ্ছি যে কাস্টোডিয়াল ডেথের ক্ষেত্রে আইন থাকলেও তার প্রযুক্ত হবার ক্ষেত্রে এক বিরাট ব্যবধান রয়ে যাচ্ছে। শুধু তাই নয় সত্তরের দশকে রাজনৈতিক বন্দিদের ক্ষেত্রে হেফাজতে হওয়া অত্যাচারের কোনো বিচারই হয়নি। শুধু  তাই নয়, মানবাধিকার কর্মী যারা জল-জঙ্গল-জমিনের অধিকারের লড়াই করছেন, সেই সকল বন্দিদের ক্ষেত্রে রাষ্ট্রের ভয়ানক অত্যাচার লক্ষ্যণীয়। কেবল হেফাজতেই নয় তার বাইরেও তাদের দমন করার চেষ্টা দেখা যায়।অতি সাম্প্রতিক ভিমা-কোরেগাঁও মামলা এর প্রকৃষ্ট উদাহরন। রোনা উইলসন,সুধা ভরদ্বাজ, সুরেন্দ্র গ্যাডলিং সহ বহু মানবাধিকার কর্মী তথা আইনজীবীকে মিথ্যা অভিযোগে বেআইনি ভাবে গ্রেফতার করা হয়েছে।

আর রাজবন্দিদের ক্ষেত্রে অত্যাচারের বহু ঘটনা এখনো জীবন্ত।আমরা সমাজকর্মী অরুণ ফেরেইরার বই ‘কালারস অফ কেজ’-এ পাই জোর করে পায়ুদেশে পেট্রল ঢোকানো হত। ছত্তীসগঢ়ের মানবাধিকার কর্মী সোনি সোরিকে পুলিশি হেফাজতে ধর্ষণ, যৌনাঙ্গে পাথর কুচি ভরে দেওয়া। আর সেই অবস্থায় আদালতে হাজির করা। এছাড়া পশ্চিমবঙ্গে প্রেক্ষিতে দেখতে পারি রাজবন্দি ঠাকুরমনি মুর্মু(তারা),পারো প্যাটেল,হিরণদি মঙ্গল সিং-দের নগ্ন করে তল্লাশি করা। যৌনাঙ্গে আঙুল ঢুকিয়ে যৌন নির্যাতন করা। এছাড়া রাজবন্দি স্বপন দাশগুপ্ত,সুদীপ চোঙদারদের কার্যত বিনা চিকিৎসায় ফেলে রাখার ফলে মৃত্যু। অর্থাৎ তথাকথিত কাস্টোডিয়াল ডেথ না হলেও একটা স্লো মোশন অফ ডেথ তো বহমান। মানবাধিকারের মৃত্যু তো প্রতি মুহূর্তেই ঘটছে। যা অতি সাম্প্রতিক তামিলনাড়ুর ফেলিক্স-জয়রাজ নামে দুই পিতা-পুত্রের পুলিশি হেফাজতে মৃত্যুর ঘটনায় সুস্পষ্ট।

Share Now:

LEAVE YOUR COMMENT

Your email address will not be published. Required fields are marked *