একচ্ছত্র অধিকার চাই আরএসএসের, সব দলের সেবামূলক উদ্যোগে বাধা দিচ্ছে বিজেপি
পিপলস ম্যাগাজিন ডেস্ক: করোনা মহামারির দ্বিতীয় ঢেউ নিঃসন্দেহে অপ্রস্তুত ভারতকে তুমুল আঘাত করেছে। ভারত রাষ্ট্রই যে তার জনগণকে এই বিপর্যয়ের মুখে ঠেলে দিয়েছে, সে ব্যাপারে আন্তর্জাতিক মহলও একমত। বিপর্যয়ের এই সময়ও, শাসক শ্রেণি জনগণের জীবন বাঁচানোয় সচেষ্ট না হয়ে প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদীর ভাবমূর্তি রক্ষা করতে বেশি উদ্যোগী।
সরকার করোনাকে হালকাভাবে নেওয়ায় ও মানুষকে সঠিকভাবে সচেতন না করার ফলেই ভাইরাসের সংক্রমণ ও দেশের মৃত্যুর হার আরও বাড়ে। করোনা ইতিমধ্যেই দেশের বিধ্বস্ত চিকিৎসা ব্যাবস্থাকে ধ্বংস করেছে। করোনার প্রথম ঢেউয়ের ফলে গরিব শ্রমজীবী মানুষ ভয়ঙ্কর বিপদের মুখে পড়েছিলেন কিন্তু এবারে গরিবদের সাথে ব্যাপক মধ্যবিত্ত শ্রেণির মানুষও বিপদে পড়েছেন, তাদের অনেকেই সংক্রমিত হচ্ছেন আর এতে বাধ্য হয়ে মূলধারার সংবাদ মাধ্যমগুলিকেও করোনার বিপর্যয়কর প্রভাবগুলি কভার করতে হচ্ছে।
এই সংকটের সময় ঐক্যবদ্ধ হয়ে বিভিন্ন সামাজিক – রাজনৈতিক সংগঠন, কর্পোরেট হাউস, সোশ্যাল মিডিয়া ইনফ্লুয়েন্সার এবং সেলিব্রিটিরা অসহায় মানুষদের পাশে থাকবার জন্য একটি নেটওয়ার্ক তৈরি করতে চেয়েছিল। বিভিন্ন নাগরিক সংগঠন, অভিনেতা সোনু সুদ ও ক্রিকেটার বিরাট কোহলির মতো ব্যক্তিরা তাদের ত্রাণ ও তহবিল সংগ্রহের জন্য যথাযথভাবে প্রশংসা পেয়েছেন। তবে মোদী সরকার এই কাজগুলিকে ‘বিরোধীদের পরিচালিত কাজ’ বলে দাগিয়ে দিয়ে একে প্রায় অপরাধ হিসেবে আখ্যায়িত করেন।
ভারতীয় যুব কংগ্রেসের নেতা বি.ভি.শ্রীনিবাস তার দলের ত্রাণ কাজের জন্য টুইটারে একটি হ্যাশট্যাগ চালু করেন (#SOSIYC) এবং এটি আন্তর্জাতিক স্তরে প্রচার পেয়েছিল, যার ফলে দিল্লি পুলিশ শ্রীনিবাসকে জিজ্ঞাসাবাদের জন্য ডেকেও পাঠিয়েছিল। দ্বিতীয়ত, বিহারে জন অধিকার পার্টির নেতা পাপ্পু যাদবকে পুলিশ গ্রেফতার করে কারণ তিনি বিজেপি নেতা রাজীবপ্রতাপ রুডির বাড়ি ‘অভিযান’ চালান এবং সেখানে থাকা অব্যবহৃত অ্যাম্বুলেন্স নিয়ে প্রশ্ন তোলেন। তৃতীয়ত, বিজেপি পরিচালিত গুজরাট সরকার, অক্সিজেন কনসেনট্রেটর-এর জন্য অর্থ সংগ্রহ করতে একটি এনজিও-র তৈরি ব্যাংক আকাউন্ট বন্ধ করে দেয়, যেখানে অর্থ দান করতে মানুষের কাছে আহ্বান জানিয়েছিলেন বিধায়ক জিগনেশ মেভানি।
সেবার রাজনীতি ও হিন্দুত্ব
হিন্দুত্ববাদীদের রাজনৈতিক গুরুত্ব বোঝার জন্য তাদের আদর্শগত ও সাংগঠনিক দৃষ্টিতে ‘সেবার’ গুরুত্ব বুঝতে হবে। এটি অবশ্যই মনে রাখা দরকার যে প্রধানমন্ত্রী মোদী জনপ্রিয় ও প্রভাবশালী হলেও তিনি কিন্তু শুধু মাত্র রাষ্ট্রীয় স্বয়ংসেবক সঙ্ঘের(আরএসএস) রাজনৈতিক শাখার মুখ হিসেবে দায়িত্ব পালন করছেন।
আরএসএসের বিশ্বদর্শনের ভিত্তি হল, এর শক্তির প্রাথমিক স্থান সমাজ, রাষ্ট্র নয়। এরা ‘সমাজসেবার’ মাধ্যমটি ব্যবহার করে সমাজের মধ্যে নিজেদের প্রভাব বিস্তার ও গ্রহণযোগ্যতা প্রসারিত করতে এবং সমর্থকদের সংগঠিত করতে। লক্ষ্যণীয় বিষয় হল, এই সেবামূলক কাজকে রাজনৈতিক হাতিয়ার হিসেবে ব্যাবহার করে স্বাধীনতা সংগ্রামে জনগণকে সংগঠিত করতেন গান্ধি ও অন্যান্য জাতীয়তাবাদী নেতারা।
শুরুর দিকে আরএসএস মূলত শাখা তৈরি করে কর্মীদের সংগঠিত করত ও মতাদর্শগত প্রশিক্ষণ দিত। সমাজসেবার পদ্ধতিটিকে মূলত ব্যবহার করতো সাম্প্রদায়িকতা প্রচারের জন্য, উদাহরণ স্বরূপ দেশভাগের পর হিন্দু শরণার্থীদের মধ্যে তাদের সেবামূলক কাজের কথা বলা যায়। তবে গান্ধি হত্যার পরে মূলধারার রাজনীতি থেকে নিষিদ্ধ ও অপসারণের ফলে সরসঙ্ঘচালক এম.এস.গোলওয়ালকর সেবাকেই হিন্দুত্ব রাজনীতি ও মতাদর্শ প্রচারের প্রাথমিক মাধ্যমে পরিণত করেছিলেন।
সেবাই আরএসএসকে প্রতিদিন জনগণের মধ্যে হিন্দু পরিচয়ের প্রচারের জন্য সুযোগ করে দেয়, এর মাধ্যমে নিজের সমর্থকদের তৈরি করে তাদের রাজনীতিকরণ করতে সক্ষম হয়। এরকম সেবা প্রকল্পের মাধ্যমে সারা দেশে আরএসএস নিজেদের আদর্শ ও রাজনীতির প্রচার করে চলেছে।
একচেটিয়া সেবার সর্বগ্রাসী অধিকার
ত্রান ও সেবামূলক কাজ করে বিভিন্ন রাজনৈতিক-সামাজিক সংগঠনগুলি শুধু যে করোনা মোকাবিলায় মোদীর নিষ্ক্রিয়তাই ফাঁস করে দিয়েছে তাই নয়, তারা ইচ্ছাকৃত বা অনিচ্ছাকৃত ভাবে আরএসএসকেও সমস্যায় ফেলেছেন। সেবামূলক কাজের মাধ্যমে যেই আরএসএস নিজেদের রাজনৈতিক ও আদর্শগত প্রচার চালিয়ে সমর্থন পেতে পারত, সেই সেবামূলক কাজের মধ্যে তারা কোনও প্রতিদ্বন্দ্বী চাইছেন না। তাই মোদী সরকারকে দিয়ে সেবামূলক কাজে যুক্ত অন্যান্য সংগঠন বা ব্যক্তিদের অপরাধী সাব্যস্ত করে সেবার একচেটিয়াকরণ করতে চাইছে।
এই প্রক্রিয়ায় তারা অধিকার সচেতন নাগরিকের বদলে দেশ জুড়ে কোটি কোটি অনুগত, বাধ্য জনগণ তৈরি করতে চাইছেন। যাকে তারা ‘দেশভক্ত হিন্দু’ নামে ডাকেন।