মৃত্যু থেকে মুনাফা: নয়া উদারনৈতিক ভারতে মোদির অতিমারি মোকাবিলা
পিপলস ম্যাগাজিন ডেস্ক: দুটি ছবি বর্তমান সংকটের চিত্রকে তুলে ধরেছে আমাদের সামনে, প্রথম হচ্ছে গত বছর লকডাউনের সময় পুলিশের পরিযায়ী শ্রমিকদের ওপর রাসায়নিক স্প্রে করা আর দ্বিতীয় হচ্ছে বর্তমানে দেশের শ্মশানগুলিতে হাজার হাজার মৃতদেহ পোড়ার ছবি।
প্রথম লকডাউনের পর যখন সংক্রমণ কম হতে লাগলো, তখন ভারতের প্রধান মন্ত্রী নরেন্দ্র মোদী করোনা ভাইরাসের বিরুদ্ধে বিজয় ঘোষণা করে দিলেন। হিন্দু পৌরাণিক কাহিনির সাথে মিলিয়ে দিয়ে মোদী বলেছিলেন যে মহাভারতের যুদ্ধ আঠারো দিনের মধ্যে জয়লাভ করেছিল আর তিনি ২১ সালের মধ্যেই করোনার যুদ্ধে জয়ী হবেন।
এই কুসংস্কারে ঘেরা নীতি নিয়ে চলছিল ভারত সরকার। সরকারের করোনা মোকাবিলায় গঠিত কমিটি মিটিং করা বন্ধ করে দিয়েছিলো এবং স্বাস্থ্য মন্ত্রী ঘোষণা করে ছিলেন যে ভারতে ‘মহামারী প্রায় নির্মূল হয়ে গেছে’। সরকার গর্ব করে বলেছিল যে তারা ৫৫ মিলিয়ন ভ্যাক্সিন বিক্রি করেছে ৬২টি আলাদা আলাদা দেশে।
এটি হিন্দুত্ববাদ ও পুঁজিবাদের মধ্যে নিখুঁত সংযোগের একটি উদাহরণ ছিল। হিন্দুত্ববাদ সরকারকে আশ্বাস দিচ্ছিল যে ভাইরাসটি শেষ হয়ে গেছে, ওপর দিকে পুঁজিবাদ বিশ্বব্যাপী অতিমারিকে টিকিয়ে রেখেছে।
জীবনরক্ষক ভ্যাকসিন উত্তর গোলার্ধের প্রায় সমস্ত দেশেই বিনামূল্যে পাওয়া যাচ্ছে, কিন্তু ভারতে তা হচ্ছে না। বিশ্বের বৃহত্তম ভ্যাকসিন প্রস্তুতকারী দ্য সেরাম ইন্সটিটিউট অফ ইন্ডিয়া(এসআইআই) বর্তমানে ভারতের ভ্যাকসিনের প্রধান নির্মাতা। জানুয়ারিতে তারা ভারত সরকারকে ভ্যাকসিনের প্রথম ১০০ মিলিয়ন ডোজ ২০০ টাকা দরে(২.৭৪ মার্কিন ডলার) বিক্রি করেছিল, এর পরে তারা ভ্যাকসিনের দাম বাড়িয়ে দেয় ও বেসরকারি সংস্থাগুলিকে ১০০০ টাকা দরে (১৩.৬৮ মার্কিন ডলার) বিক্রি করে।
এসআইআই একটি বেসরকারি সংস্থা যা পৃথিবীর অন্যতম ধনী ব্যক্তি সাইরাস পুনাওয়ালার নেতৃত্বে চলে, যার সম্পদের পরিমাণ প্রায় ১৩ বিলিয়ন ডলার। ঘোরা কেনাবেচা করে ও ঘোরদৌড়ে টাকা লাগিয়ে বিপুল অর্থের মালিক হয়েছিলেন সাইরাস। তার এই দুরন্ত জুয়াড়ি মানসিকতা, তার ছেলে আদার পুনাওয়ালার চোখ খুলে দেয় গত বছর। দুনিয়া জোড়া অতিমারির ধ্বংসলীলা দেখে তিনি বুঝতে পারেন বিশাল আর্থিক মুনাফার সুযোগ তার কাছে আসছে। আন্তর্জাতিক গণমাধ্যমকে দেওয়া এক সাক্ষাৎকারে তিনি বলেন, তিনি ঝুঁকি নেবেন এবং সামনের সারিতে থাকবেন।
জনস্বাস্থ্যের এই জরুরি অবস্থা থেকে ব্যক্তিগত মুনাফা করার জন্য এই লোকগুলো ঝাঁপিয়ে পড়েছিল। মেলিন্দা এবং বিল গেটস ফাউন্ডেশন ১৫০ মিলিয়ন ডলার বিনিয়োগ করেছে, গোল্ডম্যান শ্যাশ, সিটি এবং আভেনডাস ক্যাপিটালের মতো আর্থিক প্রতিষ্ঠানগুলি এসআইআইয়ের প্রধান উপদেষ্টা হয়েছে। দক্ষিণ গোলার্ধের বেশিরভাগ বৃহৎ পুঁজিপতির মতো আদার পুনাওয়ালাও নয়া উদারনৈতিক বাকতাল্লায় দড়। তিনি তার বিশাল জাতীয়তাবাদি অবস্থান জানিয়ে ঘোষণা করেন, শুরুর দিকে যত ভ্যাকসিন তার সংস্থা তৈরি করবে, তার বেশির ভাগটাই তিনি স্বদেশের মানুষদের দেবেন।
বাস্তবে, এসআইআই এর প্রায় ৮০% শতাংশ ভ্যাকসিন মুনাফার জন্য বিদেশে রফতানি হয়েছিল, অবশেষে মৃত্যুর সংখ্যা বাড়তে শুরু করলে ভারত সরকার রফতানিতে নিষেধাজ্ঞা জারি করে।
কিছুদিন পর এই পুঁজিপতিদের বিশেষ করে সাইরাস পুনাওয়ালার সম্পদ পাঁচ মাসে ৮৫% শতাংশ বেড়েছে। অন্য দিকে ভারতের আকাশ গণচিতার ধোঁয়ায় যখন কালো হয়ে উঠতে লাগলো, তখনই মার্চের শেষের দিকে লন্ডনে আদর পুনাওয়ালা একটি বিশাল বাংলো সপ্তাহে ৭০০০০ ডলার ভাড়া দেওয়ার চুক্তিতে স্বাক্ষর করেন।
বর্তমান রক্তপাতের জন্য মোদি সরকার সরাসরি দায়ী। তবে এখনকার রাস্তাটি তাদের পূর্বে যারা ক্ষমতায় ছিল তারাই প্রস্তুত করেছিল, যারা ১৯৮০-র দশক থেকে আন্তর্জাতিক অর্থ ভাণ্ডারের কাঠামোগত পুনর্বিন্যাস কর্মসূচি অধীর আগ্রহে মেনে নিয়েছিল এবং ভারতের মূল্যবান প্রতিষ্ঠান এবং পরিকাঠামোগুলো ধ্বংস করেছিল। মনে হচ্ছিল খাদ্য ও স্বাস্থ্যের বদলে আমাদের আরও বেশি গাড়ি, আরও বাঁধের প্রয়োজন।
১৯৯১ সালে কংগ্রেসের অধীনে ভারতীয় অর্থনীতির সরাসরি উদারীকরণের পথে হেঁটেছিল। তার পরের গল্প খুবই চেনা।
আর্থিক ঘাটতি কমিয়ে মহান উদার অর্থনীতি ‘রাজস্ব ঘাটতি’-র পথ খুলে দিল। ধনীদের করের চাপ কমানো হল এবং রাষ্ট্র সামরিক খাতে খরচ বাড়িয়ে রাষ্ট্রায়ত্ত ও সামাজিক ক্ষেত্রে খরচ কমিয়ে দিল। এটা শুধু কংগ্রেস বা বিজেপির বিষয় নয়, কেন্দ্র ও বিভিন্ন রাজ্যে যে সব দল বা জোট সরকারে থেকেছে, তারা সকলেই এই পথে হেঁটেছে। এ রাজ্যে বামেদের জমি অধিগ্রহণ করে শিল্প প্রকল্প তারই অঙ্গ। ক্ষমতা হস্তান্তেরর পরের ৫০ বছরে বড়ো বাঁধ তৈরির জন্য অন্তত ৫ কোটি মানুষ উচ্ছেদ হয়েছেন। উচ্ছেদ হওয়া মানুষদের অর্ধেকই পাহাড় ও অরণ্যে বসবাসকারী আদিবাসী ও অন্যান্য মানুষ। এই সব এলাকাতেই বেশি বাঁধ ও খনিপ্রকল্প হয়েছে। এ সবই হয়েছে পুঁজিবাদের স্বার্থে।
সামরিক ক্ষেত্রে খরচের দিক থেকে ভারত এখন দুনিয়ায় আমেরিকা ও চিনের পরেই। কিন্তু স্বাস্থ্য ক্ষেত্রের ছবিটা পুরো আলাদা। বর্তমানে ভারতে প্রতি এক হাজার জনসংখ্যার জন্য মাত্র ০.৮ জন চিকিৎসক এবং ০.৭ টি হাসপাতালের বেড রয়েছে। অন্যদিকে নয়া উদার অর্থনীতির জমানায় বেসরকারি স্বাস্থ্য পরিষেবা ফুলেফেঁপে উঠেছে। বেসরকারি স্বাস্থ্য ক্ষেত্রের খরচে ভারত এখন পৃথিবীর প্রথম কুড়িটি দেশের মধ্যে। আর সরকারি স্বাস্থ্য পরিষেবা ক্ষেত্রে খরচে দুনিয়ার একেবারে নীচের দিকে।
পুঁজিবাদের ব্যয় সংকোচন নীতি আসলে একটি সংগঠিত হিংসাত্মক কাজ. যা দিয়ে জীবন এবং জীবন সৃষ্টিকারী সমস্ত কিছুর সংগঠিত ধ্বংসসাধন করা হয়। স্কুল ও হাসপাতালের বদলে কারাগার বানানো এবং সামরিক ক্ষেত্রে ব্যয়বরাদ্দ বৃদ্ধিই তার সবচেয়ে বড়ো প্রমাণ।
শ্রমশক্তির ক্ষেত্রেও একই কথা ঘাটে। বেশি উদ্বৃত্ত তৈরির জন্য শ্রমের মূল্য কমানো হয়। কিন্তু শ্রমিকদের বেতন তখনই কমানো সম্ভব যখন শ্রম ও জীবনের সামাজিক পুনরুৎপাদনের খরচ কমিয়ে রাখা যায়। ভারতের মতো দেশে জাতি, বর্ণ, লিঙ্গবৈষম্যকে কাজে লাগিয়ে এই কাজটা করা হয়। পশ্চিমের দেশগুলিতে এসব করা হয় বর্ণবাদকে কাজে লাগিয়ে।
তবে এসব নতুন কিছু নয়, পুঁজি গ্রন্থেমার্কস লিখেছেন, সে সময় ইংল্যান্ডে ক্যানাল বোট বা ডিঙি নৌকা টানার জন্য (জলের নৌকা টানা হল খালের তীরবর্তী পথ দিয়ে)কখনও কখনও যন্ত্র ও ঘোরার বদলে মেয়েদের কাজে লাগানো হত। কারণ মেশিন বা ঘোড়া উৎপাদনের জন্য কতটা শ্রম লাগবে, তা স্পষ্ট ভাবে জানা ছিল। কিন্তু উদ্বৃত্ত জনসংখ্যার মেয়েদের রক্ষণাবেক্ষণের খরচ ছিল সব হিসেবের বাইরে।
পুঁজিবাদের এই খুনি যুক্তি ভারতে এতটাই প্রভাব বাড়িয়েছে যে বড়লোকরাও আর নিরাপদ নয়, একজন প্রাক্তন রাষ্ট্রদূত দিল্লির একটি হাসপাতালের সামনে পার্কিং-এর জায়গায় অপেক্ষা করতে করতে মারা যান। কোনও হাসপাতালের বেড নেই। কোনও আম্বুলেন্স নেই। গুজরাটের শিল্প নগরী সুরাটে, মৃতদেহ জ্বালানোর জন্য ব্যবহৃত লোহাগুলি এতো ব্যবহার হচ্ছে যে শেষ পর্যন্ত গলে গেছে।
শ্মশান ঘাটের কর্মচারীরা সকলেই প্রায় দলিত সম্প্রদায়ের, যাদের গড় মাসিক বেতন ১৩৪ ডলার। তারা কোনও পিপিই ছাড়াই চতুর্দিকে কাজ করে যাচ্ছেন। স্যানিটেশন কর্মীদের এক সংগঠনের নেতা বলেছেন “শ্মশান কর্মীদের মধ্যে কত জন যে করোনা পজেটিভ হয়েছে বা কতজন যে এর ফলে মারা গেছে তার খবর কেউ জানে না। তার কারণ সরকারি কর্মকর্তারা শ্মশান কর্মী এবং স্যানিটেশন কর্মীদের মানুষ হিসেবে দেখেন না”।
কিন্তু দেশ যখন অক্সিজেনের অভাবে ভুগছে তখন অক্সিজেন প্রস্তুতকারক লিন্ডে ইন্ডিয়ার শেয়ারের দাম দ্বিগুন হয়েছে। অন্যদিকে আদার পুনাওয়ালা নিজের জেটবিমানে চেপে ভারত ছেড়ে পালিয়ে লন্ডনে নিজের সাদামাটা ম্যানসনে ঘাঁটি গেছেছেন।
বাকি দেশ জ্বলছে। বিজেপি নেতারা গোবর ও গোমূত্র দিয়ে কোভিড সারানোর নিদান দিচ্ছেন। এখনও দেশের ২ শতাংশ জনগণকেও প্রতিষেধক দেওয়া হয়নি। রোজ ৪ লক্ষ মানুষ সংক্রমিত হচ্ছেন। আসল সংখ্যাটা অবশ্যই অনেক বেশি।
মোদি অবশ্য দিব্যি আছেন। দিল্লিতে সেন্ট্রাল ভিস্তা বানাচ্ছেন। কাশ্মীরকে গাজা বানিয়ে দিয়েছেন। দলিত, মুসলিম, আদিবাসীদের জন্য ডিটেনশন ক্যাম্প তৈরি করছেন।
এই পরিস্থিতিতে, ভেঙে পড়া স্বাস্থ্য ব্যবস্থাকে টিকিয়ে রেখেছেন সাধারণ মানুষ। সাধারণ মানুষের নানা উদ্যোগের পাশাপাশি ধর্মীয় সংগঠনগুলিও মানুষের পাশে দাঁড়িয়েছে। স্বাস্থ্য থেকে খাদ্য, সবেতেই অসরকারি উদ্যোগের জোয়ার এসেছে। অন্যদিকে বিভিন্ন রাজ্যে ওষুধ ও অক্সিজেনের কালোবাজারি চলছে। অত্যাবশ্যকীয় পণ্য আইনকে কাজে লাগিয়ে তা আটকানোর কোনো উদ্যোগ এখনও সরকারের নেই।
এ সব কিছুরই কারণ পুঁজিবাদ। আর তার অপরিসীম লোভ। নানা ভআবে রক্ত সঞ্চালন করে একে টিকিয়ে রাখার চেষ্টা যতদিন আমরা করে যাবো, ততদিন জনগণের দুর্দশা ও মৃত্যুমিছিল চলবে। আজ কোভিড, কাল অন্য কোনো কারণে।
শুধু প্রতিবাদ আর আলোচনাতে বিশেষ কোনো ফল হবে না