কর্পোরেটদের লোভের জন্যই বেড়ে চলেছে অতিমারির মেয়াদ
পিপলস ম্যাগাজিন ডেস্ক: বেশিরভাগ পশ্চিমী দেশের তথ্য থেকে দেখা যাচ্ছে মডার্না, ফাইজার, অ্যাস্ট্রোজেনেকা এবং জনসন অ্যান্ড জনসনের প্রতিষেধকগুলি ৯৫ থেকে ১০০ শতাংশ ক্ষেত্রে কোভিড আক্রান্তদের মৃত্যু এবং হাসপাতালে ভর্তি হওয়ার আশঙ্কা দূর করে দিচ্ছে। সব ধরনের করোনা ভাইরাসের ক্ষেত্রেই তা সত্য। ইংল্যান্ডের অবস্থা তার সবচেয়ে বড়ো প্রমাণ। ইতিমধ্যেই করোনায় দুনিয়া জুড়ে ৩১ লক্ষ মানুষের মৃত্যু হয়েছে। এখনও প্রতিদিন গড়ে ১২ হাজার মানুষের মৃত্যু হচ্ছে।
যে সব এলাকায় এই ভাইরাস স্থানীয় চরিত্র নিয়েছে, সেখানে এর প্রতিষেধক-প্রতিরোধী রূপে ফিরে আসার সম্ভাবনা যথেষ্ট রয়েছে। কিন্তু প্রতিষেধক উৎপাদন ও বণ্টনে বাধার পর বাধা এসেই চলেছে। ফলে বহু মানুষের মৃত্যুর সম্ভাবনা এখনও থেকে যাচ্ছে।
এর উৎস লুকিয়ে আছে অতীতে। ২০০৩-এর সার্স এবং ২০১২ সালের মার্স মহামারির সময় থেকেই বিজ্ঞানীরা আগামী দিনে করোনা অতিমারির সম্ভাবনা দেখেছইলেন। সেই সময়ে্ই তারা প্রতিষেধক তৈরির নীল নকশা বানিয়েছিলেন। কিন্তু মুনাফা সম্পর্কে নিশ্চিন্ত না হওয়ায় ওষুধ সংস্থাগুলি সে সময় প্রতিষেধক গবেষণায় পয়সা ঢালেনি। ২০১৬ সালে টেক্সাস বিশ্ববিদ্যালয়ের গবেষকরা করোনা ভআইরাসের প্রতিষেধক আবিষ্কার করে ফেলেছিলেন। কিন্তু তা পরীক্ষা করার জন্য প্রয়োজনীয় অর্থ জোটাতে পারেননি।
এমনকি গত বছর অতিমারির ছড়িয়ে পড়ার পরও এই অবস্থাটা বজায় ছিল। আমেরিকার মুখ্য চিকিৎসা পরামর্শদাতা অ্যান্থনি ফাউসি গত ফেব্রুয়ারিতে বলেন, তিনি বেশ কয়েকটি ওষুধ সংস্থার সঙ্গে কথা বলেছেন, কিন্তু তারা কেউ প্রতিষেধকের পেছনে টাকা ঢালতে প্রস্তুত নয়, তারা দেখতে চায় এই অতিমারি প্রতি বছর ফিরে আসে কিনা। কারণ প্রতিষেধক উৎপাদন লাভজনক নয়। তা একবার দিলেই প্রয়োজন ফুরিয়ে যায়। ওষুধ সংস্থাগুলি দামি ওষুধ তৈরিতে বেশি উৎসাহী। কারণ একবার তা বানিয়ে ফেললে বছরের পর বছর মুনাফা করা যায়।
ট্রাম্প প্রশাসন সে সময় বাধ্য হয়ে ৭টি ওষুধ সংস্থার সঙ্গে ১০ বিলিয়ন মার্কিন ডলারের চুক্তি করে। একই পথে হাঁটে জার্মানিও। এই সব চুক্তিতে আর্থিক ভর্তুকি ছাড়াও প্রতিষেধক কিনে নেওয়ার নিশ্চয়তাও দেওয়া হয়েছিল। বলাই বাহুল্য এই সব টাকাই ছিল জনগণের করের টাকা।
যারা সস্তার প্রতিষেধক তৈরির চেষ্টা করছেন, তাদের সমস্য আরও বেশি। যেহেতু তাতে মুনাফা কম হবে, তাই তারা তহবিল জোগাড় করতে হিমশিম খাচ্ছেন।
বাধা শুধু সেখানেই নয়। এর সঙ্গে জড়িয়ে রয়েছে, বৈজ্ঞানিক জ্ঞান গোপন রাখার বিষয়টিও। প্রথমে অক্সফোর্ড বিশ্ববিদ্যালয়, তাদের করোনাভাইরাস ভ্যাকসিন গবেষণার স্বত্ব দান করে দেওয়ার প্রতিশ্রুতি দিয়েচিল। কিন্তু অ্যাস্ট্রোজেনেকার সঙ্গে চু্ক্তিবদ্ধ হওয়ার পর তারা সেই প্রতিশ্রুতি থেকে সরে আসে। এখন বিশ্বা বাণিজ্য সংস্থা বলে দিয়েছে, ভ্যাকসিনের ক্ষেত্রে পেটেন্ট তুলে দেওয়া যাবে না। সেটা হেল ভ্যাকসিনের ওপর থেকে মেধাস্বত্ব উঠে যেত এবং অনেক সংস্থা তা উৎপাদন করতে পারত। তাতে বহু দেশ সহজেই প্রতিষেধক পেত। গত অক্টোবরে ভারত ও দক্ষিণ আফ্রিকা এই প্রস্তাব দিয়েছিল (যদিও সেই সেই দেশের ক্ষমতাসীন আদানি-অম্বানিদের মতো মুৎসুদ্দিদের স্বার্থে)। কিন্তু বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থায় সেই বিষয়ে সিদ্ধান্ত নেওয়া যায়নি। কারণ সেখানে সাধারণত ১৬৪টি দেশ সহমতের ভিত্তিতে সিদ্ধান্ত নেয়। ফলে আমেরিকা, অস্ট্রেলিয়া, কানাডা, ইউরোপিয়ান ইউনিয়নের অন্তর্ভুক্ত ধনী দেশগুলিতে এখন সেকেন্ডে এক ব্যক্তিকে প্রতিষেধক দেওয়া চলছে। একচেটিয়া ওষুধ সংস্থাগুলি প্রচুর মুনাফা করছে। অন্যদিকে গরিব দেশগুলি রয়েছে তিমিরে। তাদের ভ্যাকসিনের অন্তত একটি ডোজ পাওয়ার অধিকারও আটকে রেখেছে ধনী দেশগুলি।
যদিও ওষুধ সংস্থারগুলির বক্তব্য, মেধাসত্ব নয়, মূল সমস্যা লুকিয়ে আছে ব্যাপক উৎপাদনের অক্ষমতার মধ্যে। কিন্তু এই বক্তব্য ডাহা মিথ্যে। এরা প্রথমত প্রতিষেধক গবেষণায় টাকা ঢালতেই চায়নি। তারপর ভ্যাকসিনের ফর্মুলা গোপন না রাখায় বহু উৎপাদক সংস্থা ফাঁকা বসে আছে। তার মধ্যে বংলাদেশের ইনসেপটাও রয়েছে, যারা বছরে ৮০০ মিলিয়ন ডোজ তৈরি করতে পারে। এমনকি গরিব দেশে প্রতিষেধক তৈরির জন্য গবেষণার তথ্য চেয়ে বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার আহ্বানেও সাড়া দেয়নি এই সংস্থাগুলি। এই সবই হয়েছে মুনাফার স্বার্থে।
এ বছরের মধ্যে দুনিয়ার সব দেশের ২০শতাংশ মানুষকে প্রতিষেধক দেওয়ার জন্য কোভ্যাক্স প্রকল্প নেওয়া হয়েছিল। কিন্তু তা ব্যর্থ হয়েছে, কারণ মোট উৎপাদিত প্রতিষেধকের ৮০ শতাংশই আগে থেকে কিনে রেখেছে ধনী ও উচ্চ-মধ্য ধনী দেশগুলি। সবেচেয় গরিব দেশগুলি মোট প্রতিষেধকের মাত্র ০.৩ শতাংশ পেয়েছে। পাশাপাশি উৎপাদনেও সমস্যা তৈরি করেছে ধনী দেশগুলি। ভ্যাকসিন তৈরি জন্য প্রয়োজনীয় কাঁচামাল রফতানিতে নিষেধাজ্ঞা জারি করে আমেরিকা। তাতে সমস্যায় পড়ে ভারতের সিরাম ইনস্টিটিউট। শেষ অবধি তা কিছুটা এলেও, যেহেতু ভারতে কোভিডের দ্বিতীয় ঢেউ চলছে, তাই চুক্তি থাকা সত্ত্বেও ভারতের পক্ষে সম্ভব হচ্ছে না অন্য দেশে প্রতিষেধক পাঠানো
সব মিলিয়ে যা পরিস্থিতি, তাতে দুনিয়ার সব মানুষের প্রতিষেধক পেতে ২০২৩ হয়ে যাবে। তার বেশিও হতে পারে। এর ফলে বহু মানুষ অকারণে মারা যাবে। এর মধ্যে ভাইরাস রূপান্তরিত হয়ে হয়তো এমন চেহারা নেবে যে, প্রথম দিককার ভ্যাকসিন কাজে আসবে না।
করোনা বারবার ফিরে না এলে প্রতিষেধক তৈরি করে ওষুধ সংস্থাগুলির মুনাফা হবে কী করে!