ঐতিহাসিক দিনগুলিকে ইতিহাস বিচ্ছিন্ন করে রাখার চল আমাদের প্রচলিত ইতিহাস চর্চার মজ্জায় মজ্জায়। ঐতিহাসিক দিনের ঐতিহাসিক তাৎপর্যকে দিয়ে বর্তমান সংকটকে আমরা নির্দেশ করি বটে, তবে সেই সংকটটির ঐতিহাসিক ধারাকেই কখনও কখনও খুব সন্তর্পণে এড়িয়ে চলি, অস্বীকার করি। যেটি ক্ষতিকর; যেটি সমাধান বাতলায় না। বর্তমান সামাজিক অর্থনৈতিক রাজনৈতিক প্রেক্ষাপটে এই ইতিহাস খানিক অস্বস্তিকর হলেও তার চর্চা খুব আবশ্যিক।
আজকে ঠিক যে ‘হিন্দি ভাষার দেশব্যাপী আগ্রাসন’ নিয়ে আমাদের বাংলা ভাষা-সংস্কৃতি সচেতন নাগরিকদের দুশ্চিন্তা বেড়েই চলেছে সেটির ইতিহাসও খুব একটা সুখকর নয়, বরং অস্বস্তিকরই বটে। সংঘ পরিবারের উগ্র হিন্দি-সাংস্কৃতিক আগ্রাসন দেশের বিচিত্র জাতির, ভাষাভাষীর জনগণের নিজস্ব জাতীয় সংস্কৃতি, ভাষাকে ধ্বংস করতে উদ্যত। ‘এক দেশ এক ভাষা’-র মতন ফ্যাসিবাদী প্রচারকে জনপ্রিয় করে তুলছেন তাদের আগামী দিনে ‘এক দেশ এক ভোট’ মুখী ফ্যাসিবাদী রাষ্ট্রকাঠামোর দিকে যাত্রায়। এ নিয়ে কমবেশি প্রত্যেকটি রাজনৈতিক দলই মুখ খুলেছেন; কেউ সংসদে, কেউ রাস্তায়। কিন্তু এই আগ্রাসন, এই সংকট কোনো নতুন বিষয় নয়। ১৯১৬ সালে জাতীয় কংগ্রেস অধিবেশনে মহাত্মা গান্ধীর সভাপতিত্বে ‘সর্বভারতীয় এক ভাষা ও এক লিপি সম্মেলন’ অনুষ্ঠিত হয়। সেই থেকে শুরু। মারোয়াড়ি ও গুজরাটি শিল্পপতিদের ভারতব্যাপী বাজার গড়ে তোলার কাজে বাধা হয়ে থাকা ভাষা-সংস্কৃতির দেশজোড়া বৈচিত্র্য উপড়ে ফেলতে বিড়লাদের টাকায় সারা এশিয়া জুড়ে রাজ্যে রাজ্যে, প্রদেশে প্রদেশে গিয়ে কংগ্রেসের পক্ষ থেকে গান্ধিজি প্রচার করতে থাকেন “অহিন্দিভাষীদের হিন্দি শেখাটা হচ্ছে ধর্ম”! ভাষারূপে হিন্দি এবং লিপিরূপে দেবনাগরীকে সারা ভারত উপমহাদেশে প্রতিষ্ঠা করে ‘হিন্দু ভারতকে সংহত ও বলিষ্ঠ’ করার সংগ্রামে নেমেছিলেন গান্ধি তথা কংগ্রেস। হিন্দিকে জাতীয় ভাষা হিসেবে প্রতিষ্ঠার জন্য ১৯৩৫ সালে রাজেন্দ্র প্রসাদকে সভাপতি করে তিনি বানান ‘রাষ্ট্রভাষা প্রচার সমিতি’। ১৯৩৬/৩৭ এর লগ্নে মুসলিম লিগ এটির তীব্র বিরোধিতা করলে তৎকালীন উত্তর ভারতের কিছু কিছু অঞ্চলের একটি প্রচলিত কথ্য ভাষা ‘হিন্দুস্থানি’ (হিন্দি ও উর্দুর সংমিশ্রণে তৈরি)কে জাতীয় কথ্য ভাষা হিসেবে এবং দেবনাগরী ও উর্দুকে (পড়ুন হিন্দি) লিপি হিসেবে ব্যবহার করা যেতে পারে বলে ‘ভাষা প্রশ্ন’ নামের একটি নির্লজ্জ পুস্তিকা পর্যন্ত লিখে ফেলেন জওহরলাল নেহেরু। একদিকে গুজরাটি ও মারোয়াড়ি বেনিয়া এবং অন্য দিকে মুসলমান বেনিয়াগোষ্ঠীর এই দ্বন্দ্ব সুচারু রূপে এড়িয়ে চলেন গান্ধি তথা নেহেরু তথা কংগ্রেসের সমকালীন নেতৃত্ব। সুনীতিকুমার ঘোষ এ প্রসঙ্গে লিখছেন “যে হিন্দুস্থানী ভাষার কোন লিখিত রূপ নেই, সাহিত্য নেই, সেই ভাষায় ভারতের সংবিধান রচিত হবে, সেই ভাষা সমগ্র এশিয়ার ভাষা হবে- এর মধ্যে যে অবাস্তবতা আছে তা গান্ধীর মত ব্যক্তির কাছে অজ্ঞাত ছিল না। তারা হিন্দুস্থানী বেনামীতে হিন্দির পক্ষে ওকালতি করছিলেন।”
ইতিহাসের বর্বর পরিহাস হল আজ এই কংগ্রেসের মতন দলগুলিও সংঘ পরিবারের হিন্দি আগ্রাসনের বিরুদ্ধে কথা বলছেন এবং সংসদীয় বামশক্তিগুলি তাদের হয়ে ওকালতি করছেন।
অতএব আজকের দিনে সারা ভারতব্যাপী বিজেপি ও সংঘ পরিবারের এই সাংস্কৃতিক আগ্রাসন কোনও নতুন বিষয় নয়। গুজরাটি, মারোয়াড়ি শিল্পপতিদের প্রাচ্য থেকে প্রশান্ত পর্যন্ত বাজার দখলের যে পুরোনো কর্মসূচি তারা একসময় গান্ধী, নেহেরু তথা কংগ্রেসকে দিয়ে বাস্তবায়িত করছিল; আজ সেটাই বিজেপি-আরএসএস পুরোদমে সফল করতে নেমেছে।
সমগ্র উপমহাদেশ জুড়ে এই শিল্পপতিরা যে বাজার দখল করার পরিকল্পনা করেছিলেন, সেই পরিকল্পনা বাস্তবায়নে এই সমগ্র ভূখণ্ডে একটিই নির্দিষ্ট ভাষা ও সংস্কৃতিকে প্রতিষ্ঠা করার প্রয়োজন ছিল এবং এখনও আছে। তারই ফলস্বরূপ, তখনকার কংগ্রেসের পিছনে ও এখনকার বিজেপির পিছনে টাকা ঢেলে তারা হিন্দি ভাষাকে জাতীয় ভাষা হিসেবে প্রতিষ্ঠা করার প্রক্রিয়ায় নামিয়ে দিয়েছিল ও এখনও দিয়েছে।
একইভাবে যে উগ্র হিন্দু জাতীয়তাবাদ আজকে সারা দেশের জ্বলন্ত সমস্যা হিসেবে উঠে আসছে, তারও ইতিহাস এর সাথেই বিজড়িত। ‘নিখিল ভারতীয় জাতীয়তাবাদ’- এর জাতিহীন জাতীয়তাবাদের তত্ত্ব আসলে এই ভারত উপমহাদেশের বিভিন্ন জাতিসত্তা ও ভাষাগোষ্ঠীগুলির উপর হিন্দি ভাষা ও সংস্কৃতির আগ্রাসনেরই নামান্তর মাত্র। ‘সমস্ত ভারতীয়রা এক জাতি’- এই তত্ত্ব প্রসঙ্গে রুশ গবেষক ডায়াকোভ বলেছেন যে ‘এটি আদতে ভারতের শিল্পপতিদের, প্রধানত গুজরাটি, মারোয়াড়ি পুঁজিপতিদের কেন্দ্রমুখীনতার প্রকাশ। এই গুজিরাটি, মারোয়াড়ি শিল্পপতিরা ভারতের বাজারের উপর আধিপত্য করার একচেটিয়া অধিকার চায়।’ এক্কেবারে এর অংশ হিসেবেই উদাহরণস্বরূপ আমরা যদি বাংলার ইতিহাসও লক্ষ্য করি, দেখব একসময়ের সমৃদ্ধশালী বাংলায় এই মারোয়াড়ি ব্যবসায়ীরাই এসে এখানকার উৎপাদন ধ্বংস করে, এখানকার কাঁচামাল লুট করে নিজেরা এখানকার বাজার দখল করে। ইংল্যান্ডের যন্ত্রশিল্পের বিকাশের প্রয়োজনে ব্রিটিশদের দালাল এই মারোয়াড়ি ব্যবসায়ীরা বাংলার স্বাধীন শিল্পকে ধ্বংস করে। আজকের বড়োবাজার, যেটা কিনা বাংলার অভ্যন্তরীণ বাণিজ্যের একটা প্রধান কেন্দ্র ছিল, উনিবিংশ শতাব্দীর মাঝবয়সেই তা সম্পূর্ণরূপে মারোয়াড়ি এলাকা বনে যায়। এই মারোয়াড়িরাই বাংলা জুড়ে লন্ডন, ম্যাঞ্চেস্টারের বাজার তৈই করতে সবচেয়ে বড়ো ভূমিকা নেয়। মজার একটি পরিসংখ্যান হল ব্রিটিশ শাসনাধীন ভারতে বিদেশি বস্ত্র আমদানিকারীদের মধ্যে শতকরা ৭৫ জনই ছিল মারোয়াড়ি! বাকি প্রায় পুরোটাই ছিল ইউরোপীয় ম্যানেজিং এজেন্সি।
অর্থাৎ এটা দিনের আলোর মতই পরিষ্কার যে ব্রিটিশদের ও কংগ্রেসের সহযোগিতায় এই মারোয়াড়ি ও গুজরাটি শিল্পপতিরা সমগ্র দেশের বিভিন্ন প্রদেশের, রাজ্যের স্বাধীন অর্থনীতিকে ধ্বংস করে নিজেদের বাজার দখলের স্বার্থে। এবং এরই অংশ হিসেবে বহু জাতিসত্তার, ভাষা-সংস্কৃতির ঐতিহ্যের উপর নামায় নৃশংস আক্রমণ; নিজেদের ব্যবসায়িক স্বার্থে চাপিয়ে দেয় একটি নির্দিষ্ট ভাষা হিন্দির আধিপত্য।
দুটো বিষয় সম্পর্কে এখানে আমাদের স্পষ্ট হতে হবে। প্রথমত আজকের দিনের এই হিন্দি সংস্কৃতির আগ্রাসনকে তার ইতিহাস থেকে বিচ্ছিন্ন করে দেখলে চলবে না। এবং দ্বিতীয়ত এই ঐতিহাসিক সত্যটা আমাদের উপলব্ধি করতে হবে যে ভাষার উপর ভাষার আগ্রাসন, সংস্কৃতির উপর সংস্কৃতির আগ্রাসন; সারা দেশব্যাপী বহুধা জাতিসত্তা, তার ভাষা-সংস্কৃতির উপর একটি নির্দিষ্ট ভাষা হিন্দির আগ্রাসন – আসলে অর্থনৈতিক আগ্রাসন।
আমাদের পূর্ব বাংলার বিপ্লবীরা রক্ত দিয়ে আজকের দিনটি ইতিহাসে খোদাই করে রেখে গিয়েছেন। তাই স্কুল, কলেজে দুটো সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠানেই আমাদের কর্তব্য শেষ হয়ে যায় না। এই প্রজন্মকে এই ইতিহাস, এই আগ্রাসন ও একই সাথে এর বিরুদ্ধে ঐতিহাসিক সংগ্রাম সম্পর্কেও সচেতন করার দায়িত্ব আমাদের কাঁধে বর্তায়। সর্বোপরি আজ ‘ভাষা দিবস’ নয়, ‘আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবস’।