Home কৃষি চলমান কৃষক আন্দোলন ও ভারতের বিচারব্যবস্থা: কিছু জরুরি কথা
0

চলমান কৃষক আন্দোলন ও ভারতের বিচারব্যবস্থা: কিছু জরুরি কথা

চলমান কৃষক আন্দোলন ও ভারতের বিচারব্যবস্থা: কিছু জরুরি কথা
0
সুমনকল্যাণ মৌলিক

কর্পোরেট স্বার্থবাহী নয়া কৃষি আইন ও চলমান কৃষক আন্দোলনের বৈশিষ্ট্য নিয়ে বহু আলোচনা হয়েছে এবং আগামী দিনে আরও হবে। কিন্তু আন্দোলন যত দীর্ঘায়িত হচ্ছে তত এই আন্দোলনের কষ্টিপাথরে ভারতীয় প্রজাতন্ত্রের অঙ্গ – উপাঙ্গ গুলির চরিত্র, কর্মপদ্ধতি, ভূমিকাগুলিরও যেন নতুন করে বিচার হচ্ছে। বর্তমান নিবন্ধে আমরা কৃষি আইন ও চলমান আন্দোলনের ক্ষেত্রে ভারতীয় বিচার ব্যবস্থার ভূমিকাকে যুক্তি তর্কের আলোকে দেখে নেওয়ার চেষ্টা করব।

নয়া কৃষি আইন ও তার বিরুদ্ধে সংগঠিত গণ আন্দোলনে সর্বোচ্চ আদালতের হস্তক্ষেপের প্রয়োজন হল কেন সে বিষয়টা প্রথমে একটু বুঝে নেওয়া যেতে পারে। যে কথাটা প্রথমে উল্লেখ করা দরকার তা হল প্রতিবাদী কৃষকরা কখনও তাদের সমস্যা সমাধানের জন্য আদালতের হস্তক্ষেপ দাবি করেনি। কাগজ – কলম এটাও বলছে সরকার পক্ষও আদালতে যায়নি। আদালতে গেছে তৃতীয় পক্ষ। এদের মধ্যে একদল অবস্থান ওঠাবার নির্দেশ আনতে আইনের শরণাপন্ন হয়। আরেক দল নতুন আইনগুলি সংবিধান সন্মত কি না তা বিচার করার জন্য আদালতের দ্বারস্থ হন। আন্দোলনের সঙ্গে যুক্ত সমাজকর্মী যোগেন্দ্র যাদব ( দি প্রিন্ট, ১৩.১.২০২১) সঠিকভাবে উল্লেখ করেছেন যে কৃষক নেতারা কখনওই সরকারের সঙ্গে আলোচনায় বসতে অস্বীকার করেননি কারণ তারা এটা বিশ্বাস করেন, সমস্যা সমাধানের জন্য এটা অন্যতম একটি গণতান্ত্রিক পদ্ধতি। আর কৃষি আইনের ক্ষেত্রে চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত নেওয়ার দায় যেহেতু কেন্দ্রীয় সরকারের তাই তারা কখনো আন্দোলন ও আলোচনার প্রক্রিয়ায় আদালতের হস্তক্ষেপের প্রয়োজন অনুভব করেননি। আর একথাও সবার জানা যে আদালতের দায়বদ্ধতা মানুষের ইচ্ছে নিরপেক্ষ ভাবে সংবিধানের প্রতি।

সর্বোচ্চ আদালতের যে সিদ্ধান্তটি সবচেয়ে বেশি বিতর্কের জন্ম দিয়েছে তা হল নয়া কৃষি আইনের প্রয়োগ স্থগিত রাখা এবং সমস্যার সমাধানের জন্য আদালতের মনোমত একটি কমিটি গঠন করা। এই বিতর্কের কারণ ভারতের সংবিধানে আদালতের যে ইতিকর্তব্য নির্দিষ্ট করা হয়েছে তার সঙ্গে সর্বোচ্চ আদালতের সিদ্ধান্তগুলি সাযুজ্যপূর্ণ নয়। সংবিধানের বিভিন্ন ধারায় (অনুচ্ছেদ ৩২,১৩১-১৩৪,১৩৬) এটা স্পষ্ট যে সরকার দ্বারা প্রণীত কোন আইনের সাংবিধানিক বৈধতা নিয়ে প্রশ্ন উঠলে আদালত দু- পক্ষের যুক্তি – তর্ক শুনবে তারপর সংবিধানের আলোকে আইনটি বৈধ না অবৈধ সেই ব্যাপারে তার রায় শোনাবে। কিন্তু কোথাও এটা বলা নেই আদালত তার ইতিকর্তব্য ভুলে বিবদমান দুপক্ষের মধ্যে ‘মধ্যস্থতাকারী’ র ভূমিকা পালন করবে। এই কমিটি গঠন করে আদালত মধ্যস্থতাকারীর ভূমিকায় অবতীর্ণ হয়েছে।

আইনজীবী প্রবীণ ভার্মা ( দি ওয়ার,১৮ জানুয়ারি, ২০২১) এই কমিটি গঠনের ক্ষেত্রে যে অসঙ্গতিগুলি সামনে এনেছেন, তার মধ্যে উল্লেখযোগ্য হল — প্রথমত এই অ্যাড হক কমিটির সদস্যরা কিসের ভিত্তিতে নির্বাচিত হবেন? দ্বিতীয়ত এই সদস্যরা কি শুধুমাত্র বিচারপতিদের ইচ্ছানুসারে কমিটিতে আসবেন?  তৃতীয়ত এই রকম কোনো নির্দেশ আছে কি যে সদস্য নির্বাচন ও তাদের কর্তব্য নির্দিষ্ট করার ব্যাপারে বিবদমান পক্ষগুলির সঙ্গে কোন শলা পরামর্শ করা হবে?  চতুর্থত কমিটির সদস্য নির্বাচনের ক্ষেত্রে ‘স্বার্থের সংঘাত ‘ ( conflict of interest)-এর প্রশ্নটি কি বিবেচিত হবে?

প্রবীণ ভার্মার উত্থাপিত প্রশ্নগুলি এক নতুন মাত্রা পেয়ে যায় যখন আমরা আদালত প্রস্তাবিত কমিটির সদস্যদের নামের তালিকাটা দেখি। এই সদস্যরা বিগত সময়ে খবরের কাগজে,সাংবাদিক সম্মেলনে কৃষি আইন নিয়ে তাদের যে পর্যবেক্ষণ প্রকাশ করেছেন তাও আমাদের জানা দরকার। কমিটির প্রথম নামটি ভূপিন্দার সিং মান। এই কৃষক নেতা মনে করেন যে ভারতের কৃষি ব্যবস্থাকে প্রতিযোগিতামূলক করার জন্য সংস্কার অতীব জরুরি ( মান অবশ্য কমিটির সদস্য হিসাবে নাম ঘোষণার পর দায়িত্ব নিতে অস্বীকার করেন)।  দ্বিতীয় নামটি অনিল গানওয়াত যিনি এই বিতর্ক চলাকালীন একাধিকবার তার লিখিত বক্তব্যে বলেছেন আইনগুলি প্রত্যাহারের কোন প্রশ্নই নেই কারণ এই আইনগুলো কৃষকদের জন্য নিত্য নতুন সুবিধা বয়ে আনবে। তৃতীয় নামটি অধ্যাপক অশোক গুলাটি। নয়া উদারবাদী মডেলে ভারতের কৃষি ব্যবস্থাকে সাজানোর পক্ষে তিনি দীর্ঘদিন সওয়াল করছেন। একটি লেখায় তিনি এমনও বলেছেন  যে নয়া কৃষি আইনে বিশেষ পরিস্থতিতে ফসলের দামের ক্ষেত্রে সরকারের হস্তক্ষেপের যে সামান্য সুযোগ আছে সেটাও রাখার দরকার নেই।  চতুর্থ জন ডঃ পি কে জোশি, যার বক্তব্য হল আইনগুলোর সামান্য সংশোধন করারও দরকার নেই। স্বাভাবিক ভাবেই এই প্রশ্নটি উঠছে যে এই কমিটির যা সুপারিশ হবে তা কি পূর্ব নির্দিষ্ট! এ যেন খেলা শুরু হবার আগেই তার জয় – পরাজয় নির্দিষ্ট করার মত ব্যাপার।

আইনের কিছু পর্যবেক্ষক আরো একটি গুরুতর প্রশ্ন তুলেছেন। সেটা হল আইনটি সাংবিধানিকভাবে বৈধ কি না তা নিয়ে কোন শুনানি হবার আগেই আদালত আইনের প্রয়োগকে কী ভাবে স্থগিত করে দিতে পারে? এটাও কিন্তু ভারতীয় বিচার ব্যবস্থার ইতিহাসে খুব একটা স্বাভাবিক ঘটনা নয়।

শীর্ষ আদালতের আর একটি রায় নিয়েও বিতর্ক হচ্ছে। সেখানে আদালত রায়ের প্রথম অংশে কৃষকদের প্রতিবাদের অধিকারকে স্বীকার করে নিয়ে ধরনাস্থল খালি করার নির্দেশ দিতে অস্বীকার করে কিন্তু একই সঙ্গে আন্দোলনকারীদের মধ্যে বৃদ্ধ ও মহিলাদের উপস্থিতি নিয়ে প্রশ্ন তোলে (why are women and elders kept in the protest?) এবং আন্দোলনের নেতৃত্বের কাছে তাদের সরাতে অনুরোধ ( নির্দেশ?)  করে। আদালতের এই পর্যবেক্ষণ দুটো প্রশ্নের জন্ম দেয়। প্রথমত কে রাষ্ট্রের নাগরিক এবং কে নয়? দ্বিতীয়ত আন্দোলনের ক্ষেত্রে এবার থেকে কি কোনো ‘অভিভাবক’ থাকবে যিনি ঠিক করে দেবেন যে কে আন্দোলনে অংশ নেবে এবং কে নয়?

একটু তলিয়ে লক্ষ্য করলে দেখা যাবে আদালতের এই পর্যবেক্ষণ একাধারে পিতৃতান্ত্রিক মানসিকতা প্রসুত ( যা নারীদের স্বাধীন ও স্বতন্ত্র অবস্থানকে অস্বীকার করে) এবং অপরদিকে ভারতীয় রাষ্ট্র ব্যবস্থা যেভাবে কৃষিতে নারীদের ঐতিহাসিক ভূমিকাকে অস্বীকার করেছে, আদালতও সেই একই মনোভাব ব্যক্ত করেছে। এক্ষেত্রে পরিসংখ্যান কিন্তু অন্য কথা বলে। দি ন্যাশানাল কাউন্সিল অব অ্যাপ্লায়েড ইকনমিক রিসার্চ জমির মালিকানার প্রশ্নে পুরুষ ও নারীর বৈষম্য নিয়ে এক প্রতিবেদনে বলেছে — “দেশের কৃষি শ্রমের ক্ষেত্রে ৪২% হল মহিলা যা ভারতীয় কৃষিতে নারীদের বর্ধমান অংশগ্রহণের সূচক কিন্তু কৃষি জমির মালিকানার প্রশ্নে তাদের অধিকার ২ শতাংশেরও কম”।

আদালতের এই রায়ের ক্ষেত্রে কেউ কেউ মানবিকতার প্রশ্নটি তুলেছেন।  কিন্তু সাম্প্রতিক সময়ে আমরা দেখেছি যখন মাত্র ৪ ঘণ্টার নোটিশে অপরিণামদর্শী লকডাউনের কারণে লক্ষ লক্ষ পরিযায়ী শ্রমিক ( যাদের মধ্যে বিরাট সংখ্যায় নারী ও শিশু ছিল)  এক ভয়ঙ্কর বিপর্যয়ের শিকার হলেন ( বহু মানুষ প্রাণ হারালেন) তখন কিন্তু ‘মানবিকতার’ প্রশ্নে সর্বোচ্চ আদালত কোনো হস্তক্ষেপ করলেন না। নারী আন্দোলনের কর্মীরা তাই আমাদের সঠিক ভাবে মনে করিয়ে দিয়েছেন যে ভারতীয় সংবিধান আন্দোলনে অংশগ্রহণের প্রশ্নে বয়স ও লিঙ্গের দোহাই দিয়ে কাউকে আন্দোলনে অংশগ্রহণে নিষেধাজ্ঞা আরোপ করতে পারে না।

এই চলমান কৃষক আন্দোলনের ক্ষেত্রে শীর্ষ আদালতের ভূমিকা গণতান্ত্রিক মূল্যবোধে বিশ্বাসী মানুষদের হতাশ করলেও আশার দিক হল কৃষক নেতৃত্বের পরিণত ভূমিকা। তারা বিচার বিভাগীয় গোলোকধাঁধার শিকার হবে না বলে  কখনওই তাদের দাবির সমাধানের জন্য আদালতের দ্বারস্থ হয়নি। এই কমিটি গঠনের প্রক্রিয়াটিকে অস্বীকার ও প্রত্যাখ্যান করে তারা আসলে প্রজাতন্ত্রে বর্ণিত গণতান্ত্রিক দায়বদ্ধতা ও দায়িত্বশীল সরকারের ভূমিকাকে সক্রিয় করতে চেয়েছে।  আবার মহিলাদের অংশগ্রহণের প্রশ্নে ১৩ জানুয়ারি ( ২০২১) সংযুক্ত কিষান মোর্চা তাদের প্রেস নোটে বলেছে — ‘ কৃষিতে মহিলাদের অংশগ্রহণ পুরুষদের মতোই এবং এটা নারী পুরুষ নির্বেশেষে সমস্ত কৃষকদের আন্দোলন —- তাই তাদের অংশগ্রহণ নিয়ে প্রশ্ন তোলা লজ্জাজনক। আমরা কঠোর ভাষায় এই ভাবনার বিরোধিতা করছি ‘। আজ লক্ষ কৃষকের আন্দোলন এবং তাদের ভাবনাই এদেশে ন্যায়ের নতুন পরিভাষার জন্ম দিচ্ছে।

Share Now:

LEAVE YOUR COMMENT

Your email address will not be published. Required fields are marked *