Home রাজনীতি আমাদের সাসপেনশন আসলে বিশ্বভারতীর গেরুয়াকরণের ধারাবাহিক প্রক্রিয়ারই অংশ

আমাদের সাসপেনশন আসলে বিশ্বভারতীর গেরুয়াকরণের ধারাবাহিক প্রক্রিয়ারই অংশ

আমাদের সাসপেনশন আসলে বিশ্বভারতীর গেরুয়াকরণের ধারাবাহিক প্রক্রিয়ারই অংশ
2
ফাল্গুনী পান, সাসপেন্ড ছাত্র, বিশ্বভারতী

বর্তমানে সারা দেশ ফ্যাসিস্ট আগ্রাসনের সামনে দাঁড়িয়ে চোখে চোখ রেখে লড়াই চালিয়ে যাচ্ছে। ফাসিস্ট আক্রমণের সামনে দাঁড়িয়ে প্রতিরোধই যে একমাত্র পথ সংগঠিত জনগণ তা বারবার আমাদের চোখের সামনে আঙুল দিয়ে দেখিয়ে দিচ্ছে। পূর্বতন কংগ্রেস সরকার দেশের জল, জঙ্গল, জমি, শিক্ষা, শ্রম বিদেশি এবং দেশি কর্পোরেটের কাছে বিক্রি করার যে প্রক্রিয়া শুরু করেছিল তাকে প্রচন্ড তীব্রতায় এবং রেজিমেন্টেড পদ্ধতিতে কার্যকর করছে বর্তমান বিজেপি-আরএসএস-এর ফ্যাসিস্ট সরকার।

সেই শুরুর দিন থেকে ফ্যাসিস্ট শক্তির প্রতিরোধে সব থেকে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রেখেছে দেশের ছাত্রছাত্রী এবং মহিলারা। তাদের উপর বারবার নেমে এসেছে তীব্র আক্রমণ। জে এন ইউ, জামিয়া মিলিয়া, এলাহাবাদ, যাদবপুর প্রভৃতি বিশ্ববিদ্যালয়ের ভেতরে ঢুকে বিজেপি-আরএসএস গুন্ডারা ঢুকে তান্ডব করেছে বিভিন্ন আন্দোলন চলাকালীন। আমাদের রাজ্যের একমাত্র কেন্দ্রীয় বিশ্ববিদ্যালয় বিশ্বভারতী। যা শুধু কেন্দ্রীয় বিশ্ববিদ্যলয় হিসেবেই গুরুত্বপূর্ণ নয়। বিশ্বভারতী একই সাথে রবীন্দ্রনাথের বিকল্প শিক্ষা সংস্কৃতিকে ধারণ করার দায় বহন করে। সেখানেও ছাত্রছাত্রীরা বারবার আক্রমণের সম্মুখীন হয়েছে। কখনও গুন্ডা কখনও প্রাণনাশের হুমকি আর এখন তো কথায় কথায় সাসপেনসন লেটার ধরিয়ে দেওয়া একটা রীতি হয়ে গেছে। আইনি বেআইনি সমস্ত রকম আক্রমণের শিকার বিশ্বভারতী, তবে এই আক্রমণের সামনে দাঁড়িয়ে লড়াই চালিয়ে যাচ্ছে বিশ্বভারতী ছাত্রছাত্রী ঐক্য। আক্রমণ যখন আছে, প্রতিরোধও আছে এখানে।

সোমনাথ সৌ, সাসপেন্ড ছাত্র, বিশ্বভারতী

২০১৮ সালে বিশ্বভারতীতে উপাচার্য হিসেবে যোগ দেন বিদ্যুৎ চক্রবর্তী। উপরওয়ালাদের নির্দেশ অনুযায়ী তিনি আসার পর থেকেই একের পর এক ছাত্রছাত্রী বিরোধী পদক্ষেপ নিতে শুরু করেন। প্রথমে টাকা না থাকার অজুহাতে অস্বাভাবিক হারে অ্যাডমিশন ফি বাড়িয়ে দেন কিন্তু গোটা ক্যাম্পাস সিসিটিভিতে ভরিয়ে দেওয়া হয়। পাঠভবন ক্যাম্পাসে ঢোকা বন্ধ হয়। বিশ্বভারতীর সঙ্গে সংসর্গিত বিভিন্ন অংশকে ধীরে ধীরে বিভিন্ন অজুহাতে বিশ্বভারতী থেকে সরিয়া দেওয়ার কাজ শুরু হয়। এর মধ্যেই ফিস হাইকের বিরুদ্ধে ছাত্রছাত্রী ঐক্যের নেতৃত্বে তীব্র আন্দোলন শুরু হয়। আন্দোলন যখন সেই দফার মতো শেষ হয়েছে তখন সবার বাড়িতে সতর্কতামূলক চিঠি পাঠানো হল বিশ্বভারতীর তরফ থেকে। এরপর যখন সারা দেশ জুড়ে NRC NPR CAA বিরোধী আন্দোলন শুরু হয় বিশ্বভারতীর বুকেও ‘রেজিস্ট NRC NPR CAA’র ব্যানারে ছাত্রছাত্রী ঐক্যের নেতৃত্বে NRC প্রতিরোধের আন্দোলন তীব্রতা পায়। ৮’জানুয়ারি দেশব্যাপী যে ধর্মঘটের ডাক দেওয়া হয় তারই সমর্থনে বিশ্বভারতীতেও স্বতঃস্ফূর্ত ধর্মঘট পালিত হয়। ধর্মঘট ভেস্তে দেওয়ার উদ্দেশ্যে দালাল উপাচার্য সেই একই দিনে CAA-র সমর্থনে একটি আলোচনা সভা আয়োজন করে, সেখানে প্রধান বক্তা হিসেবে আনা হয় বিজেপির সাংসদ স্বপন দাসগুপ্তকে, যিনি সেই জয়েন্ট পার্লামেন্টরি কমিটিতে উপস্থিত ছিলেন যে কমিটি সরকারকে CAA আইনের বিষয়ে প্রশ্ন করে এবং সেখান থেকে আনা যায় ৩১৩১৩ জন ছাড়া কেউই নাগরিকত্ব পাবে না। স্বভাবতই ছাত্রছাত্রীরা এই আলোচনা সভার বিরোধিতা করে। যে সভাগৃহে এই সভা হওয়ার কথা ছিল তার বাইরে ছাত্রছাত্রীরা অবস্থান করছিল, এমত অবস্থায় হঠাৎ করেই সভার স্থান পালটে ফেলা হয়। নতুন সভাস্থানে ছাত্রছাত্রীরা পৌঁছয় সেখানেও তারা অবস্থানে বসে। এর কয়েকদিনের মধ্যেই একটি ভিডিও প্রকাশ্যে আসে যেখানে উপাচার্য তার পোষা বাইক বাইনীকে ছাত্রছাত্রীদের ‘ওষুধ’ দেওয়ার নির্দেশ দিচ্ছেন। ১৫ জানুয়ারি প্রথমে একটি হোস্টেলে তারপর পিয়ারসন মেমোরিয়াল হাসপাতালে বাইক বাহিনী আক্রমণ করে, ছাত্রছাত্রী ঐক্যের প্রতিনিধি স্বপ্ননীলকে প্রচণ্ড মারধোর করা হয়। এ সমস্ত করেও কোনো ভাবেই NRC বিরোধী আন্দোলনকে উপাচার্য যখন কোনোভাবেই দমাতে পারলেন তখন শিক্ষকদের উপর আক্রমণ করা শুরু হল বিভিন্ন ভাবে, নানা কারণে অন্যায় অজুহাত দেখিয়ে শিক্ষকদের শোকজ করা হতে শুরু করে। কর্মীরা তাদের দাবি নিয়ে অবস্থান করলে প্রথমে তাদের আন্দোলন দমন করা হয় তারপর সাসপেন্ডের ভয় দেখিয়ে তাদের দিয়ে মুচলেকা লিখিয়ে নেওয়া হয় যাতে তারা আর কোনোভাবেই কোনো আন্দোলনের দিকে না হাঁটে। কয়েক লক্ষ টাকা খরচ করে মঞ্চ তৈরি করে স্থানীয় ব্যাবসায়ীদের পেটে লাথি মারতে তাদের দোকান উচ্ছেদের উদ্দেশ্যে উপাচার্য তার সাঙ্গপাঙ্গ নিয়ে অনশনে বসেন। হোস্টেল থেকে একটি ছাত্রকে কোনো অফিসিয়াল নোটিশ ছাড়াই রাস্টিকেট করা হয়, তার অপরাধ ছিল সে উপাচার্যের একটি সংবিধান বিরোধী প্রকাশ্য বক্তব্য তার ফোনে রেকর্ড করে। একদিকে ছাত্রছাত্রী,শিক্ষক, শিক্ষিকা, শিক্ষাকর্মী সকলের মুখ বন্ধ করে দেওয়ার জন বল প্রয়োগ করা হতে থাকে অন্যদিকে শান্তিনিকেতন যে বিকল্প সংস্কৃতি নিয়ে বেড়ে উঠেছে সেটিকে ধ্বংস করে হিন্দুত্ববাদী সংস্কৃতিকে চাপিয়ে দেওয়ার কাজ চলতে থাকে। ঐতিহাসিক এবং ঐতিহ্যবাহী বেশ কিছু অনুষ্ঠান বন্ধ করে দেওয়া হয় নানা অজুহাতে। বিশ্বভারতী যে তার দর্শন এবং অভ্যাসে মুক্তচিন্তাকে বহন করে তাকে চারিদিক দিয়ে পাঁচিল দিয়ে ঘিরে ফেলতে শুরু করা হয়।একদিকে টাকা না থাকার অজুহাতে ফি বৃদ্ধি অথচ অপ্রয়োজনীয় অট্টালিকা, পাঁচিল বানিয়ে টাকা নষ্টের দ্বিচারিতা আদতে বেআইনি টাকা লেনদেনের উপায় ছাড়া আর কিছুই না। আশ্রমসংঘের স্মৃতিচারণ অনুষ্ঠান সেই শুরুর দিন থেকে আশ্রমের অভ্যন্তরে করা হত, সেই অনুমতি কেড়ে নেওয়া হয়। আলাপিনী মহিলা সমিতির ঘর কেড়ে নেওয়া হয়। শান্তিনিকেতন-বিশ্বভারতীর প্রাক্তন স্বনামধন্য ব্যক্তিদের মিথ্যে অভিযোগে মানহানি করতে শুরু করেন উপাচার্য স্বয়ং। একই সঙ্গে সমাবর্তন অনুষ্ঠানে ‘জয় শ্রীরাম’ ধ্বনি, হলকর্ষণ অনুষ্ঠানে ABVP’র প্রাক্তন সর্বভারতীয় সভাপতির উপস্থিতি, উপাচার্যের বাসভবনে ছোটো বড়ো বিজেপি নেতানেত্রীদের আনাগোনা। বিজ্ঞান, কলা বিভাগের ল্যাব বা আনুষঙ্গিক বিষয়ে কোনো উন্নতি না ঘটিয়ে, শিক্ষামূলক চর্চা, বিশ্বজোড়া জ্ঞানভান্ডারের সন্ধান না দিয়ে জমির দালালিকে প্রতিষ্ঠানের প্রধান কর্ম হিসেবে গড়ে তোলা। গবেষকদের স্টাইপেন্ডের ক্ষেত্রে নিয়মিত অনিয়ম। সাম্প্রদায়িক অমিত শাহের এখানে আসা, বিবেকানন্দের নামে এমন একটি সরণির নামকরণ, যে সরণির কস্মিন কালেও কোনো অস্তিত্ব ছিল না। অমিত শাহের আসার দিন দুই ছাত্রকে গৃহবন্দি করে রাখা। এই সমস্ত কিছুই শান্তিনিকেতন এবং একটি শিক্ষা প্রতিষ্ঠান হিসেবে বিশ্বভারতীকে গেরুয়াকরণের প্রক্রিয়ার চূড়ান্ত প্রচেষ্টা। এবং এই সমস্ত কিছুই হচ্ছে উপাচার্যের নেতৃত্বে আর ছাত্রছাত্রীদের ক্যাম্পাসে উপস্থিত না থাকার সুযোগে।

এর মধ্যে বিশ্বভারতীর সঙ্গে সংযুক্ত প্রায় ২৩ জনকে নানা অজুহাতে সাসপেন্ড করা হয়েছে। উপাচার্যের ফ্যসিস্ট কার্যকলাপের বিরুদ্ধে একনাগাড়ে চিৎকার করে যাওয়ার জন্য সাসপেন্ড করা হল আমাকে আর সোমনাথ সৌ কে। উপাচার্যের উদ্দেশ্য দমনের ভয় দেখিয়ে সমস্ত কণ্ঠকে তিনি দমিয়ে রাখবেন, বস্তুত ফ্যাসিবাদের প্রকৃত চরিত্রই হল তাই। কিন্ত ইতিহাস আমাদের বারবার দেখিয়েছে, লাঠি, গুলি দমন দিয়ে কোনোদিন বিরুদ্ধ স্বরকে স্তব্ধ করা যায়নি। বারবার প্রতিরোধের আওয়াজ মাটির বুক ছিঁড়ে বেড়িয়ে এসেছে।‘বিশ্বভারতী ছাত্রছাত্রী ঐক্য’ সকল অংশের ছাত্রছাত্রীদের কাছে আবেদন জানাচ্ছে তারা নিজ নিজ স্কুল কলেজে নিজের নিজের ক্যাম্পাস খোলার দাবিতে তীব্র থেকে তীব্র আন্দোলন গড়ে তুলুন, সামনে দীর্ঘ লড়াই, আর সেই লড়াইকে জোরদার করার জন্য আমাদের আনলক ক্যাম্পাসের দাবিকে জোরাদার করতেই হবে।

Share Now:

Comment(2)

  1. ও! মোটে সাসপেনশন! একেবারে বহিষ্কার নয়? কথাবার্তা শুনে মনে হচ্ছে, কোন ছাত্র নয়, পাকা একজন পোড়খাওয়া নক্সাল জঙ্গী নেতা। এদের আর “পড়াশোনা” করে কী হবে? টুকরে গ্রুপের শাখা অফিসটিকে বন্ধ করে দেওয়ার জন্য শ্রদ্ধেয় উপাচার্য মহাশয়কে অনুরোধ জানাই। ওঁকে আমার প্রনাম। এরা ছাত্র নয়, রাজনৈতিক দুর্বৃত্ত। এদের শাসন করুন।

  2. ভোটে লড়ে ফ্যাসিস্ট দের আটকানো যাবে না। ভারতবর্ষের ভোটপন্থি লালঝান্ডা বাহকরা এটা আগেও বোঝে নি আজও বুঝছে না।ভারতিয় বিপ্লবী দের এই কাজে এগিয়ে আসতে হবে।

LEAVE YOUR COMMENT

Your email address will not be published. Required fields are marked *