অর্ণব ব্যানার্জি
জীবন্ত বোঝাপড়া নিয়ে নাটকের পর্যালোচনা করতে হলে নাটকের নেপথ্যে জীবনের ঘুঁটি ধরে শুরু করা দরকার। বিদূষক নাট্যমণ্ডলী কী ভেবে নাটক গড়ে তোলে, গ্রামে-বস্তিতে-হেঁজিপেঁজি জায়গায় এলিতেলি মানুষের মধ্যে সেই নাটকের শেকড় চালিয়ে দিতে চায়- সে সব না বুঝলে ড্রইংরুম লাইফস্টাইলের রসনাতৃপ্তি থেকে এ নাটকের বিশেষ আস্বাদন চেটে নেওয়া মুশকিল আছে। ১৩ ডিসেম্বর. ২০২০ তারিখে রাজা বিশ্বাসের স্মরণসভায় অভিনীত হল এই নাটক। মৃত্যুর আগে নাট্যকার রাজা বিশ্বাস এ নাটকের উপস্থাপনা দেখে যাননি। কিন্তু নাটক বলে দেয়, নাট্যকার ও নাট্যমণ্ডলী উদ্দেশ্যের দিকে ক্রমশ পরিণত পা ফেলেছেন। কী উদ্দেশ্য?
গণনাট্যের শেষ সময়ে শিল্পের নিজেরই স্বাদে মগ্ন শিল্পের জমানা চেয়েছিল বহুরূপী। অর্থাৎ, ইলিশ মাছ খেতে ভালো, অতএব ইতিহাস-ভূগোল ভুলে গুজরাটি জনতাও ইলিশের কদর করবে আর কি! মানুষের বাস্তব জীবন চর্চায় আকাশ-পাতাল ফারাক থাকলেও শিল্প শুধুই শিল্পের জন্য, সেখানে সব রুচির জন্য একই খাদ্য। বিদূষক কিন্তু বিনোদনের মধ্যে প্রবৃত্তির চাহিদার সঙ্গে মননের, যুক্তির চাহিদাকেও সমান গুরুত্ব দিয়ে এসেছে। তবে, তার থেকেও বেশি গুরুত্ব পেয়েছে সেই ব্যাপক মানুষের চাহিদা, যাদের অকারণ জটিল শব্দতত্তগুলো বুঝতে অসুবিধা হয়। শহরে, গ্রামে, জীবনের বেশিটুকুই কষ্টকর হওয়ায় যাদের সরল মনে সহজ অনুভূতির গল্পগুলো আর বলা হয়ে ওঠে না। আপনার-আমার মতো কত শত মানুষ ট্রেনে-বাসে গুঁতিয়ে হন্যে হয়ে দিনের শেষে টিভিতে অলীক সিরিয়াল বা খবরের নামে ঝগড়ায় হারিয়ে যায়, অযথা পরিশ্রম শেষ হলে মাথা ভারী হয়ে আসে নেশায়, অসুখে বা ঘুমে। অথচ আমরা কিন্তু নিজেদের কথাগুলোকে মূল্য দিয়ে চাওয়া-পাওয়া-না পাওয়ার গল্প বলার মাধ্যম খুঁজে পাই না। সংস্কৃতি শুধুই ডাউনলোড হয়।
বিদূষক মানুষের বিনোদনের অধিকার, বিনোদনের মধ্যে নিজের জীবনের গল্পকে অন্যের জীবনের সঙ্গে মেলাতে পারার এবং এই ব্যর্থতার বাজারের নৈরাজ্যের মধ্যে স্বপ্ন দেখার অবলম্বনকে ক্রমশ হাজির করেছে নাটকের ভেতরে। দর্শককে নাটকের অভিনয়ের দিকে টেনে আনতে, নাট্য আন্দোলনের দিকে এগোতে চেয়েছে। ‘কেন পল্টু জোরে ছোটে’ এ কাজে খুবই উপযুক্ত সংযোজন।
কেন্দ্রীয় চরিত্র পল্টুকে ঘিরে অভিনীত নাটকটা দর্শককে কলকাতা এবং সংলগ্ন এলাকার অনামা, অথচ ভীষণ চেনা মানুষদের সাম্প্রতিক ইতিহাসের মধ্যে অন্তরঙ্গ ভাবে টেনে নিয়ে আসে। এক দিকে মূল স্রোতের রাজনৈতিক নদীতে ভেসে-চলা প্রান্তিক সব ডিঙি নৌকার মতো মানুষ, সর্বক্ষণ টাল সামলাতে ব্যস্ত, যাদের প্রতীক পল্টু, অন্যদিকে খাদ্য আন্দোলন, দেশান্তর, নকশালবাড়ি, বিহারের সশস্ত্র কৃষক আন্দোলন, জরুরি অবস্থা, খালিস্তান, দাঙ্গা ইত্যাদি আবর্ত মুনশিয়ানার সঙ্গে গেঁথে দেওয়া হয়েছে যাতে দু’দিক বজায় থাকে। কোথাও এতটুকুও দুর্বোধ্য ফান্ডা-ঝাড়া বিদ্যেবাগীশ ছাপ পড়েনি, আবার দর্শককে অতি সরল পালস পোলিও খাওয়ানোর মতো আনকোরাও সমঝানো হয়নি। যে সব মানুষের সারাজীবন ছুটে চলতেই হয়, একটা আবেগঘন ঐতিহাসিক ধারার মধ্যে তারা নিজেকে খুঁজে পাবেন এই নাটকে।
নাটকের মূল উপজীব্য তার বক্তব্য নয়। শিল্পে বক্তব্য একটা খুবই জোরের জায়গা হলেও, হৃদয়ই এখানে আসল হকদার। এই নাটকে যা বলা আছে, সেগুলো বক্তৃতায় বলে দিলে অতি পরিচিত বলেই গুরুত্ব হারাবে। কিন্তু একই কথা দর্শকের বুকে এসে বেঁধে, যখন আঙ্গিক তৈরি থাকে। নাটকটা শুরু থেকে শেষ অবধি গান গেয়ে পরিবেশিত। এবং টানা দু’ঘণ্টা শিল্পীরা সহজ কিন্ত আকর্ষণীয় সুরে ঢিমে এবং দ্রুত লয়ে গান গেয়ে পালা জমিয়ে রেখেছেন। দু-একটি অন্য সুরও এসেছে, যার মধ্যে ‘একত্রিশে অক্টোবর উনিশশো চুরাশি’ গানের ব্যবহার বিদূষকের সরলতার ফাঁক গলে একটা দলীয় ফ্লেভারের অবাঞ্ছিত অনুপ্রেবেশ হতেই পারে। বিশেষত সিদ্ধার্থশঙ্কর রায়ের জমানার বীভৎসতা যেহেতু নাটকের দৃষ্টিক্ষেত্রে বিশেষ ধরা পড়েনি। আঙ্গিকের দিক থেকে এটা পথের নাটক। অভিনয়ের মধ্যেই পোশাক বদল, একই শিল্পীর নানা সাযুজ্যপূর্ণ চরিত্রে অভিনয়, প্রত্যেকের টানা উপস্থিতি, মুখে ফোলে জাতীয় শব্দ করা, শূন্যেই গাড়ি, দুর্ঘটনা ইত্যাদির আঙ্গিক দেখানো হয়েছে। তবে পল্টুর মায়ের রঙিন শাড়ি থেকে যেভাবে সাদা শাড়ি এসেছে, তার বিপরীতে মৃত্যুর পরেও সাদা শাড়ি পরে গল্প বলে যাওয়া দেখতে ভালো লাগেনি। দ্বিতীয়বারও শাড়ি বদলে ভিন্ন চরিত্র বনে যাওয়া যেত।
পল্টুর ভালোবাসার মানুষ টুম্পা বাধ্য হয় অচেনা জায়গায় বিয়ে করতে। কিন্তু সেখান থেকে ফিরে আসার পর পল্টু বিয়ে করেছে তার আগের পক্ষের শিশুকন্যাকে নিজের মেয়ে হিসেবে মেনে নিয়ে। এবং পরে বাবা-মেয়ের সম্পর্ক ‘ছোটোলোকের’ সহজাত মানবতার অপূর্ব এক ছবি এঁকে দিয়েছে। কিন্তু এই নিপুন মুনশিয়ানার মধ্যেই মেয়ের বিয়ের গয়নার জন্য জোর করে টাকা রেখে দেওয়া দেখতে ভালো লাগেনি। বিশেষত পল্টু আর টুম্পা নিজেরা যেখানে ফিরে পাওয়া ভালোবাসার টানে বিয়ের পর পরস্পরকে জড়িয়ে ধরে কেঁদে ভাসিয়েছে, মেয়েকে তেমন কোনো বিয়েতে দেখতে চাওয়া তাদের পক্ষে স্বাভাবিক।
নাটকের অভিনয় সত্যিই ভালো। বালক পল্টুর চরিত্রে লালনের অভিনয় অতিকিশোরের নিরুপায় কৈশোরকে সাবলীল ভাবে এঁকে দিয়েছে। পল্টু এবং ওর বাবার চরিত্রে যোগ্য অভিনয় উপভোগ করার মতো। টুম্পা, টুম্পার মা, মেয়ে, কাকা, সহকর্মী এবং মামার চরিত্রে পরণত অভিনয় দেখার মতো। ন্যারেশন এবং সংলাপ মেদহীন, ঝরঝরে। নাট্যকারকে হারিয়ে অতি অল্প সময়ে মহড়া দিয়ে যেভাবে প্রায় দু’ঘণ্টার নাটক পেশ হল, নিঃসন্দেহে তা অনুপ্রেরণা জাগায়। এই কৃতিত্বের বেশিরভাগটাই পরিচালক অমিত সাহার। ভবিষ্যতে ন্যারেটর এবং ক্যারেক্টরের কনট্রাস্ট আরও বাড়বে বলে আশা করা যায়।
নাটকে কোনো বিশেষ রাজনৈতিক বা সামাজিক সমাধান হাজির করা হয়নি। কিন্তু জীবনের বাস্তবতাকে স্বীকার করে ও বারবার হেরে গিয়েও যে মানুষ স্বপ্ন দেখে এবং কোমর বাঁধে, সেই আশার আলো জ্বলে রইল নাটক শেষের পরেও। ‘সিট খালি চাঁপাডালি বারাসাত’। রাজা বিশ্বেসের কলম শোকে নয়, প্রত্যয়ে ছুটে চলল পল্টুর সঙ্গে পল্টুর মেয়ের প্রজন্মের মধ্যে।
তবে সমালোচনা হিসাবে বলা যায়, ‘লাল পার্টি’কে যেভাবে বারবার অনাবৃত করা হয়েছে, সমাজের সামগ্রিক সংকট এবং বিশেষত গৈরিক বিপদের উন্মোচন সেভাবে করতে পারেনি এই নাটক। কাশিপুর-বরানগর, মানা ক্যাম্প থেকে মরিচঝাঁপি ইত্যাদি তো আসেইনি। সময়ের দলিল হিসেবে এটা একটা খামতি।
তবে বিচারকের কলম হাতে ললিতকলা দেখার পক্ষে নয়, সহজ হৃদয়ের চাহিদা নিয়ে যারা নাটক দেখলেন, তাঁরা কোথাও নিজের একটা জায়গা খুঁজে পেলেন বলেই মনে হয়। সরল, চেনা জীবনে অন্তরঙ্গ অনুভূতি নিয়ে যাচ্ছে এই নাটক। রাজনৈতিক দিশার অভাবে সে অনুভূতি হয়তো হারিয়ে য়ায়। কিন্তু যা কিছু রাজনীতি-উত্তর, যা কিছু লক্ষ বছর চালিয়ে নিয়ে চলেছে মানুষকে তার সংগ্রাম ও ভালোবাসার গানে, তার সঙ্গে এক পংক্তিতে জায়গা করে নেওয়ার নাটক ‘কেন পল্টু জোরে ছোটে’।
ছবি: বিদূষক নাট্যমণ্ডলীর সৌজন্যে