কেন লড়ছেন বন্ধ হয়ে যাওয়া ওয়েলিংটন চটকলের শ্রমিকরা? বিস্তারিত রিপোর্ট
নিজস্ব সংবাদদাতা: রিষড়ার ওয়েলিংটন চটকল দেশের প্রথম চটকল। গত ১৫ ডিসেম্বর , ভোর ৩:১৫ নাগাদ ডিউটিরত অবস্থায় ওয়েলিংটন জুটমিলেরই গেটের সামনে লড়ির ধাক্কায় মারা যান মিলের নিরাপত্তাকর্মী রামস্বরূপ রানা । কিন্তু মিলের ম্যানেজমেন্ট শ্রমিকদের অ্যাক্সিডেন্ট বেনেফিট সহ সবরকম দায় এড়াতে দাবি করে যে ওই মৃত নিরাপত্তাকর্মী সেই মুহূর্তে ‘অন ডিউটি’ ছিলেন না । এর ফলে শ্রমিকদের মধ্যে প্রবল অসন্তোষ দেখা দেয় এবং দীর্ঘদিন ধরে শ্রমিকদের বিভিন্ন ন্যায্য অধিকার থেকে বঞ্চিত রাখার ক্ষোভ ফেটে পরে গত সোমবার। তারা জুটমিল বন্ধ রেখে জিটি রোড অবরোধ করেন।কর্তৃপক্ষ শ্রমিকদের সাথে কোনোরকম আলোচনায় তো বসেই না বরং অনৈতিকভাবে এক ঘন্টার মধ্যেই ‘সাসপেনশন অফ ওয়ার্ক’ নোটিশ ঝুলিয়ে দেয় । এমনকি সুদূর চন্ডীগড় থেকে ছুটে আসা মৃত নিরাপত্তাকর্মীর পরিবারের সাথেও বসতে নারাজ মিলের ম্যানেজমেন্ট ।
প্রাথমিকভাবে এই সিকিউরিটির প্রতি বঞ্চনার বিরুদ্ধে শ্রমিকরা বিক্ষোভ দেখালেও, তাদের ক্ষোভের তালিকা দীর্ঘ। শ্রমিকদের কোয়ার্টার ভাড়া বাবদ ৫% কেটে নেয় ম্যানেজমেন্ট , অথছ মেরামতির অভাবে প্রায় ভঙ্গুর অবস্থা ঘরগুলির, এমনকি বৃষ্টি হলে চাল বেয়ে জল পরে অনেক ঘরেই । শৌচাগারের অবস্থা আরো শোচনীয় , দোতলা একটি দণ্ডায়মান কাঠামোর দ্বিতলে, তিন দিক তিন ফুটের পাঁচিল দিয়ে ঘেড়া কয়েকটি খোপের মধ্যেই, পুরুষ মহিলা নির্বিশেষে করতে হয় মলত্যাগ। খোলা দিকে কোনো দরজা তো দূর, নেই কোনো পর্দার ব্যবস্থায় এবং না আছে জল না আছে মগের ব্যবস্থা। ড্রেনগুলোতে নোংরা জলের সাথেই জমে আছে মল এবং কিছু কিছু জায়গায় উপছে পড়ছে। এরমই অস্বাস্থ্যকর পরিবেশে জীবন যাপন করতে হচ্ছে শ্রমিকদের।
লকডাউনের সময় কেন্দ্র এবং রাজ্য সরকার দ্বারা ঢাকঢোল পিটিয়ে স্বাস্থ্য বিধি মানার পরামর্শ দিয়ে একাধিক বিজ্ঞাপন দিলেও এই অস্বাস্থ্যকর পরিবেশের দিকে নজর দেয়নি তারাও । এমনকি মিলে ৫০০ টি মাস্ক এলেও তা দেওয়া হয়নি কোয়ার্টারে থাকা শ্রমিকদের । খুপচির মতো ঘরে পরিবার নিয়ে থাকা শ্রমিকদের মধ্যে শারীরিক দূরত্ব বজায় রাখা একটি পরিহাস ছাড়া আর কিছুই নয় ।
লকডাউনে কাজ বন্ধ থাকার জন্য কোনো টাকাই দেওয়া হয়নি শ্রমিকদের । সরকার নির্দেশিত লোনের ব্যবস্থাতো দূর , নিজেদের প্রভিডেন্ট ফান্ডের থেকেও লোন চাইলে ম্যানেজমেন্ট জানিয়েছে যে ১০,০০০ এর বেশি টাকা দেওয়া সম্ভব নয় ।
লকডাউনের আগে থেকেই, বহু বছর ধরে শ্রমিকদের মাইনে থেকে কাটা ইএসআই এর টাকা মেটাচ্ছে না ম্যানেজমেন্ট । ফলস্বরূপ শ্রমিকদের চিকিৎসার যে মৌলিক অধিকার , তা থেকেও বঞ্চিত হয় তারা এবং তাদের পরিবার ।
প্রভিডেন্ট ফান্ড , গ্ৰ্যাচুইটি ও পেনশনের টাকাও মেলে না নিয়ম মাফিক। অবসর নেওয়ার পর এই সমস্ত সুবিধা না পাওয়ায় বিক্ষুব্ধ অনেক শ্রমিকই , এমনকি তাদের দাবি অনেকেই তাদের নিজেদের অর্জিত এই অর্থও না পাওয়ায় , সুচিকিৎসার অভাবে মারা গেছে। শ্রমিকদের অভিযোগ পেনশনের কাগজপত্র ঠিকঠাক করতে এসে এই শীতেও বাইরে শুতে হয়েছে কিছু শ্রমিকের পরিবারের লোককে , কোনো কোয়ার্টার বা গোডাউন খুলে দেওয়া হয়নি তাদের ।
এই সমস্ত বঞ্চনার বিরুদ্ধে মুখ খুললেও সমস্যা , শ্রমিকরা জানায় যে ম্যানেজমেন্টকে তাদের ন্যায্য অধিকারের কথা বললেই ছাঁটাই এর ভয় দেখায় কর্তৃপক্ষ । তাদের এও অভিযোগ সরকারি অফিসার এসে , ম্যানেজমেন্টের ‘টাকা খেয়ে চলে যায়’, শোনে না শ্রমিকদের সমস্যার কথা ।
এই অবস্থাতেই , সমস্তরকম অধিকার থেকে বঞ্চিত হয়ে , অমানবিক ও অস্বাস্থ্যকর পরিবেশের মধ্যেই দিন কাটাতে বাধ্য হচ্ছেন এই দুনিয়াকে সাজিয়ে তোলা শ্রমিকরা।