Home কৃষি চলমান কৃষক সংগ্রাম কর্পোরেটের বিরুদ্ধে উদীয়মান স্বাধীন পুঁজির বিকাশের লড়াই
0

চলমান কৃষক সংগ্রাম কর্পোরেটের বিরুদ্ধে উদীয়মান স্বাধীন পুঁজির বিকাশের লড়াই

চলমান কৃষক সংগ্রাম কর্পোরেটের বিরুদ্ধে উদীয়মান স্বাধীন পুঁজির বিকাশের লড়াই
0
ধীমান বসাক

( নিবন্ধটি লেখক ফেসবুকে পোস্ট করেছিলেন। লেখাটি অত্যন্ত জরুরি মনে করে আমরা এটি প্রকাশ করলাম। ভবিষ্যতে এই বিষয়ে আরও বিস্তৃত নিবন্ধ আমরা লেখকের থেকে পাওয়ার আশা করছি।)

কৃষিতে কর্পোরেটের অনুপ্রবেশ মানে আরও পুঁজির অনুপ্রবেশ, তার সাধারণত ফলাফল হল কৃষিতে প্রাক-পুঁজিবাদী সম্পর্কগুলোর আরও ক্ষয়ে যাওয়া। দিল্লিতে কৃষক বিক্ষোভ কি তাহলে পুঁজির বিরুদ্ধে প্রাক-পুঁজিবাদী সম্পর্কগুলো টিঁকিয়ে রাখার লড়াই? ফড়ের বাঁধন মুক্ত করবে নয়া কৃষি আইন, এসব বলে বিজেপি সেরকম একটা ভাষ্য দেওয়ার চেষ্টা করছে বটে।

এখানে সিঙ্গুরে অনিচ্ছুক কৃষকরা যখন কৃষিজমি কেড়ে বড় কর্পোরেটের শিল্পস্থাপনের বিরুদ্ধে দাঁড়িয়েছিল, তখনও এরকম একটা যুক্তি এসেছিল যে কৃষির বদলে কর্পোরেট বা একচেটিয়া পুঁজি নির্ভর শিল্পায়ন, উন্নয়ন বা বেকার সমস্যা সমাধানের রাস্তা খুলবে।

দুটো মতের সাদৃশ্য, বহিরঙ্গে বা অন্তর্বস্তুতে, দেখার মতো।

কৃষকরা যা চাইছেন তা প্রাক-পুঁজিবাদী সম্পর্ক টিঁকিয়ে রাখা নয়, বরং নীচে থেকে এক স্বাধীন স্বনির্ভর পুঁজির বিকাশ। ওপর থেকে চাপিয়ে দেওয়া যে পুঁজির বিকাশ তার সাথে এর বিরোধ আছে। ওপর থেকে চাপানো পুঁজির অনুপ্রবেশ, আন্তর্জাতিক পুঁজি ও তার বাজারের সাথে যুক্ত করতে চায় ভারতীয় কৃষিকে। এই পুঁজি স্থানীয় বা দেশীয় বা স্বাধীন বা নীচ থেকে বিকশিত পুঁজির বিকাশের বিরোধী। কৃষকেরা প্রাক-পুঁজিবাদী সম্পর্ক ভেঙে এগোতে চান কিন্তু বৃহৎ, একচেটিয়া, আন্তর্জাতিক পুঁজির সাথে সংযুক্ত পুঁজির অধীনে নয়, নিজস্ব কব্জির জোরে, বাজার-দাম-উপকরণের ওপর নিজের নিয়ন্ত্রণ হারিয়ে ফেলে নয়, সেগুলো ঠিক করতে রাষ্ট্রকে সাহায্য করতে বাধ্য করার মধ্যে দিয়ে। এই কৃষক বিক্ষোভের লক্ষ্যবস্তু সামন্তবাদ বা প্রাক-পুঁজিবাদী সম্পর্ক নয় বটে, কিন্তু কৃষি যে এখনও প্রাক-পুজিবাদী সম্পর্ক থেকে মূলত মুক্ত হতে পারেনি, এই লড়াইয়ের চরিত্র সেকথাই ইঙ্গিত করছে। না হলে, কৃষিতে স্বাধীন পুঁজির বিকাশ ঘটে থাকলে, কর্পোরেটের আধিপত্যের প্রশ্নটাই এভাবে হাজির হ’ত না।

সবুজ বিপ্লব চাষিকে তার নিজস্ব বীজ, নিজস্ব সার, নিজস্ব টেকনিক হারিয়ে ক্রমশ বেশি বেশি করে এগুলোর জন্য কর্পোরেটের ওপর, শিল্পজাত পণ্যের ওপর, সংকর বীজ, কৃত্রিম সার, কীটনাশক, যন্ত্রের ওপর নির্ভরশীল করে তুলেছে। প্রথমে উৎপাদন বাড়লেও ক্রমশ তা কমে এসেছে, শিল্পজাত উপকরণ বা ইনপুটের দাম বেড়েছে, কিন্তু কৃষিজাত পণ্যের দাম কমেছে। গ্রাফ আঁকলে তা একটা কাঁচির মতো, প্রাইস সিজর। ভারতের মতো দেশে, কৃষিতে প্রাক-পুঁজিবাদী সম্পর্ক কিছুটাও টিঁকিয়ে রাখতে পারলে সস্তা শ্রমের কারণে কৃষিজাত পণ্যের মূল্য কমিয়ে রাখা সহজ হয়, আর তার ফলে শিল্পজাত পণ্যের উৎপাদক একচেটিয়ারা কৃষি ইনপুটের দাম বাড়িয়ে এবং শ্রমিকদের সস্তা মজুরি দিয়ে অতি-মুনাফা কামাতে পারে।

কৃষির সাথে শিল্পের এই বিরোধাভাসের কারণ – প্রথমত এদেশে কৃষিতে ভেতর থেকে পুঁজিবাদের বিকাশ হতে চাইলেও আন্তর্জাতিক পুঁজিনির্ভর একচেটিয়া পুঁজির যে কব্জা রাষ্ট্র ও বাজারের ওপর রয়েছে তার জন্য, অন্যদিকে প্রাক-পুঁজিবাদী সম্পর্ক (জাতপাত সহ) টিঁকে থাকার জন্য তা এগোতে পারছে না।

শিল্পের ওপর এই কব্জা ভাঙতে পারে শ্রমিকশ্রেণি, আর কৃষিতে চাষির আয়ত্তাধীন প্রযুক্তির বিকাশ শ্রমিকস্বার্থের বিপরীত নয়, বরঞ্চ সহায়ক। তাই শ্রমিক ও কৃষক ভারতে স্বাভাবিক বন্ধু শক্তি। নিশ্চয়ই চাষিদের মধ্যে স্তরবিভাজন রয়েছে। বিপুল সংখ্যক ক্ষেতমজুর ও গরিব চাষি, যারা মূলত জনজাতি-দলিত-ধর্মীয় সংখ্যালঘুর দলিত অংশ থেকে এসেছেন, তাদের জমির দাবি, ন্যায্য মজুরির দাবি আরও বেশি গণতান্ত্রিক দাবি, এরা শ্রমিকশ্রেণির সবচেয়ে নির্ভরযোগ্য মিত্র। এবং কৃষকদেরও একথা বুঝে নেওয়া দরকার যে শিল্পের ওপর দেশি-বিদেশি কর্পোরেটের নিয়ন্ত্রণ, রাষ্ট্রের ওপর তাদের নিয়ন্ত্রণ ভাঙতে না পারলে, কৃষকদের সংগ্রাম তার কাঙ্ক্ষিত লক্ষে পৌঁছতে পারবে না।

কৃষিতে প্রাক-পুঁজিবাদী সম্পর্কের (জাতপাত সহ) অবসান ও দেশিবিদেশি একচেটিয়া পুঁজির হাত থেকে শিল্প ও বাজারের নিয়ন্ত্রণের অবসান দরকার। এটাই এক প্রকৃত গণতান্ত্রিক ও স্বাধীন ভারত গড়ে তোলার পথ।

Share Now:

LEAVE YOUR COMMENT

Your email address will not be published. Required fields are marked *