Home অর্থনীতি এ বছর আলুর অতিরিক্ত দাম বাড়ার পেছনে কী ছিল রহস্য?

এ বছর আলুর অতিরিক্ত দাম বাড়ার পেছনে কী ছিল রহস্য?

এ বছর আলুর অতিরিক্ত দাম বাড়ার পেছনে কী ছিল রহস্য?
0

দেবাঞ্জন রায় ও সৌম্যদীপ দত্ত (দুই লেখক বিধানচন্দ্র কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়ের কৃষি বিজ্ঞানের ছাত্র)

রাজ্যে বিধানসভা ভোটের দামামা বেজে গেছে। তাল ঠুকছে শাসক- বিরোধী দুপক্ষই। ইতিমধ্যে একাধিক প্রশাসনিক সভায় আলু-পেয়াঁজের অত্যধিক বাজার দরের জন্য কেন্দ্রের মোদি-শাহ সরকারকে দায়ী করেছেন মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দোপাধ্যায়। পাল্টা বিজেপির রাজ্য সভাপতির দাবি তৃণমূলের কাটমানি খাওয়াই আলুর দাম বৃদ্ধির কারণ। মূল্যবৃদ্ধি ভারতবর্ষে ভোটের জ্বলন্ত ইস্যু হয়ে থেকেছে বরাবরই। ১৯৮০-র লোকসভা নির্বাচনে জনতা দলের সরকারকে হারানোর জন্য ইন্দিরা গান্ধির হাতিয়ার ছিল পেঁয়াজের মূল্যবৃদ্ধি, ১৯৯৮-এর দিল্লি বিধানসভা নির্বাচনেও বিজেপির পরাজয়ের পিছনে ছিল এই মূল্যবৃদ্ধি। হালের বিহার বিধানসভা ভোটেও মূল্যবৃদ্ধির ঝাঁঝ ভালো মতোই টের পেতে হয়েছে শাসক দল জেডিইউ-কে। এখন দেখার বাংলার ভোট ভাগ্য কি এবার নিয়ন্ত্রণ করবে আলু ?

পারিবারিক রোজগার যেমনই হোক বাঙালি হেঁসেল আলু ছাড়া অচল। কখনও ইলিশ, কখনও পেঁয়াজ কিংবা লঙ্কার অতিরিক্ত দামে ছেঁকা খেতে অভ্যস্ত বাঙালি বাজার থেকে ব্যাগ ভরে আলুটা অন্তত আনতে পারত এতদিন। কিন্তু সেই আলুই এবার পুজোর মরসুমে বিকিয়েছে প্রায় ৫০ টাকা কেজি দরে। গত ১২০ মাসের গড় দামের তুলনায় এবার আলুর দাম বেড়েছে প্রায় ৯২ শতাংশ। কিন্তু কারণটা কী? সবজির দাম বাড়লেই ব্যবসাদার থেকে সরকারি আধিকারিক সবার মুখে একটা কথা খুব শোনা যায় – চাহিদার তুলনায় জোগান কম। এবারও এ রাজ্যের কৃষিকর্তারা দাবি করছেন যে গতবছর অক্টোবর মাসের শেষের দিকে অসময়ের বৃষ্টির জন্য আলু লাগাতে দেরি হওয়ায় এবছর ফলন কম হয়েছে। আলুর ক্ষেত্রে এ যুক্তি কতখানি খাটে দেখে নেওয়া যাক । পশ্চিমবঙ্গ ভারতের  দ্বিতীয় বৃহত্তম আলু উৎপাদক রাজ্য, বার্ষিক উৎপাদন কমবেশি প্রায় ১০০ লক্ষ টন। এ রাজ্যে মাসে আলুর চাহিদা ৫লক্ষ টন, অন্য রাজ্যে রফতানির চাহিদা ধরলে ৬ লক্ষ টন। তাই বৃষ্টির জন্য ১০ -১৫ শতাংশ ফলন কম হলেও জোগান কম হওয়ার কথা নয়।

এবার আসা যাক সংশোধিত অত্যাবশ্যকীয় পণ্য আইনের দিকে। মুখ্যমন্ত্রী মমতা ব্যানার্জি সহ রাজ্যের অন্যান্য মন্ত্রী- আধিকারিকরা দাবি করছেন যে কেন্দ্র সংশোধিত অত্যাবশ্যকীয় পণ্য আইন লাগু করার পর থেকেই রাজ্যের হাতে আর কোনো ক্ষমতা নেই আলুর মজুতদারি রুখে দেওয়ার। একথা সত্যি যে  নরেন্দ্র মোদির সরকার অত্যাবশ্যকীয় পণ্য তালিকা থেকে আলু, পেঁয়াজের মতো নি্ত্য প্রয়োজনীয় সামগ্রীকে বাদ দিয়ে বেআইনি মজুতদারিকে আইনি শিলমোহর দিয়েছে। কিন্তু কিছুই কি করার ছিল না মমতা বন্দোপাধ্যায়ের প্রশাসনের? প্রসঙ্গত জানিয়ে রাখি গত এক দশকে রাজ্য সরকার অত্যাবশ্যকীয় পণ্য আইন লাগু করেছে মাত্র দুবার, ২০১৪-১৫ সালে ডালের জন্য আর গতবছর পেঁয়াজের দাম নিয়ন্ত্রণে। অথচ এই বছরের মতো অতিমাত্রায় না হলেও ফি বছরই অন্তত পুজোর সময় আলুর দাম চড়তে দেখি আমরা। আর আমাদের রাজ্য সরকার টাস্ক ফোর্স গঠন করে কিছু মাত্রায় দাম কমিয়ে ফেলে অত্যাবশ্যকীয় পণ্য আইন লাগু না করেই। তাহলে বোঝাই যাচ্ছে সংশোধিত অত্যাবশ্যকীয় পণ্য আইনই আলুর লাগাম ছাড়া দামের একমাত্র কারণ নয়।

এরাজ্যে মাঠ থেকে খুচরো বাজার (যেখানে আপনি আমি আলু কিনি) পর্যন্ত আলুর যাত্রাপথটা একটু দেখে নিই আমরা। এ রাজ্যে আলু লাগানো শুরু হয় মূলত অক্টোবর মাসের শেষ সপ্তাহে, চলে ডিসেম্বর মাসের মাঝামাঝি অবধি। নতুন আলু উঠতে শুরু করে ডিসেম্বরের শেষ সপ্তাহ থেকে। পুরো আলু উঠতে সময় লাগে প্রায় মার্চ মাস পর্যন্ত। এই সময়ই পঞ্জাব, উত্তরপ্রদেশ থেকেও নতুন আলু ঢুকতে শুরু করে বঙ্গে। স্বভাবতই বছরের শুরুর দিকে আলুর দাম কমই থাকে। আমাদের রাজ্যের বেশির ভাগই ক্ষুদ্র ও মাঝারি চাষি হওয়ায় আলু ওঠার পরপরই টাকার অভাবে তাঁরা তা জলের দরে বিক্রি করে দেন এক শ্রেণির মধ্যস্বত্বভোগীর কাছে, যারা বাজারচলতি ভাষায় ‘ফোড়ে’ নামে  পরিচিত।  মার্চের শেষের দিক থেকে এপ্রিল মাসের মধ্যে সব আলু চাষিদের থেকে কিনে এই ফোড়ে এবং একদল হিমঘর মালিক হিমঘরে ঢোকান। এই বছর চাষিরা আলু বিক্রি করেছেন কেজি প্রতি ১১-১২টাকা দরে (৫০ কেজি প্যাকেট ৫০০- ৫৫০ টাকা দামে, বাজারদর যতই বাড়ুক চাষির হাতে তা পৌঁছয় না)। এই মুহুর্তে রাজ্যে ৪৬১টি সরকার অনুমোদিত হিমঘর আছে। কিন্তু এর বেশির ভাগেই আলু মজুত করেন এই ফোড়ে এবং হিমঘর মালিকেরা, আমাদের রাজ্যের বেশিরভাগ চাষিদের সেই আর্থিক সামর্থ্যই নেই যে তারা বেশি লাভের জন্য আলু হিমঘরে মজুত রেখে সরাসরি বাজারে ছাড়বেন। (ঠিক এই কারণেই নয়া কৃষিবিলের বিরুদ্ধে পাঞ্জাবের কৃষকরা যেখানে মরণপণ আন্দোলন করছেন, এ রাজ্যের চাষিদের কিছু এসে যায় না)। এরপর হিমঘরে মজুত সেই আলু সারা বছর ধরে এই রাজ্য এবং আশেপাশের রাজ্যের আলুর চাহিদা মেটায়। তাই আলুর দামের নিয়ন্ত্রণ সারা বছর থাকে কার্যত এই ফোরে আর হিমঘর মালিকদের হাতেই। হিমঘর থেকে আলু বের করার পর তা পরিবহণ খরচ সমেত এ বছর পাইকারি বাজারে বিক্রি হয়েছে ২৪-২৬ টাকা দরে। পাইকারি বাজার থেকে খুচরো বিক্রেতা এই আলু কিনছেন ২৬ -২৮ টাকা কেজি প্রতি দরে। এরপর খুচরো বাজারে গিয়ে এই দামটাই হয়ে যাচ্ছে প্রায় ১০ টাকা বেশি হয়ে ৩৮ -৪০ টাকা। নভেম্বরের মাঝামাঝি যা ছুঁয়েছিল ৫০ টাকা অবধি। অথচ খুচরো বাজারে অন্যবার দাম বাড়ে ৪-৫ টাকা। সেপ্টেম্বর মাসের ৫ তারিখের এক পরিসংখ্যান জানাচ্ছে যে সেই সময় হিমঘরে মজুত আলুর পরিমাণ ২৮ – ২৯ লক্ষ মেট্রিক টন। বোঝাই যাচ্ছে হিমঘরে যোগানে কোনো ঘাটতি নেই। এখান থেকে একটা জিনিস স্পষ্ট যে একটা কৃত্রিম সংকট তৈরি করে খুচরো বাজারে অস্বাভাবিক দাম বাড়ানো হচ্ছে। এর পিছনে কাজ করে ফোড়ে – হিমঘর মালিক- আড়তদারদের এক অসাধু চক্র। অথচ রাজ্য সরকারের টাস্কফোর্স কিনা খুচরো বাজারে বাজারে ঘুরে ঘুরে বেআইনি মজুত খুঁজে বেড়াচ্ছে, টিভি ক্যামেরায় সে ছবি উঠছে, সরকারি কৃষি আধিকারিকরা পাইকারি এবং খুচরো বাজারিদের দাম কমানোর জন্য হুঁশিয়ারি দিচ্ছেন, ফলাও করে খবর হচ্ছে দাম কমাতে তৎপর সরকার, কিন্তু দাম আর কমছে না! ফোড়ে – হিমঘর মালিকদের আড়াল করে সরকারের এই ছদ্ম তৎপরতা যেন বজ্র আঁটুনি ফস্কা গেরো।

ঠিক কী পরিমাণ মুনাফা লুটছে এই অসাধু চক্র? একটা রাফ হিসাব করা যাক-

আগেই বলেছি চাষি আলু বেচছেন কেজি প্রতি ১১ – ১২ টাকা দরে।(হিসাবের সুবিধায় ধরে নিলাম ১২ টাকা) এর ওপর হিমঘরে আলু রাখার খরচ কেজি প্রতি ১.৬ টাকা, ব্যাগ খরচ ০.২০ টাকা, ঝাড়াই বাছাই করে ট্রাকে তোলার জন্য মজুর খরচ ০.৫০ টাকা, পরিবহণ খরচ ০.৭০ টাকা, পুরোনো আলুর ওজন হ্রাসের জন্য ১ টাকা। সব মিলিয়ে হয় কেজি প্রতি ১৬ টাকা। এবছর কেজি প্রতি ২৪ -২৬ টাকা দরে আলু হিমঘর থেকে বেরিয়েছে। তাহলে এক ট্রাকে(১০০ কুইন্টাল) লাভ ৮০ হাজার থেকে ১লক্ষ টাকা! এই রাজ্যের হিমঘরের মোট ধারণ ক্ষমতা ৭১ লক্ষ টন, তার ৫০ শতাংশও এই পথে বাজারে হাজির হলে মোট লাভের অঙ্কটা হিসাব করে নিন।

এই প্রতিবেদন লেখার সময় আলুর বাজারদর অনেকটাই নেমে এসে খুচরো বাজারে কেজি প্রতি ৩০ টাকার আশেপাশে ঘোরাফেরা করছে। রাজ্য সরকার নির্দেশ জারি করেছিল ৩০ নভেম্বরের মধ্যে সমস্ত হিমঘর খালি করে দিতে হবে। সেই নির্দেশ পুরোপুরি কার্যকর না হলেও বাজারে প্রচুর যোগান চলে আসায় আলুর দর স্বাভাবিক নিয়মেই অনেকটা নেমেছে। যদিও ততদিনে ‘মৌমাছি মধু খেয়ে ফেলেছে’। আসলে আমাদের দেশে প্রকৃত বাজার দর কোনো আইন নিয়ন্ত্রণ করে না, করে রাজনৈতিক ক্ষমতা। পশ্চিমবাংলায় এই ফোড়ে- আড়তদার – হিমঘর মালিকরা ‘ঐতিহাসিক’ ভাবে শাসক দলের সঙ্গে যুক্ত, কেউ কেউ আবার নেতাও। এদের স্নেহধন্যরাই কৃষি, কৃষি বিপণন দফতরের উচ্চপদে আসীন। শাসক দলের ‘শামিয়ানা’কে ব্যবহার করেই এই রাজ্যে চলে  হিমঘরে আলুর বন্ড কেনার ‘ফাটকা’ বিনিয়োগ; আইনকে ফাঁকি দিতে চাষিদের নামে বন্ড কেনা কিংবা কম ফলনের বছরে ব্ল্যাকে বণ্ড বিক্রি। প্রতিবছরই তাই বর্ষার সময় যখন প্রাকৃতিক নিয়মেই অন্যান্য শাক সবজির জোগান কমে যায় তখন সেই সুযোগে মজুতদাররা আলুর দাম হুট করে বাড়িয়ে দেয়। এরপর পুজোর মরসুমে তা আকাশ ছুঁয়ে ফেলে। নতুন আলু না ওঠা পর্যন্ত এই খেলা চলতেই থাকে। সরকার টাস্কফোর্স গঠনের নামে ‘গ্যালারি শো’-এর আড়ালে আসলে এই মজুতদারদের সাথে আপস মীমাংসার মাধ্যমে মাঝামাঝি একটা দাম ঠিক করে। ২০১৯ লোকসভা ভোট পরবর্তী পরিবর্তিত রাজনৈতিক পরিস্থিতিতে রাজ্যে শাসক তৃণমূলের আসন টলমল, তার ওপর ৬ মাসের মধ্যে বিধানসভা নির্বাচন। এই অবস্থায় ব্যবসাদারদের ওপর চাপ তৈরিতে দ্বিধা করবে সরকার, সেটাই স্বাভাবিক। অপর দিকে দ্রুত রাজনৈতিক জমি হারাতে থাকা শাসক শিবিরকে অগ্রাহ্য করে সদা সুযোগসন্ধানী এই ব্যবসায়ীদের মুনাফা লুটে নেওয়ার ধান্দাই হয়তো এ বছর আলুর দামের হাফ সেঞ্চুরি ছুঁয়ে ফেলার কারণ। তাই বোধহয় মুখ্যমন্ত্রীর ৩০ টাকার মধ্যে আলুর দাম বেঁধে দেওয়ার কড়া হুঁশিয়ারীর পরেও দাম আরও বাড়তেই থাকে। শেষমেশ সরকারি দোকানেও প্রকৃত পক্ষে ২২ টাকার আলুর দাম কেজি প্রতি ২৬ টাকা বেঁধে দিয়ে দিদি আসলে ফোড়েরাজকেই আইনি স্বীকৃতি দিয়ে দিলেন।

তথ্যসূত্র-

১.আনন্দবাজার পত্রিকা, (৫ ই সেপ্টেম্বর,২০২০ সংখ্যা )

২. আনন্দবাজার পত্রিকা, সম্পাদকীয়(কৃষি আইন ও তার প্রতিবাদ, স্বাতী ভট্টাচার্য ২ নভেম্বর, ২০২০)

৩. আনন্দবাজার পত্রিকা ,সম্পাদক সমীপেষু (১১ সেপ্টেম্বর, ২০২০)

৪. The Telegraph, 21 January, 2020

৫. The Hindu Business line, 21 January, 2020

Share Now:

LEAVE YOUR COMMENT

Your email address will not be published. Required fields are marked *