Home ফিরে দেখা রাজা বিশ্বাস (২৮ ডিসেম্বর ১৯৭৫- ৩০ নভেম্বর ২০২০)

রাজা বিশ্বাস (২৮ ডিসেম্বর ১৯৭৫- ৩০ নভেম্বর ২০২০)

রাজা বিশ্বাস (২৮ ডিসেম্বর ১৯৭৫- ৩০ নভেম্বর ২০২০)
0

রাজার ফেসবুকের বায়োতে লেখা আছে ‘আমি তোমার মতো’। নয়া উদারনৈতিক ব্যক্তি স্বাতন্ত্র্যবাদী ‘আমি আমার মতো’ সংস্কৃতির বিরুদ্ধে নিজের দৃঢ় অবস্থানটি ওখানেই স্পষ্ট করে দিয়েছিল রাজা। ৪৫ বছরের সংক্ষিপ্ত জীবনে নানা ওঠাপড়া থেকেছে স্বাভাবিক ভাবেই। কিন্তু সমাজের প্রতি, জীবন সংগ্রামে জেরবার সাধারণ মানুষের প্রতি দৃষ্টিভঙ্গি ও সক্রিয়তায় কোনো ছেদ পড়েনি রাজার। পরিচিত মহলের সমস্যায় পাশে দাঁড়ানোর অভ্যাসের কথা বাদই দেওয়া গেল না হয়।

পূর্ব কলকাতার কাঁকুড়গাছি অঞ্চলের নিম্ন মধ্যবিত্ত পরিবারের ছেলে রাজার বাবা সরোজ বিশ্বাস ছিলেন সুপরিচিত ফরওয়ার্ড ব্লক নেতা। টাকি হাউজ স্কুলে পড়াশোনা শেষের পর গত শতকের নয়ের  দশকের মাঝামাঝি সময় বেলেঘাটার গুরুদাস কলেজে পড়তে শুরু করে রাজা। সে সময়ই নকশালপন্থী ছাত্র সংগঠন আরএসএ-র সদস্য হয়। কলেজের বিভিন্ন আন্দোলনে অংশ নেয়, জঙ্গি ভূমিকা পালন করে। ক্ষমতাসীন ছাত্র সংগঠনের সঙ্গে সংঘর্ষেও জড়ায়। এ সময় থেকে ধীরে ধীরে বেলেঘাটা-কাঁকুড়গাছি অঞ্চলে অন্যান্য রাজনৈতিক কর্মকাণ্ডেও সক্রিয় হয়ে পড়ে সে। ওই অঞ্চলের অকালপ্রয়াত বিপ্লবী রাজনৈতিক কর্মী কাকলির স্মৃতিতে নয়ের দশকের শেষের দিকে তৈরি হয়েছিল ‘কাকলি লাইব্রেরি’। সেই লাইব্রেরি গড়ে তোলা ও পরিচালনার মূল কাজগুলি রাজাই করতো।

এরপর কিছুদিন মূদ্রণ ব্যবসায় যুক্ত হয় রাজা। তারপর শুরু হয় চাকরি জীবন। পরবর্তী দেড় দশকে আকাশ বাংলা, এনই বাংলা, আর প্লাস, একদিন দৈনিক পত্রিকায় চাকরি করেছে রাজা। এছাড়াও নিয়মিত কাজ করেছে বিনোদন ইন্ডাস্ট্রি, ফুটবল ম্যাচের সরাসরি সম্প্রচারের প্রোডাকশনে। কিছুদিন বাংলা বইয়ের একটি ই-কমার্স পোর্টাল গড়ে তোলার কাজে পেশাদার হিসেবে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেছে। এমনকি নিজে স্নাতক না হয়েও একটি কলেজে অডিও-ভস্যুয়াল প্রোডাকশন বিষয়ে অতিথি অধ্যাপকের কাজও করেছে কিছুদিন। কয়েক বছর আগে কয়েক জন বন্ধু মিলে একটি অডিও ভিস্যুয়াল প্রোডাকশন হাউজ তৈরি করেছিল রাজা। তারপর নতুন কোনো পেশায় যায়নি।

পুরনো কথায় ফেরা যাক। চাকরি জীবনে ঢোকার পর রাজনৈতিক কাজকর্মে কিছুটা বিরতি আসে। যা নতুন করে শুরু হয় সিঙ্গুর-নন্দীগ্রাম আন্দোলনের সময়। না ওই আন্দোলনগুলিতে যুক্ত হয়নি রাজা। তাঁর সক্রিয়তা দেখা যায় নিজের পেশা অর্থাৎ সাংবাদিকতায়। কলকাতার বিভিন্ন সংবাদ মাধ্যমে সাংবাদিকদের অনিয়মিত বেতন, চাকরির অনিশ্চয়তা, কাজের খারাপ পরিবেশ, পরিচালনায় অপেশাদারিত্ব একটি স্বাভাবিক ঘটনা। এ সবের প্রতিবাদ করতে সাংবাদিকদের সংগঠিত করার জন্য কয়েকজন বন্ধু সাংবাদিকের সঙ্গে ‘মিডিয়া পারসনস অ্যাসোসিয়েশন’  নামে একটি সংগঠন তৈরি করে রাজা। সেই সংগঠন ১০০-র বেশি সংবাদকর্মীকে নিয়ে শিয়ালদার জর্জ ভবনে কনভেনশন করে। বিভিন্ন বিষয়ে বিবৃতি দেয় এমনকি একটি সংস্থার কর্মীদের বেতন অনিয়মিত হয়ে যাওয়ায় পোস্টারিং-ও করে। যদিও সাংবাদিকদের শ্রেণিচরিত্র ও পেশাগত দুর্বলতার জন্য তা টিকিয়ে রাখা যায়নি। এর কিছুদিন পর এ রাজ্যের হরিপুরে প্রস্তাবিত পারমাণবিক বিদ্যুৎ কেন্দ্র নিয়ে একটি তথ্যচিত্র বানায় রাজা। যদিও সেটি তৈরি হওয়ার কিছুদিনের মধ্যেই প্রকল্পটি বাতিল হয়ে যাওয়ায় সেটির ব্যপক প্রচার করা সম্ভব হয়নি।

রাজার সৃষ্টিশীলতার হাতেখড়ি কলেজ জীবনে। সে সময় সুকুমার রায়ের ‘রাজার অসুখ’ কাহিনি নিয়ে একটি নাটক লিখেছিল সে। যা বেলেঘাটা অঞ্চলে কয়েকটি অভিনয়ও হয়েছিল। ওই নাটকের হাত ধরে এলাকার কয়েকজন কিশোর গণসাংস্কৃতিক কর্মকাণ্ডের সঙ্গে যুক্ত হয়ে পড়ে। যাদের কেউ কেউ অভিনয়কে পরবর্তী কালে পেশা হিসেবে গ্রহণ করেছে। চলতি শতকের শুরুতে বেলেঘাটা অঞ্চলে তৈরি হয় ‘পূর্ব কলকাতা বিদূষক নাট্যমণ্ডলী’। প্রথম থেকে এই সংগঠনের সঙ্গে রাজা আলগা ভাবে জড়িয়ে থাকলেও সক্রিয়তা বাড়ায় ২০১১-১২ নাগাদ সংগঠনটি পুনরুজ্জীবিত হওয়ার পর। তারপর রাজা ওই সংগঠনের জন্য বেশ কয়েকটি নাটক রূপান্তর করেছে ও নতুন নাটক লিখেছে। তার মধ্যে আছে ব্রেখটের নাটকের অনুসরণে ‘খড়ির গণ্ডি’, ইরানি গল্প অবলম্বনে ‘কালো মাছের গল্প’, এছাড়া হ্যাপি প্রিন্স, রবীন্দ্রনাথের শাস্তি গল্প নিয়ে নাটক, একক মেয়ের সংগ্রামের গল্প নিয়ে ‘সাজঘর'(অভিনয় হয়নি)। এছাড়া স্কুলের বাচ্চাদের দিয়ে অভিনয় করানোর জন্য ‘রাধারানি’ ও হিন্দি নাটক ‘ভূত কা জনম’। এগুলি লেখার পেছনে মূল উদ্দেশ্য ছিল শ্রমজীবী শিশু-কিশোরদের মধ্যে সংস্কৃতি চর্চার প্রসার ঘটানো। ধাপা অঞ্চলের বস্তিবাসীদের নিয়ে এই নাটকগুলির অভিনয় হয়েছে। বিদূষকের জন্য রাজার লেখা শেষ নাটক ‘কেন পল্টু জোরে ছোটে’।

এ সবের পাশাপাশি বন্যাত্রাণ ইত্যাদির মতো সামাজিক কাজকর্ম রাজা চালিয়েই গিয়েছে। এর মধ্যে দিয়েই দু-এক বছর আগে তৈরি হয় ‘বন্যাত্রাণে নাট্যবন্ধুরা’  সংগঠন(এই কদিন আগেও লকডাউনে বিভিন্ন এলাকায় বন্ধুদের সঙ্গে ত্রাণ দেওয়ার উদ্যোগ নিয়েছে রাজা, উমপুনের পর দুবার ত্রাণ দিতে সুন্দরবন গিয়েছে)। ফ্যাসিবাদী বিজেপি এনআরসি, সিএএ, এনপিআরের পরিকল্পনা নামানোর পর মূলত তার প্রতিবাদের লক্ষ্যে ওই সংগঠন থেকে গড়ে ওঠে ফ্যাসিবাদ বিরোধী গণসাংস্কৃতিক সংগঠন ‘জনগণমন’। যার প্রধান দায়িত্বে ছিল রাজা। ২০১৯-এর নভেম্বর থেকে পথ চলা শুরু করে কয়েক মাসের মধ্যেই এ রাজ্যের এনআরসি বিরোধী আন্দোলনের প্রায় সাংস্কৃতিক মুখ হয়ে ওঠে ‘জনগণমন’। তৈরি হয় অজস্র গান। যা ছাত্র-যুবদের মুখে মুখে ছড়িয়ে পড়েছিল। শহরের প্রায় সব এনআরসি বিরোধী কর্মসূচিতে ‘জনগণমন’-র গান বাজানো প্রায় বাধ্যতামূলক হয়ে গিয়েছিল। ছড়িয়ে পড়েছিল বিভিন্ন জেলাতেও। এগুলির অধিকাংশের রচয়িতা রাজা বিশ্বাস। শুধুমাত্র এনআরসি-র মধ্যে আটকে না থেকে আম জনতার জীবনের রোজকার সমস্যাকে কেন্দ্র করে সৃজনশীলতাকে এগিয়ে নিয়ে যাওয়ার পরিকল্পনা করেছিল ‘জনগণমন’। সেই মতো রাজা লেখে নতুন পথনাটক ‘ইঁদুরকল’। আনলক শুরু হওয়ার পর গত কয়েক মাসে এই নাটকটি অভূতপূর্ব জনপ্রিয়তা পায়। ইতিমধ্যেই শহর-গ্রামে এর ৩০টির বেশি শো হয়ে গিয়েছে।

২০১৮ সালের শুরুতে বড়ো মাপের হৃদযন্ত্রের সমস্যায় রাজার বাইপাস অস্ত্রোপচার করতে হয়। কিছুটা সুস্থ হওয়ার পর থেকেই সে গণ সাংস্কৃতিক কাজকর্মে মনপ্রাণ ঢেলে দিয়েছিল। ২০২০ সালের বইমেলায় পুলিশি নিপীড়নের প্রতিবাদ করতে গিয়ে পুলিশের অত্যাচারে কিছুক্ষণের জন্য জ্ঞানও হারায়। রাজা শুধু একজন সৃষ্টিশীল গণ সাংস্কৃতিক কর্মী ছিল না। সে একই সঙ্গে ছিল একজন দক্ষ সংগঠকও। তরুণ প্রজন্মের মধ্যে অসম্ভব জনপ্রিয়তা ছিল তাঁর। তাঁর শেষযাত্রার মিছিলই তার প্রমাণ। এই ধরনের যুগলবন্দি যে কোনো ধারার রাজনীতিতে, সর্বকালেই বিরল। সাংস্কৃতিক কর্মকাণ্ডে আরও বেশি করে মনোনিবেশ করার জন্য বছর খানেক আগে নিজের  বাণিজ্যিক সংস্থার অংশীদারত্ব ছেড়ে দেয় রাজা। শ্রমজীবী জনগণের জন্য, তাদের নিয়ে সাংস্কৃতিক কাজে আরও বেশি করে সময় দেওয়ার প্রস্তুতিও তাঁর সারা হয়ে গিয়েছিল। সেই প্রস্তুতির সুফল জনগণ পেলেন না। কিন্তু মনে রাখতে হবে, রাজা বিশ্বাসকে তৈরি করেছিল এই শোষণমূলক ব্যবস্থা ও তা পরিবর্তনের জন্য মেহনতি মানুষের সংগ্রামের ধারাবাহিকতা। যতদিন এই ব্যবস্থা ও ব্যবস্থা বদলানোর লড়াই থাকবে, ততদিন জনগণের মধ্যে থেকেই আরও রাজা বিশ্বাস তৈরি হবে। রাজার জীবন ও সৃষ্টি তাতে প্রেরণা জোগাবে।

Share Now:

LEAVE YOUR COMMENT

Your email address will not be published. Required fields are marked *