Home জনস্বাস্থ্য পুঁজিবাদী প্রতিযোগিতা করোনার ভ্যাকসিন তৈরির পথে বাধা হয়ে দাঁড়াচ্ছে

পুঁজিবাদী প্রতিযোগিতা করোনার ভ্যাকসিন তৈরির পথে বাধা হয়ে দাঁড়াচ্ছে

পুঁজিবাদী প্রতিযোগিতা করোনার ভ্যাকসিন তৈরির পথে বাধা হয়ে দাঁড়াচ্ছে
0

পিপলস ম্যাগাজিন ডেস্ক: কোভিড -১৯ ভাইরাসের বিরুদ্ধে বিশ্বজুড়ে ২০০ টিরও বেশি ভ্যাকসিন তৈরি করা হচ্ছে। তার মধ্যে বারোটি গবেষণার তৃতীয় ধাপে রয়েছে,  সেগুলি মানুষের ওপর পরীক্ষা করা হয়েছে এবং ছয়টি ইতিমধ্যে প্রাথমিক বা সীমিত ব্যবহারের জন্য অনুমোদিত হয়েছে।

মানুষ এই ভ্যাকসিনগুলির তৈরির নিয়মিত খবর রেখে চলেছে এই আশায় যে সেটি মহামারিকে শেষ করবে। পুঁজিবাদী সরকারগুলি ভ্যাকসিন তৈরি করতে মরিয়া কারণ যত দ্রুত ভ্যাকসিন প্রস্তুত হবে তত দ্রুত পুঁজিবাদের অধীনে শোষণ ব্যবস্থা পুনরুজ্জীবিত হতে পারবে।

সহযোগিতার মাধ্যমে বিশ্বব্যাপী সমাধানের পরিবর্তে ‘আমেরিকা ফার্স্ট’ প্রচারের মাধ্যমে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র নিজেদের প্রথম ভ্যাকসিন পাওয়ার অধিকার জাহির করার চেষ্টা করে চলেছে এবং অন্য দেশগুলি  ভ্যাকসিন এবং সেটির সংরক্ষণের প্রয়োজনীয় সরঞ্জামগুলি নিয়ে পরস্পরের সঙ্গে দর কষাকষি করে চলেছে। এ কেবল সমন্বয়ের অভাব নয়, সারা পৃথিবী মহামারি দ্বারা আক্রান্ত হওয়ার পরেও ইরানের মতো দেশগুলির বিরুদ্ধে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের নিষেধাজ্ঞাগুলি অব্যাহত ছিল। ফলে এটি পরিষ্কার যে এই সমস্ত কার্যকলাপের পিছনে জীবন বাঁচানো মূল লক্ষ্য নয়।

তৃতীয় পর্যায়

এই প্রতিযোগিতায় ছুটে এসেছে অন্যান্য দেশও। চিনা ওষুধ সংস্থা ক্যানসিনো বায়োলজিক্স একটি ভ্যাকসিন তৈরি করছে যা চূড়ান্ত পর্যায়ে রয়েছে, তবে সেটি চিনা সেনাবাহিনীর মধ্যে ইতিমধ্যে সীমিত ব্যবহার করা হয়েছে এবং মেক্সিকো, সৌদি আরব, পাকিস্তান এবং রাশিয়ায় শেষ পর্যায়ের পরীক্ষা চলছে। সিনোভাক বায়োটেকের ভ্যাকসিনেরও একই অবস্থা, যা চিনের উচ্চ-ঝুঁকিপূর্ণ কর্মীদের উপর ব্যবহার করা হচ্ছে এবং ইন্দোনেশিয়া, তুরস্ক এবং ব্রাজিলে একটি বিতর্কিত মামলার পরেও পুনরায় তৃতীয় পর্যায়ের ট্রায়াল চলছে। রাষ্ট্রীয় মালিকানাধীন চিনা সংস্থা সিনোফার্ম সংযুক্ত আরব আমিরশাহিতে সীমিত ভাবে দুটি ভ্যাকসিন ব্যবহার করছে এবং অন্যান্য দেশে তার পরীক্ষা চালাচ্ছে।

রুশ রাষ্ট্র পরিচালিত গামালিয়া গবেষণা ইনস্টিটিউটের স্পুটনিক ভি ইতিমধ্যে ব্যবহৃত হচ্ছে, যার সাফল্যের হার ৯২% বলে ঘোষণা করা হয়েছে। মার্কিন ফার্মাসিউটিক্যাল সংস্থা ফাইজার এবং জার্মান ওষুধ প্রস্তুতকারক বায়োএনটেক তাদের ভ্যাকসিনের সাফল্যের হার ৯০% (১৮ নভেম্বর ৯৫ শতাংশ বলে জানায়) বলে ঘোষণা করার দু’দিন পরই রাশিয়া স্পুটনিক ভি-র কার্যকারিতার পরিমাণ জানায়।

সম্প্রতি মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের ফার্মাসিউটিক্যাল সংস্থা মডার্না প্রাথমিক তথ্য অনুযায়ী দাবি করেছে যে এর ভ্যাকসিনটি ৯৪.৫ শতাংশ কার্যকর হতে পারে। ফাইজারের চেয়ে এই কোম্পানির ভ্যাকসিনের একটি উল্লেখযোগ্য সুবিধা রয়েছে, ফাইজারের ভ্যাকসিন -৭০ ডিগ্রি সেলসিয়াসে সংরক্ষণ করা প্রয়োজন এবং তাই বণ্টনে যথেষ্ঠ সমস্যা রয়েছে। মডার্না দাবি করেছে যে তাদের ভ্যাকসিনটি  -২০ ডিগ্রি সেলসিয়াসেই সংরক্ষণ করা যাবে। এছাড়াও তাদের ভ্যাকসিনের ডোজ ফ্রিজে দীর্ঘ সময় থাকতে পারে( প্রায় ৩০ দিন পর্যন্ত) যা সরবরাহ ও বণ্টনকে সহজ করবে। এই দুটি ভ্যাকসিন এখন মার্কিন প্রশাসনের থেকে জরুরি ক্ষেত্রে ব্যবহারের অনুমোদন (ইইউএ) পাওয়ার কাছাকাছি পৌঁছে গিয়েছে।

এখনও অবধি উল্লেখ করা ভ্যাকসিনগুলি প্রস্তুত প্রক্রিয়ার সর্বোচ্চ পর্যায়ে পৌঁছেছে। দ্বিতীয় ধাপ বা তৃতীয় পর্যায়ে থাকা বড়ো বড়ো ফার্মাসিউটিক্যাল সংস্থাগুলি হল: জনসন এবং জনসন, অ্যাস্ট্রাজেনিকা, নোভাভ্যাক্স, কানাডার মেডিকাগো এবং ভারতের ভারত বায়োটেক। অ্যাস্ট্রাজেনেকা ঘোষণা করেছে যে তারা প্রায় ৯০ শতাংশ কার্যকারিতা পেয়েছে এবং দাবি করেছে যে তাদের ভ্যাকসিনটি শূন্যের নিচের তাপমাত্রায় সংরক্ষণের প্রয়োজন হবে না।

বিশ্বজুড়ে বিভিন্ন কোম্পানিগুলি ভ্যাকসিন তৈরির জন্য হুড়োহুড়ি করছে, কেউ ভাবতেই পারে এই কোম্পানিগুলি এবং দেশের সরকারগুলি আমাদের সকলের জন্য একত্রিত ভাবে ভাইরাসের বিস্তার রোধে সক্ষম হবে। পরিবর্তে, আমরা দেখছি যে এই সমস্ত প্রচেষ্টা, বিনিয়োগ, এবং পরীক্ষাগুলির মধ্যে কোনো সমন্বয় নেই, সহযোগিতার ব্যাপারও নেই। এই বড়ো সংস্থাগুলির জন্য, প্রথম এবং সর্বাগ্রে যা গুরুত্বপূর্ণ তা হল তাদের শেয়ারের দাম। সুতরাং তাদের পক্ষে এটি দেখানো গুরুত্বপূর্ণ যে তারাই সর্বপ্রথম ভ্যাকসিন তৈরি করে ফেলছে, তা সম্পূর্ণ ফলাফল পাওয়ার আগে হলেও। এইসব ‘ইতিবাচক’ তথ্য সময়ের আগে প্রকাশের লক্ষ্য হ’ল, অনেক দেশের সরকার সুরক্ষা বা কার্যকারিতার গ্যারান্টি ছাড়াই তাদের ভ্যাকসিন কিনতে দৌড়বে।

বাজারের বৃহত্তর অংশ দখলের জন্য বেসরকারি ফার্মাসিউটিক্যাল কর্পোরেশনগুলির মধ্যে প্রতিযোগিতা ও দ্রুত ভ্যাকসিন তৈরির চেষ্টার কারণে ভ্যাকসিনগুলির প্রতি সাধারণ মানুষ ও স্বাস্থ্যকর্মীদের অবিশ্বাস বেড়ে যাচ্ছে। স্বাস্থ্যকর্মীদের উচ্চ ঝুঁকিপূর্ণ হিসাবে বিবেচনা করা হয় এবং জরুই অনুমোদনের অধীনে এই ভ্যাকসিনগুলি তারা প্রথম পাচ্ছেন, তবে অনেক চিকিৎসক এবং নার্স তা নেওয়ার আগে বিস্তারিত তথ্য চাইছেন। পুঁজিপতিরা নতুন লকডাউনে যেতে নারাজ। এমনকি সংক্রমণ কম রাখার জন্য পর্যাপ্ত সুরক্ষার ব্যবস্থা করতেও নারাজ। মুনাফা কমানোর পরিবর্তে তারা কয়েকশো কোটি মানুষের উপর সম্পূর্ণরূপে পরীক্ষিত না হওয়া ভ্যাকসিনগুলি প্রয়োগ করবে।

সরকারি তহবিল থেকে ব্যক্তি পুঁজি

এই প্রতিযোগিতা কেবল কর্পোরেট সংস্থাগুলির লাভের জন্যেই নয়, প্রথম যে দেশ ভ্যাকসিন তৈরি করবে, তারা ব্যাপক ভূ-রাজনৈতিক সুবিধাও পাবে। অবাক হওয়ার কিছু নেই যে যে দেশগুলির ভূ-রাজনৈতিকভাবে বিশ্বে আধিপত্য করছে( মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র, জার্মানি, রাশিয়া, ইংল্যান্ড এবং চিন), তারাই বর্তমান ভ্যাকসিন দৌড়ের মূল দেশ। এই দেশগুলিতে, বেশিরভাগ দেশের মতোই, বৈজ্ঞানিক গবেষণা রাষ্ট্রীয় তহবিলের যোগানে হয়, তবে তা বেচে যে মুনাফা হয় তা ব্যক্তিমালিকানার হাতে চলে যায়। উদাহরণস্বরূপ, বেহ-দোল আইন মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের বিশ্ববিদ্যালয়গুলিকে ট্যাক্সের পয়সায় হওয়া আবিষ্কারগুলির পেটেন্ট বিক্রয় করার অনুমতি দেয়।

একনিষ্ঠ ভাবে চর্চা করলে বোঝা যাবে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের সরকার এই ভ্যাকসিন দৌড়ের পেছনে প্রচুর পরিমাণে সম্পদ ব্যয় করছে। ট্রাম্প প্রশাসনের একটি উদ্যোগ, অপারেশন ওয়ার্প স্পিড (ওডাব্লুএস)ইতিমধ্যে মডার্নার সাথে একটি চুক্তিতে পৌঁছেছে এবং ১১ আগস্ট, স্বাস্থ্য ও জনসেবা বিভাগ (এইচএইচএস) সংস্থাকে ১০ কোটি মিলিয়ন ডোজ উৎপাদন এবং বিতরণের জন্যে ১.৫ বিলিয়ন ডলার তহবিল ঘোষণা করেছে। এটি এর আগে দেওয়া ৪৮৩ মিলিয়ন এবং ৪৭২ মিলিয়ন ডলারের সাথে যোগ হয়েছে।

ওডাব্লুএস-এর মূল বিনিয়োগগুলির মধ্যে রয়েছে, ৫ আগস্ট জনসন অ্যান্ড জনসনের (জ্যানসান)-এর ভ্যাকসিন বৃহৎ পরিমাণে উৎপাদন এবং সরবরাহের জন্য প্রায় ১ বিলিয়ন ডলার তহবিল দেওয়া – যা আগের ৪৫৬ মিলিয়ন ডলারের সাথে যুক্ত হয়েছে। ২১ মে, অ্যাস্ট্রাজেনিকা এবং অক্সফোর্ড বিশ্ববিদ্যালয়ের যৌথভাবে তৈরি ভ্যাকসিনের জন্য ১.২ বিলিয়ন ডলারের তহবিল ঘোষণা করেছে। ৭ জুলাই নোভাভ্যাক্সকে সাহায্য করতে ১.৬ বিলিয়ন ডলারের তহবিল ঘোষণা করেছে। ৩১ জুলাই সানোফি এবং গ্ল্যাক্সো স্মিথক্লিনের (জিএসকে) ভ্যাকসিনের জন্য ২ বিলিয়ন ডলার ঘোষণা করা হয়েছিল। ওডব্লিউএসের জন্য এই ১০ বিলিয়ন ডলার বাজেটটি সংসদেই অনুমোদিত হয়েছিল।

ফাইজার কোনও ওডাব্লুএস তহবিল পায়নি। সরকারি অনুমোদন পেলে ফাইজারের ভ্যাকসিনের ১০০ মিলিয়ন ডোজ কেনার একটি চুক্তি হয়েছে, যা ৫০ মিলিয়ন মানুষের জন্য প্রয়োজনীয় দুটি ডোজ দেওয়ার জন্যে যথেষ্ট। চুক্তিতে অতিরিক্ত ৫০০ মিলিয়ন ডোজ কেনার বিকল্পও রয়েছে। কিছুদিন আগে ফাইজার জানায়, তারা মার্কিন সরকারি প্রকল্পের অংশ নয়(যেহেতু টাকা নেয়নি)।কিন্তু প্রেসিডেন্ট ট্রাম্প গত ১৩ নভেম্বর বলেন ফাইজারের ওই বক্তব্যে তিনি হতাশ, কারণ তারা সরকারি প্রকল্পের অংশ। ফলে এটা স্পষ্ট যে রাষ্ট্রপতি ট্রাম্প, অন্যান্য বিশ্ব নেতাদের মতোই, এই স্বীকৃতির জন্য লোলুপ যে তাঁর সরকার ভ্যাকসিন গবেষণার অংশ ছিল।

সারা পৃথিবীর ভ্যাকসিন নয়

কোভিড -১৯ মহামারিটি, বড়ো ওষুধ কোম্পানিগুলির জন্য এক ব্যাপক মুনাফা কামানোর সুযোগ। এই কোম্পানিগুলি জনসাধারণের তহবিল ব্যবহার করে ভ্যাকসিন তৈরি করেছে এবং তাদের শেয়ারের দাম বাড়িয়েছে, এর সাথে মুনাফা যোগ হতে চলেছে মিলিয়ন মিলিয়ন ডলার যা বিভিন্ন দেশকে ভ্যাকসিন পাওয়ার জন্য দিতে হবে।

লন্ডন ভিত্তিক গ্লোবাল জাস্টিস নাওয়ের মতো সংগঠনগুলি ইতিমধ্যে তথ্য প্রকাশ করেছে যে, অদূর ভবিষ্যতে যে পরিমাণ ভ্যাকসিন ডোজ পাওয়া যাবে সেগুলির বেশিরভাগই ধনী দেশগুলি দাবি করেছে। উদাহরণস্বরূপ, ৭৮০ মিলিয়ন ডোজ – যা মডার্নার আগামী বছরের উৎপাদন ক্ষমতার ৭৮ শতাংশ – ইতিমধ্যে বিশ্বের ধনী সরকারগুলির কাছে বিক্রি হয়ে গেছে। ভ্যাকসিন প্রতিযোগিতা সাম্রাজ্যবাদের সক্রিয়তাকে কয়েক গুণ বাড়িয়ে তুলেছে। বৃহৎ শক্তিগুলি লুটেপুটে নেওয়ার পর পড়ে থাকা অবশিষ্ট নিয়েই বিশ্বের বেশিরভাগ দেশকে খেয়োখেয়ি করতে হবে।

চ্যালেঞ্জটি কেবল ভ্যাকসিনগুলি কেনার ক্ষেত্রে নয়, বিতরণ, সংরক্ষণের জন্য ফ্রিজার এবং শুকনো বরফের ব্যবস্থা করাটাও ভাবার বিষয়। মহামারি সম্পর্কে পেরুর প্রস্তুতি নিয়ে কাজ করা ডাঃ জার্মেন মালাগা সিএনএনকে জানিয়েছেন যে ফাইজার ভ্যাকসিন মজুদ করতে লিমায় প্রায় ৩০ টি প্রয়োজনীয় ফ্রিজার রয়েছে, তবে “এন্ডিজ পর্বতমালা এবং বনাঞ্চলের ২০ মিলিয়ন পেরুভিয়ানদের জন্য কিছুই নেই। ” ভারত ও দক্ষিণ আফ্রিকা ‘হু’কে কোভিড -১৯ এর প্রতিরোধ, নিয়ন্ত্রণ এবং চিকিৎসার জন্য টিআরআইপিএস (বৌদ্ধিক সম্পত্তির অধিকার সম্পর্কিত বাণিজ্যিক দিক) চুক্তির কিছু বিধান থেকে ছাড়ের গ্যারান্টি দেওয়ার অনুরোধ জানিয়েছে। আসলে ভ্যাকসিন উৎপাদন পেটেন্টধারী কোম্পানিগুলির হাতেই থাকবে।

সরকারগুলির ভ্যাকসিন কেনার দৌড়াদৌড়ি বা ভবিষ্যতের ভ্যাকসিন ডোজ নিয়ে বিভিন্ন দাবি স্পষ্ট করে দিচ্ছে মানুষকে কাজে ফিরিয়ে আনার জন্য পুঁজিপতিরা কতখানি মরিয়া। অনেক দেশই ভাইরাস ছড়িয়ে পড়া নিয়ন্ত্রণ করতে অক্ষম হয়েছে কারণ পুঁজিবাদ ব্যাপক জনগণকে সহায়তা করে মহামারি রোধ করার প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নেয়নি।  উলটে, নেতারা লোকদের কাজে ফেরত পাঠাতে টিকার জন্য ক্রমশ মরিয়া হয়ে উঠছে। এর অর্থ হ’ল তারা ভ্যাকসিন কেনার পরেই তা আদৌ কাজ করবে কিনা বা কতখানি নিরাপদ সেই বিষয়ে নিশ্চিত হওয়ার আগেই জনগণকে তা নেওয়ার জন্য চাপ দেওয়া শুরু করবে। দক্ষিণ কোরিয়ার মতো দেশ যারা ভাইরাসের বিস্তারকে কার্যকরভাবে নিয়ন্ত্রণ করেছে, তারা ভ্যাকসিনের জন্য তাড়াহুড়ো না করার সিদ্ধান্ত নিয়েছে। ওয়াল স্ট্রিট জার্নালের মতে, “স্বাস্থ্য আধিকারিকরা আশঙ্কা করছেন যে দ্রুত তৈরি হওয়া ভ্যাকসিনগুলি কার্যকর নাও হতে পারে বা তার দীর্ঘমেয়াদি পার্শ্ব প্রতিক্রিয়া থাকতে পারে।”

বৃহৎ ফার্মা কোম্পানির বিরুদ্ধে

পুঁজিপতিরা ভ্যাকসিন তৈরির বিষয়টিকে উদ্ভাবনী ক্ষমতার চমৎকারিত্ব বলে দেখাচ্ছে। বাস্তবে যদিও বিশ্বব্যাপী ভ্যাকসিন প্রতিযোগিতা বুর্জোয়াদের সম্পর্কে গড়ে ওঠা বিভিন্ন ধারণাকে(যা বুর্জোয়া এলিটরা নিজেরাও বিশ্বাস করতো) মিথ্যা বলে প্রমাণ করে দিয়েছে। যেমন পুঁজিবাদ ‘সমস্ত নৌকাকেই ভাসিয়ে রাখে’ এবং ‘উদ্ভাবনকে উৎসাহিত করে’ জাতীয় ধারণা। আমরা যেরকম দেখছি, বৈজ্ঞানিক গবেষণার ফলাফলগুলি সমন্বয় ও ভাগ করে নেওয়ার পরিবর্তে প্রতিটি বহুজাতিক সংস্থা সম্পূর্ণ গোপনীয়তার সাথে নিজস্বভাবে কাজ করছে।

সংস্থাগুলি ধরনের একগাদা গবেষণার জন্য সব ধরনের সম্পদের অপচয় করছে এবং ভ্যাকসিন তৈরি করতে অনেক বেশি সময় নিচ্ছে। কল্পনা করুন যে পৃথিবীর দুর্দান্ত বৈজ্ঞানিক মস্তিষ্কগুলি যদি সবচেয়ে কম সময়ে সবচেয়ে ভাল সম্ভাব্য ভ্যাকসিন তৈরি করতে কাজ করতো, তাহলে কত সুবিধা হতো। আমরা সম্ভবত ইতিমধ্যে একটি ভ্যাকসিন পেয়ে নিরাপদ জীবন কাটাতে পারতাম।

নতুন জৈবপ্রযুক্তির প্রাথমিক গবেষণার বেশিরভাগই সরকারি টাকায় চালানো হয় পরে তা বেসরকারি সংস্থাগুলির হাতে চলে যায়। এই সংস্থাগুলি সর্বাধিক মুনাফা নিশ্চিত করতে এর যোগান সীমিত করে জনগণকে চড়া দামে কিনতে বাধ্য করে। ওষুধগুলি জনসাধারণের কল্যাণে তৈরি করা উচিত, বেসরকারি সংস্থাগুলি দ্বারা স্বত্ব দখল করে রাখার জন্যে নয়। উপভোক্তা নজরদারি গোষ্ঠী পাবলিক সিটিজেন উল্লেখ করেছে, “করদাতারা মডার্নার কোভিড -১৯ ভ্যাকসিন তৈরির ১০০% অর্থ প্রদান করছেন। সম্পুর্ণটাই। তবুও করদাতাদের আরও কয়েক বিলিয়ন টাকা দিয়ে সেই ভ্যাকসিন কিনতে হবে, যদি তা নিরাপদ এবং কার্যকর প্রমাণিত হয়। মডার্নার ভ্যাকসিনটি মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের জনগণের স্বাভাবিক প্রাপ্য। আমরা এর জন্য অর্থ প্রদান করেছি। ফেডারেল বিজ্ঞানীরা গবেষণা চালিয়েছেন। ফলে এটি জনগণের ভ্যাকসিন হওয়া উচিত, কোনো নতুন করদাতার বোঝা নয়”।

সমস্ত ওষুধ, ভ্যাকসিন এবং উপকারী চিকিৎসা জনসাধারণের নিজেদের। এটি কোনে নতুন বা বিপ্লবী ধারণা নয়। ১৯৫৫ সালে পোলিওর ভ্যাকসিন তৈরির পরে, সিবিএস-এর সাংবাদিক  অ্যাডওয়ার্ড আর মোরোর, জোনাস সালকের কাছে জিজ্ঞাসা করেছিলেন পেটেন্টটির মালিক কে (সালক পেটেন্টের মালিক ছিলেন)?  সালক উত্তর দিয়েছিলেন, “জনগণ … এর কোনও পেটেন্ট নেই। আপনি কি সূর্যের পেটেন্ট কিনতে পারবেন?”

আমাদের ওষুধ এবং বিজ্ঞানকে জনসাধারণের কাছ থেকে মুনাফা কামানোর কাজে লাগানোর সংস্কৃতিকে বদলে এগুলিকে জনসাধারণের মঙ্গল সাধনের কাজে লাগাতে হবে। আমাদের ভুলে যাওয়া উচিত নয়: ফার্মাসিউটিক্যাল কর্পোরেশন এবং রাষ্ট্র রোগ প্রতিরোধের চেয়ে প্রতিকারগুলিতে বেশি বিনিয়োগ করে। যেমন আমরা জানি, ভ্যাকসিন বিক্রি করা সর্বদা বেশি লাভজনক। পুঁজিবাদ কোভিড -১৯ এর মতো রোগের মূল কারণগুলি দূর করতে অস্বীকার করে।

একটি ভ্যাকসিন পাওয়া নিঃসন্দেহে একটি বিশাল পদক্ষেপ হবে, তবে আমরা এই সংস্থাগুলি এবং বর্তমান বিতরণ পরিকল্পনাগুলিকে বিশ্বাস করতে পারি না। এই ধরনের ভ্যাকসিন প্রায় -৭০ ডিগ্রি সেলসিয়াসে সংরক্ষিত রাখা দরকার, যার জন্য পরিবহন এবং সংরক্ষণের জন্য বিশেষ ফ্রিজার প্রয়োজন হবে। পুঁজিবাদ ইতিমধ্যেই যেখানে স্বাস্থ্যকর্মীদের জন্য পর্যাপ্ত মাস্ক তৈরি করতেই অক্ষম, সেখানে আমরা কীভাবে আশা করতে পারি যে এরা ভ্যাকসিন সংরক্ষণের জন্য নিরাপদ এবং কার্যকর পর্যাপ্ত হাই-টেক ফ্রিজার উৎপাদন এবং বিতরণ করতে সক্ষম হবে? মহামারিটির প্রথম ঢেউ চলাকালীন ভেন্টিলেটর উৎপাদনের মতো ফ্রিজারের ব্যাপক উৎপাদনের একই পরিণতি হবে না কি? কোভিড -১৯ পুঁজিবাদী অর্থনৈতিক ব্যবস্থার বর্ণবাদী ও শ্রেণিবৈষম্যমূলক ভিত্তিকে স্পষ্ট করে দিয়েছে। আমরা কীভাবে বিশ্বাস করতে পারি যে, যারা কোভিড -১৯-এ সবচেয়ে ঝুঁকিপূর্ণ অবস্থায় তারা এই ভ্যাকসিনটি পেতে সক্ষম হবেন?

আমাদের প্রতিযোগিতা দূর করে সীমানা নির্বিশেষে গবেষণা এবং উন্নয়ন প্রচেষ্টা একত্রিত করতে হবে। অবিলম্বে বিনা ব্যয়ে প্রতিটি দেশের জন্য নিরাপদ এবং কার্যকর ভ্যাকসিন তৈরি করা জরুরি, যা সব দেশ পাবে। স্বাস্থ্য পরিষেবার রাষ্ট্রীয়করণ এবং ভ্যাকসিন সম্পর্কিত সমস্ত শিল্পকে শ্রমিক শ্রেণির নিয়ন্ত্রণাধীন করা একান্ত প্রয়োজন। মেহনতি মানুষের রাজনৈতিক ক্ষমতা দখলের লড়াই ছাড়া তা অসম্ভব।

Share Now:

LEAVE YOUR COMMENT

Your email address will not be published. Required fields are marked *