Home রাজনীতি বিশ্বজুড়ে ভুয়ো গণতন্ত্রের সংকট দেখিয়ে দিচ্ছে সর্বহারা বিপ্লবের একান্ত প্রয়োজনীয়তাকে

বিশ্বজুড়ে ভুয়ো গণতন্ত্রের সংকট দেখিয়ে দিচ্ছে সর্বহারা বিপ্লবের একান্ত প্রয়োজনীয়তাকে

বিশ্বজুড়ে ভুয়ো গণতন্ত্রের  সংকট দেখিয়ে দিচ্ছে সর্বহারা বিপ্লবের একান্ত প্রয়োজনীয়তাকে
0

পিপলস ম্যাগাজিন ডেস্ক: সাম্প্রতিক কেমব্রিজ বিশ্ববিদ্যালয়ের এক গবেষণায় ১৯৯৫ সাল থেকে আজ পর্যন্ত বুর্জোয়া গণতন্ত্র সম্পর্কে জনগণের অসন্তুষ্টির এক নিদারুণ ছবি প্রকাশিত হয়েছে। এই সময় কালে বুর্জোয়া গণতন্ত্রের প্রতি সাধারণ মানুষের অসন্তুষ্টির হার পৃথিবী জুড়ে ৪৭.৯% থেকে বেড়ে ৫৭.৫%-এ পৌঁছে গিয়েছে।

সমীক্ষাটি ২০১৫ সালকে বিশ্বব্যাপী একটি সন্ধিক্ষণ হিসেবে ধরে প্রধানত প্রথম বিশ্বের সাম্রাজ্যবাদী শক্তিগুলি, বিশেষত মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রর পাশাপাশি লাতিন আমেরিকার দিকে দিকে দৃষ্টি আকর্ষণ করেছে। লাতিন আমেরিকা এবং উত্তর আমেরিকা ছাড়াও, সাব-সাহারান আফ্রিকা এবং ইউরোপের কিছু অংশের (প্রধানত পূর্ব ইউরোপ) জনগণ বুর্জোয়া রাজনৈতিক ব্যবস্থার প্রতি হতাশ।

সমীক্ষায় দেশগুলিকে চারটি অঞ্চলে ভাগ করা হয়েছে। এর মধ্যে কেবল সাতটি দেশ বুর্জোয়া গণতন্ত্রকে ভালো চোখে দেখছে। উল্টো দিকে, ব্রাজিল, মেক্সিকো এবং পেরুর সাথে আরও চারটি দেশ ‘সঙ্কটাপন্ন অঞ্চল’ হিসাবে রয়েছে। সমীক্ষায় দেখা গেছে এই দেশগুলিতে জনগণের সিংহভাগই চলতি গণতন্ত্রের বিরোধী। ফলে শাসকশ্রেণি প্রকৃতই ‘বৈধতার সংকট’- এর মুখোমুখি।

লাতিন আমেরিকার ক্ষেত্রে, গবেষণায় উল্লেখ করা হয়েছে যে, উপমহাদেশটি বুর্জোয়া গণতন্ত্র বিরোধী অসন্তুষ্টির ‘চতুর্থ পর্যায়’- এর মধ্য দিয়ে চলেছে, প্রথম তিনটি ছিল ১৯২০, ১৯৫০ এবং ১৯৮০-র দশকে।

অসন্তুষ্টির জন্য উল্লিখিত কারণগুলির মধ্যে রয়েছে ‘বাম বাঁক’ নেওয়া আর্জেন্টিনার কির্চনার  এবং ব্রাজিলে লুলা সরকারগুলির সুবিধাবাদের বিরুদ্ধে সাধারণ বিদ্রোহ। এছাড়াও সম্পদের কেন্দ্রীকরণ, দারিদ্র্যের বিস্তৃতি, অসংগঠিত ক্ষেত্রের কারণে বেকারত্বের উচ্চ হার, শ্রম অধিকার বঞ্চনার পাশাপাশি প্রথাগত দুর্নীতি ক্রমবর্ধমান হতাশার অন্যান্য কারণ। এই ধরনের সমস্যাগুলি চলতি রাষ্ট্র ব্যবস্থা সমাধান করতে অক্ষম।

লাতিন আমেরিকার দেশগুলির মধ্যে, সমীক্ষাটি বিশেষত ব্রাজিল এবং মেক্সিকোয় মনোনিবেশ করেছে, যে দুটি দেশে জনগণের মোহভঙ্গের হার উচ্চতম। নিবন্ধ অনুসারে, ১৯৯০-এর দশকে পুরনো গণতন্ত্রের প্রতি অসন্তুষ্টি বাড়ছিল, সুবিধাবাদী লুলা সরকারের শুরুতে অসন্তুষ্টি হ্রাস পেয়েছিল। কিন্তু বাম সুবিধাবাদ তার সত্যিকারের চেহারা দেখানোর পর, ২০১৩ সালে এবং বিশেষত ২০১৪ সালে বিশ্বকাপের সময় দেশে দীর্ঘকালীন জঙ্গি বিক্ষোভের দ্বারা অসন্তোষের মাত্রা আবার বেড়েছে।

মেক্সিকোর বিষয় নিবন্ধে বলা হয়েছে যে তথাকথিত ‘উত্তরণের সময়’ থেকেই, “জনগণ কখনই বুর্জোয়া গণতান্ত্রিক প্রক্রিয়ার প্রতি আস্থা প্রকাশ করেনি।”

সাম্রাজ্যবাদী দেশগুলির মধ্যে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে বুর্জোয়া গণতন্ত্রের বিরুদ্ধে অসন্তুষ্টির মাত্রা সর্বোচ্চ। কারণগুলির মধ্যে, গবেষণাটি ২০০৮ সালের সাম্রাজ্যবাদের সাধারণ সংকটের পাশাপাশি অর্থনীতিতে ফাটকাবাজির প্রাধান্য বৃদ্ধিকে সাম্রাজ্যবাদী দেশগুলিতে বৈষম্য বেড়ে যাওয়ার কারণ হিসেবে চিহ্নিত করেছে।  আরও একটি উল্লেখ যোগ্য কারণ হ’ল শাসক শ্রেণির দলগুলির প্রতি অনাস্থা। জনগণ মনে করেন, একবার নির্বাচনে জিতে যাওয়ার পর জনপ্রতিনিধিরা জনগণকে উপেক্ষা করে।

মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে চলতি বুর্জোয়া গণতান্ত্রিক শাসন ব্যবস্থার বিরুদ্ধে অসন্তুষ্টির বৃদ্ধি ছিল যথেষ্ঠ নাটকীয়। গবেষণায় আলোচিত দেশগুলির অবস্থায় এই ইঙ্গিত স্পষ্ট যে সাম্রাজ্যবাদের দিন শেষ হয়ে আসছে। যেমন আগেই উল্লেখ করা হয়েছে, মূল সন্ধিক্ষণ হ’ল ২০০৮ সালের সাম্রাজ্যবাদের সাধারণ সঙ্কট, তার পাশাপাশি ইরাকের ইয়াঙ্কি আগ্রাসন যুদ্ধ (২০০৩-২০১১) এবং মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে শোষিত শ্রেণি এবং সাম্রাজ্যবাদী বুর্জোয়া শ্রেণির মধ্যে দন্দ্ব বৃদ্ধি। ইয়াঙ্কি দেশ কাঁপানো সাম্প্রতিক গণবিক্ষোভগুলিতে এই সমস্যাগুলি প্রকাশ পেয়েছে।

ইংল্যান্ড এবং ইউরোপে পুরানো শাসন ব্যবস্থা প্রত্যাখ্যান

অ্যাংলো-স্যাকসন সাম্রাজ্যবাদী দেশগুলির মধ্যে সমীক্ষা অনুযায়ী ১৯৭০-এ “ব্রিটেনের গভীর সঙ্কটের সময়” যেখানে সাধারণ ধর্মঘট, ব্ল্যাকআউট এবং আইরিশ রিপাবলিকান আর্মি (আইআরএ) -র সাম্রাজ্যবাদবিরোধী সংগ্রামের সূচনা, পুরানো শাসন ব্যবস্থার বিরুদ্ধে বিক্ষোভের বৃদ্ধি হিসাবে চিহ্নিত হয়েছিল। মনে রাখা দরকার যে, ১৯৭০-এর দশকে, মার্গারেট থ্যাচার এবং সমগ্র ব্রিটিশ প্রতিক্রিয়াশীল রাষ্ট্র জনগণের মৌলিক অধিকারগুলির বিরুদ্ধে আক্রমণাত্মক পদক্ষেপ নিয়েছিল। ১৯৮০-র দশকে নিজেদের অধিকারের দাবিতে নাবিকদের ধর্মঘট সর্বহারা শ্রেণি সংগ্রামের এক দৃষ্টান্তমূলক উদাহরণ।

১৯৯০-এর দশক থেকে আইআরএ-র আত্মসমর্পণ এবং সুবিধাবাদী লেবার পার্টির সরকার গঠন হওয়ার সাথে অসন্তোষের মাত্রা সাময়িক কমে। তবে, ব্রিটেনের ইরাকের বিরুদ্ধে আগ্রাসনের যুদ্ধে প্রত্যক্ষ অংশগ্রহণের পাশাপাশি সেই সময়ের সংসদীয় ব্যয় এবং ব্রিটেন এবং ইউরোপীয় ইউনিয়নের (জার্মানির নেতৃত্বে) আন্তঃ সাম্রাজ্যবাদী দ্বন্দ্বের ফলস্বরূপ ব্রেক্সিট ইত্যাদিতে জনগণের হতাশা বৃদ্ধি ঘটেছে। ফলে এই সমীক্ষায় অংশগ্রহণকারী ৫০% -এর বেশি লোক ইংলিশ বুর্জোয়া গণতন্ত্রে অসন্তুষ্ট।

বিশ্বের অন্যান্য অংশের মতো, ইউরোপ, বিশেষত পশ্চিম ইউরোপেও ২০০৮-এর সাম্রাজ্যবাদের সাধারণ সঙ্কটের পরে জনগণের হতাশার মাত্রা বেড়েছে। ফ্রান্স এবং স্পেনের মতো দেশগুলিতে হতাশার মাত্রা এখনও প্রকট। হতাশার সাথে রয়েছে দেশের বিভিন্ন অংশের মধ্যে ক্রমবর্ধমান আঞ্চলিক পার্থক্য (কোনো কোনো অঞ্চল অন্যগুলির চেয়ে দরিদ্র) দেশগুলিতে, পাশাপাশি শোষিত শ্রেণি এবং সাম্রাজ্যবাদী বুর্জোয়া শ্রেণির মধ্যে বৈষম্যও কেবলই বেড়ে চলেছে।

ইউরোপীয় দেশগুলির মধ্যে গ্রিসের শাসন ব্যবস্থা সবচেয়ে কুখ্যাত বলা চলে। ২০০৮ সালে সাম্রাজ্যবাদের সাধারণ সঙ্কট গ্রিসকে একটি দীর্ঘ মন্দায় ফেলে দেয় এবং হাজার হাজার শ্রমিককে দুর্ভিক্ষের দিকে ঠেলে দেয়। তার পর থেকে জনসংখ্যার ৭৫% দেশের শাসন ব্যবস্থার উপর চরম অসন্তুষ্ট।

পূর্ব ইউরোপে, পূর্বতন সোভিয়েত প্রজাতন্ত্রগুলিতে সংশোধনবাদের পরে বুর্জোয়া একনায়কতন্ত্রও সংকটে রয়েছে। রাশিয়া এবং বেশ কয়েকটি দেশ যেমন বেলারুশ, কিরগিজস্তান এবং মলডোভায় অসন্তুষ্টির মাত্রা ৫০% থেকে ৭০%। ইউক্রেনে  অসন্তোষের মাত্রা বাড়েনি, তবে বুর্জোয়া শ্রেণির নিপীড়ন ও শোষণের কারণে শাসন ব্যবস্থার উপর হতাশার সংখ্যা প্রায় ৭৫% এ ‘আটকে’ আছে। মনে রাখতে হবে যে এই দেশগুলিতে কার্যনির্বাহী স্তর এবং সশস্ত্র বাহিনীগুলিতে রাজনৈতিক ক্ষমতার ব্যাপক কর্পোরেটাইজেশন এবং কেন্দ্রীকরণ হয়েছে। ফলে তাদের ঘোষিত উদ্দেশ্যগুলির ব্যর্থতা জনগণের হতাশা আরও বাড়িয়ে তুলেছে।

উত্তাল মধ্য প্রাচ্য

সমীক্ষা অনুযায়ী এশিয়াতে, বিশেষত মধ্য প্রাচ্য অঞ্চলটি ‘বুর্জোয়া গণতন্ত্রায়ণের অন্যতম প্রতিরোধী’। এই অঞ্চলের মানুষ  অবিচ্ছিন্ন লড়াই চালিয়ে যাচ্ছেন। এই অঞ্চলে গবেষণা শুরু হওয়ার সময় বুর্জোয়া প্রহসনের উপর অসন্তুষ্টি  যথেষ্টই ছিল। ক্রমেই তা বাড়ে এবং ‘আরব বসন্ত’ বিক্ষোভে আরও বৃদ্ধি পায়। উদাহরণ হিসেবে তিউনিসিয়ার কথা বলা চলে, যেখানে অর্ধেক তিউনিসিয়ান জনগণ বুর্জোয়া গণতন্ত্রকে অযোগ্য বলে ঘোষণা করেছে, প্রায় জনসংখ্যার ৭২%- এর ব্যবস্থার প্রতি অনাস্থা রয়েছে।

অন্যদিকে সাব-সাহারান আফ্রিকার বেশিরভাগ দেশে ‘উপনিবেশবাদের অবসান’ এবং তথাকথিত ‘গণতন্ত্র’- (১৯৬০) এর আগমনে বিশেষ উৎসাহ ছিল। কিন্তু উপনিবেশিকতাবিরোধী সংগ্রামের সুবিধাবাদী ও সংশোধনবাদী নেতৃত্ব সাম্রাজ্যবাদ দ্বারা নিপীড়িত মানুষের আশাআকাঙ্ক্ষাকে বিক্রি করে দেয়। ১৯৯০-এর দশক থেকেই, জনগণের মধ্যে এই জাতীয় প্রতিশ্রুতিবদ্ধ গণতন্ত্র সম্পর্কে হতাশার মাত্রা বেড়েছে, মহাদেশের ৫০% -রও বেশি মানুষ তাদের দেশের বুর্জোয়া শ্রেণির পুরানো শাসন ব্যবস্থাকে প্রশ্নবিদ্ধ করছে।

সমীক্ষায় বিশেষ নজর দেওয়া হয় নাইজেরিয়া দেশটিতে, যেখানে ১৯৯৯ সালে ফ্যাসিবাদী সামরিক শাসনের অবসান ঘটে এবং তথাকথিত ‘গণতন্ত্র’- এর সূচনা হয়। তবে ২০০০- এর দশকের গোড়ার থেকে নাইজেরিয়ার বেশিরভাগ মানুষ তাদের নয়া উদারনৈতিক ‘গণতন্ত্র’- এর বৈধতাকে চ্যালেঞ্জ জানিয়েছে, ৫০% এরও বেশি মানুষের বৃহৎ বুর্জোয়া শ্রেণির শাসনের প্রতি অনাস্থা প্রকাশ করেছে। পুলিশি রাষ্ট্রের বর্বর নির্যাতনের বিরুদ্ধে আজ নাইজেরিয়ায় উত্তাল বিক্ষোভ।

শেষে, দক্ষিণ এশিয়াতে, উদাহরণস্বরূপ নেপালে, প্রচণ্ড এবং তাঁর চক্র আত্মসমর্পনের মধ্যে দিয়ে জনগণের সাথে বিশ্বাসঘাতকতা করে। এখন সংশোধনবাদী দলের নেতৃত্বে গঠিত বুর্জোয়া গণতন্ত্রের প্রতি জনগণের অসন্তুষ্টি উচ্চ মাত্রায়। সাক্ষাৎকার দেওয়া তিন চতুর্থাংশ মানুষের দেশের চলতি শাসন ব্যবস্থার উপর অসন্তুষ্টি এটি প্রমাণ করে যে নেপালি জনগণ এখনও একটি নতুন দেশ চায়।

পরিশেষে, এটি উল্লেখ করা প্রয়োজন যে এই গবেষণায় বেশ কিছু সমস্যা রয়েছে। উদাহরণস্বরূপ, ভেনেজুয়েলার মতো দেশকে ‘একনায়কতন্ত্র’ হিসাবে চিহ্নিত করা  হয়েছে, যখন বাস্তবে, সমস্ত দেশই এক শ্রেণির উপর অন্য শ্রেণির একনায়কতন্ত্র (‘গণতন্ত্র’-এর মুখোশযুক্ত বা নয়) ,অথবা বুর্জোয়া শাসন ব্যবস্থা প্রত্যাখ্যানের এই জোয়ারের বিষয়ে গবেষকদের হতাশার বহিঃপ্রকাশ, সমীক্ষার পক্ষপাত স্পষ্ট করেছে। তবে জনগণের সংগ্রামে প্রতিশ্রুতিবদ্ধদের জন্য এই গবেষণা কিছু জিনিস খুব স্পষ্ট করে দেখিয়েছে। তা হল, জনগণ সত্যিকারের পরিবর্তনের জন্য সংগ্রাম করে চলেছে, তারা পুরোনো শৃঙ্খলার বাইরে বেরোতে চাইছে। বিপ্লবী এবং জনগণের সেবায় নিয়োজিতদের কাজ, নতুন বিশ্বের পথ দেখানো।

Share Now:

LEAVE YOUR COMMENT

Your email address will not be published. Required fields are marked *