মানসিক সমস্যার বিপ্লবী চিকিৎসা
ফিলিপিনসের কমিউনিস্ট পার্টির কেন্দ্রীয় কমিটির মুখপত্র ‘অ্যাং বায়াং’(জনগণ)-এর ৭ নভেম্বর সংখ্যায় এই প্রবন্ধটি প্রকাশিত হয়েছে। প্রবন্ধটি ফিলিপিনসের প্রেক্ষাপটে লেখা। রচনাটির গুরুত্ব অনুধাবন করে আমরা এটির ভাবানুবাদ করলাম।
গত অক্টোবরে মানসিক স্বাস্থ্যের জাতীয় কেন্দ্র জানিয়েছে যে তাদের জাতীয় আত্মহত্যা বিষয়ক হটলাইনে ফোনের সংখ্যা ১১৯ শতাংশ বৃদ্ধি পেয়েছে। এই তথ্য থেকে স্পষ্ট বোঝা যাচ্ছে, নিষেধাজ্ঞা, কাজ ও উপার্জন হারানো, দীর্ঘদিন ঘরে বন্দি থাকার ফলে বহু মানুষের মানসিক চাপ ব্যাপক বেড়ে গিয়েছে।
এই রিপোর্ট থেকে পরিষ্কার বোঝা যাচ্ছে, অতিমারি মোকাবিলায় সরকারের ব্যর্থতার ফলে অর্থনীতি ও জীবনজীবিকায় যে বিপর্যয় নেমে এসেছে, তার সঙ্গে মানসিক স্বাস্থ্য সংক্রান্ত সমস্যার সরাসরি যোগসূত্র রয়েছে।
বিপ্লবী আন্দোলনের মধ্যেও বিভিন্ন গণ সংগঠনের সদস্যরা মানসিক স্বাস্থ্য সংক্রান্ত সমস্যায় ভোগেন। বিপ্লবী সংগঠনের সদস্য হিসেবে, তাদের কমরেডরা তাদের দেখভাল করেন এবং এই সমস্যা থেকে উত্তীর্ণ হতে তাদের সাহায্য করেন। তাদের একজন হলেন সি স্যাম। তিনি আগে ছাত্র রাজনীতি করতেন, বর্তমানে গ্রামাঞ্চলে সর্বক্ষণের কৃষক সংগঠক হিসেবে কাজ করেন।
এই মেয়েটির মানসিক সমস্যা য়খন প্রথম সামনে আসে, তখন সে স্কুলের উঁচু ক্লাসে পড়তো। সে কেবল নিজের ক্ষতি করার চেষ্টা করতো। তাঁর ধারণা, তাঁর বাবামায়ের মধ্যে বিচ্ছেদ হওয়ার ফলেই এই সমস্যা শুরু হয়েছে। ওই ঘটনায় সে খুবই ধাক্কা খেয়েছিল। কলেজে থাকাকালীন এক চিকিৎসক, তার মধ্যে ‘বাইপোলার ডিজঅর্ডার’-এর রোগ নির্ণয় করেন। তার আগে তাকে স্কুল থেকে তাড়িয়ে দেওয়া হয় এবং নিজের পড়াশোনার খরচ জোটানোর জন্য সে কাজকর্ম করা শুরু করে। সেই সময় সে প্রথম আত্মহত্যার চেষ্টা করেছিল।
স্যামের কথা অনুযায়ী, তাঁর দর্শন এবং বিশ্ব দৃষ্টিভঙ্গি পরিবর্তিত হওয়ার পর সে নিজের সমস্যাটা গভীর ভাবে উপলব্ধি করে। বিশ্লেষণের মার্কসবাদী-লেনিনবাদী দৃষ্টিভঙ্গি এবং জনগণের স্বার্থকে সর্বাধিক গুরুত্ব দেওয়ার নীতি তাঁকে ব্যাপক ভাবে সাহায্য করে।
“সংগঠিত হওয়ার আগে, কোনো কিছুকে পরিষ্কার ভাবে বোঝার মার্কসবাদী পদ্ধতি আমার কাছে ছিল না। আমার নিজের সমস্যাকে বিশ্লেষণ করতে শেখানোর মতো কোনো পথনির্দেশক আমার ছিল না। মুখ্য ও গৌণ, অন্তর্বস্তু ও বাহ্যিকের তফাৎ আমি বুঝতাম না। তখন আমি ছিলাম দ্বন্দ্বে জীর্ণ নিষ্ক্রিয় জনতার মতো যারা নিজেকে নিয়ে কষ্টে এবং গোটা দুনিয়ার ওপর ক্রুদ্ধ হয়ে থাকে।
সচেতন হয়ে ওঠার প্রক্রিয়ায় স্যাম বিভিন্ন দ্বন্দ্বকে চিহ্নিত করার দক্ষতা অর্জন করে এবং সেগুলি সমাধানের কাজে অংশ নেয়। বিপ্লবী কর্মকাণ্ডকে এগিয়ে নিয়ে যাওয়ার কাজে অংশ নেওয়ার মধ্যে দিয়ে সে বিভিন্ন দ্বন্দ্বগুলির সঠিক সমাধান করার কাজে প্রশিক্ষিত হয়। তার মধ্যে যেমন পার্টির মধ্যেকার সাধারণ ভুল বোঝাবুঝি ছিল, তেমনই ছিল কৃষক ও জমিদারদের মধ্যে অবৈরিমূলক দ্বন্দ্বগুলোও। এগুলি তাকে তার নিজের মধ্যেকার দ্বন্দ্বগুলোকে পরিচালনা করতে সাহায্য করে।
“ঠিক কোন কোন ঘটনা একজন মানসিক সমস্যায় ভোগা মানুষের মনে নেতিবাচক আবেগ, অনুভূতি বা উদ্বেগ তৈরি করে(যাকে এক কথায় ‘ট্রিগার’ বলা হয়) এবং সেগুলো কীভাবে তার মেজাজ ও কাজকর্মকে নিয়ন্ত্রণ করে, সেটা জানা জরুরি”, বলেন স্যাম। একজন ব্যক্তির ট্রিগারগুলিকে চিহ্নিত করা, তাঁর চিকিৎসার প্রথম ধাপ।
একজন একবার স্যামকে জিজ্ঞাসা করেছিলেন, গ্রামাঞ্চলের কঠিন পরিস্থিতি কি তার মানসিক সমস্যাকে ট্রিগার করে? স্যাম বলেছিলেন, “অবশ্যই। কিন্তু এই পচাগলা ব্যবস্থায় জীবন সংগ্রাম চালাতে হলে সেটা আমার যেমন লাগত, সেভাবেই আমি এই অবস্থাটাকে দেখি। তফাতটা হল, এই জায়গাটাকে আমি নিজের বলে মনে করি, বেশি কিছু জয় আমাদের হয়েছে। ‘আশা’ শুধু কোনো অবসাদগ্রস্ত মানুষকে উৎসাহিত করার বিষয় নয়, বরং এটা প্রতিদিন জনগণের সঙ্গে আদানপ্রদানের মাধ্যমে আমি তার প্রামাণ পাই”।
“ট্রিগার থেকে বাড়াবাড়ি হয়ে যাওয়ার মূলে থাকে মনোগতবাদ, যাকে প্রতিহত করা দরকার। এগুলো এমন অনুভূতি, যার সঙ্গে বাস্তবের সম্পর্ক নেই এবং অনিশ্চিত”, ব্যাখ্যা করেন স্যাম। “আমার অভিজ্ঞতা বলে, যদি আমার মনোগতবাদকে সমালোচনা না করা হয়, তাহলে আমার নেতিবাচক চিন্তার ঝুলি ক্রমেই ভরে উঠবে এবং শেষ অবধি তা আমার এবং আমার চারপাশের মানুষের ক্ষতি করবে”।
যৌথ জীবন, সমালোচনা এবং আত্মসমালোচনা, এই সমস্যা সমাধানের ক্ষেত্রে গুরুত্বপূর্ণ, বলেন স্যাম। এই ‘থ্রি চেকআপস’-এর মাধ্যমে নিয়মিত নিজের মনমেজাজ নিয়ে অন্যদের সঙ্গে আলোচনা করলে, কমরেডরা মানসিক সমস্যায় আক্রান্ত ব্যক্তিদের কাছে পরিস্থিতির বস্তুনিষ্ঠ ব্যাখ্যা করতে পারবে এবং মনোগতবাদকে প্রতিহত করতে পারবে। এটা নাগরিক জীবনের বিপরীত, সেখানে ব্যক্তিস্বাতন্ত্রযবাদ ব্যাপক ভাবে ছড়িয়ে গিয়েছে। সেখানে কেউ কারও সমস্যা নিয়ে মাথা ঘামায় না এবং কেবল ধনীরাই চিকিৎসার সুযোগ পায়।
“তবে, উদারতাবাদের কবলে পড়লে যৌথ জীবন, সমালোচনা, আত্মসমালোচনা অর্থহীন”,বলেন স্যাম। “মূল কথাটা হল, তুমি যতই নিজের মতামতকে ভুল মনে কর বা তোমার কথা শুনলে কমরেডরা রেগে যাবে মনে কর, তোমায় সৎ হতে শিখতে হবে। নিজের কথাটা খুলে বলাটা সবচেয়ে জরুরি, একমাত্র তাহলেই তোমার অবস্থা এবং ট্রিগারগুলি কমরেড বুঝতে পারবে এবং তোমায় সাহায্য করতে পারবে”।
মানসিক সমস্যার চিকিৎসা নিয়ে পড়াশোনা করাটা বিপ্লবীদের পক্ষেও জরুরি। ফিলিপিনস কমিউনিস্ট পার্টির স্বাস্থ্য ব্যুরোর নির্দেশিকায় বিভিন্ন ধরনের মানসিক সমস্যার ব্যাখ্যা দেওয়া রয়েছে, সেগুলি কীভাবে বাড়ে এবং সেগুলি চিকিৎসা কেমন হবে তাও বলা রয়েছে। নয়া গণফৌজের মধ্যেও স্বাস্থ্যকর্মীদের প্রশিক্ষণ দেওয়া হয়, যাতে যোদ্ধা ও জনগণের মধ্যে যারা মানসিক সমস্যায় ভুগছেন, তাদের চিকিৎসা করতে পারেন।
মানসিক সমস্যায় আক্রান্ত ব্যক্তিদের কালিমালিপ্ত করা এবং এ সম্পর্কে অবৈজ্ঞানিক ধ্যানধারণার দৃঢ় ভাবে বিরোধিতা করতে হবে। মানসিক সমস্যায় আক্রান্ত ব্যক্তিদের যথাযথ চিকিৎসার পদ্ধতি নির্ণয় করার ব্যাপারে গভীর মনোযোগ দিতে হবে।
তুমি যেখানে যাবে, মানসিক স্বাস্থ্য জনিত সমস্যা সেখানেই তোমায় ছায়ার মতো অনুসরণ করবে। বিপ্লবীদের প্রতিদিন নিজেদের বুর্জোয়া-উদারতাবাদী প্রবণতার বিরুদ্ধে লড়াই করে নিজেদের পুননির্মাণ করতে হয়, মানসিক সমস্যার চিকিৎসাও তার থেকে আলাদা কিছু নয়।