Home রাজনীতি ফ্রান্স: প্রেক্ষিতহীন ভাবে কোনো ধর্মকে ‘অপরাধী’ বানানোর উগ্র নাস্তিকতা শাসকের হাতই শক্ত করে

ফ্রান্স: প্রেক্ষিতহীন ভাবে কোনো ধর্মকে ‘অপরাধী’ বানানোর উগ্র নাস্তিকতা শাসকের হাতই শক্ত করে

ফ্রান্স: প্রেক্ষিতহীন ভাবে কোনো ধর্মকে ‘অপরাধী’ বানানোর উগ্র নাস্তিকতা শাসকের হাতই শক্ত করে
0
শুভেন্দু ঘোষ
গবেষক, পদার্থবিদ্যা

ফ্রান্সের ইসলামিক মৌলবাদীর হাতে শিক্ষকের হত্যার পর হঠাৎ করে উগ্র নাস্তিকদের মধ্যে ‘সুশান্ত সিং রাজপুত অনুরাগী সিন্ড্রোম’ জেগে উঠেছে। যত্রতত্র ইসলামের মহানবী মুহাম্মদের কার্টুন, তাকে নিয়ে রসালো চুটকি রচনায় আপাতত প্রগতিশীলতার মাপকাঠি হয়ে দাঁড়িয়েছে। নিরপেক্ষতার জন্য মাঝেমধ্যে অন্যান্য ধর্ম ‘অবমাননাও’ চলছে । অবশ্য এ সমস্ত কিছুই হঠাৎ বললে সঠিক বলা হবে না, পুতুল নাচের ইতিকথার মতো এই পুতুলের সুতো অনেকদিন আগে থেকেই সাম্রাজ্যবাদের হাতেই বাঁধা।

ইউরোপে বুর্জোয়া বিপ্লবের প্রাক্কালে আধুনিক বিজ্ঞান, তার মতাদর্শ এবং অন্যান্য গণতান্ত্রিক প্রগতিশীল মতাদর্শগুলো বিকশিত হতে থাকে। এই আদর্শগুলো সেই সময়ের শাসক শ্রেণি সামন্তপ্রভু ও তাদের তল্পিবাহক চার্চের বিরুদ্ধে অবস্থান নেয়। নাস্তিক্যবাদ এর আগে উপস্থিত থাকলেও আধুনিক বিজ্ঞানের আবিষ্কারের ফলে প্রাকৃতিক শক্তিগুলোর উপর মানুষের নিয়ন্ত্রণ প্রতিষ্ঠা এবং বিভিন্ন প্রাকৃতিক ঘটনার ব্যাখ্যা প্রদান নাস্তিকতাকে শক্তিশালী ভিত্তির উপর দাঁড় করিয়ে দেয়। অন্যদিকে চার্চের মতাদর্শ তখন অপসারিত ও প্রতিক্রিয়াশীল সামন্তশ্রেণীর মতই নিশ্চল। ফলে সেই সময়ে দাঁড়িয়ে ইউরোপে এককভাবে নাস্তিকতাও একটি প্রগতিশীলতাকে ধারণ করতো।

অন্যদিকে, ইউরোপে এইসব ভাঙচুরের সাথে সাথেই ইউরোপিয়ান ব্যবসায়ীর দল পৃথিবী জুড়ে উপনিবেশ গড়ে তুলছে। এশিয়া, আফ্রিকা, আমেরিকার অধিবাসীদের গণহত্যা, ক্রীতদাস বানানো ও নির্মম অত্যাচারের মধ্যে দিয়ে আধিপত্য স্থাপন চলছে। ইউরোপীয় বুর্জোয়ারা এইসব উপনিবেশগুলোতে কিছুটা পুঁজিবাদী উৎপাদন সম্পর্ক প্রতিষ্ঠা করলেও মোটের উপর সামন্ততান্ত্রিক কাঠামোকে অক্ষুণ্ণ রেখে দেয় এবং নিজেদের পেটোয়া একটা পরজীবী শ্রেণির জন্ম দেয়। ‘সুশান্ত সিং রাজপুত অনুরাগী সিন্ড্রোম’-এর বীজ লুকিয়ে আছে এই পেটোয়া শ্রেণির জন্মের মধ্যে। ইউরোপের আধুনিকতার সাথে পরিচয় ঘটল এদের মাধ্যমেই। সমস্ত দর্শনই দিনশেষে কোনো না কোনো শ্রেণিস্বার্থ রক্ষা করে, ফলে ইউরোপের রেনেসাঁর যুগের যেসব মহৎ প্রগতিশীল দর্শনগুলো কলোনিতুতো কারণে উপনিবেশগুলোতে এসে পৌঁছাল, অবশ্যম্ভাবীরূপে তার মধ্যে ঔপনিবেশিক ছাপ পুরোদস্তুর রয়ে গেল।

নাস্তিকতাবাদ থেকে শুরু করে মার্ক্সবাদ, কেউই তার ব্যতিক্রম নয়। ইউরোপিয়ানদের উপনিবেশ রক্ষার তাগিদে যেমন দরকার ছিল পেশীর জোর, তেমনই দরকার ছিল মতাদর্শগত বিজয়।  যা কিছু  প্রগতিশীল তাই ইউরোপীয় এবং যা কিছু ইউরোপীয় তাই আধুনিক, এই চিন্তাধারা সে তার শিক্ষা সংস্কৃতির দ্বারা উপনিবেশের মানুষের মাথায় ঢুকিয়ে দিতে শুরু করল। যেন উপনিবেশগুলো ইউরোপীয় দ্বারা শাসিত এবং শোষিত হয়ে ধন্য হয়ে গেছে, এক স্বর্গের দিকে যাত্রা শুরু হয়েছে। আধুনিক ইউরোপীয় প্রগতিশীল চিন্তাগুলো দেশীয় দালালদের হাতে প্রেক্ষিতহীনভাবে ব্যবহৃত হতে থাকল। বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই তাদের অবস্থান হত নিপীড়িত মানুষের বিপক্ষে (অবশ্যই দ্বন্দ্ববিকাশের মাধ্যমে নাস্তিকতা, জাতীয়তাবাদ, বিজ্ঞানভিত্তিক চিন্তা, মার্ক্সবাদ  আস্তে আস্তে নিপীড়িত মানুষের হাতিয়ার হয়ে ওঠে, সে আলোচনা পৃথক)।

অপর পক্ষে উপনিবেশগুলোর নিপীড়িত মানুষেরা প্রথম দিকে মূলত ধর্মীয় বা গোষ্ঠীয় ধারণাকে কেন্দ্র করে বিভিন্ন সাম্রাজ্যের বিরুদ্ধে মুক্তি সংগ্রামে সংগঠিত হতে থাকে। বাংলার ক্ষেত্রেই সন্ন্যাসী ফকির বিদ্রোহ, সাঁওতাল বিদ্রোহ, মুন্ডা বিদ্রোহ এরকম প্রচুর উদাহরণ আছে। আমরা মনে করতে পারি ১৮৫৭ এর মহাবিদ্রোহের তুষে আগুন দিয়েছিল একটা ‘কুসংস্কার’,  কার্তুজের খোলে গোরু-শুয়োরের চর্বি আছে। প্রত্যাশিতভাবেই,  ‘রেনেসাঁয়িত’,  আধুনিক বিজ্ঞানভাবনার দিশারীরা তখন কলকাতায় বসে ‘কন্ডেম-কন্ডেম’ খেলা খেলছেন, এবং কোনো কোনো ‘বীরপুরুষ’ ব্রিটিশের পক্ষে হাতিয়ার ধরার কথাও ভাবছেন। ইউরোপে যে ধর্ম পশ্চাদপদতার চিহ্ন হয়ে দাঁড়িয়েছিল, তার পতাকার নিচেই মুক্তিকামী মানুষ এসে দাঁড়াচ্ছেন,  শ্রেণি বিচ্যুত হয়ে দেখলে এই ঘটনা কুসংস্কার ছাড়া আর কিছু নয়। আজকের দিনেও দেখা যাবে বিভিন্ন জায়গায় আদিবাসীরা খনি উত্তোলনের বিরোধিতা করেন কারণ ওই জঙ্গল বা পাহাড় তাঁদের দেবতা। এই দ্বন্দ্ব যে প্রকৃতিকে নিয়ন্ত্রণের আধুনিকতা বনাম ধর্মীয় কুসংস্কারের নয়, বরং সাম্রাজ্যবাদী লুটের সাথে মানুষের জীবন জীবিকার দ্বন্দ্ব, সেটা ভুলে গেলে উগ্র যুক্তিবাদী নাস্তিকদের হাতে পেনসিলটাও পড়ে রইবে না।

উপনিবেশগুলোর সাথে আধুনিক ইউরোপীয় দর্শনের পরিচয় মূলত সাম্রাজ্যবাদের হাত ধরে। ফলে স্বাভাবিকভাবেই এইসব দেশগুলোতে মানুষের মধ্যে ‘আধুনিকতা’কে প্রত্যাখ্যান করার একটা প্রবণতা থেকে যায়। সেই সব দেশগুলির মানুষ যখন বাধ্য হয়ে অভিবাসী শ্রমিক হিসেবে সাম্রাজ্যবাদী দেশগুলিতে যান, তখনও তাদের মধ্যে সেই প্রবণতা থাকে। সেই প্রবণতাকে কাজে লাগিয়ে ধর্মীয় মৌলবাদীরা নিজেদের পতাকার তলে ব্যাপক সংখ্যক মানুষকে আকৃষ্ট করতে সক্ষম হয়। এই মৌলবাদীদের একটা বড়ো অংশ আবার সাম্রাজ্যবাদের সরাসরি দালাল হিসেবে কাজ করে অথবা দক্ষিণপন্থী প্রতিক্রিয়াশীল শক্তির হাত শক্ত করে। অন্যদিকে উগ্র নাস্তিকের দল প্রেক্ষিতহীনভাবে ধর্মকে শত্রু ঠাউরে আক্রমণের মধ্যে দিয়ে, ব্যাপক মানুষকে ক্রিমিনালাইজড করে সেই শাসকের হাতই শক্ত করে। মনে রাখা উচিত, তৃতীয় বিশ্বের দেশগুলিতে নাস্তিকতা এক ধরনের প্রিভিলেজ।  সে নাস্তিক হবার ‘সুযোগ’ পেয়েছে বলেই নাস্তিক হয়েছে, ব্যাপক সংখ্যক নিপীড়িত মানুষের কাছে সেই সুযোগ নেই বলেই তারা আস্তিক।

মত প্রকাশের স্বাধীনতা অবশ্যই থাকতে হবে। যতক্ষণ না কোনো মত কোনো সম্প্রদায়ের মানুষকে ক্রিমিনালাইজড করছে ততক্ষণ মতপ্রকাশের স্বাধীনত পরম, তা সে যতই ভাবাবেগকে আঘাত করুক না কেন!  যে মত ভাবাবেগকে আঘাত দেয় তা প্রকাশের স্বাধীনতার প্রয়োজন, ‘রসগোল্লা একটা সুস্বাদু খাবার’ বলার জন্য আলাদা করে স্বাধীনতার দরকার হয় না।

তবে যেসব উগ্র নাস্তিক, যুক্তিবাদী ধর্ম অবমাননাকে প্রগতিশীলতা মাপার যন্ত্র ধরে বসে তার মধ্যে মোক্ষ খুঁজছে তাদের কিছু বলার নেই। কিন্তু যেসব বাম গণতান্ত্রিক মানুষেরা সত্যিই ভাবে এই পৃথিবীকে বাসযোগ্য গড়ে তোলা যায়, তাদের বোঝা উচিত,  সাম্রাজ্যবাদের বিরুদ্ধে ব্যাপক জনগণকে সমাবেশিত করার মাধ্যমে ও সঠিক বিজ্ঞানচর্চা দ্বারা মানুষকে ধর্মীয় মৌলবাদ থেকে মুক্ত করেই একমাত্র তা সম্ভব।

Share Now:

LEAVE YOUR COMMENT

Your email address will not be published. Required fields are marked *