পিপলস ম্যাগাজিন ডেস্ক: একচেটিয়া পুঁজির কিছু নির্দিষ্ট বৈশিষ্ট্য রয়েছে। তারা প্রতিযোগিতামূলক পুঁজিবাদের কথা মুখে বলে কিন্তু বাস্তবে রাজনৈতিক নেতা ও আমলাদের সঙ্গে অশুভ আঁতাত করে সবকিছু নিয়ন্ত্রণ করে। বিভিন্ন বৃহৎ কর্পোরেট সংস্থা নিজেদের মধ্যে বোঝাপড়া ও কার্টেল বানিয়ে গোটা দুনিয়ার বাজারকে নিজেদের মধ্যে ভাগাভাগি করে নেয়। উদ্যোগ, ঝুঁকি, সৃজনশীলতা- যেগুলি পুঁজিবাদের শুরুর দিনগুলিতে পুঁজিপতিদের বৈশিষ্ট্য ছিল, একচেটিয়া পুঁজির কালে সে সবই গৌণ হয়ে যায়। সবটাই হয়ে যায় বোঝাপড়া ও আঁতাতের খেলা। একেই বলা হচ্ছে লুঠেরা পুঁজিবাদ বা ক্রোনি ক্যাপিটালিজম। ঊনবিংশ শতকে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে এই পুঁজিবাদের প্রাণপুরুষ ছিলেন রকফেলার। ভারতে এই মুহূর্তে তার পথ ধরে চলছেন মুকেশ অম্বানি।
২০১৯ সালে গোটা দুনিয়ায় আর্থিক মন্দা চলছিল, সে সময় ভারতে প্রতি মাসে তিনজন করে নতুন বিলিয়নেয়ারের জন্ম হচ্ছিল(১ বিলিয়ন হল ১০০০ কোটির সমান)।বছর শেষে ভারতে মোট বিলিয়নেয়ারের সংখ্যা দাঁড়ায় ১৩৮(চিন ও আমেরিকার পরেই)।
মুকেশ এই মুহূর্তে ভারতের সবচেয়ে ধনী ব্যক্তি। এ বছর তিনি ইউরোপের সবচেয়ে ধনী বানার্ড আর্নল্টকে টপকে গিয়েছেন। তিনি এখন দুনিয়ার চতুর্থ সবচেয়ে ধনী মানুষ(জেফ বেজোস, বিল গেটস ও মার্ক জুকেরবার্গের পরেই)।দুনিয়ার উন্নয়নশীল দেশগুলির মধ্যে মুকেশই একমাত্র ব্যক্তি যিনি পৃথিবীর সবচেয়ে ধনী ১০ জনের মধ্যে রয়েছেন।
মজার ব্যাপার হল, ২০১৪ সালে, যখন বিজেপি কেন্দ্রে ক্ষমতায় আসে, তখন মুকেশ অম্বানির সম্পত্তির মূল্য ছিল ১৮.৬ বিলিয়ন ডলার। তখন তিনি ছিলেন পৃথিবীর চল্লিশতম ধনী ব্যক্তি। ছয় বছরে তার সম্পত্তি প্রায় সাড়ে চার গুন বেড়ে ৮০ বিলিয়ন ডলার টপকে গিয়েছে। তার মধ্যে এ বছরই তিনি অর্জন করেছেন ২২ বিলিয়ন ডলার(সাধারণ মানুষের এই দুর্দশার মধ্যেও)। প্রশ্ন হল, মুকেশের এই চমকপ্রদ উত্থানের পেছনে কী রয়েছে? ব্যবসায়িক ঝুঁকি ও উদ্যোগ নাকি ক্রোনি ক্যাপিটালিজম?
গত কয়েক দশকে মূলত বাণিজ্যিক সৃজনশীলতা ও উদ্যোগের অভাবেই ভারতের অর্থনীতি চিনের থেকে পিছিয়ে পড়েছে। গ্লোবাল ইনোভেশন ইনডেক্সে ভারতের স্থান বেশ খারাপ। পৃথিবীতে ৪৮ নম্বরে। ভারতে একটি বেশ বড়ো সংখ্যায় ইংরাজি-জানা কর্মী বাহিনী থাকলেও উৎপাদন ও প্রযুক্তির দিক থেকে ভারত, আমেরিকা, চিন ও জাপানের থেকে অনেকটাই পেছনে। বিশ্ব অর্থনীতিতে ভারতের অংশীদারিও খুবই কম। পরিকাঠামো, রসদ ও কলাকৌশল, সরবরাহ ব্যবস্থায় অদক্ষতা এবং দুর্নীতি- ভারতের উৎপাদনশীলতা কম হওয়ার পেছনে এই সবকটি কারণই রয়েছে।
কিন্তু সম্পদ তৈরির জন্য উৎপাদনশীলতা খুবই জরুরি বিষয়। উৎপাদন বাড়লে গোটা দেশের জীবনযাত্রার মানও বাড়ে। দেশির বৃদ্ধিও শক্তিশালী হয়। নাহলে অসাম্য বাড়ে, বাড়বাড়ন্ত হয় লুঠেরা পুঁজির।
সাম্প্রতিক তথ্য অনুযায়ী, ভারতের জনসংখ্যার নীচের তলার অর্ধেক মানুষ দেশের মোট সম্পদের মাত্র ৬.৪ শতাংশের মালিক। ওপরের তলার ১ শতাংশ মানুষের অধিকারে রয়েছে ৩০ শতাংশ সম্পদ। দ্য ইকোনমিস্টের হিসেব অনুয়ায়ী ক্রোনি ক্যাপিটালিজমের প্রভাব যে দেশগুলিতে সবচেয়ে বেশি, তাদের মধ্যে ভারত নবম স্থানে রয়েছে। ভারতের জিডিপির ৩.৪%-ই লুঠেরা পুঁজির দখলে।
১৯৯১ সালের অর্থনৈতিক সংস্কারের সময় ভারতের নীতি নির্ধারকদের মধ্যে একটি ঐক্যমত হয়েছিল। তা হল, অর্থনীতির উদারিকরণ হলে ব্যবসায়ী ও রাজনীতিবিদদের মধ্যে অশুভ আঁতাত শেষ হবে। ব্যক্তি পুঁজির বিকাশ হবে। অনেক বেশি মানুষ বিনা বাধায় পণ্য ও পরিষেবা ক্ষেত্রে ব্যবসা করতে পারবেন। তাতে সমাজের উন্নতি হবে।
কার্যত, আর্থিক সংস্কারের ফলে ব্যবসায়ী ও রাজনীতিবিদদের মধ্যে সম্পর্ক আরও জোরদার হল। ভারতের বাজার খুলে যাওয়ায় বড়ো বিনিয়োগকারীরা এল, রাজনৈতিক নেতাদের বিপুল পরিমাণ ঘুষ দিল। অনেক সময় রাজনীতিবিদরা নিজেরাই ব্যবসায়ী হয়ে গেল এবং সরকারি ব্যাঙ্কগুলিকে চাপ দিয়ে নিজেদের ঘনিষ্ট ব্যবসায়ীদের ঋণ দিতে বাধ্য করল।
বিজয় মাল্য, নীরব মোদি, মেহুল চোকসির মতো পলাতক ব্যবসায়ী এবং বড়ো বড়ো আর্থিক কেলেঙ্কারির ঘটনাগুলো আসলে সরকারি ক্ষমতার অপব্যবহারের উদাহরণ।মোদির জমানাতেও সেই ট্র্যাডিশন চলছে। তার বদলে মোদিকে সার্বিক সহযোগিতা করছেন মুকেশ অম্বানি(এবং আরেক উঠে আসা তারকা গৌতম আদানি)।
এদের পরস্পরের প্রতি প্রশংসা এবং সমর্থন খোলা চেখেই দেখা যায়। অম্বানি বেশিরভাগ সময়ই সরকারি সিদ্ধান্তগুলিকে খোলাখুলি সমর্থন জানান। মোদির নোটবন্দির সিদ্ধান্তকে তিনি ‘মোড় ঘোরানো’ সিদ্ধান্ত বলেছিলেন। যদিও ভারতীয় অর্থনীতিতে এই সিদ্ধান্ত বিপর্যয় বয়ে আনে।
গত ছ বছরে অম্বানি ও আদানির সম্পত্তি যথাক্রমে ৫ গুন ও ৩ গুন বৃদ্ধি পেয়েছে। অম্বানির এই সম্পদ বৃদ্ধির পেছনে কোনো সৃজনশীলতা নেই, রয়েছে একচেটিয়া ক্ষমতা। সব ক্ষেত্রেই তার একচেটিয়া ক্ষমতা রয়েছে। সে টেলিকম হোক, তেল হোক, খুচরো ব্যবসা হোক বা বিনোদন। বহুবারই তিনি ক্ষমতাসীন সরকারের রাজনৈতিক প্রভাব কাজে লাগিয়ে আইন পালটে নিজের স্বার্থে কাজে লাগিয়েছেন।
টেলিকমের বাজারে রিলায়েন্স জিও-র চমকপ্রদ প্রবেশের কথাই ধরা যাক। তিনি একাই ভারতের ডেটা চার্জ দুনিয়ার মধ্যে সবচেয়ে কম করে দিলেন। যার ফলে বাকি অপারেটররা দামের যুদ্ধে জড়িয়ে পড়ল।
এর ফলাফল হল মারাত্মক। বাকি ব্যবসায়ীদের আয়(খরচ বাদ দেওয়ার আগে) কমে ১৫ থেকে ৪০ শতাংশের মধ্যে চলে এল। তাদের ঋণ ও আয়(খরচ বাদ দেওয়ার আগে)-এর অনুপাত হয়ে গেল বিপজ্জনক। আইডিয়ার ক্ষেত্রে তা হল ৯:১।
ট্রাইয়ের নির্দেশিকা ছিল, কোনো সংস্থা ৯০ দিনের বেশি সময়সীমার কোনো বিপণনমূলক অফার দিতে পারবে না। রিলায়েন্স সেই নিয়ম মানছে না বলে সেলুলার অপারেটর্স অফ ইন্ডিয়া অ্যাসোসিয়েশন সরকারের কাছে হস্তক্ষেপ দাবি করে। সরকার তা না শুনে নিজের তৈরি করা নিয়মই পালটে দেয়। পাশাপাশি তার আগে কোনো সংস্থার নির্দিষ্ট পণ্যে বাজারে অংশীদারিত্ব ৩০ শতাংশের বেশি হলে, তা বিপজ্জনক হিসেবে চিহ্নিত ছিল। ট্রাই সেই নিয়মও পরিবর্তন করে। বর্তমানে রিলায়েন্সের মার্কেট শেয়ার ৩৪%।
একই ভাবে গত বছরের জানুয়ারিতে ভারত সরকার তার ই-কমার্স নীতি পরিবর্তন করে। নতুন নিয়ম অনুয়ায়ী, যে সব ই কমার্স সংস্থায় বিদেশি বিনিয়োগ রয়েছে, তারা তাদের মোট বিক্রির ২৫%-এর বেশি একটি নির্দিষ্ট পণ্য থেকে করতে পারবেন না। এর ফলে সমস্যায় পড়ে যায় অ্যামাজন ও ফ্লিপকার্ট। তারা উৎসবের মরশুমে তাদের মোট বিক্রির ৫০ শতাংশই করতো ওয়ান প্লাস, স্যামসাং ও জিয়াওমির মোবাইল ফোন। এর জন্য তারা ওই মোবাইলগুলিতে বিপুল ছাড়ও দিত।
এতে ক্রেতা এবং ই-কমার্স সংস্থা দুই পক্ষেরই লাভ হচ্ছিল। কিন্তু সরকার বলে বিদেশি এবং ভারতীয় সংস্থাগুলির লড়াইয়ের ময়দানে সমতা রক্ষা করার জন্যই তারা এই নীতি গ্রহণ করেছে।
কিন্তু সবচেয়ে বেশি লাভবান হয়েছে ভারতের বৃহৎ খুচরো ব্যবসায়ীরা। যাদের মধ্যে সবচেয়ে বড়ো রিলায়েন্স রিটেইল। সাম্প্রতিক মূল্যায়ন অনুযায়ী ২০২৪ সালের মধ্যে ভারতের ই-কমার্স ব্যবসার মূল্য বেড়ে দাঁড়াবে ৯৯ হাজার কোটি ডলার। ফেসবুকের সঙ্গে তাদের সাম্প্রতিক চুক্তির ফলে অনলাইন মুদি দ্রব্যের ব্যবসার অর্ধেকই থাকবে রিলায়েন্সের দখলে।
এদের চুক্তি অনুযায়ী জিওমার্ট এবং হোয়াটসঅ্যাপ এমন একটি প্ল্যাটফর্ম তৈরি করবে, যার মধ্যে দিয়ে ক্রেতাদের তাদের সবচেয়ে কাছের খুচরো ব্যবসায়ীর থেকে পণ্য নিতে পারবেন। এর মধ্যে দিয়ে জিওমার্ট ৩ কোটি খুচরো ব্যবসায়ীর সঙ্গে জুড়ে গেল। ফেসবুক ও রিলায়েন্সের ৫৭০০ কোটি টাকার চুক্তিটি ভারত সরকার ২ মাসের মধ্যে অনুমোদন করে দেয়। এটি প্রযুক্তি ক্ষেত্রে ভারতের সবচেয়ে বড়ো প্রত্যক্ষ বিদেশি বিনিয়োগ।
অবাক করা বিষয় হল, সরকার এই অনুমোদন দেওয়ার সময় নেট নিরপেক্ষতা নিয়ে বিন্দুমাত্র মাথা ঘামাল না। জিও(৩৮ কোটি ৮০ লক্ষ ব্যবহারকারী), ফেসবুক (৩২ কোটি ৮০ লক্ষ ব্যবহারকারী), হোয়াটসঅ্যাপ(৪০ কোটি ব্যবহারকারী)- প্রতিটি প্ল্যাটফর্মেই কোটি কোটি ভারতবাসীর ব্যক্তিগত তথ্য রয়েছে। এর ফলে তারা সম্মিলিত ভাবে প্রতিযোগীদের তুলনায় অনেক বেশি সুবিধা পাবে। যে সুবিধা অনৈতিক। বৃহত্তম টেলিকম ব্যবসায়ী হিসেবে জিও, ফেসবুক ও জিওকে অনেক বাড়তি সুবিধা দিতে পারবে।
এগুলি হল পরোক্ষ ভাবে সরকারি সাহায্য পাওয়ার ঘটনা। কিন্তু ২০১৮ সালে নরেন্দ্র মোদি জিওকে ভারতের সবচেয়ে বড়ো রাষ্ট্রায়ত্ত ব্যাঙ্ক, স্টেট ব্যাঙ্ক অফ ইন্ডিয়ার সঙ্গেও যুক্ত করে দেন। জিও পেমেন্টস ব্যাঙ্কের সঙ্গে রিলায়েন্সের ৩০:৭০ অনুপাতে যৌথ উদ্যোগ প্রতিষ্ঠিত হয়। যে পেমেন্টস ব্যাঙ্ক সবে ২০১৫ সালে অনুমোদন পেয়েছিল। এসবিআই-এর বিপুল সম্পদও এখন রিলায়েন্সের করায়ত্ত।
আরও বড়ো কথা হল, এসবিআই-য়ের চেয়ারউইম্যান অরুন্ধতী ভট্টাচার্যের আমলেই এই চুক্তি সম্পন্ন হয়। ২০১৭ সালের অক্টোবরে তিনি অবসর নেন। তারপর এক বছরের কুলিং অফ কাটিয়েই ২০১৮ সালে তিনি ৫ বছরের জন্য রিলায়েন্স ইন্ডাস্ট্রিজ লিমিটেডের নন এক্সিকিউটিভ ডিরেক্টর পদে যোগ দেন। স্বাভাবিক ভাবেই তার আমলে এসবিআই-রিলায়েন্সের সম্পর্কে গুরুতর স্বার্থের সংঘাতের প্রশ্ন জড়িয়ে রয়েছে।
এরকম অসংখ্যা উদাহরণ দেওয়া যায়, যেখানে দেশের স্বার্থকে জলাঞ্জলি দিয়ে মোদি সরকার বৃহৎ একচেটিয়া পুঁজিপতিদের স্বার্থকে অগ্রাধিকার দিয়েছে। তাই আজ যদি কৃষকরা মনে করেন, নয়া কৃষি আইনে তাদের স্বার্থ দেখা হয়নি, তাহলে তা অস্বীকার করা যায় না। রেকর্ড তেমনই।
প্রতিটি ক্ষেত্রেই কেন্দ্রীয় সরকার বাজার নিয়ন্ত্রণের বিধিনিয়মগুলি পালটে দিয়েছে। তার হাত ধরেই রিলায়েন্স প্রতিটি ক্ষেত্রে বাজারে সর্বাধিক নিয়ন্ত্রণ কায়েম করেছে এবং মুকেশের সম্পত্তি হুহু করে বেড়েছে। নিয়ন্ত্রক সংস্থাগুলো রাখার অর্থই খুঁজে পাওয়া যাচ্ছে না।
এর ফলে কারা কারা সবচেয়ে বেশি লাভবান হচ্ছে সেটা নিয়ে কেউ চাইলে চর্চা করতেই পারেন। কিন্তু হেরে যাচ্ছে ভারতের মানুষ, তাতে কোনো সন্দেহই নেই।