ব্রাহ্মণ্যবাদ বিজ্ঞানচেতনার শত্রু, সারা জীবনের চর্চায় তা প্রমাণ করে গিয়েছেন মেঘনাদ সাহা
১) ব্যাপক ঝড়বৃষ্টির রাতে জন্ম, ছেলের নাম হল মেঘনাথ। একটু বড় হতে মেঘনাথ শুনলেন রামায়ণ, পড়লেন মেঘনাদবধ কাব্য। একজন বিদ্রোহীর, একজন মহাবীর স্বাধীনতাকামীর প্রতি এক দরিদ্র বালকের তীব্র অনুরাগ তৈরি হল। মেঘনাথ নিজের নাম পাল্টে করলেন মেঘনাদ, যিনি স্বর্গ জয় করেছিলেন। বাংলার( বর্তমান বাংলাদেশের) নিম্নবর্ণের গরীব পরিবারে লেখাপড়ার তেমন চল ছিল না। ১৯০৫ সালে বঙ্গভঙ্গের বিরুদ্ধে গভর্নর সাহেবের স্কুল পরিদর্শন বয়কট করলেন মেঘনাদসহ কিছু ছাত্র, অবিলম্বে স্কুল থেকে বিতাড়িত সাথে সাথে ভোগে গেল সরকারি বৃত্তিটুকু।
পরে অঙ্ক নিয়ে ভর্তি হন প্রেসিডেন্সি কলেজে, উঠলেন ইডেন হিন্দু হোস্টেলে। মেঘনাদ ছোট থেকেই জেনে এসেছেন তিনি ‘নিচুজাত’-এর। ছোটবেলায় অনন্ত দাসের বাড়িতে বা ঢাকার হোস্টেলে কেউ তাঁকে গ্লাস দেয়নি, হাত পেতে জল খেতে হয়েছে। স্কুলে সরস্বতী পুজোর সময় জোর করে একবার মন্ডপ থেকে নামিয়ে দেওয়া হয়। ‘নবজাগরণের’ শহর কলকাতায় আলাদা কিছু হয়নি অবশ্য। ইডেন হোস্টেলে তাঁকে আলাদা করে বারান্দায় খেতে দেওয়া হয়। ১৯১৩ সালের ইডেন হোস্টেলে সরস্বতী পুজোর প্রাঙ্গনে মেঘনাদকে প্রবেশ করতে দেওয়া হল না। বিক্ষুব্ধ কিছু বন্ধুরা, জ্ঞানচন্দ্র ঘোষের নেতৃত্বে হোস্টেল ছেড়ে বেরিয়ে এলেন, মেস নিলেন ছানাপট্টীতে। এই মেস বা ইডেন হোস্টেলে থাকার সময় দেশিপ্রেমী মেঘনাদের সাথে আলাপ হয় বিভিন্ন বিপ্লবীর সাথে; বাঘা যতীন, পুলিন দাস আসেন এই মেসবাড়িতে। এই যোগাযোগ শেষ অবধি মেঘনাদকে আইএফএসে বসতে দিল না, গোয়েন্দা রিপোর্টে মেঘনাদের নামের পাশে ঢ্যাঁড়াকাটা।
ছোটোবেলা থেকে এই জাতপাতের রূপ, দেশপ্রেমের আবেগ তা মেঘনাদকে বরাবর দিশানির্দেশ করে গেছে। গজদন্তমিনারে বসে বিজ্ঞানচর্চা করার মানুষ তিনি ছিলেন না, বরং প্রকৃত অর্থেই হয়ে উঠেছিলেন গণবিজ্ঞানী।
আজ প্রায় একশ বছর পর ব্রাহ্মণ্যবাদী ফ্যাসিস্টরা যখন রাষ্ট্রক্ষমতা দখলের দিকে পা বাড়াচ্ছে, অতীত গৌরবের নাম করে হিন্দুত্ববাদী কুসংস্কারকে বিজ্ঞান হিসেবে চালাচ্ছে, জাতিভেদপ্রথাকে তাদের আদর্শগত ভিত্তি হিসেবে প্রতিষ্ঠা করছে তখন এই বিদ্রোহীর জীবন ও চিন্তা নতুন করে প্রাসঙ্গিক হয়। মেঘনাদ বিভিন্ন হিন্দুত্ববাদী অপবিজ্ঞানের বিরুদ্ধে আজীবন লড়াই করেছেন, ‘সবই ব্যাদে আছে’ তো আজকে কাল্ট লাইনে পরিণত হয়েছে, সেসব যুক্তি-তক্কো নিয়ে লেখাও অনেক হয়েছে। আমরা বরং এখানে বুঝতে চাইব বিজ্ঞানচর্চার সাথে ব্রাহ্মণ্যবাদের বিরোধটা কেন মৌলিক, সে কেন বরাবর বিজ্ঞানের প্রগতির পথে বাধা হয়ে দাড়িয়েছে।
২) ইতিহাসের দিকে তাকালে আমরা দেখব, ইন্দ্রিয়গ্রাহ্য জ্ঞান থেকে যুক্তিগ্রাহ্য জ্ঞানের স্তরে উল্লম্ফন ঘটে শ্রেণিসমাজে এসে। সেই অর্থে প্রাকৃতিক বিজ্ঞানে নির্দিষ্ট কিছু শ্রেণির অধিকারই স্বীকৃত। শ্রেণি সমাজে কায়িক শ্রম থেকে মুক্ত শ্রেণিটি শিক্ষা বিজ্ঞানচর্চা শুরু করে এবং প্রাথমিক ভাবে তা সমাজের উৎপাদিকা শক্তিকে বৃদ্ধি করতে তথা সামগ্রিকভাবে সামাজিক প্রগতিকেই সূচিত করে। কিন্তু পরবর্তীকালে উৎপাদন প্রক্রিয়া থেকে সম্পূর্ণ বিচ্ছিন্ন এই শ্রেণিটি প্রতিক্রিয়াশীল হয়ে ওঠে ও জ্ঞানচর্চা ও প্রগতির পথে বাধা হয়ে দাঁড়ায়। নিজেদের শোষক অবস্থানকে টিকিয়ে রাখার জন্য এই কায়েমী শ্রেণিটি একদিকে কায়িক শ্রমকে নিচু দেখানো শুরু করল, অন্যদিকে নানান ‘সুপারবিইং’ এর অবতারণার মাধ্যমে শোষণকে স্বাভাবিক দেখানো হতে থাকল।
কায়িক শ্রমের সাথে মানসিক শ্রমের এই বিচ্ছিন্নতার আলোকেই আমরা মেঘনাদ সাহার বিজ্ঞানদর্শন বুঝে উঠতে পারব৷ ছোটবেলা থেকে জাতপাতের মধ্যে বেড়ে ওঠার পথে এবং একজন বিশ্বস্থানীয় বিজ্ঞানী হিসেবে তিনি আসল শত্রুকে চিহ্নিত করে গেছেন বরাবর।
ব্রাহ্মণ্যবাদ তার জন্মলগ্ন থেকেই প্রতিক্রিয়াশীল, ইতিহাসে কোনোদিন কোনো ইতিবাচক দিক তার ছিল না। মেঘনাদ লিখছেন “শিল্পী, কারিগর ও স্থপতির স্থান এই সমাজের অতি নিম্নস্তরে এবং হিন্দু সমাজে হস্ত ও মস্তিষ্কের কোনো যোগাযোগ নাই।” আর একটি প্রবন্ধে তিনি বলছেন, ” আমার মতে এই জাতিভেদপ্রথা হস্ত ও মস্তিষ্কের মধ্যে যোগসূত্র সম্পূর্ণ ছিন্ন করিয়া দিয়াছে এবং এইজন্য ভারতে বস্তুতান্ত্রিক সভ্যতা ইউরোপ-আমেরিকার বহু পশ্চাতে পড়িয়া রহিয়াছে। যিনি বুদ্ধিজীবী, তিনি চিরকাল পুস্তকগত বিদ্যা, টীকাটিপ্পনী, ব্যাকরণদর্শনের তর্ক নিয়া ব্যস্ত আছেন এবং লোককে বিদ্যার দৌড় দেখাইয়া চমক লাগানোই মধ্যযুগের ভারতীয় পন্ডিতদের আদর্শ ছিল। বাস্তবজীবনের সহিত তাহাদের সংস্রব খুবই কম ছিল।….বস্ত্রবয়ন, ভূমিকর্ষণ, স্থপতিবিদ্যা, ধাতুবিদ্যা, যুদ্ধবিদ্যা ইত্যাদিতে বহুকাল হইতে ভারতে নূতন কোনো প্রক্রিয়া উদ্ভাবিত হয় নাই। ইহার কারণ জাতিভেদপ্রথা অনুসারে মস্তিষ্কের কাজকে খুব বড় করিয়া এবং সমস্ত হাতের কাজকে হেয় করিয়া দেখা, সেজন্য মস্তিষ্ক ও হাতের যোগসূত্র সম্পূর্ণ ছিন্ন হইয়া গিয়াছে।”
মস্তিষ্কের উপর এই মাহাত্ম্য আরোপ শ্রেণিসমাজের বৈশিষ্ট্য হলেও ব্রাহ্মণ্যবাদ তাকে আরো তীব্রভাবে ব্যবহার করেছে; ‘বৈদিক অসভ্যেরা'(সাহার ব্যবহৃত শব্দবন্ধ) জাতিভেদপ্রথার মাধ্যমে বিজ্ঞানচর্চা ও প্রগতির সমস্ত দ্বাররুদ্ধ করে দেয়। বৌদ্ধ ও জৈন ধর্মের আমলে, ‘ভারতের ইতিহাসে সর্বাপেক্ষা গৌরবময় যুগ’, শল্যবিদ্যা গণিত বা জ্যোতির্বিজ্ঞানে যে উন্নতি শুরু হয়, ইতিহাস জানাচ্ছে ব্রাহ্মণ্যবাদের পুনরুত্থানে আবার সেই অন্ধকারে নিমজ্জিত হয় ভারতের উন্নতিকল্প। নিজেদের মৌরসীপাট্টা ধরে রাখতে ব্রাহ্মণ্যবাদ নিম্নবর্ণের মানুষের সমস্ত ধরণের জ্ঞানচর্চায় বাধা দেয়। সাহার ভাষায় ” শূদ্র শাস্ত্র অধ্যয়ন করিলে সে ব্রাহ্মণের প্রাধান্য মানিবে না, সুতরাং তাহাকে শাস্ত্রশিক্ষার অধিকার থেকে বঞ্চিত করিতে হইবে। এইজন্য প্রথম বা দ্বিতীয় শতাব্দীতে মনুমহারাজের মুখ দিয়ে বলানো হইয়াছে যে শূদ্র যদি বেদ পড়ে, তাহা হইলে তপ্ত শিসা ঢালিয়া তাহার মুখ বন্ধ করিতে হইবে।”
৩) শান্তিনিকেতনে একটি বক্তৃতার প্রেক্ষিতে মেঘনাদ সাহার সাথে হিন্দুত্ব পুনরুত্থানবাদীদের ধারাবাহিক বিতর্কের শুরু হয়। ফ্যাসিস্টদের ‘অতীত গৌরবের খোঁজে’ যে যাত্রা, তা আদতে এই ব্রিটিশ অনুগ্রহে বেড়ে ওঠা শ্রেণিটির মধ্যেই দেখা গেছিল সেটা আজকে আর কারুর অজানা নয়। মজার ব্যাপার হল, ওইসব ধারাবাহিক প্রবন্ধে হিন্দুত্ববাদীদের যেসব ‘সবই ব্যাদে আছে’কে খন্ডন করেছিলেন সাহা, আজকে ফ্যাসিস্টদের বাণী তার থেকে আলাদা কিছু না। বরং সময়ের সাথে ভাটের যুক্তিতে ভাট ক্রমশ বেড়েছে, যুক্তিটা ‘দেশদ্রোহের’ দিকে ঠেলে। আসলে এই পরজীবী শ্রেণিটি আধুনিক বিজ্ঞানকে নিজেদের বিকৃত দর্শনে আত্মীকরণের চেষ্টা চালিয়েছিল, মেঘনাদ সাহা তারই বিরুদ্ধে বিদ্রোহ করেন। বিবর্তনতত্ত্ব, জ্যোতির্বিজ্ঞান, শল্যশাস্ত্রএর সেসব খন্ডন নিয়ে আগ্রহীরা আরো পড়তে পারেন। কিন্তু আমাদের লক্ষ্য ছিল এটা বোঝা , হিন্দু ফ্যাসিস্টরা যে ‘প্রাচীন বিজ্ঞানের গৌরবের’ অর্গাজমে ভোগে, মেঘনাদ সাহা দেখিয়েছিলেন মূলগতভাবেই ব্রাহ্মণ্যবাদ নিজেই সেই চর্চাকে সম্ভব হয়ে উঠতে দেয় না। বরং প্রাচীন ভারতের যা কিছু গৌরবময় ব্যাপার ছিল, ফ্যাসিস্টদের পেয়ারের ব্রাহ্মণ্যবাদ তার ধ্বংসসাধন করেছে।
জাতীয়তাবাদী আন্দোলনে সাহায্য, ব্রাহ্মণ্যবাদের বিরুদ্ধে রুখে দাঁড়ানো বা পরবর্তীকালে সক্রিয় রাজনীতিতে অংশগ্রহণ করে জনগণের স্বার্থে বিজ্ঞান প্রযুক্তিকে ব্যবহারের পক্ষে সওয়াল বা জনগণের অর্থনীতির জন্য কাজ করাটা আসলে মেঘনাথ থেকে মেঘনাদ হয়ে ওঠার যাত্রাপথেই সুপ্ত ছিল। আজকে সাম্রাজ্যবাদের দালাল ও সামন্ততান্ত্রিক ব্রাহ্মণ্যাবাদীদের যৌথ আঁতাত যখন ভারতের বৃহৎ সংখ্যক শ্রমজীবী মানুষকে ধ্বস্ত করছে, তখন এই মহান বিজ্ঞানীর দর্শনকে দ্বান্দ্বিক চর্চার মাধ্যমে হাতিয়ারে পরিণত করাটাই সঠিক শ্রদ্ধার্ঘ্য হতে পারে।