অতিমারিকে কাজে লাগিয়ে আমজনতার রক্ত শুষে নিচ্ছে বিশ্বের ধনকুবেররা: অক্সফ্যামের রিপোর্ট
পিপলস ম্যাগাজিন ডেস্ক: এই অতিমারিরর সময়েও দুনিয়ার বৃহৎ পুঁজিপতিরা জনগণের ওপর লুঠপাট চালিয়ে তাদের পকেট ভরিয়েই চলেছে। গত ৯ সেপ্টেম্বর অক্সফাম প্রকাশিত ‘পাওয়ার, প্রফিট এন্ড দ্য প্যান্ডেমিক’ শীর্ষক প্রতিবেদনে এই ছবি প্রকাশ পেয়েছে। বিশ্বের বৃহৎ ২০টি অসরকারি দাতব্য সংস্থার অলাভজনক জোট হল অক্সফ্যাম। ১৯৪২ সাল থেকে এই সংগঠন দারিদ্র্য দূরীকরণে কাজ করে চলেছে। এই অভূতপূর্ব সামাজিক এবং অর্থনৈতিক সংকট কালে প্রায় ১ কোটি মানুষের জীবন বিপন্ন কোভিডের কারণে, কাজ হারিয়েছে প্রায় ৪০কোটি মানুষ, ৪৩ কোটি ছোটো ব্যবসা প্রায় বন্ধের মুখে আর তার সাথে অনাহারের কবলে পড়েছে প্রায় সাড়ে ২৬ কোটি মানুষ যা সাধারণ অবস্থার থেকে প্রায় দ্বিগুন। এই পরিসংখ্যান থেকেই স্পষ্ট কিভাবে সমাজের ধনী শ্রেণি সাধারণ মানুষের থেকে অতিরিক্ত পরিমাণ মুনাফা লুটছে এবং তার জন্য এই অতিমারি পরিস্থিতিকে কাজে লাগাতে মরিয়া হয়ে উঠেছে।
মানুষের জীবনের চেয়ে বিভিন্ন বহুজাতিক সংস্থা এবং তার কোটিপতি মালিকদের মুনাফা অর্জনকে বেশি গুরুত্ব দেওয়ার মতো ন্যাক্কারজনক আচরণ মোটেই অবাক করার মতো নয়। একজন শুভবুদ্ধিসম্পন্ন মানুষের পক্ষে এটা বোঝা কঠিন নয় যে ,এক দীর্ঘস্থায়ী বৈষম্য, যা আগেও চলে আসছিলো তা কেবল আরো উন্মুক্ত হয়ে গেলো এই সংকটময় পরিস্থিতিতে। অক্সফ্যাম প্রদত্ত তথ্য ও উদাহরণ- এর মাধ্যমে যে ভয়াবহ চিত্র ফুটে উঠেছে তা শুধু হৃদয়বিদারকই নয়, একইসঙ্গে রক্ত গরম করে দেওয়ার জন্য যথেষ্ট। শাসক সম্প্রদায় যে নির্মমভাবে সাধারণ মানুষের জীবন ও জীবিকাকে অবজ্ঞা করে, তার নির্ভেজাল প্রমাণ পাওয়া যায় এই প্রতিবেদনের বিভিন্ন চিত্র ও বর্ণনার মাধ্যমে। এর মধ্যে দিয়ে উঠে আসে এক অধোগামী এবং পচাগলা ব্যবস্থার স্বরূপ।
দারিদ্র্যের মাঝে মুনাফা
অক্সফ্যামের প্রতিবেদন থেকে জানা যায়, সারা বিশ্বের সবথেকে বড়ো সংস্থাগুলোর মধ্যে ৩২ টি বহুজাতিক সংস্থার ২০২০ সালে মুনাফার পরিমাণ বৃদ্ধি পেয়েছে প্রায় ১০৯০০ কোটি ডলার আর ঠিক এই সময়কালের মধ্যেই প্রায় ৫০কোটি মানুষ পড়েছে প্রবল দারিদ্র্যের কবলে। GAFAM (গুগল, অ্যাপেল, ফেসবুক, আমাজন, মাইক্রোসফট) এই ৫ টি বড়ো তথ্যপ্রযুক্তি সংস্থা ৪৬০০ কোটি ডলারেরও বেশি মুনাফা কমিয়েছে এই অতিমারির মধ্যে। দেখা যাচ্ছে বিশ্বের সর্ববৃহৎ ওষুধ কোম্পানিগুলির মুনাফা বৃদ্ধির হার বেড়েছে প্রায় ২১% , যার অর্থমূল্য প্রায় ১২০০ কোটি ডলার। ২০২০ তে প্রায় ১০০ টি সংস্থা শেয়ার বাজারে দর বাড়িয়েছে প্রায় ৩ লক্ষ কোটি ডলার পরিমাণ। আমাজন-এর কর্ণধার জেফ বেজোস লকডাউন পরবর্তী সময়ে নিজের ব্যাক্তিগত সম্পত্তির পরিমাণ বাড়িয়েছে প্রায় ৯২০০কোটি ডলার। অক্সফ্যাম-এর হিসেব অনুযায়ী ওই পরিমাণ অর্থে আমাজনের মোট ৮,৭৬,০০০ জন কর্মচারীকে পুরো বেতন দিয়ে আরও ১,০৫,০০০ ডলার বোনাস হিসাবে দিলেও যে পরিমাণ মুনাফা বাঁচবে, তা এ বছর মার্চ মাসে হওয়া আমাজনের মুনাফার সমান। কিন্তু তা সত্ত্বেও কর্মচারীদের কম বেতনের বিনিময়ে কাজ করতে বাধ্য করাচ্ছে আমাজন এবং তাদের নিরাপত্তার কোনো ব্যবস্থা করার প্রয়োজনও বোধ করছে না।
অক্সফ্যাম আরো উদাহরণ দিয়েছে। ভারতীয় চা কোম্পানিগুলি তাদের মুনাফার হার বাড়িয়ে চলেছে বা বজায় রেখেছে মূলত মহিলা চা শ্রমিকদের বেতন দেওয়া বন্ধ করে। খুচরো কাপড়ের ব্যবসায়ী কোহল এবছর প্রায় ১৫ কোটি ডলারের অগ্রিম অর্ডার বাতিল করেছে ,তাও তার হাতে মুনাফার অঙ্ক প্রায় ১১ কোটি ডলার। অথচ তারা কোনোরকম সামাজিক নিরাপত্তার ব্যবস্থা ছাড়াই বাংলাদেশ ও কোরিয়া থেকে আসা কর্মচারীদের বেতন না দিয়েই বাড়ি পাঠিয়ে দিচ্ছে। শুধু বাংলাদেশেই প্রায় ২ কোটি্ ২০ লক্ষ মানুষ পথে বসেছে এই বস্ত্রশিল্পের কারণে। কারখানা বন্ধের কারণে রাষ্ট্র রাজস্ব খুইয়েছে প্রায় ৩০০ কোটি ডলার । অপর দিকে ১০টি বড় পোশাক সংস্থা তার লভ্যাংশের থেকে শেয়ার হোল্ডারদের ২১০০ কোটি ডলার দিয়েছে।
প্রতিবেদনে আরো দেখানো হয়েছে, আমেরিকার জীবাশ্ম জ্বালানির সংস্থা চেরভন তার মোট ৪৫,০০০ কর্মচারীর মধ্যে ১০-১৫% ছাঁটাই করেছে অথচ এবছরের প্রথম ৪ মাসে তারা লভ্যাংশের বিপুল পরিমাণ অর্থ শেয়ার হোল্ডারদের হাতে তুলে দিয়েছে। এরকমই নাইজেরিয়ার সবথেকে বড় সিমেন্ট কোম্পানি Dangote cement প্রায় ৩০০০ কর্মচারী ছাঁটাই করেও ১৩৬% লভ্যাংশ শেয়ার মালিকদের দিয়েছে।
মারাত্মক শোষণ
এই প্রতিবেদন থেকে আমরা দেখতে পাচ্ছি, কীভাবে বড়ো সংস্থাগুলির মুনাফা অর্জনের লোভ তাদের হাজার হাজার কর্মচারীকে মৃত্যুর মুখে ঠেলে দিচ্ছে। যেমন দেখা গেছে, করোনা দাবানলের মতো ছড়িয়ে পড়েছে মাংস প্রক্রিয়াকরণ শিল্পের শ্রমিকদের মধ্যে। আমেরিকার প্রায় ২৭,০০০ মাংস প্যাকিং শ্রমিক করোনা পজিটিভ। কিন্তু তারপরেও সেখানকার সবচেয়ে বড় মাংস প্রস্তুতকারী সংস্থা Tyson foods সরকারের এক অংশের সঙ্গে লবি করে, প্রচুর সময় ও অর্থ ব্যয় করেছে শুধু যাতে তাদের প্লান্টটা বন্ধ না হয়ে যায়। ব্রাজিলের মাংস কোম্পানি JBS, যাদের সরকারকে ঘুষ খাওয়ানোরও ইতিহাস আছে, এই পরিস্থিতিতেও সরকারকে ঘুষ দিয়ে চাপ সৃষ্টি করে খাদ্য শ্রমিকদের নিরাপত্তা সংক্রান্ত এবং শারীরিক দূরত্ববিধিগুলিকে নতুনভাবে তৈরি করার জন্য। সেখানে ইতিমধ্যেই প্রায় ১০০ জন শ্রমিক করোনায় আক্রান্ত। প্রতিবেদনের শুরুতে একটি উক্তি আছে মেরিল্যান্ড-এর একজন মৃত পোল্ট্রি শ্রমিকের স্ত্রীর। তিনি বলেছেন – “ওদের শ্রমিক দরকার বেশি পরিমাণ মুনাফা লাভের জন্য কিন্তু তাতে কে বাঁচলো না মরলো তাতে কিছু এসে যায় না। চিকেন প্লান্ট এখনো চলছে, এখনো মুনাফা লাভ করছে তা থেকে, কিন্তু ওদের যদি শ্রমিকদের স্বাস্থ্য সম্পর্কে কোন খেয়াল থাকতো, যদি তারা অসুখটা সম্পর্কে জানাতেন তাহলে হয়তো এরকম হতো না”। প্লান্ট- এর লোকজনরা জানতেন তার স্বামীর রোগের লক্ষণগুলি সম্পর্কে, কিন্তু তাও তাকে কাজ করতে বাধ্য করা হয়।”
আরও মৌলিকভাবে দেখতে গেলে তার বক্তব্যের মধ্যে শ্রমিকশ্রেণির মধ্যে ক্রমশঃ বেড়ে চলা শ্রেণি চেতনতার ছাপ স্পষ্ট। কারণ এই অতিমারির সময়ে তাদের ভুগতে হচ্ছে, প্রাণ দিতে হচ্ছে মালিকদের অবহেলার কারণে। খাদ্য পরিবহন সংস্থাগুলো ভীষণ ধাক্কা খেয়েছে তাদের ফাঁপা আত্মনির্ভর মডেলের জন্য যেখানে শ্রমিকদের নেই কোনোরকম প্রাথমিক অধিকার, নেই অসুস্থতাকালীন ছুটি বা স্বাস্থ্যসুরক্ষার বিষয়টিও। প্রতিবেদনে দেখানো হয়েছে কিভাবে অধিকারের দাবিতে, নিরাপত্তা এবং স্বাস্থ্যসুরক্ষার দাবিতে সারা বিশ্বে ধর্মঘট হয়েছে। আমেরিকার ইনস্টাকার্ট এবং ভারতের সুইগি, জোম্যাটো এর প্রকৃষ্ট উদাহরণ।
অন্য এক জায়গায় বলা হয়েছে কীভাবে বিশ্বের কল সেন্টার এজেন্সি টেলিপারফর্মান্সও ধাক্কা খেয়েছে কর্মচারীদের পুরোপুরি নিরাপত্তা দেওয়ায় অনীহার কারণে। এর মধ্যেই সংস্থাগুলো আবার শ্রমিকদের বিরুদ্ধে প্রতিশোধমূলক ব্যাবস্থাও নিচ্ছে একাধিক দেশে।
অক্সফ্যাম ব্যাখ্যা করেছে- পেরু, মেক্সিকো এবং গুয়াতেমালাতে খনি শ্রমিকদের প্রায় ১০০ জনের করোনা ধরা পড়ার পরেও কাজ চলছে কোনো নিরাপত্তার ব্যবস্থা ছাড়াই। আরও দেখানো হয়েছে কীভাবে লকডাউন-এর মধ্যে শ্রমিকের অভাবে আফ্রিকার কোকো ফার্মগুলিতে শিশুশ্রমিক-এর হার অস্বাভাবিক বেড়েছে। থাইল্যান্ড-এর সিফুড শ্রমিকেরা কাজ ছেড়ে দিচ্ছে এবং প্রতিরোধ গড়ে তুলছে কারণ করোনা , ‘গ্লোবাল সাপ্লাই চেন’- এ প্রভাব ফেলার সাথে সাথে তাদের স্বাস্থ্যসুরক্ষার বিষয়টিও প্রকাশ্যে এনে দিচ্ছে যেখানে তাদের এতদিন সম্পূর্ণ অসুরক্ষিত অবস্থায় কাজ করতে হতো।
ত্রাণের রাজনীতি
মূলধারার মিডিয়াগুলি বর্তমানে শুধু কর্পোরেট সংস্থাগুলির উদারতার গল্পে ছেয়ে গেছে। হ্যাঁ ,এখনও মালিকেরা মুনাফা লাভ করে চলেছে শ্রমিকদের মৃত্যুর মুখে ঠেলে দিয়ে কিন্তু তারা দেখাতে চাইছে যে এটা সমাজের উপকারের জন্যই। কারণ তারা জনকল্যাণে প্রচুর পরিমাণ অর্থ খরচ করছে বিভিন্ন দাতব্য সংস্থায় , NGO তে।
অক্সফাম-এর প্রতিবেদনে এই প্রচারের আসল রূপ তুলে ধরা হয়েছে। দেখা গেছে ২০১৯ সালে বড়ো সংস্থাগুলি মোট উপার্জনের মাত্র ০.৩২% দান করেছে। অথচ সেই কারণে তারা রাজস্ব ছাড় পেয়েছে প্রায় ১৩,৫০০ কোটি ডলার কিন্তু তাদের দান করা অর্থের মোট পরিমাণ মাত্র ২০০০ কোটি ডলার। দেখা গেছে বেশিরভাগ সংস্থা বাধ্যতামূলক কাজ, যেমন কর দেওয়া বা শ্রমিকদের বেতন মেটানোর পরিবর্তে স্বেচ্ছাসেবী কার্যকলাপকে বেশি গুরুত্ব দেয় কারণ সেটাকে তুলে ধরা যাবে মানুষের সামনে। তার সাথে তারা এতে কর দেওয়া থেকেও নিস্তার পায়। এটাও তাদের এক ধরণের বিপণন কৌশল যা আদৌ সমাজের কোনো কাজে লাগে না।
সরকারের ভূমিকা
যদিও এই প্রতিবেদনের কেন্দ্র হচ্ছে এই অতিমারির সময়েও কর্পোরেট দের ক্রমবর্ধমান লোভ কিন্তু তা দেখাতে গিয়ে কোম্পানিগুলির সাথে সরকারের অশুভ আঁতাতও প্রকাশ পেয়ে গেছে। আমাদের কাছে এরকম অনেক উদাহরণ আছে যেখানে সরকার এই পরিস্থিতির সুযোগ নিয়ে বড় ব্যবসায়ীদের সুবিধা করে দিচ্ছে। এমনকি তাদের স্বার্থে অতিমারির নির্দেশিকাও বদলে দিচ্ছে। অথচ সেই সংস্থাগুলি কর্মচারীদের পথে বসিয়ে বিপুল পরিমাণ মুনাফা লাভ করছে। সরকার তাদের সুবিধার্থে কেইনেসিয়ান স্টিমুলাস প্যাকেজ -এর মতো বিভিন্ন প্যাকেজ ঘোষণা করছে। সেসব সংস্থাগুলির করও মাফ করে দেওয়া হচ্ছে এমনকি যাদের আগেও কর ফাঁকি দেওয়ার ইতিহাস রয়েছে তাদেরও। রয়টার্স- এর তথ্যানুযায়ী প্রায় ৪০% করদাতা ৪০ লক্ষ ডলার- এর থেকেও বেশি কর ফাঁকি দিয়েছে শেষ বছর পর্যন্ত। আবার আমেরিকা সরকারের রিলিফ ফান্ড যা মূলত ছোটো ব্যাবসায়ীদের জন্য বানানো হয়েছিল কিন্তু বড়ো কোম্পানিগুলি তার থেকে সুযোগ নিচ্ছে। ১৯ টা জীবাশ্ম জ্বালানি সংস্থা প্রায় ১লক্ষ ২০হাজার কোটি ডলার কর ছাড় পেয়েছে, যার মধ্যে ২৯%সরকারের থেকে ঋণ নিয়েছে এবং আগে কর ফাঁকি দেওয়ার সাথেও যুক্ত। আসলে কোম্পানিগুলির একটা বড় অংশ এখনো সর্বসমক্ষে ধরা পড়েনি। এটা অবশ্যম্ভাবী যে বড়ো কোম্পানিগুলির প্রতিনিধি, যারা সরকারের বিভিন্ন পদে আছে তারা কোম্পানির স্বার্থেই কাজ করছে এই সংকটকালীন পরিস্থিতিতেও। আমেরিকার লবিয়িস্ট রা এখন আগের চেয়ে বেশি তদবির করে চলেছে এবং সে কারণে বছরের প্রথম ৩ মাসেই প্রায় ৯৩ কোটি ডলার খরচ করেছে। অক্সফ্যাম দেখিয়েছে বিভিন্ন পন্থা, যার মাধ্যমে এই পরিস্থিতিও কর্পোরেটদের সাফল্য এনে দিয়েছে। আমেরিকার খাদ্য প্রস্তুতকারী সংস্থা থেকে মেক্সিকোর বস্ত্রশিল্পের বহু কোম্পানি নিজেদের কাজ চালিয়ে গেছে WHO বা স্থানীয় প্রশাসন-এর কোনোরকম নির্দেশিকা না মেনেই। ভারতীয় লবিয়িস্টরা সক্ষম হয়েছে স্টক পুনঃবিক্রির উপর শুল্ক বন্ধ করতে এবং একত্রিতভাবে খনিগুলিকে করমুক্ত করতে। ইউরোপিয়ান ইউনিয়ন-এর অধীন বিভিন্ন সংস্থা বিশেষকরে বিমান সংস্থাগুলি পরিবেশ রক্ষা এবং CO2 নির্গমণের নিয়মগুলিকে অমান্য করতে করোনা পরিস্থিতির অজুহাত দিচ্ছে।
সরকারগুলি অনিচ্ছা সত্ত্বেও বিভিন্ন ব্যবস্থা গ্রহণ করতে বাধ্য হচ্ছে এই অর্থনৈতিক ও সামাজিক বিপর্যয়কে রোধ করতে যা প্রধানত সর্বসাধারণের চোখে ধুলো দেওয়ার কৌশলমাত্র। এই প্রতিবেদন থেকে বোঝা যায় যে সরকার আসলে কাদের পক্ষে। একের পর এক দেশের সরকার ক্রমশই প্রমাণ করে চলেছে যে তারা একমাত্র ধনীদের স্বার্থই দেখে।
অতীতকে নতুনভাবে গড়ে তোলা – একটা ভ্রান্ত ধারণা
অনেকে মনে করেন পৃথিবী এই অতিমারির সময়ে আবার পরিশুদ্ধ হচ্ছে এবং এটা বসুন্ধরার সামনে আরও একটা সুযোগ এনে দিলো। অক্সফ্যাম-এর রিপোর্টে যে নিরবিচ্ছিন্ন সম্পদের কেন্দ্রীকরণ এবং বর্বর শোষণের চিত্র ফুটে উঠেছে তা চোখে আঙ্গুল দিয়ে দেখিয়ে দিয়েছে, এই ধারণা কতটা ভ্রান্ত । কিভাবে করোনা সংকট তৈরি হয়েছে , এই প্রতিবেদন সেই তর্কে যায় না বরং বলে একটা উদ্বেগপূর্ণ অর্থনৈতিক প্রবণতা সম্পর্কে যা করোনার কারণে আরো গতিশীল হয়েছে। পুঁজিবাদী সমাজে অর্থনৈতিক সংকট আগে থেকেই ছিল যা এই পরিস্থিতিতে আরো স্পষ্ট এবং গভীরভাবে প্রকাশ পেয়েছে। ভিন্ন শ্রেণি র মধ্যে মোট সম্পদের পার্থক্যটা ক্রমেই বেড়ে চলছিল যা এখন ভীষণ স্পষ্ট।
পুঁজিবাদের পথে কোনো দিশা নেই
যাইহোক, কল্পনা করা যায় পুঁজিবাদী বাবস্থাতেও চিত্রটা অন্য হতো যদি বড়ো সংস্থাগুলি শেয়ার মালিকদের বিপুল পরিমাণ অর্থ না দিতো এবং মালিকেরা যদি অন্য পথ বেছে নিতে পারতো। সাইবার প্রযুক্তি সংস্থা Vera র মতে – “আমাদের বেছে নিতে হবে প্রচলিত ব্যবসায় ফিরে যাওয়া এবং এই অবস্থা থেকে শিক্ষা নিয়ে একটা স্বচ্ছ ও টেকসই অর্থনীতির দিকে এগিয়ে চলার মধ্যে।” এখানে আমাদের বলতে ওরা বুঝিয়েছেন সমাজের শাসকশ্রেণির মানুষদের যারা সবকিছুকে নিজেদের স্বার্থে ব্যবহার করতে চায় এবং সরকারকেও নিয়ন্ত্রণ করে।
কার্ল মার্ক্স্ দেড়শো বছর আগে তাঁর ‘পুঁজি’ বইতে ব্যাখ্যা করেছেন ১৫০ বছরের আগে কিছু হাতে গোনা মানুষের হাতে সম্পদের একত্রিত হওয়ার কথা। অক্সফ্যাম- এর এই প্রতিবেদন স্বীকার করছে যে বিভিন্ন পন্থায় শাসকশ্রেণি শ্রমিকদের উৎপাদিত সম্পদের আরো বেশি অংশ কেড়ে নিতে সক্ষম হয় (যেমন স্টক পুনঃক্রয় ইত্যাদির মাধ্যমে) এবং এটা নতুন কিছু নয়। এবং যখন Vera বলছে, শাসকশ্রেণি ক্ষমতা এবং প্রশাসন দুইয়ের জোরেই সাধারণের নীতিগুলিকে নিজেফের মতো আকার দিতে পারে; তখন তারা কীভাবে ধরে নিলেন যে পরেও ক্ষমতা এবং সম্পদ শাসকশ্রেণি নিয়ন্ত্রণ করবে না?
একটা কারণ অবশ্যই আছে। অক্সফ্যাম নিজেও পুঁজিবাদী ব্যাবস্থার বাইরে কিছু ভাবেনি। হালে, তাদের ৬ অঙ্কের বেতন পাওয়া কর্মচারীদের সংখ্যাটাও বেড়েছে। উল্লেখ্য যে অক্সফাম যেহেতু নিজেই একটা দাতব্য সংস্থা এবং এই সমাজেরই একটা অংশ যে শুধু পুঁজিবাদী সমাজের এই দিকগুলো তুলে ধরেছে।
এই প্রতিবেদনটি আসলে চিহ্নিত করে সেইসব নীতি ও কৌশলকে যা পুঁজিবাদী সমাজের ধ্বংসের কারণ হয়ে দাঁড়াতে পারে। বস্তুত পুঁজিবাদীদের আচরণে গণতান্ত্রিক ব্যাবস্থার উপর মানুষের বিশ্বাস উঠে যাচ্ছে। একটা বিশৃঙ্খল অবস্থার সৃষ্টি হচ্ছে যা সংকট পরবর্তী একটা গুরুত্বপূর্ণ ফলাফল। আর কোনোভাবেই এই অবস্থার পুনর্নবীকরণ সম্ভব নয় যা বিশ্ব জুড়ে শ্রমিকশ্রেণির মধ্য গড়ে ওঠা ক্রোধকে প্রশমিত করতে পারে।
সমাজতান্ত্রিক প্রতিক্রিয়া
এই ব্যবস্থা যা প্রধানত সংখ্যালঘু কিছু মানুষের হাতে সংখ্যাগরিষ্টের শোষণ-এর উপর দাঁড়িয়ে , তার আর সংশোধন সম্ভব নয়। এই ব্যবস্থা কেবল দারিদ্র্য তৈরি করে ও এক শ্রেণিকে পরজীবীর মত বাঁচতে বাধ্য করে।
সমাজতান্ত্রিক সমাজে এই অর্থনৈতিক সমস্যার মোকাবিলা করার পন্থা সম্পূর্ণ ভিন্ন। এর লক্ষ্য সমস্ত সঞ্চিত সম্পদকে কাজে লাগিয়ে সাধারণের প্রাথমিক চাহিদা পূরণে ব্যবহার করা, সবার কর্মসংস্থান এবং প্রাপ্য বেতন দেওয়া এবং বিনামূল্যে স্বাস্থ্য সুরক্ষা প্রদান। শ্রমিকরা নিজেদের মধ্যে গণতান্ত্রিক সংগঠন তৈরী করবে এবং কীসে তাদের ভালো, তা নির্ধারণ করবে।
স্বাস্থকর্মীদের সুরক্ষা সরঞ্জাম- এর অভাব থাকবে না, থাকবে না এরকম কোনো বাধ্যবাধকতা যেখানে বেঁচে থাকার জন্য জীবনের ঝুকি নিতে হয়। অক্সফ্যামে প্রকাশিত মোট সঞ্চিত সম্পদ থেকে বিশ্বের প্রত্যেকটা মানুষের প্রাথমিক প্রয়োজনীতা মেটানো সম্ভব।
অক্সফামের প্রতিবেদনটি আমাদের ব্যবস্থা বদলের লড়াইয়ে যেন আগুনে ঘি ঢালার মতো । নতুন সেই ব্যবস্থা মানবজাতির মধ্যে লুকিয়ে থাকা বিপুল সম্ভাবনাকে মূর্ত চেহারা দেবে।