Home কৃষি শুধু কৃষি-বিল প্রত্যাহার নয়, কৃষক আন্দোলনে জুড়তে হবে আরও বেশ কিছু দাবি
0

শুধু কৃষি-বিল প্রত্যাহার নয়, কৃষক আন্দোলনে জুড়তে হবে আরও বেশ কিছু দাবি

শুধু কৃষি-বিল প্রত্যাহার নয়, কৃষক আন্দোলনে জুড়তে হবে আরও বেশ কিছু দাবি
0
সুমনকল্যাণ মৌলিক

কৃষক স্বার্থ বিরোধী তিনটি আইনের বিরুদ্ধে কৃষকদের বিক্ষোভ এই করোনা কবলিত সময়ে মুক্তির আশ্বাস নিয়ে এল। লকডাউন ও হাজারো আইন বিধির সাহায্যে করোনা আতঙ্ককে কাজে লাগিয়ে একের পর এক জনবিরোধী কর্মসূচিকে আগ্রাসী ভাবে লাগু করার যে কৌশল মোদি সরকার নিয়ে চলেছে, অন্তত একটা ক্ষেত্রে তার প্রত্যাঘাত হল। বিল পাশ করতে রাজ্যসভায় যে কুৎসিত নাটক আমরা দেখলাম তা অবশ্য নতুন নয়। সংসদীয় গণতন্ত্রের এই ধরনের অনির্বচনীয় লীলা আমরা গত ৭০ বছরে অনেক বার প্রত্যক্ষ করেছি। আসলে এ লড়াইয়ের ফয়সালা হবে রাস্তায়। কৃষকদের সংগঠিত প্রতিরোধের তীব্রতার উপর, সঠিক কর্মসূচি নির্ণয়ের ক্ষমতার উপর, কোনোরকম আপসের সামনে মাথা নত না করার শপথের উপর কৃষকদের আন্দোলনের সাফল্য নির্ভর করছে। প্রস্তাবিত আইনগুলির বিষয়বস্তু তথা ভালোমন্দ সংক্রান্ত আলোচনা ইতিমধ্যেই হয়েছে । বর্তমান নিবন্ধে আমরা পয়েন্ট আকারে আলোচনা করব আন্দোলনের যথার্থতা, পক্ষে- বিপক্ষে উঠে আসা মতামত ও লড়াইয়ের কর্মসূচির উপর।

আরও পড়ুন: নয়া কৃষি বিল: কর্পোরেট রাজকে ঠেকাতে হবে, পালটাতে হবে বর্তমান অবস্থাটাও

(১) প্রথমেই বলে নেওয়া ভালো যে নরেন্দ্র মোদি সরকার কর্তৃক পাশ করানো আইন তিনটি কোন বিচ্ছিন্ন ঘটনা নয়। ১৯৯০’ এর দশকে আর্থিক সংস্কারের নামে ‘ উদারীকরণ – বেসরকারিকরণ- ভুবনায়নের’ যে নীতি ভারতবর্ষের রাজনৈতিক দল, নীতিপ্রণেতা, মিডিয়া প্রায় ঐক্যমতের ভিত্তিতে গ্রহণ করে ( there is no alternative), তার প্রভাব সেই সময় থেকেই ভারতের কৃষি ক্ষেত্রে পড়ে। ১৯৯৪ সালে ভারত বিশ্ববাণিজ্য সংস্থার সদস্য হয়। ২০০০ সালে প্রথম বার ঘোষিত হয় ‘ ন্যাশানাল এগ্রিকালচার পলিসি ‘, ২০০২ সালে ঘোষিত হয় ‘ লং টার্ম গ্রেইন পলিসি’, ২০০৬ সালে  ‘ন্যাশানাল কমিশন অন ফার্মার্স’,তার পর আসে কুখ্যাত BRAI( biotech regulatory authority of india)। সেই ধারাবাহিকতায় এই নতুন তিনটি আইন। পার্থক্য শুধু একটাই, ২০১৪ সালে নরেন্দ্র মোদি তার নির্বাচনী প্রচারে কর্পোরেটদের প্রতি একটা বার্তা দিয়েছিলেন,তা হল কর্পোরেট নির্ধারিত সংস্কার কর্মসূচি (যার ভগীরথ অবশ্যই নরসিমা রাও- মনমোহন সিং যুগলবন্দি) রূপায়ণে তিনি অনেক বেশি নিয়মনিষ্ঠ ও আগ্রাসী হবেন। কর্পোরেট বিশেষজ্ঞদের অভিমত হল নব্বই-এর দশকে অর্থনীতির অন্যান্য ক্ষেত্রে যে ধরনের সংস্কার হয়েছে, কৃষি তার থেকে অনেক পিছিয়ে আছে। এই আইন তিনটির মধ্যে সেই অভাব পূরণের চেষ্টা রয়েছে।

(২)  এই আইনগুলোর সবচেয়ে বড়ো কথা হল সবুজ বিপ্লবের এক দশক পর থেকে রাষ্ট্র যেভাবে ধীরে ধীরে কৃষি ক্ষেত্র থেকে তার দায় অস্বীকার করছিল,তা এবার সম্পূর্ণ হল। সার, কীটনাশক, জ্বালানি, সেচ প্রভৃতিতে রাষ্ট্রের যে ভরতুকি ছিল তা বহুদিন আগে থেকেই খতম হচ্ছিল, এবার চুক্তি চাষের আড়ালে কৃষকের জমিতে কর্পোরেটের হাত পড়ল। নতুন পেটেন্ট আইন অনুসারে এবার থেকে বীজও তাকে বহুজাতিক সংস্থাগুলির কাছ থেকে কিনতে হবে। যে কথাটা আমাদের স্বীকার করতেই হবে যে ৯০’ এর দশক থেকে ভারতে কৃষিকাজ আর লাভজনক থাকছে না যার কারণ সরকারের উদাসীনতা, নীতিসমূহের পর্বতপ্রমাণ ব্যর্থতা, ফসলের ন্যায্য দাম না পাওয়া, অভাবি বিক্রি, বিমার বন্দোবস্ত না থাকা, চড়া সুদে মহাজনি ঋণ প্রভৃতি। সংকট এতটাই তীব্র যে গত ২৫ বছরে ভারতে সাড়ে তিন লক্ষ কৃষক আত্মহত্যা করেছেন। ভারতের প্রথম প্রধানমন্ত্রী জওহরলাল নেহেরু একদা মন্তব্য করেছিলেন – Everything else can wait but not agriculture.। কিন্তু স্বাধীনতার পর থেকে সুদিন ফিরবার প্রতীক্ষায় ভারতীয় কৃষকের শবরীর প্রতীক্ষা আজও শেষ হয়নি। বরং মোদিবাবুদের সৌজন্যে রাষ্ট্রের বদলে কৃষক এখন মসিহা ভাববে কর্পোরেটদের। তাই যারা আজ এই তিনটি আইনকে কৃষকদের জন্য মৃত্যু পরোয়ানা বলছেন, তাদের বলতে চাই ভারতীয় কৃষকদের মৃত্যু পরোয়ানার ঘোষণা নব্বই-এর দশকেই ঘোষিত হয়েছিল, নতুন তিনটি আইন প্রকৃত অর্থে এদেশের কৃষকদের কফিনে শেষ পেরেক।

(৩)  এবারও যেগুলি নিয়ে এত বিতর্ক হচ্ছে তার বেশিটাই কিন্তু বিভিন্ন রাজ্য সরকার ( শুধু বিজেপি নয়,সমস্ত রাজনৈতিক দল) নানান সময়ে বিভিন্ন রাজ্যে ক্ষমতাসীন থাকার সময়ে সংশোধন করেছেন। ২০০৩ সালের ‘ মডেল এপিএমসি’ আইনের অনুকরণে ১৭ টি রাজ্য ও কেন্দ্রশাসিত অঞ্চল ফল ও সবজি বাজারের বিনিয়ন্ত্রণ করেছে, ই- ট্রেডিং চালু হয়েছে ২২ টি রাজ্যে, ডাইরেক্ট মার্কেটিং ২১ টিতে, গুদাম ও হিমঘরকে বাজার চিহ্নিত করা ৬ টি রাজ্যে ইত্যাদি ( তথ্য সূত্র – কবিতা কুরুগান্তি, দি ওয়ার,২১সেপ্টেম্বর,২০২০)। চুক্তি চাষও বিভিন্ন রাজ্যে প্রচলিত। অত্যাবশক পণ্য আইনেও স্বাধীনতার পর বেশ কয়েকবার সংশোধনী এসেছে। তাহলে এত তাড়াহুড়ো কেন? কারণ বর্তমান শাসক জোট মতাদর্শগত ভাবে যুক্তরাষ্ট্রের বিরোধী এবং কেন্দ্রীয়করণের পক্ষে। এই আইনগুলো সেই মতাদর্শের পরিপূরক। কৃষি রাজ্য তালিকায় থাকলেও এই সংস্কারগুলি সাধিত হওয়ার পরে নীতি নির্ধারণে রাজ্য সরকারগুলোর আর কোনো ভূমিকা থাকবে না। আবার কর্পোরেট লবির চাহিদাও তাই কারণ সারা দেশে একটা কেন্দ্রীয় আইন (one country – one law- one market) থাকলে তাদেরই বাজার দখলে সুবিধা হবে।

(৪) কৃষি বিল নিয়ে আন্দোলনের সময় সবচেয়ে বেশি বিতর্ক হচ্ছে ন্যূনতম সহায়ক মূল্য (minimum support price / msp) নিয়ে। প্রধানমন্ত্রী স্বয়ং টুইটারে বিরোধীদের বিরুদ্ধে মিথ্যাচারের অভিযোগ এনেছেন এবং তড়িঘড়ি করে কিছু ফসলের এম এস পি ঘোষণা করেছেন। বিষয়টি নিয়ে একটু বিশদে আলোচনার প্রয়োজন। প্রথমত তত্ত্বগত ভাবে দেখলে কৃষি পণ্যের মূল্য যদি বাজার নির্ভর হয় তবে সেই ব্যবস্থায় সরকারের হস্তক্ষেপের অবকাশ থাকে না। তাই এই সংস্কারগুলি যে মতাদর্শের উপর দাঁড়িয়ে আছে, এমএসপির ধারণা ঠিক তার বিপরীত। দ্বিতীয়ত, কোনো কৃষি আইনেই এমএসপি কৃষকের আইনি অধিকার হিসেবে স্বীকৃত নয় বরং তা সরকারের সদিচ্ছা নির্ভর। এক্ষেত্রে আলাদা করে উল্লেখ করা প্রয়োজন বিজেপি আমলে গঠিত শান্তাকুমার কমিটির সুপারিশ, যেখানে বলা হয়েছে যেহেতু মাত্র ৬.৮% কৃষক এম এস পি ঘোষণায় উপকৃত হয় তাই এই ব্যবস্থাকে দীর্ঘায়িত না করাই দরকার। তৃতীয়ত স্বামীনাথন কমিটির সুপারিশ ছিল উৎপাদন খরচের ( যার মধ্যে জমির ভাড়া ও শ্রমের দামও যুক্ত ছিল)  উপর ৫০% লাভ ধরে এম এস পি নির্ধারিত হবে। গত দু’বছরে কৃষকদের আন্দোলনের প্রধান দাবি ছিল এটাই। কিন্তু এবারেও যে এমএসপি ঘোষিত হয়েছে তাতেও ঐ ফর্মুলাকে প্রত্যাখ্যান করা হয়েছে। চতুর্থত, অনেকে বলার চেষ্টা করছেন যে সরকার যেহেতু গণবন্টন ব্যবস্থা চালু রেখেছে তাই আগামি দিনেও সরকার এমএসপি ঘোষণা করে ফসল সংগ্রহ করবে। এক্ষেত্রে সহজ হিসাবটা বুঝে নেওয়া দরকার। সরকার যদি শুধু এই সিদ্ধান্তটুকুই নেয়, গণবন্টন ব্যবস্থার জন্য যতটুকু ফসল দরকার ততটুকুই সংগ্রহ করবে তাহলে  বর্তমান ব্যবস্থায় সরকার যতটা ফসল কেনে তার থেকে অর্ধেক কিনবে। আর একটা কথা হল গণবন্টন ব্যবস্থা সংক্রান্ত আইনে কোথাও লেখা নেই যে সরকারকে সরাসরি চাষিদের কাছ থেকে ফসল কিনতে হবে। সরকার ইচ্ছে করলেই আগামি দিনে আম্বানি- আদানিদের কাছ থেকে ফসল কিনতে পারে। পঞ্চমত, দেশে প্রায় বার্ষিক তিরিশ লক্ষ কোটি টাকার কৃষি পণ্য উৎপাদিত হয়। এমএসপিতে সরকার খুব বেশি হলে তার মধ্যে দেড় থেকে দুই লক্ষ কোটি টাকার আনাজ কেনে। বাকিটা খোলা বাজারে বিক্রি হয়। এমএসপির কার্যকারিতা হল সে ফসলের একটা দাম নির্ধারণ করে যা সামান্য হলেও কৃষকদের স্বার্থ রক্ষা করে। খোলা বাজার যদি কৃষি পণ্যের সঠিক দাম নির্ধারণ করতে পারত তাহলে কি এদেশে এমএসপি ঘোষণার প্রয়োজন থাকত? যারা বলছে কৃষক যেখানে খুশি সেখানে ফসল বিক্রি করতে পারবে, তারা কি এটা গ্যারান্টি দিতে পারছে যে কৃষকরা ফসলের সঠিক দাম পাবে? আমরা বিগত সময়ের অভিজ্ঞতায় দেখেছি ন্যূনতম সহায়ক মূল্য আসলে হয়ে দাঁড়িয়েছে সর্বোচ্চ বিক্রয় মূল্য। সরকার যেহেতু নিজে সামান্য ফসল কেনে তাই কৃষককে এমএসপির চেয়ে কমে বাজারে ফসল বিক্রি করতে হয়। তাই কৃষক সংগঠনগুলির ন্যায্য দাবি হল সরকারকে আরও বেশি পরিমাণে এবং আরো বিভিন্ন ধরনের ফসল কিনতে হবে। কিন্তু এই আইন পাকাপাকি ভাবে কৃষকের ন্যায্য দাম পাওয়ার প্রশ্নটিকে হিমঘরে পাঠিয়ে দিল।

(৫) কৃষি বিপণনের ক্ষেত্রেও বিজেপি ও সংঘ পরিবারের সহযোগী সংগঠনগুলির পক্ষ থেকে সুকৌশলে প্রচার করা হচ্ছে যে কেউ যদি এই বিলের বিরুদ্ধে হয়,তাহলে সে ফোড়েদের পক্ষে। এটাকে তর্কে আনা দরকার।  একথা অনস্বীকার্য যে প্রচলিত মান্ডি ব্যবস্থায় বহু ত্রুটিআছে। যেমন  তার লাইসেন্সিং প্রথা,ফড়েদের দাপট। কিন্তু মান্ডি ব্যবস্থার উপযোগিতা শূন্য একথা বলা যায় না। এটাই এখনও পর্যন্ত একমাত্র জায়গা যেখানে কৃষকের এমএসপিতে ফসল বিক্রির সুযোগ থাকে। একটা মাত্রা পর্যন্ত সরকারি হস্তক্ষেপের সুযোগ থাকে। তাই কৃষকের স্বার্থে মান্ডি ব্যবস্থাকে ত্রুটিমুক্ত করার উদ্যোগ নেওয়াই যেতে পারত। কিন্তু তার বদলে সরকার মান্ডি ব্যবস্থাটাকেই উঠিয়ে দিচ্ছে।  এ যেন আঙ্গুলে ফোঁড়া হলে আঙ্গুল বাদ দিয়ে দেওয়ার নিদান। পরিবর্তে সরকার কৃষককে মুক্ত বাজারের দিকে ঠেলে দিচ্ছে। সরকার পক্ষের বক্তব্য হল তারা ফসলের যোগ্য দাম দিতে অপারগ। এই আইনে কৃষক তার ফসল পাতিপুকুর থেকে হনলুলু যেখানে খুশি বিক্রি করতে পারবে এবং কৃষক যেখানে বেশি দাম পাবে সেখানে বিক্রি করবে। এই নির্বোধ ভাবনার সমস্যা হল, বাজার বড়ো হলেই কৃষক দাম পায় না। তার দরাদরির ক্ষমতা (bargaining power) বৃদ্ধি পায় যদি তাকে অভাবি বিক্রি করতে না হয়, তার কাছে গুদাম ও হিমঘরের ব্যবস্থা থাকে, কৃষিপণ্য পরিবহণের ব্যবস্থা থাকে। উল্টোটা হলে ফসলের ন্যায্য দাম পাওয়ার কোনো সম্ভাবনাই নেই। বরং সরকারি নিয়ন্ত্রণহীন, ভৌগোলিক সীমাহীন মুক্তবাজারে চাষি আরো বিপদে পড়ে যাবে। ওয়ারহাউস ও কোল্ড চেনগুলো কৃষি পণ্যের বাজারে নতুন ক্রেতা হিসাবে আবির্ভূত হবে। এরা কোথায় কিভাবে ফসল কেনা-বেচা করছে সে ব্যাপারে কোনো তথ্য সরকারের কাছে থাকবে না। তুলনায় কম পুঁজি ও গ্রাম্য অর্থনীতির সঙ্গে যুক্ত ফোড়েদের বদলে আগমন ঘটবে কোট-প্যান্ট- টাই পরা কর্পোরেট দালালদের।

(৬)  এখানে অন্য একটা জরুরি প্রশ্ন তোলাও আবশ্যক। সরকারের ঘোষিত বাজেট অনুযায়ী দেশ জুড়ে এক লক্ষ কোটি টাকার কোল্ড স্টোরেজ গড়ে তোলা হবে। কৃষিজ পচনশীল পণ্যের ক্ষেত্রে কোল্ডট্রেন চলবে। কেন্দ্রীয় অর্থমন্ত্রী তার বাজেট বক্তৃতায় বলেছিলেন  আগামি ৫ বছরে ১০ হাজার এফপিও বা ফার্মার প্রোডিউসার অর্গানাইজেশন গড়ে তোলা হবে। এগুলিকে যদি মূলধন জুগিয়ে শক্তিশালী করে গড়ে তোলা যায় তাহলেও তো বহু কৃষকের ক্ষমতায়ন হত, তারা দরাদরির ক্ষমতা অর্জন করতে পারতেন। এখন কর্পোরেটরা এই সংস্থাগুলিতে প্রবেশ করবে। অথচ সমবায়  আইনের সংশোধন করা যেতে পারত। এখনকার সমবায় আইন অনুযায়ী সদস্যতা যেহেতু এলাকা ভিত্তিক, তার মূলধন ও কর্মক্ষেত্র সীমিত। কর্পোরেট দের খোলা ছুট দেওয়া হল,তাহলে তো কৃষি সমবায় সমিতিগুলিকে ভৌগোলিক সীমারেখার বন্ধন মুক্ত করে সারা দেশ জুড়ে সদস্য সংগ্রহ ও ব্যবসা করার অনুমতি দিয়ে বিল আনা যেত। কিন্তু তা হল না কারণ সরকার ভারতের কৃষিপণ্যর কারবার কর্পোরেট হাঙরদের হাতে তুলে দিতে দায়বদ্ধ।

(৭) চুক্তি চাষ ও অত্যাবশক পণ্য নিয়ন্ত্রণ আইন দুটি আদতে একে অপরের পরিপূরক। এ দেশে যেহেতু কৃষকের ফসলের দাম পাওয়ার বিষয়টি অনিশ্চিত তাই প্রাথমিক পর্বে এটা নিয়ে কৃষকদের মধ্যে উৎসাহের সৃষ্টি হবে। কিন্তু এদেশে বিক্ষিপ্তভাবে কিছু এলাকায় ও পৃথিবীর অন্যান্য দেশে চুক্তি চাষের অভিজ্ঞতা এটাই দেখায় যে যতদিন যাবে চুক্তির ক্ষেত্রে স্পনসরই প্রধান হয়ে উঠবে। তারাই ঠিক করে দেবে কৃষক কী ফসল ফলাবে। বহুজাতিক কৃষি কোম্পানিগুলি বহুদিন ধরে দাবি করে আসছে ভারতে খাদ্যশস্যের উৎপাদন হ্রাস ও অর্থকরী ফসলের উৎপাদন বৃদ্ধি। এই নতুন ফসলের চাষ অনেক বেশি ব্যয়বহুল ও প্রযুক্তি নির্ভর। এর ফলে কৃষককে  স্পনসরের দাদন নির্ভর হয়ে উঠতে হবে যা নীল চাষের ঘটনার পুনরাবৃত্তি ঘটাবে। একই সঙ্গে অত্যাবশক পণ্য নিয়ন্ত্রণ আইন থেকে একাধিক ফসলকে বিযুক্ত করার ফলে যথেচ্ছ মজুতদারি বাড়বে, কৃষি ফসলের দাম বাড়বে- যার একমাত্র লাভ পাবে কর্পোরেটরা। অন্যদিকে এটাও বলা দরকার কৃষি ক্ষেত্র সরকারি নিয়ন্ত্রণ মুক্ত হলে যথেচ্ছ আমদানি বাড়বে। কৃষি পণ্যের আন্তর্জাতিক কারবারিদের কাছে ১৩০ কোটি জনসংখ্যার এই দেশ এক অতীব সম্ভাবনাময় বাজার। চুক্তি চাষের সুযোগ নিয়ে একদিকে তারা খাদ্য শস্যর উৎপাদন কমাবে, অন্যদিকে আমদানি করা খাদ্য শস্যে ভরে যাবে দেশ। এইভাবে আমরা যতটুকু খাদ্য স্বনির্ভরতা অর্জন করেছি তার বিসর্জন হবে। দেশ খাদ্যের ব্যাপারে বাধ্য হবে কর্পোরেট নির্ভর হতে।

(৮)অনেকে কৃষি বিল বিরোধী আন্দোলন কয়েকটি নির্দিষ্ট রাজ্যে সীমাবদ্ধ থাকার বিষয়টি উল্লেখ করেছেন যা অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। একথা সঠিক যে কৃষকদের স্বতঃস্ফূর্ত প্রতিবাদ মূলত হচ্ছে পাঞ্জাব,হরিয়ানা,পশ্চিম উত্তর প্রদেশ,কর্নাটক এবং তেলেঙ্গানায়।অন্য জায়গায় কৃষক প্রতিবাদ কৃষক সংগঠনগুলির আহ্বানে সংগঠিত ও নিয়মমাফিক। একটু লক্ষ্য করলে দেখা যাবে আন্দোলন প্রথমে ফেটে পড়েছে সবুজ বিপ্লবের এলাকাগুলিতে যেখানকার কৃষকরা দীর্ঘ দিন ধরে এমএসপির সুবিধা পেয়েছেন এবং মূলত ভারতের শস্য গোলা বলে পরিচিত। এমএসপির ক্রমিক হ্রাস ও মান্ডি ব্যবস্থার ধ্বংস সাধন তাদের অনেক বেশি প্রভাবিত করবে। কিন্তু ভারতের বহু জায়গা এমন আছে(অন্যতম উদাহরণ পশ্চিমবঙ্গ) যেখানে সেই অর্থে কোন মান্ডি ব্যবস্থা নেই ও কেন্দ্রীয় সরকারের পক্ষ থেকে এমএসপিতে ফসল কেনাবেচা হয় না বললেই চলে, তাই সেখানে কৃষকেরা এখনও বিপদের মাত্রাটা উপলব্ধি করতে পারছেন না। আবার যেহেতু কৃষকেরা এক সমাজ সেখানে বৃহৎ, মধ্য, ক্ষুদ্র ও প্রান্তিক কৃষক এবং ব্যাপক সংখ্যায় কৃষি মজুর রয়েছে তাই সবার প্রতিক্রিয়াটা এক রকম হবে না। তবে এই আইনগুলি কার্যক্ষেত্রে দেশজুড়ে প্রয়োগ হলে আক্রান্ত কৃষকের সংখ্যাটা বাড়বে।কৃষিতে কর্পোরেট অনুপ্রবেশ যত বাড়বে তত বাড়বে যান্ত্রিকীকরণ।এর ফলে কৃষি মজুররা কাজ হারাতে শুরু করবেন। কৃষিতে রাষ্ট্রের দায় না থাকলে কর্পোরেট মুনাফাই হবে একমাত্র বিবেচ্য।ফলে বৃহৎ ও মধ্য কৃষকদের আয় কমবে। প্রান্তিক কৃষকরা তো ইতিমধ্যেই খাদে পড়ে গেছেন। সেই জন্য আগামি দিনে কৃষক বিক্ষোভ সর্বভারতীয় চরিত্র নিতে পারে।

(৯)কৃষি ক্ষেত্রে অর্ডিন্যান্স আকারে এই বিলগুলি তিন মাস আগে যখন প্রথম এল তখন থেকেই বিভিন্ন আলোচনায় এই প্রশ্নটি উঠতে শুরু করেছে যে ভারতীয় কৃষি ব্যবস্থায় পুঁজিবাদ কায়েম হল। ভারতে কৃষকের হাতে গড়পড়তা জমির পরিমাণ, উৎপাদন সম্পর্ক, জমির খণ্ডীকরণ, বিপণন ব্যবস্থা- সমস্ত মাপকাঠিতে বিচার করলে এখনও পর্যন্ত ভারতীয় কৃষি চরিত্রগত ভাবে আধাসামন্ততান্ত্রিক ও আধাঔপনিবেশিক। আবার একই সঙ্গে গত তিরিশ বছরে এই ক্ষেত্রে ফিনান্স পুঁজিরও অনুপ্রবেশ ঘটেছে। কিন্তু আমূল ভূমি সংস্কার ঘটিয়ে কৃষির বুর্জোয়া বিকাশ ঘটানোর ক্ষমতা ভারতীয় শাসকদের নেই। কিন্তু আন্তর্জাতিক অর্থ লগ্নি সংস্থাগুলির চাপে কৃষিতে কর্পোরেট প্রবেশের পথ যে কোনো মূল্যে প্রশস্ত করতে হবে। তাই উপর থেকে পুঁজিবাদ চাপানোর এক বকচ্ছপ প্রচেষ্টা। এর ফলে উপরিকাঠামোয় পুঁজির চলাচল পরিমাণগত ভাবে বাড়লেও কৃষি ক্ষেত্রে বুনিয়াদি উৎপাদন সম্পর্কের কোন গুণগত পরিবর্তন ঘটবে না।

এই আন্দোলন অতীব সম্ভাবনাময়। মনে রাখা দরকার যে জিডিপিতে কৃষির অংশ যত কমই হোক না কেন, এই ক্ষেত্রের সঙ্গে প্রত্যক্ষ বা পরোক্ষভাবে দেশের ৫৫% মানুষ যুক্ত। তাই কৃষকেরা প্রতিবাদে রাস্তায় নামলে রাজ্য হোক বা কেন্দ্রীয় সরকার, নড়ে চড়ে বসতে বাধ্য। সাম্প্রতিক সময়ে মোদি সরকারের বিরুদ্ধে একাধিক কৃষক আন্দোলন হয়েছে(বিগত বছরে লংমার্চ বা দেশের রাজধানীতে কৃষক সংসদ), যার ফলে শুধু কেন্দ্রীয় সরকার নয়, বিভিন্ন রাজ্য সরকারও কৃষকদের জন্য বিভিন্ন আর্থিক সহায়তা প্রকল্প ঘোষণা করতে বাধ্য হয়েছে। এবারও তড়িঘড়ি করে এমএসপি ঘোষণা সেই লক্ষ্যেই। আজ কৃষক সংগঠনগুলিকে মনে রাখতে হবে যে শুধু এই তিনটি আইন প্রত্যাহারই নয়, একই সঙ্গে তার আন্দোলনের দাবি সনদে যুক্ত করতে হবে আমূল ভূমি সংস্কার, খাস জমি বন্টন, জমির ঊর্ধ্বসীমা আইনের সংশোধন প্রত্যাহার, কৃষি উপকরণের মূল্য হ্রাস, এমএসপিকে আইনি অধিকার দান, সর্বজনীন গণবন্টন ব্যবস্থা, কৃষি বিপণন ব্যবস্থায় সরকারের ভূমিকা বৃদ্ধি, কৃষি মজুরি বৃদ্ধির মতো মূলগত বিষয়গুলি।এইগুলি বাস্তবায়নের লড়াই সফল হলে কর্পোরেট অ্যাজেন্ডা পরাস্ত হবে, নচেৎ নয়।

Share Now:

LEAVE YOUR COMMENT

Your email address will not be published. Required fields are marked *